Mahmudur Rahman's Blog

May 15, 2022

ভাদুড়ি, ভাদুড়ির গল্প এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাদের অল্প বয়স থাকার একটা ট্রেন্ড রয়েছে। ফেলুদার কথা বাদ, ব্যোমকেশেরও শুরুটা অল্প বয়সেই। এমনকি তার জনপ্রিয় গল্পগুলোতে ব্যোমকেশকে তুলনামূলক তরুণ বলেই পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ল্যাসিক গোয়েন্দা গল্পের সময়কালে প্রৌঢ় গোয়েন্দাদের একজন হলেন চারু ভাদুড়ি। তাকে এমনকি বৃদ্ধ বললেও ভুল হয় না। আর তার সঙ্গী দুজনের মধ্যে সদানন্দ বাবু তো রীতিমত বৃদ্ধ কিন্তু নিয়ম মেনে চলার কারণে শরীরটা তার মজবুত। আর কিরণ বাবুর চরিত্রটি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজের আদলে এঁকেছেন তা বলা বাহুল্য।

এহেন তিন চরিত্রকে নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ বেশকিছু গল্প ও উপন্যাসিকা লিখেছিলেন যার বেশিরভাগই সম্ভবত নানা পূজা সংখ্যায় প্রকাশ হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে চারটি উপন্যাসিকা নিয়ে ভাদুড়ি সমগ্রর প্রথম, ছয়টি নিয়ে দ্বিতীয় এবং সাতটি উপন্যাসিকা নিয়ে তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়।

ভাদুড়ি, ভাদুড়ির গল্প এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে সাধারণ আলোচনা করতে গেলে বলতে হয় গল্পগুলো বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ধারা অনুসরণ করেছে। এখানে খুন আছে কিন্তু সহিংসতা নেই। ধর্ষণের কিছু পাওয়া যায় না। তবে মানুষের জিঘাংসা, কাম প্রবৃত্তি এই গল্পগুলোতে এসেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাদুড়ি, কিরণ ও সদানন্দ বাবুর আলোচনায় সেসব উঠে আসে কিন্তু কোনো রগরগে পিলে চমকানো বর্ণনা নেই। সম্ভবত গোয়েন্দা প্রৌঢ় হলেও লেখা হয়েছিল কিশোরদের জন্য, সে কারণে এমনটা করা হয়েছে।

ভাদুড়ির গল্পে যে বিষয়টা ভালো লাগে তা হলো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গল্প বলার ধরণটা। প্রতিটি উপন্যাসিকায় একটি নিরেট গল্প আছে এবং সেটা যেভাবে নীরেন বাবু একটু একটু করে বলে যান তা পাঠককে ধরে রাখে। এর সঙ্গে আছে একটি পারিবারিক আবহ। কিরণ এবং সদানন্দ বাবু দুজনেই সংসারী। তাদের সংসারের চিত্র নানা সময়ে এই রহস্য গল্পের মধ্যে উঠে আসে। এছাড়া কলকাতায় ভাদুড়ি মশাই এসে ওঠেন তার বোনের বাসায়। সেখানে পুরোপুরি একটি পরিবারের দৈনন্দিন চিত্র উঠে আসে।

আরেকটি মজার বিষয় হলো গত শতকের আশি থেকে এই শতকের শুরুর দিকের কলকাতার মানুষের ভাষার একটা দারুণ উদাহরণ পাওয়া যায় ভাদুড়িতে। ক্যালকেশিয়ান অ্যাকসেন্ট যাকে বলে তার কয়েকটি ভার্সন তুলে এনেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সম্ভবত কবি ও সম্পাদক বলেই বিষয়টি এতো ভালো উপস্থাপন করেছেন। তবে রহস্য গল্পের পাঠকেরা কিছু কিছু জায়গায় বিরক্ত হবেন তাতে সন্দেহ নাই। তাছাড়া নানা সময়ে সাহিত্য পত্রিকায় লেখার কারণে একাধিক চরিত্রের পরিচয় তিনি বারবার দিয়েছেন। সংকলন সম্পাদনায় সেসব বাদ পড়ার কথা থাকলেও পড়েনি। তাই পুনরাবৃত্তি বলে বিরক্ত হতে হয়।

কিছু কিছু জায়গায় ভাদুড়ি ও চক্রবর্তী মশাই কিছু উপদেশ দিতে চান। অন্যথায় গল্পগুলো এগিয়েছে গল্পের মতো। কাহিনীগুলো পড়তে গিয়ে একটা উপরি লাভ হলো কবির চোখে নানা জায়গা ভ্রমণ। গল্পের প্লট অনুসারে সেসব জায়গার বেশ মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাই রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে খুব উপাদেয় না হলেও একজন আগ্রহী পাঠকের আগ্রহের দাবী রাখে ভাদুড়ি।
2 likes ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 15, 2022 11:41 Tags: ভ-দ-ড়, ভ-দ-ড়-সমগ-র

April 29, 2021

তন্দ্রা-মাঝে জীবনের পাঠশালা

‘শনি থেকে শুরু করে একটানা তেরোদিন বৃষ্টি, মাথার খুলির ভিতরেও একহাঁটু পানি’—একে বর্ষা-বন্দনা বলা যায় না, বরং ঘোরগ্রস্ত মানুষের আধো দেখা আর আধো অনুভবের মধ্যকার অদ্ভুত জগত থেকে দেখা বাস্তব সময়ের প্রতিচ্ছবি যা মাহমুদুল হক ফুটিয়ে তোলেন তাঁর নিজের ভাষায় এবং অদ্ভুত লাগে যে এক ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে তাঁর এই লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয় পর্দার ওপাড়ে রোদ মরে গিয়ে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল। তখন হয়ত কোন পাঠকের বিছানার পাশে এসে কোন নারী চরিত্র দাঁড়ায় না কিন্তু ‘নিরাপদ তন্দ্রা’র শেষ বাক্যে এসে জলেশ্বর মাঝি আমার জন্য কোথাও অক্রুর হয়ে ধরা দেয় কিংবা জলিল বুকির সাথে আমি বাধ্য হয়ে মন্দার বোসকে মিলিয়ে ফেলি। মাহমুদুল হক আমাকে নিয়ে যান নতুন কোন মাত্রায় যেখান থেকে ওই ঘোরগ্রস্ত অবস্থায়ও লেখার ভাষা আর গল্প বলার ধরন নিয়ে ভাবতে বাধ্য হই।

মাহমুদুল হক তাঁর ভাষা এবং সেই ভাষার বিন্যাসে যে ভিন্নতা দেখিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে তা দুর্লভ। বলছি এ কারণে যে সদ্য প্রকাশিত ‘রচনাসমগ্র’র প্রথম তিনটি উপন্যাস পড়লে দেখা যাবে তাঁর ভাষা বদলে গেছে। ‘অনুর পাঠশালা’ যেখানে খানিকটা দূর থেকে এক কিশোরকে দেখিয়ে পাঠককে তাঁর কাছে নিয়ে যায়, সেখানে মাহমুদুল হক নিরাপদ তন্দ্রার মূল চরিত্রকে আরও কিছু চরিত্র দিয়ে কখনও ঘিরে ধরেছেন, কখনও প্রকাশ করেছেন তাদেরই ভাষায় কিন্তু সেখানে লেখকের এক নিজস্ব বয়ান তৈরি হয় এবং পাঠক তখন নিজে এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করে মাহমুদুল হকের সেই হিরন চরিত্রটিকে দেখতে পায় নিজের মতো করে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন জাগে, ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ কি আদৌ হিরনের গল্প? কিংবা ‘অনুর পাঠশালা’ কি অনুর গল্প, নাকি সরুদাসীর? এই ভাবনায় ডুবে গিয়ে আমি ঠিক নিরাপদ তন্দ্রার মতো বুকের নিচে বালিশ দিয়ে ভাবতে বসলে দেখতে পাই, যদিও প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় ‘অনুর পাঠশালা’ আর ‘নিরাপদ তন্দ্রা’র ভাষা, গল্প বলার ধরন ভিন্ন, কিন্তু দুপুর রোদে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করলে জলেশ্বর মাঝির সাথে বেরিয়ে সরুদাসীর খোঁজে গেলে আমার মনে হয় অনুই বুঝি বড় হয়ে সরুদাসীর বদলে হিরনের গল্প শুনল। অনুর ঘর-পালানোর সেই অলীক সাধ পূরণ করে আরেক স্থবির মানুষ নিজেকে একটা তক্তপোষে বন্দী করে নিয়েছিল কেননা অনু যে সরুদাসীকে খুঁজে পায়নি, মাহমুদুল হক হিরনের মধ্য দিয়ে তাকে ফেরালেন।

মাহমুদুল হক নিজে বলেছেন (১), “আমার কোনো বই কিন্তু আরেকটি বইয়ের মতো না। জীবন আমার বোন যদি কেউ পড়ে, সে কিন্তু বুঝবে না এই লেখকেরই নিরাপদ তন্দ্রা, প্রত্যেকটা বইয়েরই কিন্তু আলাদা ভাষা। ভাষা আলাদা করতে না পারলে সেই বই আমি লিখিনি।” ‘ অনুর পাঠশালা’ আর ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ পেরিয়ে ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসে পৌঁছলে লেখকের কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। একই লেখকের বই পরপর পড়ে গেলে যে সাদৃশ্য পাওয়া যায়, মাহমুদুল হকে তা নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়টার যে generic বয়ান আমরা পেয়ে আসি—ঢাকা ফুঁসছিল, সবাই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত—এর বাইরেও যে কিছু মানুষ ছিল যারা তখনও নানা রকম তত্ত্ব তালাস, আড্ডা, আলোচনা নিয়ে সময় কাটিয়েছিল, সেই কথা লিখেছেন হক, কিন্তু এখানেও তাঁর অন্য দুটি উপন্যাসের মতো একটি মানুষের অস্থিরতা প্রবল।

মাহমুদুল হকের উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং। সরুদাসী (অনুর পাঠশালা), হিরন (নিরাপদ তন্দ্রা) থেকে নীলা ভাবী (জীবন আমার বোন) যেন কোন না কোন ভাবে উপন্যাসের মূল পুরুষ চরিত্রটির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার একটি পরিপূরক অংশ। হয় সেই অস্থিরতা প্রবল ভাবে ফুটিয়ে তুলছে, কিংবা শান্ত করছে। নীলা ভাবীকে কেউ বিপ্লব, কেউ খোকার অস্থিরতা কী কামুকতার বলি হিসেবেও ধরে নিতে পারে। যদিও আখ্যানে সত্যিকার বলি রঞ্জু, কিংবা আরও গভীরে গিয়ে ভাবলে—অঞ্জু, মঞ্জু। কিন্তু আলোচ্য তিনটি উপন্যাসে, তিন বয়সের তিনটি পুরুষ চরিত্রের অন্তর্গত অস্থিরতার স্বরূপ কোথাও না কোথাও গিয়ে মিলে যায় এবং ভাষা, উপমা আর গল্প দিয়ে এই চরিত্রগুলোর সাথে জড়িত সমস্ত আখ্যান আমাদের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে।

মাহমুদুল হক মূলত নিজ হাতে একটা করে জগত সৃষ্টি করেছেন (এই তিন উপন্যাসে), যেখানে চরিত্র আছে, গল্প আছে এবং তিনি পাঠকের মধ্যে কিছু চাওয়া পাওয়া সৃষ্টি করেছেন। ক্ষুদ্র এই তিন উপন্যাসের প্রতিটিতেই তিনি শেষে এসে সেই জগতের বাস্তবের প্রতি পাঠককে সন্দিগ্ধ করেন। আমরা ভাবতে বাধ্য হই যে অনু আসলেই বাড়ি থেকে বেরোতে পেরেছিল কিনা, হিরনের গল্প আদৌ কেউ বলেছিল নাকি তক্তপোষের পায়ার সামান্য লেখা থেকেই এক স্থবির মানুষ একটা গল্প তৈরি করে নিয়ে তার আশেপাশের সবাইকে সে গল্পে জুড়ে দিয়েছিল? আর শেষমেশ নীলা ভাবীর হাতে চর খাওয়া খোকা যখন রঞ্জুর মধ্য দিয়ে আরেকবার অঞ্জু, মঞ্জুকে পুকুরে তলিয়ে যেতে দেখে, তখন মাহমুদুল হকের পাঠকরাও তলিয়ে যেতে থাকে। এই সবের মধ্যেই জীবন-বাস্তবতার যে স্বরুপ তিনি তুলে ধরেছেন, সেসব এতো ভারী হয়ে কাঁধে চাপে যে তলিয়ে গিয়ে তন্দ্রার মাঝেই সেসব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।

#মাহমুদুল_হক ০১

১. মৃধা, প্রশান্ত (২০২১), নিরাপদ তন্দ্রা?, দৈনিক দেশ রূপান্তর
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter

August 6, 2020

অনিমেষের গল্প

১.
মহাভারতের ষোড়শ পর্বের নাম 'মুষল পর্ব'। প্রবল-প্রতাপ শ্রীকৃষ্ণের যাদব বংশ ধ্বংসের গল্প। যে মানুষটি মর্ত্যে দেবতার আসন পেয়েছিলেন, নেপথ্যে থেকে চালিয়েছিলেন সমগ্র কুরুক্ষেত্র, সেই বুদ্ধিমান এবং জনপ্রিয় মানুষটির চোখের সামনে শেষ হয়ে গেলো সব। সেই মুষল পর্বের সাথে মিল রেখে, সমরেশ ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ পেরনোর অনেক বছর পর লিখলেন মৌষলকাল।

‘উত্তরাধিকার’ থেকে অনিমেষের গল্প শুরু। কিন্তু সে গল্প যতখানি অনিমেষের, ঠিক ততখানি সরিৎশেখরের। তারচেয়ে বেশি পুরুষানুক্রমে চলে আশা চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস আর পথ পরিবর্তনের। অনিমেষকে আমরা আরও কাছ থেকে দেখি ‘কালবেলা’য়। এ গল্প অনিমেষ আর মাধবীলতার। যতখানি প্রেমের, তারচেয়ে বেশি একটা সময়ের। যে সময় প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার।

‘কালবেলা’র পর ‘কালপুরুষ’। মাঝে পেরিয়েছে অনেকটা সময়। পুলিশের অত্যাচারে পা হারানো অনিমেষ এখন কোন নকশাল নেতা নয়। যোগাযোগ রাখেনি কোন রাজনীতির সাথে। মাধবীলতা বয়ে চলেছে অনিমেষের ভার। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে ভার হয়তো বোধ হয় না। আর তাদের ছেলে অর্ক। বস্তির পরিবেশে বখে যেতে যেতে ভেতরে অনিমেষের রক্ত কথা বলে উঠলো। পরিবর্তন আনতে গিয়ে ঠিক বাবার মতই মাঝপথে থমকে গেল।

সাতকাহন করে এতক্ষণ যা বললাম, তা সমরেশের পাঠকমাত্রই জানেন। 'উত্তরাধিকার', 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' ট্রিলজি। 'কালপুরুষ' লেখার প্রায় তিরিশ বছর পর সমরেশ আবার অনিমেষ আর মাধবীলতাকে নিয়ে কলমে আঁচড় কাটলেন। ‘মৌষলকাল’ খুব কাছাকাছি সময়ের গল্প। যেখানে বহুদিনের পুরনো মানুষেরা ফিরে আসে নতুন করে।

২.
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনিমেষ আর রাজনীতির কাছে ঘেঁষে নি। তার ছেলে অর্ক, বস্তিতে কমিউন গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পিতার মতই গুটিয়ে গেছে। সে এখন নিয়ম করে অফিসে যায়, বাড়িতে এসে ঘুমায়। অর্কর বয়স এখন চল্লিশ। অনিমেষ, মাধবীর ষাট। শরীরে সময়ের ছাপ, মনের গভীরে তবু থেকে যায় পুরনো আগুন।

সমরেশের লেখায় রাজনীতির প্রসঙ্গ থাকবেই, এবং তা অনেক বিস্তারিত ভাবেই। 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' এমনকি 'উত্তরাধিকার' আসলে রাজনীতির পটভূমিতেই লেখা (যদিও 'উত্তরাধিকার'-এ সেটা প্রচ্ছন্ন)। 'মৌষলকাল' তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বামফ্রন্টের পতন আর তৃণমূলের উত্থান। এবং সেই উত্তাল সময়, পট পরিবর্তন আর তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কিছু পুরনো মানুষ।

‘মৌষলকাল’ নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি। এবং সেটা রাজনৈতিক মতবাদে নয়, বরং সমালোচনা হয়েছিল সমরেশের উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষমতা নিয়ে। কেননা অনেকের মতেই যোগ্যতার বিচারে ‘মৌষলকাল’ তার পূর্বের তিন বইকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সমরেশের ভক্ত নই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার ব্যতিক্রম লেগেছে ‘মৌষলকাল’।

৩.
বইটা পড়ার আগে প্রশ্ন ছিল, “সমরেশ তিন দশক পর কেন এই সিরিজের নতুন বই লিখলেন? প্রকাশকের চাপে, নাকি নিজের পুরনো কাহিনীকে টেনে কিছু কপি বিক্রি করার আশায়?” বই পড়ে উত্তর পেলাম। আসলে এসব কিছুই নয়। সব গল্প, সব চরিত্র, সব কাহিনী পরিণতি চায়। কিন্তু হয়ত সবাই পায় না। কালপুরুষ পর্যন্ত এই গল্পও পরিনতি পায়নি। পরিনতি পায়নি মাধবী-অনিমেষ। সেই গল্পকে পরিনতি দিতেই সমরেশ লিখেছেন এই বই।

‘কালপুরুষ’ শেষ হয়েছিল পথের একটা বাঁকে। সেখান থেকে সামনের পথ পথিকের জন্য খোলা ছিল। এখানে পথিক হলেন পাঠক। তিনি তার ভাবনার চাকা যে কোনো দিকেই ঘোরাতে পারেন। কিন্তু বাঁকটা সেখানে একটু জটিল ছিল। তাই অর্জুনের পক্ষে পথ নির্ণয় সম্ভব ছিল না। অগত্যা সারথি হয়ে রথের চাকা ঘোরালেন শ্রীকৃষ্ণ।

‘উত্তরাধিকার’ ছিল অনিমেষের শুরু। অনি থেকে অনিমেষ হয়ে ওঠার আঁতুড়ঘর। তারপর ‘কালবেলা’। সেখানে শুরুতে অনিমেষ কিছুটা দ্বিধাান্বিত। তারপর হয়তো আবেগের বশেই একদিকে ছুটে যাওয়া। ভালোবাসা। আহত পাখির মত নীড়ে ফিরে আসা। তারপর নিস্তরঙ্গ জীবন। তার পাশে ছায়ার মত মাধবীলতা। এখানে হয়তো, সে-ই অনিমেষের সারথি।

‘কালপুরুষ’ শুরু হয়েছিল অনিমেষকে দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে পাদপ্রদীপ পড়ে অর্কর গালে। নায়ক হয়ে ওঠে সে। সেকালের গল্প একালে ছাইচাপা হয়ে আছে। অনিমেষ কেবলে ভুল পথে যাওয়া নকশাল নেতা। বদলাতে পারেনি সে কিছুই। সময়ের স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে অর্ক কিছু একটা করতে চায়। কিন্তু পারে না। স্রোত তাকে দাঁড়াতে দেয় না। তবে তাকে ভাসিয়েও রাখে। সময়ের চোখে এখন সে-ই নায়ক।

কিন্তু যে গল্প অনিমেষের, সেখানে অর্ক কি করে নায়ক? ‘কালপুরুষ’ তাই থেমে গিয়েছিল মাঝপথে। কিংবা আমার মনে হয়েছিল এখানেই শেষ নয়। সমরেশও বোধয় বুঝেছিলেন। তার গল্পে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা। তাই তিনি কি করে কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে অনিমেষের জায়গা অর্ককে দেবেন?

এই গল্পে অনিমেষ ফিরে যায় তার শেকড়ে। যেখানে তার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। বহুদিন হল সে সবের সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফিরে যেতেই শেকড় বুঝি আঁকড়ে ধরে। সেখানে সময় খুব ধীরে ধীরে বদলায়। তবু সাপেরা নিঃশ্বাস ফেলে। বাধ্য হয়েই আবার তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ওদিকে বহুদিন সবকিছু থেকে দূরে থাকা অর্কও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। সরাসরি না হলেও পরিবর্তনের হাওয়া স্পর্শ করে তাকে।

কালপুরুষে অনিমেষ ছিল ম্রিয়মান। স্তিমিত প্রদীপ যেন। সেখানে মাধবী ছিল অগ্নিশিখার মত। বিয়ে তারা কোনদিন করেনি। পাশাপাশি দুজন মানুষ, আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি। বার্ধক্যের সীমায় এসে এখনও তারা ঠিক প্রচলিত স্বামী স্ত্রী নয়, সেই আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি আছে। তাদের ভালোবাসা কিংবা সময়ের প্রয়োজনে আসা অর্ক রয়ে গেছে একা। অবশ্য কুন্তীর দেখা পেয়েছে সে। তবে কি অর্ক আসলে পাণ্ডু?

৪.
যেমন আগে বলেছি, কাহিনীকেকে পরিনতি দিতে এই গল্পের সৃষ্টি। ‘কালবেলা’র অনিমেষ ছিল কনফিউজড, তারপর আবেগি। ‘কালপুরুষে’ এসে সে ম্রিয়মান। কিন্তু এই ষাট বছরে এসে সে তার নিজের ভাবনায়, মননে অনেকখানি স্থির। এখন তার মত কিংবা পথ কোনটিই ভাসা ভাসা নয়। ধর্মে অবিশ্বাসী অনিমেষ তাই যখন ছোটমার শ্রাদ্ধে মাথা কামিয়ে জানায়, তার বিশ্বাসের চেয়ে অপর এক বিশ্বাসীর সুখ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তখন মাধবী বোঝে যে অনিমেষকে সে আজও চেনেনি। আর যখন শেষবার অনিমেষকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে হয়, তখন অনিমেষের পঙ্গুত্ব কেবল শরীরে। আদর্শবাদী সেই নকশাল অনিমেষ এখনও তার আদর্শে অটল। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করায় অটল মাধবী আজও অনিমেষের পাশে।

পুত্রের মাঝে পিতার দোষ-গুণ কিছু হলেও থাকে। অর্কও পেয়েছে। তবে পুরোটা না। অনিমেষের দৃঢ়তা তার নেই। তাই সে আমাদের নায়ক নয়। জেলের বাইরে অর্কের জন্য হয়ত কুন্তী অপেক্ষা করে, কিন্তু কুন্তীও মাধবীলতা হবে না কোনদিন। সময়ের স্রোতে পরিবর্তন আসে। আবার নিমিষে মিলিয়ে যায়। শুধু অনিমেষ আর মাধবীলতারা থেকে যায় ঠিক আগের মত। আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চায়, কৃষ্ণের মত মৌষলকাল যেন তাদের দেখতে না হয়।

এতকিছুই রেখেছেন আসলে সমরেশ তার এই উপন্যাসে। আর সেটা বুঝতে হলে পশ্চিমবঙ্গের ঐ সময়কালের পরিবর্তন জানতে হবে। সমরেশ যদিও তার লেখায় রাজনীতি রাখেন কিন্তু সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম বড় হয়ে ওঠে। যেমন বড় হয়েছিল 'কালবেলা'য়। এই বইয়েও মুষল পর্বের সেই মুমূর্ষু অবস্থা তিনি সরাসরি দেখান না। দেখালে হয়ত ভালো করতেন।

সমরেশের সমালোচনা তাই হতে পাড়ে তার সৃষ্টির এই জায়গাটিতে এসে। কিন্তু আদতে রাজনীতির কতটা আর উপন্যাসে সত্যিই আনা যায়। আনলেও পাঠক কেন পড়বে? রাজনীতি জানতে হলে তো নন ফিকশনই পড়া যায়। তাই সমরেশের বা অন্য অনেক লেখকের যা লেখা উচিৎ ছিল তা তারা লেখেন না। আবার পাঠকের যেখানে সমালোচনা করা উচিৎ তারাও সেখানে সমালোচনা করেন না। 'মৌষলকাল' তাই সমালোচিত পাঠক কালপুরুষ হয়ে 'কালবেলা'র উত্তরাধিকারের আবেগে 'মৌষলকাল' নিয়ে সমালোচনা করে বসেন। এই হলো লেখক, লেখা আর পাঠকের চক্র।

(২০১৬ সালের লেখা, খানিক পরিমার্জিত)
1 like ·   •  1 comment  •  flag
Share on Twitter

August 2, 2020

পপুলিস্ট মানসিকতার আধ-পড়ুয়াদের হাতে মির্চা-মৈত্রেয়ীর প্রেম

১.
পুরানা পল্টনের বইয়ের স্তূপ ঘাটতে ঘাটতে বেশ কয়েক বার একটা বই হাতে উঠে এসেছিল; ‘লা নুই বেঙ্গলী’। মির্চা এলিয়াদ (Mircea) নামটা আমার তখনকার স্বল্প জ্ঞানের গণ্ডির বাইরে ছিল। তাই প্রতিবার বইটা সরিয়ে রাখতাম। কিন্তু একদিন প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে একটু চমকে যাই। মৈত্রেয়ী দেবীর নামটা জানা ছিল। ভাবলাম এই মৈত্রেয়ী কি তিনিই?

উজ্জ্বলের দোকানে দাঁড়ায়েই পড়তে শুরু করলাম। এক এক পাতা পড়লাম, আর অবাক হলাম। আপন প্রেমের এমন সোজাসাপটা বয়ান তখনও পর্যন্ত পড়া হয়নি আমার। তাই বিশ টাকায় বইটা কিনে ফেললাম। খোঁজ খবর করে জানলাম এর সিক্যুয়েল (তখন তা-ই জানতাম) আছে, মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা। মামুন ভাই জানালেন 'লা নুই' আগে পড়া শ্রেয়। হাতে ছিলই। পড়া শুরু করলাম।

২.
ইউরোপের দেশ রোমানিয়ার ছেলে মির্চা, ভারতের দর্শন জানার জন্য তিনি এলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর কাছে। শেখার পিপাসা নিয়ে এসেছিলেন মির্চা। কিন্তু পেলেন আরও বেশি কিছু। গুরুগৃহে বসবাসের সময় মৈত্রেয়ীর সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। মির্চার বয়স তখন একুশ, মৈত্রেয়ী চৌদ্দ। মৈত্রেয়ীর রূপে মজতে মির্চার সময় লাগে না। মৈত্রেয়ীরও একই হাল। আর সময় যত এগিয়ে যেতে থাকে, তা বাড়ে বৈ কমে না।

তাদের দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে নানা ভাবে। কখনও ঘরের বাইরে, কখনও ভেতরে। এর পাশাপাশিই দুজনের মধ্যে চলে আসে শরীরী প্রেম। কিন্তু,১৯৩০ এর ভারতবর্ষে এই সম্পর্ক কি মানা যায়? তিরিশ কেন, এখনও হয়তো এমন সংস্কার প্রধান গৃহে তা মানা হবে না। তাই চলে যেতে হয়েছিল মির্চাকে, পেছনে পড়েছিলেন মৈত্রেয়ী। সেই সময়ে পড়া শেষ করে অবাক হয়ে ভাবছিলাম-এটা কি প্রেম, না ভালবাসা?

অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। কেননা মির্চা আর মৈত্রেয়ীর বিচ্ছেদের বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী লিখলেন একটি বই;‘ন হন্যতে’। অর্থাৎ, যার মৃত্যু নেই। ‘লা নুই বেঙ্গলী’ পড়ে অনেক প্রশ্ন জমে ছিল মনে। এক এক করে তার উত্তর দিতে লাগল ‘ন হন্যতে’।

৩.
মির্চার গল্প যেখানে শেষ হয়, তার পরের গল্পটা এই বইতে পাওয়া যায়। সাথে পুরনো গল্পের বাকি অংশ। কিন্তু ‘লা নুই বেঙ্গলী’তে মৈত্রেয়ীকে পেলেও এখানে সে অমৃতা হয়ে গেল। 'লা নুই বেঙ্গলী'তে মৈত্রেয়ীকে মির্চার বয়ানে পাওয়া যায় আর 'ন হন্যতে'তে মৈত্রেয়ী নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখালেন।

লা নুই বেঙ্গলী পড়ে জমা প্রশ্নের উত্তর মৈত্রেয়ীর বইয়ে পেলেও এ বই অনেক ভ্রম তৈরী করে। কেননা মির্চা যেখানে তার বইয়ে প্রেমের অকপট বয়ান করেছেন, মৈত্রেয়ী সেখানে ভাষার আশ্রয় (চাতুরী?) নিয়ে এক ভিন্ন গল্প বলেন। মির্চার লেখা পড়ে তাকে সদ্য যুবক এক প্রেমিক মনে হয় কিন্তু মৈত্রেয়ীর লেখা পড়ে মির্চাকে এক সুযোগ সন্ধানী দেহজ চাহিদা-স্বর্বস্ব মানুষ বলে মনে হবে।

সাহিত্য বিচারে, আমার মনে হয় ‘ন হন্যতে’ অনেক ঋদ্ধ। বইটি কেবল একটা খণ্ডিত আত্মজীবনী-ই নয়, কবিতা হয়ে উঠেছে। এর কিছু কারণের মধ্যে প্রধান হলো বইটি বাংলায় লেখা আর মির্চারটা অনুবাদ। দ্বিতীয়, মির্চা ফিরে গিয়েই কাতর মনে নিজের প্রেমের গল্পটি লেখেন। তার বয়ান মেদ বর্জিত, ঋজু। কখনও কেবল এক ব্যর্থ প্রেমিকের অতুল প্রেমের হা হুতাশ আর হারানো প্রেমের স্মৃতি।

অনেকে বলে থাকেন মির্চার লেখায় শরীরী প্রেমের অত্তিত্ব বড় বেশি। বেয়াল্লিশ বছর পর মৈত্রেয়ী তার বইয়ে জানান তেমন কোন শরীরী বিষয় আদৌ ছিল না। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে অমৃতা একটা মোহে পড়েছিল যা ভঙ্গ হতে বেশি সময় নেয়নি। কিন্তু মির্চার লেখা থেকে মনে হয় ফুলশরে দুজনেই বিঁদ্ধ হয়েছিলেন। আর মির্চা তার ইউরোপীয় ভাবধারা থেকে বেরিয়ে ভারতীয় 'প্লেটোনিক প্রেম' খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু 'লা নুই বেঙ্গলি' অনুসারে, তার আগেই শরীর প্রেমও এসে যায় তাদের মাঝে।

৪.
ইদানিং বইয়ের গ্রুপ কেন্দ্রিক আলোচনা চোখে পড়ে যেখানে মির্চার লেখাকে মিথ্যা বলে অনেকেই তার প্রতি নিপীড়কের তকমা লাগানোর পপুলিস্ট থিয়োরি দিয়ে বেশ লাইক কমেন্ট কামায়। অবশ্য খোদ মৈত্রেয়ী লিখেছিলেন মির্চার সাথে তার কিছু হয়নি।

এখন তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতো পারে ইউরোপীয় সমাজে সেক্সটা স্বাভাবিক বলে মির্চা তার লেখায় সেটা রেখেছিলেন। সেটা অসম্ভব নয় কিন্তু ষোড়শী হতে চলা একটি মেয়ের সাথে তরতাজা একটা যুবকের প্রেম হওয়ার পর সুযোগ থাকলে শরীরী সম্পর্ক হবে না, এমন ভাবাটাও বোকার স্বর্গে থাকা। মির্চাকে দোষারোপ করার আগে মির্চারই লেখার দিকে তাকালে দেখা যাবে মৈত্রেয়ীর দ্বিধার কথা তিনি স্পষ্টই লিখেছেন। মৈত্রেয়ীকে 'গডেস' বা দেবী বলে সম্বোধন করা তার প্রেমের অভিব্যক্তি হওয়াই সম্ভব।

অন্যদিকে মৈত্রেয়ী যখন লিখেছেন তখন তিনি একজনের স্ত্রী, কারও মা। সমাজে একজন পরিচিত ব্যক্তি। আশ্চর্যের কথা তিনি নাকি জানতেনই না মির্চা তাকে নিয়ে বই লিখে 'মিথ্যাচার' করেছে, যা বছর চল্লিশেক আগে প্রকাশিত। তো মৈত্রেয়ী লিখলেন সেই 'মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে' সত্য প্রকাশ করতে। ভাষার কারুকাজে তিনি মির্চাকে খলনায়ক তো করলেনই, একটা অপার্থিব আবহ আনতে রবীন্দ্রনাথকে এনে বসালেন দেবতার আসনে। সবকিছু এমন করে বর্ণনা করলেন যা চৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণের জীবনী লিখতেও অনেকে আনতে পারেনি।

৫.
খেয়াল করার বিষয় মির্চার লেখা যতটা স্পষ্ট, মৈত্রেয়ীর লেখা ততটাই কুয়াশামাখা। আর বাকিটা বুঝতে একটু বুদ্ধি খাটালেই হয়। মির্চার লেখায় এক বাঙালী ষোড়শীর মানসিক দ্বন্দ্ব এতো স্পষ্ট যা খণ্ডাতে মৈত্রেয়ীকে তার বইয়ে যথেষ্ট খাটতে হয়েছে। যদি ধরেও নেই মির্চা 'সেক্স' এনে বইয়ের বিক্রি বাড়াতে চেয়েছেন, তাহলে এতাও মানা উচিৎ মৈত্রেয়ী, রবীন্দ্রনাথকে ঢাল বানিয়ে সামনে রেখে দিয়েছেন। শেষ জীবনে মির্চার সাথে দেখা করতেও গিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী। নিজের বইয়ে লিখেছেন, 'মির্চার চোখে দৃষ্টি নেই'। মৈত্রেয়ীর এই কথাটা রুপক হিসেবে নেওয়া যায়। মৈত্রেয়ীর প্রতি মির্চার চোখে কোন আবেগ ছিল না।

মির্চা-মৈত্রেয়ী শেষ জীবনে দেখা করে হয়তো পারস্পরিক একটা বোঝাপরাই করেছিলেন, সে তারাই জানেন। কিন্তু এতোদিন পর তাদের প্রেমের গল্প পড়ে, পুরুষতন্ত্র, যৌনতার ভিত্তিতে চিন্তা করে কাওকে নিপীড়ক বানিয়ে দেওয়া বাতুলতা বৈ কিছু না। পপুলিস্ট স্টেটমেন্ট তৈরী না করে একটু তলিয়ে ভাবা জরুরী৷ এমনকি নিজের বইয়ের নাম মৈত্রেয়ী রেখেছেন 'ন হন্যতে' অর্থাৎ 'যা মরে না'। হয় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তার শরীর যাই হোক আত্মা অমৃত ছিল। কিংবা তিনি বলতে চান 'প্রেম অমর' আর প্রেমের টানেই তিনি মির্চার কাছে গিয়েছিলেন যেকথা তখন সমাজের সামনে বলা যায় না, যেটা মির্চা বলতে পেরেছিলেন।

লিখতে লিখতে আরেকটা জিনিস মনে হচ্ছে। মির্চা, মৈত্রেয়ী দুজনেই হয়ত পাঠক-মানসিকতা জানতেন। তাদের কেউ তুমুল প্রেম আর কেউ ঐশ্বরিক দীপ্তি যুক্ত প্রেম পছন্দ করে। একজন দার্শনিক, অন্যজন কবি তাদের বইয়ে সেসবই এনেছিলেন। দুজনের লেখাই দুই দেশে, দুই ধরণের পাঠকের কাছে সমাদৃত। আর নানা ভাবে চর্চিত। কিন্তু তারা বাঙালী আধ-পড়ুয়াদের চরিত্র জানতেন কিনা জানি না, যারা সাহিত্য, প্রেম ইত্যাদি থেকেই লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার নিয়ে চর্চা করতে বেশি পছন্দ করে। যারা বই পড়ে গল্প, ভাষা, লেখার কৌশল কিংবা নিদেন ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়ে চিন্তা করার আগেই বইয়ে কতটা 'সেক্স' আছে, সেটা চিন্তা করে।

'বাংলার রাত' উপন্যাসে যৌনতা কিংবা 'যা অমর' (অনুবাদ হইলে এমনই নাম দিত) উপন্যাসে রবীন্দ্রপূজা ছাড়াও তাদের জীবনে অনেক কাজ ছিল। অনেক অ্যাচিভমেন্ট ছিল। মির্চার কাজের এক বিশাল তালিকা, আলোচনা আছে উইকিতেই। মৈত্রেয়ীও একজন ভালো কবি, কর্মী, ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তারা আমাদের কাছে পরিচিত তাদের উক্ত দুই বইয়ের দৌলতে এবং নিঃসন্দেহে বইদুটো নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ কেননা মির্চার প্রেম, প্রেমের বয়ান, সে সময়ের ভারতের একটি পরিবারের কথা, প্রেমিক-প্রেমিকার মানসিক দ্বন্দ্ব; অনেক কিছুই আছে। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী দেবীর বইয়ের বেলায়ও একই কথা। তাদের লেখাকে অন্যভাবে দেখার কথা ছিল; পপুলিস্ট, জাজমেন্টাল, বানসালী কিংবা সৃজিতের সিনেমার মতো করে না।

নোট
১. বই দুইটা ২০১৪ সালে পড়া, তখনই ছোট করে রিভিউ লিখছিলাম। এই ছয় বছর পর খুঁটিনাটি মনে নাই। থাকলে কোট করে লেখা যাইত। তবে প্রয়োজন মনে করতেছিও না আসলে।

২. লা নুই থেকে প্রায় সরাসরি কাহিনী নিয়ে সঞ্জয় লীলা বানসালী 'হাম দিল দে চুকে সানাম' সিনেমা তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে সৌমিত্র-শাবানা আজমী অভিনয়ে 'দি বেঙ্গলি নাইট' নামে একটি সিনেমা হয়।
2 likes ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter

July 30, 2020

আহমদ ছফা সম্পর্কীয় মাতামাতি এবং ফেবুসিয়েস (ফেসবুকীয় বিসিএস) সমাজ

আহমদ ছফা তাঁর সময়ের একজন বড় চিন্তক। তাঁকে কালোত্তীর্ণ বলার সময় হয়ত এখনও আসেনি তবে তাঁর চিন্তা, মতবাদ, ব্যাখ্যা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং দৃশ্যত মনে হয় সামনেও তা বলবৎ থাকবে। এহেন ছফাকে নিয়ে আলোচনা হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু আদতে এই সময়ে যেটা হচ্ছে সেটা ঠিক ছফা-চর্চা না; যদিও অনেকে এঁকে চর্চা বলেই মনে করেন।

ছফাকে কয়জন চেনেন? অনেকেই চিনতে পারেন কিন্তু প্রশ্ন হলো কয়জন জানেন? চেনার চেয়ে জানাটা জরুরী। বিশেষ করে ছফার মতো লেখক, মানুষ, চিন্তকের ক্ষেত্রে। ধারণ করার প্রশ্ন পরে আসে কেননা তা একটা বিস্তৃত বৃহৎ প্রসঙ্গ। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুকের আরও কিছু ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয়ের মতো ছফাও ট্রেন্ডিং। প্রশ্ন আসে, ট্রেন্ডিং হওয়াতে খারাপ কী আছে? চর্চা তো হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে ট্রেন্ডিং হওয়া খারাপ, কেননা ট্রেন্ডিং আর চর্চা এক জিনিস নয়। মান্টোর জন্মদিনে মান্টোকে নিয়ে ‘গণহারে’ পোস্ট দেখে একই কথা বলেছিলাম। আমার কথার অর্থ এই নয় যে ছফা, মান্টো এলিট পাঠকদের সম্পত্তি। তবে হ্যাঁ, এদের নিয়ে চর্চা হতে হলে গভীর ভাবেই হওয়া উচিৎ যেখানে মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের নামও হয়ত অনেকে জানেন না কিন্তু মান্টোর জন্মদিনে মান্টোকে নিয়ে পোস্ট করেন। অন্যদিকে ছফার পরিচিতি এদের কাছে হয়ত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ এবং ‘গাভি বিত্তান্ত’র মাঝে সীমাবদ্ধ।

মজার ব্যপার মান্টো আলোচিত হলো নন্দিতা দাশের সিনেমা থেকে আর ছফার জন্মদিনে যে পোস্টটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেল সেটা কপি পেস্ট করা, যেখানে ছফা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া এমনকি এককালে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব কেমন করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে কথাই আলোচ্য। ছফাকে নিয়ে মাতামাতির এই জায়গাটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এবং একই সাথে ভয়াবহ।

একটা সময়ে (এই কিছুদিন আগেও) ছফা একটা নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে চর্চিত ছিলেন। বাম ধারার সেই রাজনীতির যারা অনুসারী তারা ছফা চর্চা করতেন। তাদের কারো কারো সাথে আলাপ হওয়ার কারণে জানি তারা ছফাকে ধারণ করতেন (যদিও ছফার মতো তারাও নিজের মতের বাইরে অন্ধ)। পরবর্তীতে ‘যদ্যপি আমার গুরু’-তে তৎকালীন বাংলাদেশের কিছু প্রেক্ষাপট এবং অন্যান্য কারণে বিসিএস কেন্দ্রিক ফেসবুক গ্রুপে ছফা হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বলা ভালো তাঁকে জনপ্রিয় করা হয়। এটা একটা দিক।

দ্বিতীয় দিক হলো ঐ উপর্যুক্ত তিন হেভিওয়েট ব্যক্তিকে ছফার প্রত্যাখ্যান। অর্থাৎ ছফা এই সময়ে এসে রাজনৈতিক একটা চরিত্র যাকে দিয়ে দেখানো হচ্ছে কীভাবে বিভিন্ন মতবাদ, ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়। আরও সহজ করে বললে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নানা কারণে কথা বলতে যাদের ইচ্ছা করে কিন্তু সরাসরি বলতে ভয় পায়, তারা ছফাকে সামনে এনে ইশারা ইঙ্গিতে নানা কথা বলে থাকে। অর্থাৎ ছফা এখানে শিখণ্ডী।

ছফার বহুল পঠিত বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। একথা কেউ অস্বীকার করবে না যে বাংলাদেশে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো জ্ঞানী মানুষ দুর্লভ। কিন্তু যে ছফা ব্যক্তিপূজার বিরোধী তিনিও এই বইতে সে কাজটাই করলেন। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় এই বইতে আব্দুর রাজ্জাকও খানিকটা শিখণ্ডী। তাঁর মুখ থেকে অনেক কথা এসেছে যা হয়ত ছফা নিজে হয়ত বলতেন না কিংবা ছফার চেয়ে রাজ্জাক সাহেবের মুখে কথাগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য। বিষয়গুলো রাজনৈতিক এবং কখনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

‘বাঙালী মুসলমানের মন’ কয়জনের পড়া আছে সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। ছফার ‘অলাতচক্র’ থেকে অনেকে শিক্ষা নেয় যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতায় বসে কেবল রাজা উজির মারা হতো। সেখানে কিছু মানুষ বেশ চালে ডালে ভালো সময় কাটিয়েছে। কিন্তু আদতে ছফা ঐ সময়ে যে জায়গাটায় ছিলেন, যে জায়গা দেখেছেন সেটাকেই উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তাঁর ঐ দেখার বাইরেও অনেক কিছু ছিল। ঐ বই থেকেই 'চোখ ওঠা'কে ‘জয় বাংলা রোগ’, সস্তা জিনিসকে ‘জয় বাংলা’ বলে কলকাতার দোকানদারদের উল্লেখ করার বিষয়টা ছফা দেখিয়েছেন।

কিন্তু ছফার লেখা থেকে সেই অংশটুকু কোট করে অনেকেই ভারত বিরোধী একটা প্রচারণা চালান। অথচ ছফার লেখায় ঐ ঘটনার কনটেক্স উল্লেখ করা হয় না যেটা ছফাও আদতে করেননি। (জয় বাংলা সাবান, জয় বাংলা রোগ বলা যদি ক্যাল্কেশিয়ান পাপ হয়, তাহলে রোহিঙ্গা বলে গালি দেওয়ার ব্যপারটা এই ছফা পূজারীরা কীভাবে দেখবেন আমি জানি না)। কিন্তু কথা ছড়ানো হচ্ছে ঠিকই এবং সেটা করা হচ্ছে নিজস্ব কিংবা গোষ্ঠীগত প্রয়োজনে। অর্থাৎ ছফা এক শ্রেনির মানুষের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার।

ছফার ‘ওঙ্কার’ একটা অসাধারণ উপন্যাস। কিন্তু তাঁর অন্যান্য বইয়ের মতো আলোচিত হয় না। সেখানে আলী কেনানের উত্থান পতনের 'কানিং প্রেজেন্টেশন' হয়ত অনেকের চোখেই পড়ে না। কিন্তু উপন্যাস ছাড়িয়ে ছফার আসল কৃতিত্ব তাঁর প্রবন্ধ যার চর্চা আদতে নেই।

অনেকে বলে থাকেন, চর্চা নেই কিন্তু এখন অনেকে নাম জানছে, চর্চা হবে। এটা তো ভালো। আসলে এটা ভালো না। ভালো এ কারণে না যে তাঁকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেই উপস্থাপনাই ভুল। ছফা চর্চা হতে হলে একটা মানে পৌঁছতে হয়। সেই শিক্ষা, মনন ব্যতীত ছফা বোঝা সম্ভব না। সকলের পক্ষে সম্ভব না কিন্তু যারা পৌঁছেছে তারা সহজ করে ছফাকে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু যারা টুকটাক বুঝেছে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে নইলে চুপ করে আছে।

ছফার জন্মদিনে যত মানুষ ছফাকে নিয়ে পোস্ট করেছে তার মধ্যে অনেকেই লকডাউনে টাইম পাস হিসেবে কাজটা করেছে। এদের কথা বাদ। বাকি যারা টুকটাক জানে বা পড়ে, এদের কাছে ছফা যেভাবে পৌঁছচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরে ছফা ‘দ্বিতীয় হুমায়ূন আহমেদ'-এ পরিণত হবেন। দেখা যাবে ছফা কবে কী বলেছেন তাই নিয়ে পোস্ট হচ্ছে যার মধ্যে অনেক কথা ছফা আদৌ বলেননি। হুমায়ূন যেখানে রোমান্টিক, ছফা সেখানে ‘ব্যাডঅ্যাস’। শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু সত্যিই ছফাকে এই ‘ব্যাডঅ্যাস’, 'শ্যাভেজ' হিসেবেই প্রচার করা হচ্ছে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি নয়।

'বেচে খাওয়া' মানে কেবল বই বেচে খাওয়াকে বোঝায় না। কাওকে ব্যবহার করা মানেই বেচে খাওয়া। ছফাও এখন নেহায়েত একটা প্রোডাক্ট। বিসিএস গ্রুপ থেকে যার নব উত্থান। যারা ছফা চর্চার আশা দেখছেন, আমার বিশ্বাস এখানে এই সময়ে তা সম্ভব না। কেননা ছফাকে পাবলিক প্রোডাক্ট বানিয়ে বিক্রির ধান্দা হচ্ছে যেখানে সে মোটেও পাবলিক প্রোডাক্ট না, ছফা আমাদের প্রোপার্টি যার প্রোপার নার্চার হয় নাই।

**আমি নিজে ছফা গুলে খাই নাই। এই পোস্ট ছফার বই, কাজ নিয়েও না বরং ছফাকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার সার্বিক একটা সরলীকৃত চিত্র। আরও বিস্তারে বললে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই হইল অবস্থা।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on July 30, 2020 09:04 Tags: আহমদ-ছফ, ছফ, ফ-সব-ক, হ-ম-য়-ন-আহম-দ