Mahmudur Rahman's Blog - Posts Tagged "ম-ত-র-য়-দ-ব"
পপুলিস্ট মানসিকতার আধ-পড়ুয়াদের হাতে মির্চা-মৈত্রেয়ীর প্রেম
১.
পুরানা পল্টনের বইয়ের স্তূপ ঘাটতে ঘাটতে বেশ কয়েক বার একটা বই হাতে উঠে এসেছিল; ‘লা নুই বেঙ্গলী’। মির্চা এলিয়াদ (Mircea) নামটা আমার তখনকার স্বল্প জ্ঞানের গণ্ডির বাইরে ছিল। তাই প্রতিবার বইটা সরিয়ে রাখতাম। কিন্তু একদিন প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে একটু চমকে যাই। মৈত্রেয়ী দেবীর নামটা জানা ছিল। ভাবলাম এই মৈত্রেয়ী কি তিনিই?
উজ্জ্বলের দোকানে দাঁড়ায়েই পড়তে শুরু করলাম। এক এক পাতা পড়লাম, আর অবাক হলাম। আপন প্রেমের এমন সোজাসাপটা বয়ান তখনও পর্যন্ত পড়া হয়নি আমার। তাই বিশ টাকায় বইটা কিনে ফেললাম। খোঁজ খবর করে জানলাম এর সিক্যুয়েল (তখন তা-ই জানতাম) আছে, মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা। মামুন ভাই জানালেন 'লা নুই' আগে পড়া শ্রেয়। হাতে ছিলই। পড়া শুরু করলাম।
২.
ইউরোপের দেশ রোমানিয়ার ছেলে মির্চা, ভারতের দর্শন জানার জন্য তিনি এলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর কাছে। শেখার পিপাসা নিয়ে এসেছিলেন মির্চা। কিন্তু পেলেন আরও বেশি কিছু। গুরুগৃহে বসবাসের সময় মৈত্রেয়ীর সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। মির্চার বয়স তখন একুশ, মৈত্রেয়ী চৌদ্দ। মৈত্রেয়ীর রূপে মজতে মির্চার সময় লাগে না। মৈত্রেয়ীরও একই হাল। আর সময় যত এগিয়ে যেতে থাকে, তা বাড়ে বৈ কমে না।
তাদের দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে নানা ভাবে। কখনও ঘরের বাইরে, কখনও ভেতরে। এর পাশাপাশিই দুজনের মধ্যে চলে আসে শরীরী প্রেম। কিন্তু,১৯৩০ এর ভারতবর্ষে এই সম্পর্ক কি মানা যায়? তিরিশ কেন, এখনও হয়তো এমন সংস্কার প্রধান গৃহে তা মানা হবে না। তাই চলে যেতে হয়েছিল মির্চাকে, পেছনে পড়েছিলেন মৈত্রেয়ী। সেই সময়ে পড়া শেষ করে অবাক হয়ে ভাবছিলাম-এটা কি প্রেম, না ভালবাসা?
অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। কেননা মির্চা আর মৈত্রেয়ীর বিচ্ছেদের বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী লিখলেন একটি বই;‘ন হন্যতে’। অর্থাৎ, যার মৃত্যু নেই। ‘লা নুই বেঙ্গলী’ পড়ে অনেক প্রশ্ন জমে ছিল মনে। এক এক করে তার উত্তর দিতে লাগল ‘ন হন্যতে’।
৩.
মির্চার গল্প যেখানে শেষ হয়, তার পরের গল্পটা এই বইতে পাওয়া যায়। সাথে পুরনো গল্পের বাকি অংশ। কিন্তু ‘লা নুই বেঙ্গলী’তে মৈত্রেয়ীকে পেলেও এখানে সে অমৃতা হয়ে গেল। 'লা নুই বেঙ্গলী'তে মৈত্রেয়ীকে মির্চার বয়ানে পাওয়া যায় আর 'ন হন্যতে'তে মৈত্রেয়ী নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখালেন।
লা নুই বেঙ্গলী পড়ে জমা প্রশ্নের উত্তর মৈত্রেয়ীর বইয়ে পেলেও এ বই অনেক ভ্রম তৈরী করে। কেননা মির্চা যেখানে তার বইয়ে প্রেমের অকপট বয়ান করেছেন, মৈত্রেয়ী সেখানে ভাষার আশ্রয় (চাতুরী?) নিয়ে এক ভিন্ন গল্প বলেন। মির্চার লেখা পড়ে তাকে সদ্য যুবক এক প্রেমিক মনে হয় কিন্তু মৈত্রেয়ীর লেখা পড়ে মির্চাকে এক সুযোগ সন্ধানী দেহজ চাহিদা-স্বর্বস্ব মানুষ বলে মনে হবে।
সাহিত্য বিচারে, আমার মনে হয় ‘ন হন্যতে’ অনেক ঋদ্ধ। বইটি কেবল একটা খণ্ডিত আত্মজীবনী-ই নয়, কবিতা হয়ে উঠেছে। এর কিছু কারণের মধ্যে প্রধান হলো বইটি বাংলায় লেখা আর মির্চারটা অনুবাদ। দ্বিতীয়, মির্চা ফিরে গিয়েই কাতর মনে নিজের প্রেমের গল্পটি লেখেন। তার বয়ান মেদ বর্জিত, ঋজু। কখনও কেবল এক ব্যর্থ প্রেমিকের অতুল প্রেমের হা হুতাশ আর হারানো প্রেমের স্মৃতি।
অনেকে বলে থাকেন মির্চার লেখায় শরীরী প্রেমের অত্তিত্ব বড় বেশি। বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী তার বইয়ে জানান তেমন কোন শরীরী বিষয় আদৌ ছিল না। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে অমৃতা একটা মোহে পড়েছিল যা ভঙ্গ হতে বেশি সময় নেয়নি। কিন্তু মির্চার লেখা থেকে মনে হয় ফুলশরে দুজনেই বিঁদ্ধ হয়েছিলেন। আর মির্চা তার ইউরোপীয় ভাবধারা থেকে বেরিয়ে ভারতীয় 'প্লেটোনিক প্রেম' খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু 'লা নুই বেঙ্গলি' অনুসারে, তার আগেই শরীর প্রেমও এসে যায় তাদের মাঝে।
৪.
ইদানিং বইয়ের গ্রুপ কেন্দ্রিক আলোচনা চোখে পড়ে যেখানে মির্চার লেখাকে মিথ্যা বলে অনেকেই তার প্রতি নিপীড়কের তকমা লাগানোর পপুলিস্ট থিয়োরি দিয়ে বেশ লাইক কমেন্ট কামায়। অবশ্য খোদ মৈত্রেয়ী লিখেছিলেন মির্চার সাথে তার কিছু হয়নি।
এখন তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতো পারে ইউরোপীয় সমাজে সেক্সটা স্বাভাবিক বলে মির্চা তার লেখায় সেটা রেখেছিলেন। সেটা অসম্ভব নয় কিন্তু ষোড়শী হতে চলা একটি মেয়ের সাথে তরতাজা একটা যুবকের প্রেম হওয়ার পর সুযোগ থাকলে শরীরী সম্পর্ক হবে না, এমন ভাবাটাও বোকার স্বর্গে থাকা। মির্চাকে দোষারোপ করার আগে মির্চারই লেখার দিকে তাকালে দেখা যাবে মৈত্রেয়ীর দ্বিধার কথা তিনি স্পষ্টই লিখেছেন। মৈত্রেয়ীকে 'গডেস' বা দেবী বলে সম্বোধন করা তার প্রেমের অভিব্যক্তি হওয়াই সম্ভব।
অন্যদিকে মৈত্রেয়ী যখন লিখেছেন তখন তিনি একজনের স্ত্রী, কারও মা। সমাজে একজন পরিচিত ব্যক্তি। আশ্চর্যের কথা তিনি নাকি জানতেনই না মির্চা তাকে নিয়ে বই লিখে 'মিথ্যাচার' করেছে, যা বছর চল্লিশেক আগে প্রকাশিত। তো মৈত্রেয়ী লিখলেন সেই 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে' সত্য প্রকাশ করতে। ভাষার কারুকাজে তিনি মির্চাকে খলনায়ক তো করলেনই, একটা অপার্থিব আবহ আনতে রবীন্দ্রনাথকে এনে বসালেন দেবতার আসনে। সবকিছু এমন করে বর্ণনা করলেন যা চৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণের জীবনী লিখতেও অনেকে আনতে পারেনি।
৫.
খেয়াল করার বিষয় মির্চার লেখা যতটা স্পষ্ট, মৈত্রেয়ীর লেখা ততটাই কুয়াশামাখা। আর বাকিটা বুঝতে একটু বুদ্ধি খাটালেই হয়। মির্চার লেখায় এক বাঙালী ষোড়শীর মানসিক দ্বন্দ্ব এতো স্পষ্ট যা খণ্ডাতে মৈত্রেয়ীকে তার বইয়ে যথেষ্ট খাটতে হয়েছে। যদি ধরেও নেই মির্চা 'সেক্স' এনে বইয়ের বিক্রি বাড়াতে চেয়েছেন, তাহলে এতাও মানা উচিৎ মৈত্রেয়ী, রবীন্দ্রনাথকে ঢাল বানিয়ে সামনে রেখে দিয়েছেন। শেষ জীবনে মির্চার সাথে দেখা করতেও গিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী। নিজের বইয়ে লিখেছেন, 'মির্চার চোখে দৃষ্টি নেই'। মৈত্রেয়ীর এই কথাটা রুপক হিসেবে নেওয়া যায়। মৈত্রেয়ীর প্রতি মির্চার চোখে কোন আবেগ ছিল না।
মির্চা-মৈত্রেয়ী শেষ জীবনে দেখা করে হয়তো পারস্পরিক একটা বোঝাপরাই করেছিলেন, সে তারাই জানেন। কিন্তু এতোদিন পর তাদের প্রেমের গল্প পড়ে, পুরুষতন্ত্র, যৌনতার ভিত্তিতে চিন্তা করে কাওকে নিপীড়ক বানিয়ে দেওয়া বাতুলতা বৈ কিছু না। পপুলিস্ট স্টেটমেন্ট তৈরী না করে একটু তলিয়ে ভাবা জরুরী৷ এমনকি নিজের বইয়ের নাম মৈত্রেয়ী রেখেছেন 'ন হন্যতে' অর্থাৎ 'যা মরে না'। হয় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তার শরীর যাই হোক আত্মা অমৃত ছিল। কিংবা তিনি বলতে চান 'প্রেম অমর' আর প্রেমের টানেই তিনি মির্চার কাছে গিয়েছিলেন যেকথা তখন সমাজের সামনে বলা যায় না, যেটা মির্চা বলতে পেরেছিলেন।
লিখতে লিখতে আরেকটা জিনিস মনে হচ্ছে। মির্চা, মৈত্রেয়ী দুজনেই হয়ত পাঠক-মানসিকতা জানতেন। তাদের কেউ তুমুল প্রেম আর কেউ ঐশ্বরিক দীপ্তি যুক্ত প্রেম পছন্দ করে। একজন দার্শনিক, অন্যজন কবি তাদের বইয়ে সেসবই এনেছিলেন। দুজনের লেখাই দুই দেশে, দুই ধরণের পাঠকের কাছে সমাদৃত। আর নানা ভাবে চর্চিত। কিন্তু তারা বাঙালী আধ-পড়ুয়াদের চরিত্র জানতেন কিনা জানি না, যারা সাহিত্য, প্রেম ইত্যাদি থেকেই লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার নিয়ে চর্চা করতে বেশি পছন্দ করে। যারা বই পড়ে গল্প, ভাষা, লেখার কৌশল কিংবা নিদেন ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে চিন্তা করার আগেই বইয়ে কতটা 'সেক্স' আছে, সেটা চিন্তা করে।
'বাংলার রাত' উপন্যাসে যৌনতা কিংবা 'যা অমর' (অনুবাদ হইলে এমনই নাম দিত) উপন্যাসে রবীন্দ্রপূজা ছাড়াও তাদের জীবনে অনেক কাজ ছিল। অনেক অ্যাচিভমেন্ট ছিল। মির্চার কাজের এক বিশাল তালিকা, আলোচনা আছে উইকিতেই। মৈত্রেয়ীও একজন ভালো কবি, কর্মী, ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারা আমাদের কাছে পরিচিত তাদের উক্ত দুই বইয়ের দৌলতে এবং নিঃসন্দেহে বইদুটো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ কেননা মির্চার প্রেম, প্রেমের বয়ান, সে সময়ের ভারতের একটি পরিবারের কথা, প্রেমিক-প্রেমিকার মানসিক দ্বন্দ্ব; অনেক কিছুই আছে। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী দেবীর বইয়ের বেলায়ও একই কথা। তাদের লেখাকে অন্যভাবে দেখার কথা ছিল; পপুলিস্ট, জাজমেন্টাল, বানসালী কিংবা সৃজিতের সিনেমার মতো করে না।
নোট
১. বই দুইটা ২০১৪ সালে পড়া, তখনই ছোট করে রিভিউ লিখছিলাম। এই ছয় বছর পর খুঁটিনাটি মনে নাই। থাকলে কোট করে লেখা যাইত। তবে প্রয়োজন মনে করতেছিও না আসলে।
২. লা নুই থেকে প্রায় সরাসরি কাহিনী নিয়ে সঞ্জয় লীলা বানসালী 'হাম দিল দে চুকে সানাম' সিনেমা তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে সৌমিত্র-শাবানা আজমী অভিনয়ে 'দি বেঙ্গলি নাইট' নামে একটি সিনেমা হয়।
পুরানা পল্টনের বইয়ের স্তূপ ঘাটতে ঘাটতে বেশ কয়েক বার একটা বই হাতে উঠে এসেছিল; ‘লা নুই বেঙ্গলী’। মির্চা এলিয়াদ (Mircea) নামটা আমার তখনকার স্বল্প জ্ঞানের গণ্ডির বাইরে ছিল। তাই প্রতিবার বইটা সরিয়ে রাখতাম। কিন্তু একদিন প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে একটু চমকে যাই। মৈত্রেয়ী দেবীর নামটা জানা ছিল। ভাবলাম এই মৈত্রেয়ী কি তিনিই?
উজ্জ্বলের দোকানে দাঁড়ায়েই পড়তে শুরু করলাম। এক এক পাতা পড়লাম, আর অবাক হলাম। আপন প্রেমের এমন সোজাসাপটা বয়ান তখনও পর্যন্ত পড়া হয়নি আমার। তাই বিশ টাকায় বইটা কিনে ফেললাম। খোঁজ খবর করে জানলাম এর সিক্যুয়েল (তখন তা-ই জানতাম) আছে, মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা। মামুন ভাই জানালেন 'লা নুই' আগে পড়া শ্রেয়। হাতে ছিলই। পড়া শুরু করলাম।
২.
ইউরোপের দেশ রোমানিয়ার ছেলে মির্চা, ভারতের দর্শন জানার জন্য তিনি এলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর কাছে। শেখার পিপাসা নিয়ে এসেছিলেন মির্চা। কিন্তু পেলেন আরও বেশি কিছু। গুরুগৃহে বসবাসের সময় মৈত্রেয়ীর সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। মির্চার বয়স তখন একুশ, মৈত্রেয়ী চৌদ্দ। মৈত্রেয়ীর রূপে মজতে মির্চার সময় লাগে না। মৈত্রেয়ীরও একই হাল। আর সময় যত এগিয়ে যেতে থাকে, তা বাড়ে বৈ কমে না।
তাদের দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে নানা ভাবে। কখনও ঘরের বাইরে, কখনও ভেতরে। এর পাশাপাশিই দুজনের মধ্যে চলে আসে শরীরী প্রেম। কিন্তু,১৯৩০ এর ভারতবর্ষে এই সম্পর্ক কি মানা যায়? তিরিশ কেন, এখনও হয়তো এমন সংস্কার প্রধান গৃহে তা মানা হবে না। তাই চলে যেতে হয়েছিল মির্চাকে, পেছনে পড়েছিলেন মৈত্রেয়ী। সেই সময়ে পড়া শেষ করে অবাক হয়ে ভাবছিলাম-এটা কি প্রেম, না ভালবাসা?
অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। কেননা মির্চা আর মৈত্রেয়ীর বিচ্ছেদের বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী লিখলেন একটি বই;‘ন হন্যতে’। অর্থাৎ, যার মৃত্যু নেই। ‘লা নুই বেঙ্গলী’ পড়ে অনেক প্রশ্ন জমে ছিল মনে। এক এক করে তার উত্তর দিতে লাগল ‘ন হন্যতে’।
৩.
মির্চার গল্প যেখানে শেষ হয়, তার পরের গল্পটা এই বইতে পাওয়া যায়। সাথে পুরনো গল্পের বাকি অংশ। কিন্তু ‘লা নুই বেঙ্গলী’তে মৈত্রেয়ীকে পেলেও এখানে সে অমৃতা হয়ে গেল। 'লা নুই বেঙ্গলী'তে মৈত্রেয়ীকে মির্চার বয়ানে পাওয়া যায় আর 'ন হন্যতে'তে মৈত্রেয়ী নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখালেন।
লা নুই বেঙ্গলী পড়ে জমা প্রশ্নের উত্তর মৈত্রেয়ীর বইয়ে পেলেও এ বই অনেক ভ্রম তৈরী করে। কেননা মির্চা যেখানে তার বইয়ে প্রেমের অকপট বয়ান করেছেন, মৈত্রেয়ী সেখানে ভাষার আশ্রয় (চাতুরী?) নিয়ে এক ভিন্ন গল্প বলেন। মির্চার লেখা পড়ে তাকে সদ্য যুবক এক প্রেমিক মনে হয় কিন্তু মৈত্রেয়ীর লেখা পড়ে মির্চাকে এক সুযোগ সন্ধানী দেহজ চাহিদা-স্বর্বস্ব মানুষ বলে মনে হবে।
সাহিত্য বিচারে, আমার মনে হয় ‘ন হন্যতে’ অনেক ঋদ্ধ। বইটি কেবল একটা খণ্ডিত আত্মজীবনী-ই নয়, কবিতা হয়ে উঠেছে। এর কিছু কারণের মধ্যে প্রধান হলো বইটি বাংলায় লেখা আর মির্চারটা অনুবাদ। দ্বিতীয়, মির্চা ফিরে গিয়েই কাতর মনে নিজের প্রেমের গল্পটি লেখেন। তার বয়ান মেদ বর্জিত, ঋজু। কখনও কেবল এক ব্যর্থ প্রেমিকের অতুল প্রেমের হা হুতাশ আর হারানো প্রেমের স্মৃতি।
অনেকে বলে থাকেন মির্চার লেখায় শরীরী প্রেমের অত্তিত্ব বড় বেশি। বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী তার বইয়ে জানান তেমন কোন শরীরী বিষয় আদৌ ছিল না। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে অমৃতা একটা মোহে পড়েছিল যা ভঙ্গ হতে বেশি সময় নেয়নি। কিন্তু মির্চার লেখা থেকে মনে হয় ফুলশরে দুজনেই বিঁদ্ধ হয়েছিলেন। আর মির্চা তার ইউরোপীয় ভাবধারা থেকে বেরিয়ে ভারতীয় 'প্লেটোনিক প্রেম' খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু 'লা নুই বেঙ্গলি' অনুসারে, তার আগেই শরীর প্রেমও এসে যায় তাদের মাঝে।
৪.
ইদানিং বইয়ের গ্রুপ কেন্দ্রিক আলোচনা চোখে পড়ে যেখানে মির্চার লেখাকে মিথ্যা বলে অনেকেই তার প্রতি নিপীড়কের তকমা লাগানোর পপুলিস্ট থিয়োরি দিয়ে বেশ লাইক কমেন্ট কামায়। অবশ্য খোদ মৈত্রেয়ী লিখেছিলেন মির্চার সাথে তার কিছু হয়নি।
এখন তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতো পারে ইউরোপীয় সমাজে সেক্সটা স্বাভাবিক বলে মির্চা তার লেখায় সেটা রেখেছিলেন। সেটা অসম্ভব নয় কিন্তু ষোড়শী হতে চলা একটি মেয়ের সাথে তরতাজা একটা যুবকের প্রেম হওয়ার পর সুযোগ থাকলে শরীরী সম্পর্ক হবে না, এমন ভাবাটাও বোকার স্বর্গে থাকা। মির্চাকে দোষারোপ করার আগে মির্চারই লেখার দিকে তাকালে দেখা যাবে মৈত্রেয়ীর দ্বিধার কথা তিনি স্পষ্টই লিখেছেন। মৈত্রেয়ীকে 'গডেস' বা দেবী বলে সম্বোধন করা তার প্রেমের অভিব্যক্তি হওয়াই সম্ভব।
অন্যদিকে মৈত্রেয়ী যখন লিখেছেন তখন তিনি একজনের স্ত্রী, কারও মা। সমাজে একজন পরিচিত ব্যক্তি। আশ্চর্যের কথা তিনি নাকি জানতেনই না মির্চা তাকে নিয়ে বই লিখে 'মিথ্যাচার' করেছে, যা বছর চল্লিশেক আগে প্রকাশিত। তো মৈত্রেয়ী লিখলেন সেই 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে' সত্য প্রকাশ করতে। ভাষার কারুকাজে তিনি মির্চাকে খলনায়ক তো করলেনই, একটা অপার্থিব আবহ আনতে রবীন্দ্রনাথকে এনে বসালেন দেবতার আসনে। সবকিছু এমন করে বর্ণনা করলেন যা চৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণের জীবনী লিখতেও অনেকে আনতে পারেনি।
৫.
খেয়াল করার বিষয় মির্চার লেখা যতটা স্পষ্ট, মৈত্রেয়ীর লেখা ততটাই কুয়াশামাখা। আর বাকিটা বুঝতে একটু বুদ্ধি খাটালেই হয়। মির্চার লেখায় এক বাঙালী ষোড়শীর মানসিক দ্বন্দ্ব এতো স্পষ্ট যা খণ্ডাতে মৈত্রেয়ীকে তার বইয়ে যথেষ্ট খাটতে হয়েছে। যদি ধরেও নেই মির্চা 'সেক্স' এনে বইয়ের বিক্রি বাড়াতে চেয়েছেন, তাহলে এতাও মানা উচিৎ মৈত্রেয়ী, রবীন্দ্রনাথকে ঢাল বানিয়ে সামনে রেখে দিয়েছেন। শেষ জীবনে মির্চার সাথে দেখা করতেও গিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী। নিজের বইয়ে লিখেছেন, 'মির্চার চোখে দৃষ্টি নেই'। মৈত্রেয়ীর এই কথাটা রুপক হিসেবে নেওয়া যায়। মৈত্রেয়ীর প্রতি মির্চার চোখে কোন আবেগ ছিল না।
মির্চা-মৈত্রেয়ী শেষ জীবনে দেখা করে হয়তো পারস্পরিক একটা বোঝাপরাই করেছিলেন, সে তারাই জানেন। কিন্তু এতোদিন পর তাদের প্রেমের গল্প পড়ে, পুরুষতন্ত্র, যৌনতার ভিত্তিতে চিন্তা করে কাওকে নিপীড়ক বানিয়ে দেওয়া বাতুলতা বৈ কিছু না। পপুলিস্ট স্টেটমেন্ট তৈরী না করে একটু তলিয়ে ভাবা জরুরী৷ এমনকি নিজের বইয়ের নাম মৈত্রেয়ী রেখেছেন 'ন হন্যতে' অর্থাৎ 'যা মরে না'। হয় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তার শরীর যাই হোক আত্মা অমৃত ছিল। কিংবা তিনি বলতে চান 'প্রেম অমর' আর প্রেমের টানেই তিনি মির্চার কাছে গিয়েছিলেন যেকথা তখন সমাজের সামনে বলা যায় না, যেটা মির্চা বলতে পেরেছিলেন।
লিখতে লিখতে আরেকটা জিনিস মনে হচ্ছে। মির্চা, মৈত্রেয়ী দুজনেই হয়ত পাঠক-মানসিকতা জানতেন। তাদের কেউ তুমুল প্রেম আর কেউ ঐশ্বরিক দীপ্তি যুক্ত প্রেম পছন্দ করে। একজন দার্শনিক, অন্যজন কবি তাদের বইয়ে সেসবই এনেছিলেন। দুজনের লেখাই দুই দেশে, দুই ধরণের পাঠকের কাছে সমাদৃত। আর নানা ভাবে চর্চিত। কিন্তু তারা বাঙালী আধ-পড়ুয়াদের চরিত্র জানতেন কিনা জানি না, যারা সাহিত্য, প্রেম ইত্যাদি থেকেই লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার নিয়ে চর্চা করতে বেশি পছন্দ করে। যারা বই পড়ে গল্প, ভাষা, লেখার কৌশল কিংবা নিদেন ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে চিন্তা করার আগেই বইয়ে কতটা 'সেক্স' আছে, সেটা চিন্তা করে।
'বাংলার রাত' উপন্যাসে যৌনতা কিংবা 'যা অমর' (অনুবাদ হইলে এমনই নাম দিত) উপন্যাসে রবীন্দ্রপূজা ছাড়াও তাদের জীবনে অনেক কাজ ছিল। অনেক অ্যাচিভমেন্ট ছিল। মির্চার কাজের এক বিশাল তালিকা, আলোচনা আছে উইকিতেই। মৈত্রেয়ীও একজন ভালো কবি, কর্মী, ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারা আমাদের কাছে পরিচিত তাদের উক্ত দুই বইয়ের দৌলতে এবং নিঃসন্দেহে বইদুটো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ কেননা মির্চার প্রেম, প্রেমের বয়ান, সে সময়ের ভারতের একটি পরিবারের কথা, প্রেমিক-প্রেমিকার মানসিক দ্বন্দ্ব; অনেক কিছুই আছে। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী দেবীর বইয়ের বেলায়ও একই কথা। তাদের লেখাকে অন্যভাবে দেখার কথা ছিল; পপুলিস্ট, জাজমেন্টাল, বানসালী কিংবা সৃজিতের সিনেমার মতো করে না।
নোট
১. বই দুইটা ২০১৪ সালে পড়া, তখনই ছোট করে রিভিউ লিখছিলাম। এই ছয় বছর পর খুঁটিনাটি মনে নাই। থাকলে কোট করে লেখা যাইত। তবে প্রয়োজন মনে করতেছিও না আসলে।
২. লা নুই থেকে প্রায় সরাসরি কাহিনী নিয়ে সঞ্জয় লীলা বানসালী 'হাম দিল দে চুকে সানাম' সিনেমা তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে সৌমিত্র-শাবানা আজমী অভিনয়ে 'দি বেঙ্গলি নাইট' নামে একটি সিনেমা হয়।
Published on August 02, 2020 06:20
•
Tags:
ন-হন-যত, ম-ত-র-য়-দ-ব, ম-র-চ-এল-য়-দ, ল-ন-ই-ব-ঙ-গল


