কালো বরফ কালো বরফ question


12 views
মাহমুদুল হকঃ লেখকের বিচ্ছিন্নতাবোধের স্বরূপ সন্ধানে
Saiful Sourav Saiful Jun 07, 2019 10:34AM
মাহমুদুল হকঃ লেখকের বিচ্ছিন্নতাবোধের স্বরূপ সন্ধানে

Mahmudul Haque

কালো বরফ
জীবন আমার বোন
নিরাপদ তন্দ্রা
অনুর পাঠশালা

মাহমুদুল হকের বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব সত্তরের দশকে । ভাষা শৈলীতে নিজস্ব ভঙ্গিমার জন্য তিনি স্মরণীয় । কাব্যপনা, অপ্রচলিত শব্দের সংস্থান, গল্প গাঁথুনিতে সাবলীল ইত্যাদি তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ‘জীবন আমার বোন’, ‘অনুর পাঠশালা’, ‘নিরাপদ তন্দ্রা’, ‘কালো বরফ' এর মত গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস নিয়ে আসেন । ‘খেলাঘর’, ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ তার গল্পগ্রন্থ । বিভিন্ন রচনায় মুক্তিযুদ্ধ বা যুদ্ধকালিন গল্প এবং সমকালিন সামাজিক বাস্তবতা প্রাসঙ্গিক হলেও অনেক চরিত্রদের উপস্থিতি যেন এক আচ্ছন্নতা বা বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রতিরূপ ।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের সময় মাহমুদুল হক ছিলেন কিশোর । পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত উপজেলা থেকে ঢাকার আজিমপুরে এসে যখন সপরিবারে বসবাস শুরু করেন তখন তার বয়স মাত্র দশ । শ্রেণিকক্ষের বাধ্যবাধকতা ও রুটিন মাফিক লেখাপড়ার চাইতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেই বেশি পছন্দ করতেন । ফলে ইন্টারমিডিয়েটে ওঠার পর আঠারো বছর বয়সেই তিনি একাডেমিক লেখাপড়ায় ইস্তফা দেন । কিন্তু প্রবল ব্যক্তিগত আগ্রহ ও অভিসন্ধিৎসু মনের জোরে শিল্প, দর্শন, ইতিহাস, জীব বৈচিত্রের বিভিন্ন শাখায় নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যান । যার জন্য নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরিতে এক অবিস্মরণীয় নাম হয়ে ওঠেন । এই রচনায় লেখক মাহমুদুল হকের শৈলী, বৈশিষ্ট্য এবং কতিপয় বৈশিষ্ট্যের পেছনের স্বরূপ সন্ধান করাই মূখ্য উদ্দেশ্য ।

‘জীবন আমার বোন’ যুদ্ধের নয়, যুদ্ধকালিন উপন্যাস । যেখানে একজন ভাই ‘খোকা’ তার বোন ‘রঞ্জু’র সাথে শহরের প্রত্যন্ত জায়গায় থাকে । যুদ্ধের মধ্যেও উদাসিন হেঁটে বেড়ায় খোকা । আজ না, কাল না করেও কোথাও আশ্রয় নিতে যায় না সে বোনকে নিয়ে । যেন এই পরিস্থিতির কিছুই সে ধরতে পারছে না, এর সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই এবং এইসবের কিছুই সে চায়নি বা নিতান্তই এসে পড়েছে । এদিকে যখন শহরে ঢুকে পড়েছে মিলিটারি এবং সমস্ত দেশ মুহূর্মুহু আক্রমণে ভঙ্গুর প্রায়, তখন খোকার চোখে ঝরে পড়ছে অন্ধকার । ইতিপূর্বে বন্ধুদের আড্ডায় বাকপটু খোকাকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে দেখা যায় । কিন্তু পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যতা বিধানে অপারগ খোকা সম্যকভাবে বিচ্ছিন্নই রয়ে যায় । যেমন গল্পের মধ্যে আড্ডার এক পর্যায়ে খোকা আত্মধিক্কারের মত বলে- ‘আসলে কি জানো, আমার মেটামরফসিস হয়েছে, আমি শালা গ্রেগর স্যামসার মত বিটকেলে পোকা বনে গিয়েছি’ । আমরা দেখি কাফকার গল্পের চরিত্রের সাথে নিজেকে মিলিয়ে কিভাবে এক অসাড় অবস্থান নেন খোকা রূপী লেখক । যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ ছাড়াও অনেক অজানা অবশ অংশের মতই কেবল একজন দ্রষ্টার মতো বিঘ্নহীন উৎকন্ঠায় বয়ে চলে গল্পের চরিত্র । ক্ষণিকতা ও মুড বেইজড লজিক কথা-বার্তায় প্র্যাকটিস করে সে । খিস্তি ও অসহিষ্ণু আচরণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে কি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তা মাহমুদুল হক পড়লে আরেকবার অনুধাবন করা যায় । ইন্স্যানিটির চুড়ান্ত মাত্রাকেও যেন অতিক্রম করে চরিত্ররা । যেমনঃ ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ উপন্যাসে আমরা দেখি একজন স্বশিক্ষিত লোককে, যে কিনা শহরের কোন এক রেললাইন নিকটস্থ বস্তিতে গিয়ে কোন নির্দিষ্ট কর্মকান্ডহীন বসবাস করে একটা খুপড়ি ঘরে । এ গল্পের মূল চরিত্র ‘হিরণ’ গ্রাম থেকে শহরে আসা ছিন্নমূল এক যুবতী নারী । তাকে অবলোকনের মধ্য দিয়ে বর্ণনাত্বক এক বাস্তবধর্মী চিত্রায়ন ঘটে এই উপন্যাসে । একটা মেয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে শহরে যার সাথে আসে, তার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ধোঁকা খেয়ে হাত বদলে অন্যত্র গিয়ে পড়ে । সেখানে তাকে পণ্যের মত বিকোয় নানা শ্রেণীর মানুষ এবং আবার অন্য এক সম্পর্কের জেরে বেরিয়ে আসে সেই অস্তানা থেকে । শেষ পর্যন্ত নানা টানা পোড়নের মধ্য দিয়েও নারীকে প্রেমের পুণ্যভূমি, প্রাণের আদিকেন্দ্র হিসেবেই প্রতিভূ করেন লেখক এই উপন্যাসে । এই উপন্যাসে বর্ণনাকারী বা বক্তাকে একজন নির্জন দ্রষ্টা বলে মনে হয়, যার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা নেই । গল্পকারের সামাজিক বিত্ত ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক শ্রেণী বিন্যাসের সাথে যোগাযোগহীনতা উপন্যাসে লেখককে নিরপেক্ষ দ্রষ্টা করে তোলে । ব্যক্তি জীবনের সাথে বোঝাপড়ার সূত্রের জন্যই হয়ত একজন লেখকের পক্ষে নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে নির্বিকার বর্ণনা ও বাস্তবতা অবলোকন করা সম্ভব হয় । লেখকের কাব্যপনা কখনো বা গল্পকে কিছুক্ষন প্রচ্ছন্ন করে রাখে । বলতে বলতে নিয়ে যাবেন অন্য নদী, ধারণা ও জীবনের তীরে । ক্লেদাক্ত কর্কট শহরের বাইরে থেকে দেখা যায় চকচকে ও আলোকোজ্জ্বল কিন্তু ভেতরে বাক্সে বাক্সে চলে বিভ্রমী গন্তব্য । তারপরও মানুষ হতে মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসা, জীবনের পক্ষে কাছের মানুষ, দূরের মানুষদের চিনতে শেখা, দ্বিধা থরোথরো অমরাবতীর ধুলোর দিনে ফেরা আর নিজের পরিচয়কে খুঁজে চলার অবিরাম অভিরাম ভার খুঁজে ফেরা এক নারীমূর্তির অংকন যেন শক্তিমান এক আধার নারীত্বের সম্ভ্রমের পক্ষে । শহরের পথে যেন মানুষেরা হাঁটে না এ গল্পে, মানুষদের হাঁটায় শহরের পথ- বাঁচার আশায়, তাগিদে । যেন শুধু গল্পই না, রং ও ছাইয়ে আলো-আঁধারির এক যুক্তি ও কল্পনার বিমূর্ত চিত্রের মত কিন্তু গতিময় ।

জীবদ্দশায় মাহমুদুল হকের জীবন ধারণের অবলম্বন ছিল পারিবারিক অলংকার ব্যবসা । লেখনী থেকে আয়ের আশা আর দশ জনের মতই ছিল না বললেই চলে । লেখাকে তিনি সাধনার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করতেন । সমকালে তিনি তুখোড় আড্ডাবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন । ৭১-এর আগে জিন্নাহ এভেন্যুর রেকস রেস্তরা, পরবর্তীতে বিউটি বোর্ডিং, তৎকালীন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন সহ নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘তাসমেন জুয়েলার্স’ ইত্যাদি ছিল বন্ধু ও সহযাত্রীদের সাথে আড্ডা দেয়ার জায়গা । বিভিন্ন সময়ে নানান আড্ডায় তার সঙ্গী ও নিকটস্থরা ছিলেন খালেদ চৌধুরী, মীজানুর রহমান, মুহম্মদ খসরু, রফিক আজাদ, কায়েস আহমেদ, শহীদ কাদরী, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস সহ প্রমুখ ।

‘আবদুল খালেক' 'কালো বরফ' উপন্যাসে সংসারের কর্তা । স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্কের সামান্য মধুরতা ছাড়া অধিকাংশই বীতরাগ ও মনের অমিল । যা তাদের সংসার নিয়ে কিছুটা উদাসীন করে রাখে । একমাত্র সন্তান কি করছে ঘরে-বাইরে সেই তদারকিতে তাদের মন কম যোগ দেয় । আব্দুল খালেক কলেজ মাস্টার । ঘরে থাকা আর বাইরে মাস্টারি ছাড়াও এলাকার এক হোমিওপ্যথি ডাক্তারের সাথে আড্ডা দেয়, গল্প ও পরামর্শ করে । মিলহীন সংসারে যখন চূড়ান্ত অশান্তি নেমে আসছে তখন আব্দুল খালেক তার স্ত্রীকে নিয়ে একটা নৌভ্রমনে বের হয় । সাদামাটা প্লটের একটা গল্পে দৈনন্দিনতা ও জীবনের বাস্তবিক চিত্র রূপায়িত হয় এই উপন্যাসে

'অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসে লেখকের সে ধরণের এক কাতরতা ধরা পড়ে যা পরবর্তীতে লেখক এক সাক্ষাৎকারে মেনেও নেন । এই উপন্যাসে বিচ্ছিন্ন পিতা-মাতার সম্পর্কের মধ্যে অপ্রিতীকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা কতিপয় শিশুর মানসিক গড়নের দিকে নজর দেন লেখক । ‘সরুদাসী’ নামের চরিত্রের সাথে শিশু ‘পোকার’র মানসিক লেনাদেনা, নিজের ভাই ‘মনিভাইজান’ এর সাথে বনিবনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শব্দ শৃংখলে আবদ্ধ হয় পটভূমি, যা লেখকের বিচ্ছিন্ন শৈশবকে যেন ফিরিয়ে আনে। উপন্যাসে শৈশব স্মৃতিতে আশ্রয় নিয়ে বর্তমানের বিরূপতা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় যেন লেখক । উপন্যাসিকের নিজের বর্ণনায় ব্যক্তির স্বরূপ পুরোপুরি উন্মোচন করা যখন অসম্ভব হয় তখন নানা কায়দায় ব্যক্তির আত্মকথনের আশ্রয় নিতে হয় । অতীত পুনরুক্তি বা স্মৃতি কাতরতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । এর মধ্য দিয়ে মানুষ এক প্রকার রোমন্থনের রসাস্বাধনের সুযোগ পান । সমস্ত স্বত্তে এই অনুভূমিকায় উপনীত হওয়া যায় যে, লেখক মাহমুদুল হক বিচ্ছিন্নতাবোধ সমগ্র জীবন বয়ে চলেন ।

কোন লেখক যদি প্রকৃত অর্থে জীবনকে দেখতে চান তবে অবশ্যই তাকে সময়কে বুঝতে ও জানতে হবে । মাহমুদুল হক জেনে বুঝেই শেষ জীবনে আট বছর সাহিত্য রচনা ও এই জগৎ থেকে দূরে থাকেন । অনেকে তখন চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলতে পারেননি । এটা একটা রহস্যময় ট্র্যাজেডি যে একজন সাহিত্যিক তার দীর্ঘ জীবন অতিক্রম করার পর কেন হঠাৎ নিজের একান্ত জীবন থেকে আড়ালে ছিলেন । এই আড়াল শুধু মাহমুদুল হক নন, তার মতো আরো কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে ছিলেন । তবে কি এই সব সরে যাওয়া, দূরে যাওয়া আড়ালেরা ব্যক্তি ও সমাজ সংঘাত? নাকি কোন অবোধ অভিমান অপ্রীতিকর পৃথিবীর প্রতি?

-সাইফুল সৌরভ
১৪/১০/২০১৬



back to top