অনিমেষের গল্প
১.
মহাভারতের ষোড়শ পর্বের নাম 'মুষল পর্ব'। প্রবল-প্রতাপ শ্রীকৃষ্ণের যাদব বংশ ধ্বংসের গল্প। যে মানুষটি মর্ত্যে দেবতার আসন পেয়েছিলেন, নেপথ্যে থেকে চালিয়েছিলেন সমগ্র কুরুক্ষেত্র, সেই বুদ্ধিমান এবং জনপ্রিয় মানুষটির চোখের সামনে শেষ হয়ে গেলো সব। সেই মুষল পর্বের সাথে মিল রেখে, সমরেশ ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ পেরনোর অনেক বছর পর লিখলেন মৌষলকাল।
‘উত্তরাধিকার’ থেকে অনিমেষের গল্প শুরু। কিন্তু সে গল্প যতখানি অনিমেষের, ঠিক ততখানি সরিৎশেখরের। তারচেয়ে বেশি পুরুষানুক্রমে চলে আশা চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস আর পথ পরিবর্তনের। অনিমেষকে আমরা আরও কাছ থেকে দেখি ‘কালবেলা’য়। এ গল্প অনিমেষ আর মাধবীলতার। যতখানি প্রেমের, তারচেয়ে বেশি একটা সময়ের। যে সময় প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার।
‘কালবেলা’র পর ‘কালপুরুষ’। মাঝে পেরিয়েছে অনেকটা সময়। পুলিশের অত্যাচারে পা হারানো অনিমেষ এখন কোন নকশাল নেতা নয়। যোগাযোগ রাখেনি কোন রাজনীতির সাথে। মাধবীলতা বয়ে চলেছে অনিমেষের ভার। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে ভার হয়তো বোধ হয় না। আর তাদের ছেলে অর্ক। বস্তির পরিবেশে বখে যেতে যেতে ভেতরে অনিমেষের রক্ত কথা বলে উঠলো। পরিবর্তন আনতে গিয়ে ঠিক বাবার মতই মাঝপথে থমকে গেল।
সাতকাহন করে এতক্ষণ যা বললাম, তা সমরেশের পাঠকমাত্রই জানেন। 'উত্তরাধিকার', 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' ট্রিলজি। 'কালপুরুষ' লেখার প্রায় তিরিশ বছর পর সমরেশ আবার অনিমেষ আর মাধবীলতাকে নিয়ে কলমে আঁচড় কাটলেন। ‘মৌষলকাল’ খুব কাছাকাছি সময়ের গল্প। যেখানে বহুদিনের পুরনো মানুষেরা ফিরে আসে নতুন করে।
২.
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনিমেষ আর রাজনীতির কাছে ঘেঁষে নি। তার ছেলে অর্ক, বস্তিতে কমিউন গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পিতার মতই গুটিয়ে গেছে। সে এখন নিয়ম করে অফিসে যায়, বাড়িতে এসে ঘুমায়। অর্কর বয়স এখন চল্লিশ। অনিমেষ, মাধবীর ষাট। শরীরে সময়ের ছাপ, মনের গভীরে তবু থেকে যায় পুরনো আগুন।
সমরেশের লেখায় রাজনীতির প্রসঙ্গ থাকবেই, এবং তা অনেক বিস্তারিত ভাবেই। 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' এমনকি 'উত্তরাধিকার' আসলে রাজনীতির পটভূমিতেই লেখা (যদিও 'উত্তরাধিকার'-এ সেটা প্রচ্ছন্ন)। 'মৌষলকাল' তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বামফ্রন্টের পতন আর তৃণমূলের উত্থান। এবং সেই উত্তাল সময়, পট পরিবর্তন আর তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কিছু পুরনো মানুষ।
‘মৌষলকাল’ নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি। এবং সেটা রাজনৈতিক মতবাদে নয়, বরং সমালোচনা হয়েছিল সমরেশের উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষমতা নিয়ে। কেননা অনেকের মতেই যোগ্যতার বিচারে ‘মৌষলকাল’ তার পূর্বের তিন বইকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সমরেশের ভক্ত নই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার ব্যতিক্রম লেগেছে ‘মৌষলকাল’।
৩.
বইটা পড়ার আগে প্রশ্ন ছিল, “সমরেশ তিন দশক পর কেন এই সিরিজের নতুন বই লিখলেন? প্রকাশকের চাপে, নাকি নিজের পুরনো কাহিনীকে টেনে কিছু কপি বিক্রি করার আশায়?” বই পড়ে উত্তর পেলাম। আসলে এসব কিছুই নয়। সব গল্প, সব চরিত্র, সব কাহিনী পরিণতি চায়। কিন্তু হয়ত সবাই পায় না। কালপুরুষ পর্যন্ত এই গল্পও পরিনতি পায়নি। পরিনতি পায়নি মাধবী-অনিমেষ। সেই গল্পকে পরিনতি দিতেই সমরেশ লিখেছেন এই বই।
‘কালপুরুষ’ শেষ হয়েছিল পথের একটা বাঁকে। সেখান থেকে সামনের পথ পথিকের জন্য খোলা ছিল। এখানে পথিক হলেন পাঠক। তিনি তার ভাবনার চাকা যে কোনো দিকেই ঘোরাতে পারেন। কিন্তু বাঁকটা সেখানে একটু জটিল ছিল। তাই অর্জুনের পক্ষে পথ নির্ণয় সম্ভব ছিল না। অগত্যা সারথি হয়ে রথের চাকা ঘোরালেন শ্রীকৃষ্ণ।
‘উত্তরাধিকার’ ছিল অনিমেষের শুরু। অনি থেকে অনিমেষ হয়ে ওঠার আঁতুড়ঘর। তারপর ‘কালবেলা’। সেখানে শুরুতে অনিমেষ কিছুটা দ্বিধাান্বিত। তারপর হয়তো আবেগের বশেই একদিকে ছুটে যাওয়া। ভালোবাসা। আহত পাখির মত নীড়ে ফিরে আসা। তারপর নিস্তরঙ্গ জীবন। তার পাশে ছায়ার মত মাধবীলতা। এখানে হয়তো, সে-ই অনিমেষের সারথি।
‘কালপুরুষ’ শুরু হয়েছিল অনিমেষকে দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে পাদপ্রদীপ পড়ে অর্কর গালে। নায়ক হয়ে ওঠে সে। সেকালের গল্প একালে ছাইচাপা হয়ে আছে। অনিমেষ কেবলে ভুল পথে যাওয়া নকশাল নেতা। বদলাতে পারেনি সে কিছুই। সময়ের স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে অর্ক কিছু একটা করতে চায়। কিন্তু পারে না। স্রোত তাকে দাঁড়াতে দেয় না। তবে তাকে ভাসিয়েও রাখে। সময়ের চোখে এখন সে-ই নায়ক।
কিন্তু যে গল্প অনিমেষের, সেখানে অর্ক কি করে নায়ক? ‘কালপুরুষ’ তাই থেমে গিয়েছিল মাঝপথে। কিংবা আমার মনে হয়েছিল এখানেই শেষ নয়। সমরেশও বোধয় বুঝেছিলেন। তার গল্পে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা। তাই তিনি কি করে কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে অনিমেষের জায়গা অর্ককে দেবেন?
এই গল্পে অনিমেষ ফিরে যায় তার শেকড়ে। যেখানে তার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। বহুদিন হল সে সবের সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফিরে যেতেই শেকড় বুঝি আঁকড়ে ধরে। সেখানে সময় খুব ধীরে ধীরে বদলায়। তবু সাপেরা নিঃশ্বাস ফেলে। বাধ্য হয়েই আবার তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ওদিকে বহুদিন সবকিছু থেকে দূরে থাকা অর্কও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। সরাসরি না হলেও পরিবর্তনের হাওয়া স্পর্শ করে তাকে।
কালপুরুষে অনিমেষ ছিল ম্রিয়মান। স্তিমিত প্রদীপ যেন। সেখানে মাধবী ছিল অগ্নিশিখার মত। বিয়ে তারা কোনদিন করেনি। পাশাপাশি দুজন মানুষ, আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি। বার্ধক্যের সীমায় এসে এখনও তারা ঠিক প্রচলিত স্বামী স্ত্রী নয়, সেই আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি আছে। তাদের ভালোবাসা কিংবা সময়ের প্রয়োজনে আসা অর্ক রয়ে গেছে একা। অবশ্য কুন্তীর দেখা পেয়েছে সে। তবে কি অর্ক আসলে পাণ্ডু?
৪.
যেমন আগে বলেছি, কাহিনীকেকে পরিনতি দিতে এই গল্পের সৃষ্টি। ‘কালবেলা’র অনিমেষ ছিল কনফিউজড, তারপর আবেগি। ‘কালপুরুষে’ এসে সে ম্রিয়মান। কিন্তু এই ষাট বছরে এসে সে তার নিজের ভাবনায়, মননে অনেকখানি স্থির। এখন তার মত কিংবা পথ কোনটিই ভাসা ভাসা নয়। ধর্মে অবিশ্বাসী অনিমেষ তাই যখন ছোটমার শ্রাদ্ধে মাথা কামিয়ে জানায়, তার বিশ্বাসের চেয়ে অপর এক বিশ্বাসীর সুখ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তখন মাধবী বোঝে যে অনিমেষকে সে আজও চেনেনি। আর যখন শেষবার অনিমেষকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে হয়, তখন অনিমেষের পঙ্গুত্ব কেবল শরীরে। আদর্শবাদী সেই নকশাল অনিমেষ এখনও তার আদর্শে অটল। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করায় অটল মাধবী আজও অনিমেষের পাশে।
পুত্রের মাঝে পিতার দোষ-গুণ কিছু হলেও থাকে। অর্কও পেয়েছে। তবে পুরোটা না। অনিমেষের দৃঢ়তা তার নেই। তাই সে আমাদের নায়ক নয়। জেলের বাইরে অর্কের জন্য হয়ত কুন্তী অপেক্ষা করে, কিন্তু কুন্তীও মাধবীলতা হবে না কোনদিন। সময়ের স্রোতে পরিবর্তন আসে। আবার নিমিষে মিলিয়ে যায়। শুধু অনিমেষ আর মাধবীলতারা থেকে যায় ঠিক আগের মত। আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চায়, কৃষ্ণের মত মৌষলকাল যেন তাদের দেখতে না হয়।
এতকিছুই রেখেছেন আসলে সমরেশ তার এই উপন্যাসে। আর সেটা বুঝতে হলে পশ্চিমবঙ্গের ঐ সময়কালের পরিবর্তন জানতে হবে। সমরেশ যদিও তার লেখায় রাজনীতি রাখেন কিন্তু সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম বড় হয়ে ওঠে। যেমন বড় হয়েছিল 'কালবেলা'য়। এই বইয়েও মুষল পর্বের সেই মুমূর্ষু অবস্থা তিনি সরাসরি দেখান না। দেখালে হয়ত ভালো করতেন।
সমরেশের সমালোচনা তাই হতে পাড়ে তার সৃষ্টির এই জায়গাটিতে এসে। কিন্তু আদতে রাজনীতির কতটা আর উপন্যাসে সত্যিই আনা যায়। আনলেও পাঠক কেন পড়বে? রাজনীতি জানতে হলে তো নন ফিকশনই পড়া যায়। তাই সমরেশের বা অন্য অনেক লেখকের যা লেখা উচিৎ ছিল তা তারা লেখেন না। আবার পাঠকের যেখানে সমালোচনা করা উচিৎ তারাও সেখানে সমালোচনা করেন না। 'মৌষলকাল' তাই সমালোচিত পাঠক কালপুরুষ হয়ে 'কালবেলা'র উত্তরাধিকারের আবেগে 'মৌষলকাল' নিয়ে সমালোচনা করে বসেন। এই হলো লেখক, লেখা আর পাঠকের চক্র।
(২০১৬ সালের লেখা, খানিক পরিমার্জিত)
মহাভারতের ষোড়শ পর্বের নাম 'মুষল পর্ব'। প্রবল-প্রতাপ শ্রীকৃষ্ণের যাদব বংশ ধ্বংসের গল্প। যে মানুষটি মর্ত্যে দেবতার আসন পেয়েছিলেন, নেপথ্যে থেকে চালিয়েছিলেন সমগ্র কুরুক্ষেত্র, সেই বুদ্ধিমান এবং জনপ্রিয় মানুষটির চোখের সামনে শেষ হয়ে গেলো সব। সেই মুষল পর্বের সাথে মিল রেখে, সমরেশ ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ পেরনোর অনেক বছর পর লিখলেন মৌষলকাল।
‘উত্তরাধিকার’ থেকে অনিমেষের গল্প শুরু। কিন্তু সে গল্প যতখানি অনিমেষের, ঠিক ততখানি সরিৎশেখরের। তারচেয়ে বেশি পুরুষানুক্রমে চলে আশা চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাস আর পথ পরিবর্তনের। অনিমেষকে আমরা আরও কাছ থেকে দেখি ‘কালবেলা’য়। এ গল্প অনিমেষ আর মাধবীলতার। যতখানি প্রেমের, তারচেয়ে বেশি একটা সময়ের। যে সময় প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার।
‘কালবেলা’র পর ‘কালপুরুষ’। মাঝে পেরিয়েছে অনেকটা সময়। পুলিশের অত্যাচারে পা হারানো অনিমেষ এখন কোন নকশাল নেতা নয়। যোগাযোগ রাখেনি কোন রাজনীতির সাথে। মাধবীলতা বয়ে চলেছে অনিমেষের ভার। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে ভার হয়তো বোধ হয় না। আর তাদের ছেলে অর্ক। বস্তির পরিবেশে বখে যেতে যেতে ভেতরে অনিমেষের রক্ত কথা বলে উঠলো। পরিবর্তন আনতে গিয়ে ঠিক বাবার মতই মাঝপথে থমকে গেল।
সাতকাহন করে এতক্ষণ যা বললাম, তা সমরেশের পাঠকমাত্রই জানেন। 'উত্তরাধিকার', 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' ট্রিলজি। 'কালপুরুষ' লেখার প্রায় তিরিশ বছর পর সমরেশ আবার অনিমেষ আর মাধবীলতাকে নিয়ে কলমে আঁচড় কাটলেন। ‘মৌষলকাল’ খুব কাছাকাছি সময়ের গল্প। যেখানে বহুদিনের পুরনো মানুষেরা ফিরে আসে নতুন করে।
২.
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া অনিমেষ আর রাজনীতির কাছে ঘেঁষে নি। তার ছেলে অর্ক, বস্তিতে কমিউন গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পিতার মতই গুটিয়ে গেছে। সে এখন নিয়ম করে অফিসে যায়, বাড়িতে এসে ঘুমায়। অর্কর বয়স এখন চল্লিশ। অনিমেষ, মাধবীর ষাট। শরীরে সময়ের ছাপ, মনের গভীরে তবু থেকে যায় পুরনো আগুন।
সমরেশের লেখায় রাজনীতির প্রসঙ্গ থাকবেই, এবং তা অনেক বিস্তারিত ভাবেই। 'কালবেলা', 'কালপুরুষ' এমনকি 'উত্তরাধিকার' আসলে রাজনীতির পটভূমিতেই লেখা (যদিও 'উত্তরাধিকার'-এ সেটা প্রচ্ছন্ন)। 'মৌষলকাল' তার ব্যতিক্রম নয়। এই উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বামফ্রন্টের পতন আর তৃণমূলের উত্থান। এবং সেই উত্তাল সময়, পট পরিবর্তন আর তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া কিছু পুরনো মানুষ।
‘মৌষলকাল’ নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি। এবং সেটা রাজনৈতিক মতবাদে নয়, বরং সমালোচনা হয়েছিল সমরেশের উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষমতা নিয়ে। কেননা অনেকের মতেই যোগ্যতার বিচারে ‘মৌষলকাল’ তার পূর্বের তিন বইকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সমরেশের ভক্ত নই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার ব্যতিক্রম লেগেছে ‘মৌষলকাল’।
৩.
বইটা পড়ার আগে প্রশ্ন ছিল, “সমরেশ তিন দশক পর কেন এই সিরিজের নতুন বই লিখলেন? প্রকাশকের চাপে, নাকি নিজের পুরনো কাহিনীকে টেনে কিছু কপি বিক্রি করার আশায়?” বই পড়ে উত্তর পেলাম। আসলে এসব কিছুই নয়। সব গল্প, সব চরিত্র, সব কাহিনী পরিণতি চায়। কিন্তু হয়ত সবাই পায় না। কালপুরুষ পর্যন্ত এই গল্পও পরিনতি পায়নি। পরিনতি পায়নি মাধবী-অনিমেষ। সেই গল্পকে পরিনতি দিতেই সমরেশ লিখেছেন এই বই।
‘কালপুরুষ’ শেষ হয়েছিল পথের একটা বাঁকে। সেখান থেকে সামনের পথ পথিকের জন্য খোলা ছিল। এখানে পথিক হলেন পাঠক। তিনি তার ভাবনার চাকা যে কোনো দিকেই ঘোরাতে পারেন। কিন্তু বাঁকটা সেখানে একটু জটিল ছিল। তাই অর্জুনের পক্ষে পথ নির্ণয় সম্ভব ছিল না। অগত্যা সারথি হয়ে রথের চাকা ঘোরালেন শ্রীকৃষ্ণ।
‘উত্তরাধিকার’ ছিল অনিমেষের শুরু। অনি থেকে অনিমেষ হয়ে ওঠার আঁতুড়ঘর। তারপর ‘কালবেলা’। সেখানে শুরুতে অনিমেষ কিছুটা দ্বিধাান্বিত। তারপর হয়তো আবেগের বশেই একদিকে ছুটে যাওয়া। ভালোবাসা। আহত পাখির মত নীড়ে ফিরে আসা। তারপর নিস্তরঙ্গ জীবন। তার পাশে ছায়ার মত মাধবীলতা। এখানে হয়তো, সে-ই অনিমেষের সারথি।
‘কালপুরুষ’ শুরু হয়েছিল অনিমেষকে দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে পাদপ্রদীপ পড়ে অর্কর গালে। নায়ক হয়ে ওঠে সে। সেকালের গল্প একালে ছাইচাপা হয়ে আছে। অনিমেষ কেবলে ভুল পথে যাওয়া নকশাল নেতা। বদলাতে পারেনি সে কিছুই। সময়ের স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে অর্ক কিছু একটা করতে চায়। কিন্তু পারে না। স্রোত তাকে দাঁড়াতে দেয় না। তবে তাকে ভাসিয়েও রাখে। সময়ের চোখে এখন সে-ই নায়ক।
কিন্তু যে গল্প অনিমেষের, সেখানে অর্ক কি করে নায়ক? ‘কালপুরুষ’ তাই থেমে গিয়েছিল মাঝপথে। কিংবা আমার মনে হয়েছিল এখানেই শেষ নয়। সমরেশও বোধয় বুঝেছিলেন। তার গল্পে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা। তাই তিনি কি করে কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে অনিমেষের জায়গা অর্ককে দেবেন?
এই গল্পে অনিমেষ ফিরে যায় তার শেকড়ে। যেখানে তার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। বহুদিন হল সে সবের সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক নেই। কিন্তু ফিরে যেতেই শেকড় বুঝি আঁকড়ে ধরে। সেখানে সময় খুব ধীরে ধীরে বদলায়। তবু সাপেরা নিঃশ্বাস ফেলে। বাধ্য হয়েই আবার তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। ওদিকে বহুদিন সবকিছু থেকে দূরে থাকা অর্কও ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। সরাসরি না হলেও পরিবর্তনের হাওয়া স্পর্শ করে তাকে।
কালপুরুষে অনিমেষ ছিল ম্রিয়মান। স্তিমিত প্রদীপ যেন। সেখানে মাধবী ছিল অগ্নিশিখার মত। বিয়ে তারা কোনদিন করেনি। পাশাপাশি দুজন মানুষ, আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি। বার্ধক্যের সীমায় এসে এখনও তারা ঠিক প্রচলিত স্বামী স্ত্রী নয়, সেই আলাদা সত্ত্বা হয়েও কাছাকাছি আছে। তাদের ভালোবাসা কিংবা সময়ের প্রয়োজনে আসা অর্ক রয়ে গেছে একা। অবশ্য কুন্তীর দেখা পেয়েছে সে। তবে কি অর্ক আসলে পাণ্ডু?
৪.
যেমন আগে বলেছি, কাহিনীকেকে পরিনতি দিতে এই গল্পের সৃষ্টি। ‘কালবেলা’র অনিমেষ ছিল কনফিউজড, তারপর আবেগি। ‘কালপুরুষে’ এসে সে ম্রিয়মান। কিন্তু এই ষাট বছরে এসে সে তার নিজের ভাবনায়, মননে অনেকখানি স্থির। এখন তার মত কিংবা পথ কোনটিই ভাসা ভাসা নয়। ধর্মে অবিশ্বাসী অনিমেষ তাই যখন ছোটমার শ্রাদ্ধে মাথা কামিয়ে জানায়, তার বিশ্বাসের চেয়ে অপর এক বিশ্বাসীর সুখ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তখন মাধবী বোঝে যে অনিমেষকে সে আজও চেনেনি। আর যখন শেষবার অনিমেষকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে হয়, তখন অনিমেষের পঙ্গুত্ব কেবল শরীরে। আদর্শবাদী সেই নকশাল অনিমেষ এখনও তার আদর্শে অটল। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করায় অটল মাধবী আজও অনিমেষের পাশে।
পুত্রের মাঝে পিতার দোষ-গুণ কিছু হলেও থাকে। অর্কও পেয়েছে। তবে পুরোটা না। অনিমেষের দৃঢ়তা তার নেই। তাই সে আমাদের নায়ক নয়। জেলের বাইরে অর্কের জন্য হয়ত কুন্তী অপেক্ষা করে, কিন্তু কুন্তীও মাধবীলতা হবে না কোনদিন। সময়ের স্রোতে পরিবর্তন আসে। আবার নিমিষে মিলিয়ে যায়। শুধু অনিমেষ আর মাধবীলতারা থেকে যায় ঠিক আগের মত। আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চায়, কৃষ্ণের মত মৌষলকাল যেন তাদের দেখতে না হয়।
এতকিছুই রেখেছেন আসলে সমরেশ তার এই উপন্যাসে। আর সেটা বুঝতে হলে পশ্চিমবঙ্গের ঐ সময়কালের পরিবর্তন জানতে হবে। সমরেশ যদিও তার লেখায় রাজনীতি রাখেন কিন্তু সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম বড় হয়ে ওঠে। যেমন বড় হয়েছিল 'কালবেলা'য়। এই বইয়েও মুষল পর্বের সেই মুমূর্ষু অবস্থা তিনি সরাসরি দেখান না। দেখালে হয়ত ভালো করতেন।
সমরেশের সমালোচনা তাই হতে পাড়ে তার সৃষ্টির এই জায়গাটিতে এসে। কিন্তু আদতে রাজনীতির কতটা আর উপন্যাসে সত্যিই আনা যায়। আনলেও পাঠক কেন পড়বে? রাজনীতি জানতে হলে তো নন ফিকশনই পড়া যায়। তাই সমরেশের বা অন্য অনেক লেখকের যা লেখা উচিৎ ছিল তা তারা লেখেন না। আবার পাঠকের যেখানে সমালোচনা করা উচিৎ তারাও সেখানে সমালোচনা করেন না। 'মৌষলকাল' তাই সমালোচিত পাঠক কালপুরুষ হয়ে 'কালবেলা'র উত্তরাধিকারের আবেগে 'মৌষলকাল' নিয়ে সমালোচনা করে বসেন। এই হলো লেখক, লেখা আর পাঠকের চক্র।
(২০১৬ সালের লেখা, খানিক পরিমার্জিত)
Published on August 06, 2020 06:51
•
Tags:
অন-ম-ষ, অর-ক, উত-তর-ধ-ক-র, ক-লপ-র-ষ, ক-লব-ল, ম-ধব-লত, ম-ষলক-ল, সমর-শ-মজ-মদ-র
date
newest »
newest »
message 1:
by
Mustahid
(new)
Aug 29, 2020 04:47AM
সমরেশের "ত্রিরত্ন"(উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ) পড়েছিলাম জীবনের কলেজ অধ্যায়ে। ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই সিরিজ আর গর্ভধারিনী ছাড়া তাঁর আর কোনো লেখাই আমাকে টানে নি। খুব বেশি পড়াও হয়নাই। _মৌষলকাল_ এর কথা জানার পরই চট করে বই টা কিনে ফেললেও নেতিবাচক রিভিউ এর সমুদ্রের ঢেউয়ে পড়ার ইচ্ছা উবে গিয়ে বইটা আলমারিতে ধুলোমলিন হয়ে পড়ে আছে। আপনার রিভিউ তো আবার পড়তে আগ্রহী করে দিলো মশাই!
reply
|
flag


