মিশরে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা

 


মিশর নিয়ে যারা আগ্রহী, তাদের তো এই বছর পোয়াবারো। তিন মাস কাটেনি, এর মধ্যেই বিভিন্ন সাইটে এমন সব মাথা খারাপ করা আবিষ্কার হয়েছে যে আর্কিওলজিস্ট আর ইজিপ্টোলজিস্টদের মাথা ঘুরে গেছে। প্রাচীন মিশরের লোকজন আমাদের জন্য গাদা গাদা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে গিয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু এমন পরপর মাইন্ডব্লোইং ডিসকভারি এর আগে কোনওদিন হয়েছে কিনা সন্দেহ! যাকে বলে আর্কিওলজিকাল বোনাঞ্জা! তা ঠিক কী কী হয়েছে মিশরে? চটপট দু চারটে দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমেই বলতে হয় গিজা গিগা ডিসকভারির কথা। যেই মুহুর্তে আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছি যে গিজার পিরামিডের সমস্ত রহস্য খতম, এখন শুধু ওই জায়গাটা টুরিস্ট সাইট আর সিজ্জিতদার সিনেমার শুটিংয়ের জন্যই কাজে লাগানো হবে, গবেষকরা এমন একটা বম্বশেল ফেলেছে বেচারি ইন্ডিয়ানা জোনসও টুপি খুলে ঘাম মুছবেন। স্কটিশ আর ইতালিয়ান স্কলারদের একটা টিম গিজার পিরামিডের তলায় একটা বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড শহর আবিষ্কার করছে। হ্যাঁ, শহর, চেম্বার ফেম্বার নয়, আস্ত একটা সাবটেরেনিয়ায় সিটি। এই দলের দায়িত্বে ছিলেন পিসা ইউনিভার্সিটির কোরাদো মালাঙ্গা আর স্ট্রাথক্লাইড ইউনিভার্সিটির ফিলিপো বিওন্দি, তারা অত্যাধুনিক SAR মানে সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাফরে পিরামিডের ভিতরে জরিপের কাজ চালাচ্ছিল। এমন সময় তারা সেখানে একটা ঘরের মতো ফর্মেশন দেখতে পায়। আরো ভালো করে খোঁজাখুঁজি করে দেখা যায় একটা বা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা ঘর, সেগুলো ভূমিগত পথ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আজকাল সিমস বলে একটা ভিডিও গেম বেরিয়েছে, সেটার আবার একটা পিরামিড এডিশন আছে, সেখানে হেঁয়ালি সলভ করে আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বার আর শহর বানাতে হয়। দেখা যাচ্ছে সাড়ে চার হাজার বছর আগে ইজিপ্টের লোকজন বাস্তবেই সেই গেম খেলছিল। এখন রেডার প্রযুক্তির রিডিং ঠিক হলে এই আন্ডারগ্রাউড চেম্বারগুলো বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। মানে, একটা শহর যত বড় হতে পারে আর কি! রেডারে তোলা ছবিতে ভার্টিকাল শ্যাফট, সর্পিল সিড়ি, ওয়াটার পাইপলাইনের চিহ্ন অব্দি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিতর্কও কম হচ্ছে না। ইজিপ্টের বৈজ্ঞানিকরা ভূমিগত শহরের ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন এই বলে যে ওই রেডারের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এই নিয়ে তুমুল শোরগোল পড়েছে। অন্যদিকে রিসার্চাররা অবশ্য সেখানেই থেমে নেই, তারা ক্লেম করেছেন খুব সম্ভবত এই চেম্বারগুলো হলস অফ আমেনতি হতে পারে। এখন আমেনতি মিশরীয় লোককথায় একটা ভয়ানক কন্সেপ্ট, এই নিয়ে একগাদা মিথ আছে। সহজ ভাষায়  হলস অফ আমেনতি বাস্তব দুনিয়া আর অতিলৌকিক দুনিয়ার মাঝের সেই জায়গা যেখানে নশ্বর বা কায়িক শরীর ছেড়ে আত্মিক অস্তিত্ব অর্জন করা যায়। সাধারণ মানুষ জীবিত অবস্থায় সেখানে গেলে সেখানে অবস্থিত পোর্টাল ইউজ করে মৃতদের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে, অতিলৌকিক ক্ষমতাও অর্জন করতে পারে। দশকের পর দশক ধরে পূরাতত্ববিদরা মিশরের এই মিথিকাল চেম্বার খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এই বছর রিসার্চারদের দাবী শুনে তারা এমন জোরে মাথা চুলকোতে শুরু করেছে যেন মাথায় উকুন হয়েছে। সত্যি মিথ্যে যাই হোক, আমাদের এই সব জেনে রোমাঞ্চিত হতে কোনও বাধা নেই। তবে থামুন, আবিষ্কারের ফিরিস্তি এই সবে শুরু হল।

যেই সময় একদল আর্কিওলজিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় এমন একটা ভীষণ আবিষ্কার হল যে ইজিপ্ট প্রেমীরা চেয়ার থেকে পড়ে যায় আর কি! বলা হচ্ছে, তুতানখামের সমাধি পাওয়ার পর এত বড় কোনও আবিষ্কার হয়নি। কথা হচ্ছে ফারানো থুতমোস দ্বিতীয়র ( Thutmose II)  প্রায় এক শতাব্দী ধরে ইনি ইতিহাসবিদ আর আর্কিওলজিস্টদের ঘোল খাইয়ে খাইয়ে ঘুরিয়ে মেরেছেন। কত বছর ধরে ভদ্রলোকের সমাধি খোঁজা হচ্ছে তার হিসেব নেই। 'পেল পেল' করে রব উঠেছে বহুবার, কিন্তু পায়নি কেউই। থুতমোস বাবু আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন প্রায় এক শতাব্দী ধরে। ভদ্রলোক এমনিতেই দুর্ভাগা, তার দজ্জাল বউ রানি হাপশেটশুত সব লাইমলাইট নিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, কিন্তু জানা যায় না বলেই মারা যাওয়ার এতদিন পর তিনি ইজিপ্টোলজিস্টদের দুনিয়ায় উচ্চস্থান অর্জন করেছেন। প্রসঙ্গত তার মমি পাওয়া গিয়েছিল বহু আগে, শুধু টুম্বটার খোঁজ চলছে দেড়শো বছর ধরে। যাই হোক, ইজিপ্ট আর ব্রিটেনের আর্কিওলজিস্টরা ভ্যালি অফ দ্য কিংসের পাশেই থেবস অঞ্চলে তাঁর সমাধি আবিষ্কার করেছে। অবশ্য জায়গাটা আড়াই বছর আগে জানা ছিল, কিন্তু হায়েরোগ্লিফগুলো প্রায় মুছে গিয়েছিল, টুম্বের অবস্থাও ভালো ছিল না, সব রিঅ্যানিমেট করে কনফার্ম করতে করতেই এতদিন কেটে গেল। এই আবিষ্কারের সবচেয়ে স্পেশাল পয়েন্ট হল, এই প্রথম কোনও ফারাওয়ের সমাধিতে রাখা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জিনিসপত্র পাওয়া গেল। সে এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে সেটা যে কোনও ফারাওয়ের সেটা আগে কেউ অনুমান করেনি, সবাই ভেবেছিল, সুয়োরানি দুয়োরানি কারো হবে। ওয়েল, জেন্ডার সোয়্যাপের ধারণা আজকের নয়। দেখা গেল, আসলে সেটাই রাজামশাইয়ের টুম্ব। এখন এই সমাধির হিয়েরোগ্লিফ লিপি আর উদ্ধার করা জিনিসপত্র যে আগামীতে কী খেল দেখাবে সেটা ভবিষ্যত বলবে, আপাতত একশো বছরের লুকোচুরি শেষ হল।

আরো আছে। সাক্কারার কথা তো অনেকেই জানেন। মিশরের প্রাচীনতম পিরামিড এবং নেক্রোপলিস, এই বিশাল এক্সক্যাভেশন সাইটে সবসময় কিছু না কিছু আবিষ্কার হচ্ছেই। রহস্য আর শেষ হয় না। সাক্কারার ভূমি দেবতাও দু হাত খুলে কিছু না কিছু দিয়েই যাচ্ছেন। একবারের জন্যও বলছেন না, যতই দাও ততোই চাই। খিল্লি বাদ দিয়ে বলি, জানুয়ারি মাসে জাপান আর ইজিপ্টের একটা জয়েন্ট আর্কিওলজিকাল মিশনের কর্তারা ঘোষণা করলেন, তারা প্রাচীন মাস্তাবা, মানে কফিনই কিন্তু চারটে হাতি ঢুকে যাবে এমন রেক্টাঙ্গুলার সুপারস্ট্রাকচার, আবিষ্কার করেছেন। সঙ্গে সেকেন্ড আর থার্ড ডাইনেস্টির প্রচুর মূল্যবান বস্তু পাওয়া গিয়েছে। সেসব ২৬৫০ বিসির জিনিস। এছাড়াও ১৫৫০-১২৯২ বিসি, মানে যে সময়টা ইজিপ্টে এইটিন্থ ডাইনেস্টি অফ অফ দ্য নিউ কিংডম বলে পরিচিত, সেই সময়ের দশটারও বেশি সমাধির খোঁজ পেয়েছেন। এখানেই শেষ হলেও হত, কিন্তু সাক্কারাতে সেসব হয় না। একটা চাইলে চারটে পাতুরি ঢেলে দেয়। এই দলের লোক এর পাশাপাশি দুটো মাটির ইট দিয়ে নির্মিত মাস্তাবা, দুটো পাথর দিয়ে কুঁদে বানানো সমাধিও খুঁজে বের করেছে, আর সঙ্গে একটা চুনাপাথর দিয়ে সিল করা শ্যাফটও পাওয়া গেছে যেটা একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধিক্ষেত্রতে যাচ্ছে। প্রায় রোজই সেখানে নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে। কয়েক মাস পর দেখা যাক এই নতুন আবিষ্কারগুলো কী বোমা ফাটায়!

কিন্তু দাঁড়ান। এই বছর আর্কিওলজিকাল জ্যাকপট যখন চলছেই, লাক্সর পিছনে থাকবে তা কেমন করে হয়? ফারাওদের রাজধানী বলে কতা! সেখানে কিছু পাওয়া যাবে না তা হয়?জানুয়ারি মাসেই ইজিপ্টের রিসার্চাররা জানালেন এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা, যা পাওয়া গিয়েছে দেইর-এল-বেহরিতে রানি হাপশেটসুতের মন্দিরের একদম কাছেই। রানির অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য নির্মিত কমপ্লেক্স থেকে দেড় হাজারেরও বেশি লাইমস্টোন ব্লক পাওয়া গিয়েছে, প্রতিটাই চমৎকার ভাবে মেন্টেন্ড আছে। রঙটঙ চটে যায়নি, হায়েরোগ্লিফে একদম ঠাসা। এখন প্রথম কয়েকটার অর্থ উদ্ধার করে জানা গিয়েছে এ এক বিশাল জিগশ পাজল, কিন্তু অসম্ভব গোপনীয় আর মাথা খারাপ করা কিছু। হায়েরোগ্লিফ এক্সপার্টরা আপাতত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, কিন্তু বাকিরা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে। এক্সক্যাভেশনে অবশ্য একগাদা রাজকীয় উপাদানও পাওয়া গিয়েছে, এই ধরনের আর্টেফ্যাক্টও তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর থেকে আর পাওয়া যায়নি, সে একশো তিন বছর হয়ে গেল। যা বুঝলাম, রানি হাপশেটসুত পণ করেছিলেন, মৃত্যুর পরেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন, গার্ল পাওয়ার কাকে বলে। জাস্ট কিডিং!

এইবার আসল মজা। এতসবের মধ্যে এমন একটা ভয়ংকর আবিষ্কার হয়েছে যে সকলের রাতের ঘুম উড়ে গেছে, ঘেমেনেয়ে গেছে সারা দুনিয়ার মিশর এক্সপার্টরা। আবাইদোসে মাউন্ট আনুবিস নেক্রোপলিসে একজন ফারাওয়ের সমাধি পাওয়া গিয়েছে, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব এক মার্কিন-ইজিপশিয়ান টিমের। মুশকিল হচ্ছে এই ফারাও কে, কেউ জানে না। মানে, কিছুই জানে না। কোত্থেকে ইনি উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, তাঁর বংশ পরিচয় কী, তিনি কোন রাজত্বে ছিলেন, কিছুই জানা যায় না। খোদাই করা লিপি পড়ে অনুমান করা হচ্ছে এই রহস্যময়ী ফারাও এমন এক নতুন বংশ বা ইতিহাসের কথা জানাতে পারে যে সম্পর্কে এখনও কেউ কিচ্ছুটি জানে না। তেমন হলে মিশরের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।

এছাড়াও প্রায় নিত্যনতুন আবিষ্কার হচ্ছে এ বছর। মিশর নিয়ে যারা উৎসাহী, তাদের জন্য রোমাঞ্চিত হওয়ার সুবর্ণ সুয়োগ। এ-ই লেখায় কিছু কিছু আলগা টার্ম আছে, মিশর নিয়ে ক্র‍্যাশ কোর্স চাইলে অনির্বাণ ঘোষের 'হায়েরোগ্লিফের দেশে' পড়ে ফেলুন।

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on March 24, 2025 05:38
No comments have been added yet.