আহমদ ছফা সম্পর্কীয় মাতামাতি এবং ফেবুসিয়েস (ফেসবুকীয় বিসিএস) সমাজ

আহমদ ছফা তাঁর সময়ের একজন বড় চিন্তক। তাঁকে কালোত্তীর্ণ বলার সময় হয়ত এখনও আসেনি তবে তাঁর চিন্তা, মতবাদ, ব্যাখ্যা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং দৃশ্যত মনে হয় সামনেও তা বলবৎ থাকবে। এহেন ছফাকে নিয়ে আলোচনা হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু আদতে এই সময়ে যেটা হচ্ছে সেটা ঠিক ছফা-চর্চা না; যদিও অনেকে এঁকে চর্চা বলেই মনে করেন।

ছফাকে কয়জন চেনেন? অনেকেই চিনতে পারেন কিন্তু প্রশ্ন হলো কয়জন জানেন? চেনার চেয়ে জানাটা জরুরী। বিশেষ করে ছফার মতো লেখক, মানুষ, চিন্তকের ক্ষেত্রে। ধারণ করার প্রশ্ন পরে আসে কেননা তা একটা বিস্তৃত বৃহৎ প্রসঙ্গ। কিন্তু বর্তমানে ফেসবুকের আরও কিছু ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয়ের মতো ছফাও ট্রেন্ডিং। প্রশ্ন আসে, ট্রেন্ডিং হওয়াতে খারাপ কী আছে? চর্চা তো হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে ট্রেন্ডিং হওয়া খারাপ, কেননা ট্রেন্ডিং আর চর্চা এক জিনিস নয়। মান্টোর জন্মদিনে মান্টোকে নিয়ে ‘গণহারে’ পোস্ট দেখে একই কথা বলেছিলাম। আমার কথার অর্থ এই নয় যে ছফা, মান্টো এলিট পাঠকদের সম্পত্তি। তবে হ্যাঁ, এদের নিয়ে চর্চা হতে হলে গভীর ভাবেই হওয়া উচিৎ যেখানে মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের নামও হয়ত অনেকে জানেন না কিন্তু মান্টোর জন্মদিনে মান্টোকে নিয়ে পোস্ট করেন। অন্যদিকে ছফার পরিচিতি এদের কাছে হয়ত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ এবং ‘গাভি বিত্তান্ত’র মাঝে সীমাবদ্ধ।

মজার ব্যপার মান্টো আলোচিত হলো নন্দিতা দাশের সিনেমা থেকে আর ছফার জন্মদিনে যে পোস্টটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেল সেটা কপি পেস্ট করা, যেখানে ছফা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া এমনকি এককালে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব কেমন করে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে কথাই আলোচ্য। ছফাকে নিয়ে মাতামাতির এই জায়গাটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এবং একই সাথে ভয়াবহ।

একটা সময়ে (এই কিছুদিন আগেও) ছফা একটা নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে চর্চিত ছিলেন। বাম ধারার সেই রাজনীতির যারা অনুসারী তারা ছফা চর্চা করতেন। তাদের কারো কারো সাথে আলাপ হওয়ার কারণে জানি তারা ছফাকে ধারণ করতেন (যদিও ছফার মতো তারাও নিজের মতের বাইরে অন্ধ)। পরবর্তীতে ‘যদ্যপি আমার গুরু’-তে তৎকালীন বাংলাদেশের কিছু প্রেক্ষাপট এবং অন্যান্য কারণে বিসিএস কেন্দ্রিক ফেসবুক গ্রুপে ছফা হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বলা ভালো তাঁকে জনপ্রিয় করা হয়। এটা একটা দিক।

দ্বিতীয় দিক হলো ঐ উপর্যুক্ত তিন হেভিওয়েট ব্যক্তিকে ছফার প্রত্যাখ্যান। অর্থাৎ ছফা এই সময়ে এসে রাজনৈতিক একটা চরিত্র যাকে দিয়ে দেখানো হচ্ছে কীভাবে বিভিন্ন মতবাদ, ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়। আরও সহজ করে বললে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নানা কারণে কথা বলতে যাদের ইচ্ছা করে কিন্তু সরাসরি বলতে ভয় পায়, তারা ছফাকে সামনে এনে ইশারা ইঙ্গিতে নানা কথা বলে থাকে। অর্থাৎ ছফা এখানে শিখণ্ডী।

ছফার বহুল পঠিত বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। একথা কেউ অস্বীকার করবে না যে বাংলাদেশে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো জ্ঞানী মানুষ দুর্লভ। কিন্তু যে ছফা ব্যক্তিপূজার বিরোধী তিনিও এই বইতে সে কাজটাই করলেন। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় এই বইতে আব্দুর রাজ্জাকও খানিকটা শিখণ্ডী। তাঁর মুখ থেকে অনেক কথা এসেছে যা হয়ত ছফা নিজে হয়ত বলতেন না কিংবা ছফার চেয়ে রাজ্জাক সাহেবের মুখে কথাগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য। বিষয়গুলো রাজনৈতিক এবং কখনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

‘বাঙালী মুসলমানের মন’ কয়জনের পড়া আছে সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। ছফার ‘অলাতচক্র’ থেকে অনেকে শিক্ষা নেয় যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কলকাতায় বসে কেবল রাজা উজির মারা হতো। সেখানে কিছু মানুষ বেশ চালে ডালে ভালো সময় কাটিয়েছে। কিন্তু আদতে ছফা ঐ সময়ে যে জায়গাটায় ছিলেন, যে জায়গা দেখেছেন সেটাকেই উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তাঁর ঐ দেখার বাইরেও অনেক কিছু ছিল। ঐ বই থেকেই 'চোখ ওঠা'কে ‘জয় বাংলা রোগ’, সস্তা জিনিসকে ‘জয় বাংলা’ বলে কলকাতার দোকানদারদের উল্লেখ করার বিষয়টা ছফা দেখিয়েছেন।

কিন্তু ছফার লেখা থেকে সেই অংশটুকু কোট করে অনেকেই ভারত বিরোধী একটা প্রচারণা চালান। অথচ ছফার লেখায় ঐ ঘটনার কনটেক্স উল্লেখ করা হয় না যেটা ছফাও আদতে করেননি। (জয় বাংলা সাবান, জয় বাংলা রোগ বলা যদি ক্যাল্কেশিয়ান পাপ হয়, তাহলে রোহিঙ্গা বলে গালি দেওয়ার ব্যপারটা এই ছফা পূজারীরা কীভাবে দেখবেন আমি জানি না)। কিন্তু কথা ছড়ানো হচ্ছে ঠিকই এবং সেটা করা হচ্ছে নিজস্ব কিংবা গোষ্ঠীগত প্রয়োজনে। অর্থাৎ ছফা এক শ্রেনির মানুষের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার।

ছফার ‘ওঙ্কার’ একটা অসাধারণ উপন্যাস। কিন্তু তাঁর অন্যান্য বইয়ের মতো আলোচিত হয় না। সেখানে আলী কেনানের উত্থান পতনের 'কানিং প্রেজেন্টেশন' হয়ত অনেকের চোখেই পড়ে না। কিন্তু উপন্যাস ছাড়িয়ে ছফার আসল কৃতিত্ব তাঁর প্রবন্ধ যার চর্চা আদতে নেই।

অনেকে বলে থাকেন, চর্চা নেই কিন্তু এখন অনেকে নাম জানছে, চর্চা হবে। এটা তো ভালো। আসলে এটা ভালো না। ভালো এ কারণে না যে তাঁকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেই উপস্থাপনাই ভুল। ছফা চর্চা হতে হলে একটা মানে পৌঁছতে হয়। সেই শিক্ষা, মনন ব্যতীত ছফা বোঝা সম্ভব না। সকলের পক্ষে সম্ভব না কিন্তু যারা পৌঁছেছে তারা সহজ করে ছফাকে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু যারা টুকটাক বুঝেছে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে নইলে চুপ করে আছে।

ছফার জন্মদিনে যত মানুষ ছফাকে নিয়ে পোস্ট করেছে তার মধ্যে অনেকেই লকডাউনে টাইম পাস হিসেবে কাজটা করেছে। এদের কথা বাদ। বাকি যারা টুকটাক জানে বা পড়ে, এদের কাছে ছফা যেভাবে পৌঁছচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরে ছফা ‘দ্বিতীয় হুমায়ূন আহমেদ'-এ পরিণত হবেন। দেখা যাবে ছফা কবে কী বলেছেন তাই নিয়ে পোস্ট হচ্ছে যার মধ্যে অনেক কথা ছফা আদৌ বলেননি। হুমায়ূন যেখানে রোমান্টিক, ছফা সেখানে ‘ব্যাডঅ্যাস’। শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু সত্যিই ছফাকে এই ‘ব্যাডঅ্যাস’, 'শ্যাভেজ' হিসেবেই প্রচার করা হচ্ছে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি নয়।

'বেচে খাওয়া' মানে কেবল বই বেচে খাওয়াকে বোঝায় না। কাওকে ব্যবহার করা মানেই বেচে খাওয়া। ছফাও এখন নেহায়েত একটা প্রোডাক্ট। বিসিএস গ্রুপ থেকে যার নব উত্থান। যারা ছফা চর্চার আশা দেখছেন, আমার বিশ্বাস এখানে এই সময়ে তা সম্ভব না। কেননা ছফাকে পাবলিক প্রোডাক্ট বানিয়ে বিক্রির ধান্দা হচ্ছে যেখানে সে মোটেও পাবলিক প্রোডাক্ট না, ছফা আমাদের প্রোপার্টি যার প্রোপার নার্চার হয় নাই।

**আমি নিজে ছফা গুলে খাই নাই। এই পোস্ট ছফার বই, কাজ নিয়েও না বরং ছফাকে কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার সার্বিক একটা সরলীকৃত চিত্র। আরও বিস্তারে বললে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই হইল অবস্থা।
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on July 30, 2020 09:04 Tags: আহমদ-ছফ, ছফ, ফ-সব-ক, হ-ম-য়-ন-আহম-দ
No comments have been added yet.