আল্লাহ্র জন্য না আল্লাহ্র দাসের জন্য?
শায়খ সালমান বিন ফাহ্দ আল-‘আওদাহ
আহমাদ ও ইবন খুযায়মার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় যে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “তোমাদের যে ব্যাপারটিতে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই তা হচ্ছে ছোট শির্ক – রিয়া।” হাদীসটির ইসনাদকে আল-মুনযিরী ভালো সাব্যস্ত করেছেন “আত-তারগীবে।” ইবন মুফলিহ এটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন “আল-আদাব আশ-শার’ইয়াহ”তে। আর আল-আলবানী হাদীসটিকে সহীহ্র তালিকাতেই রেখেছেন।
মানুষের প্রশংসা পেয়ে আনন্দিত বোধ করার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। রিয়া তখনই হয় যখন কাজের পেছনে মানুষের নিয়ত হয়ে থাকে মূলত আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও জন্য, যাতে করে এই কাজের পেছনে যদি অন্য কারও সমর্থন না থাকতো তবে সে সেটা করতোই না।
রিয়ার প্রকারভেদঃ
১. ঈমানের ক্ষেত্রে রিয়াঃ সেটা হচ্ছে আদতে মুনাফিকী – ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে ঈমান দাবী করছে যদিও অন্তরে রয়েছে কুফ্র বা অবিশ্বাস।
২. শারীরিক ভাবে রিয়াঃ এমন কিছু করা যাতে মনে হতে পারে ব্যক্তি ইবাদাতে প্রচুর পরিশ্রম দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ কপালে সেজদার দাগ তৈরির চেষ্টা করা, অথবা ঠোঁট শুকিয়ে রাখা যাতে মনে হয় সে রোজা রেখেছে। মাথা কুঁজো করে বা চুল এলোমেলো করে চলা যাতে বোধ হয় তার ধর্মভীরুতা খুব চড়া।
৩. কথার মাধ্যমে রিয়াঃ সেটা হলো মানুষকে শোনানো। হাদীসে এসেছেঃ “যে মানুষকে শুনিয়ে বেড়ায় তাকে আল্লাহ বিপর্যস্ত করবেন” [বুখারী ও মুসলিম] যেমন ফাতওয়া, নবী সাহাবিদের কাহিনী, ওয়াজ-নসীহত করে বেড়ানো এটা বোঝানোর জন্য যে বক্তা মু’মিনদের অবস্থা নিয়ে খুবই চিন্তাশীল। অথবা যিক্র করার মতো করে ঠোঁট নাড়ানো বা শিশের মত শব্দ বের করা যাতে মানুষ তার ব্যাপারে বলে যেঃ ভদ্রলোক খুবই আল্লাহ্র স্মরণকারী বা তওবাকারী।
৪. কাজের মাধ্যমে রিয়াঃ যেমন নামাজে খুশু’ বা আল্লাহ্-ভীতি দেখানোর নিমিত্তে নামাজে দাঁড়ানো, রুকু করা বা সেজদা করা – এসব কাজকে দীর্ঘায়িত করা।
৫. অবস্থানের মাধ্যমে রিয়াঃ ‘উলামা বা পরহেজগার লোকেরা যেখানে ওঠাবসা করেন সেখানে ঘন ঘন যাওয়া যাতে লোকে মনে করে এই ব্যক্তিও তাদের অন্তর্ভুক্ত।
খেয়াল করা দরকার যে এসব ক্ষেত্রে কাজ নয়, বরং কাজের পেছনে যে মূল উদ্দেশ্য বা মোটিভেশান সেটাই বিবেচ্য।
রিয়ার মূল উৎস হচ্ছে মানুষের প্রশংসা ও অনুমোদন পাওয়ার ইচ্ছে, তাদের নিন্দা লাভের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং মানুষের কাছে যা আছে তা লাভের মোহ। যে ব্যক্তি ইবাদাতের সময় এসব থেকে দূরে থাকতে পারবে তার কাজ মোটেই নষ্ট হবে না বা বাতিল হবে না।
কেউ কেউ কাজ ছেড়ে দেয় রিয়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে। এটা হচ্ছে আরেক ভুল এবং শয়তানের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়া। এর ফলে অলসতা ও ভালো কাজ ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের উদ্দেশ্য সঠিক থাকবে ততক্ষণ রিয়ার ভয়ে কাজ ছেড়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না। একারণেই ফুদায়ল ইবন ‘আয়্যাদ বলেনঃ “মানুষের নিমিত্তে করা কাজ হচ্ছে শির্ক, আর মানুষের জন্য কাজ ছেড়ে দেয়া হচ্ছে রিয়া। ইখলাস হচ্ছে আল্লাহ্ যখন তোমাকে এই দুইটি থেকে মুক্ত রাখেন”।
দেখা যায় কোনো কোনো ছাত্র অপরিণত অবস্থায়ই ফাতওয়া দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে যায়, অথবা দাঁড়িয়ে পড়ে শিক্ষকতা করতে। হাবে ভাবে সে যেন এক কেউকেটা। আমি জানি না – এটা বলাটা তার জন্য খুবই কষ্টকর। বড় ‘আলেমদের ভাব ধরে সে বলেঃ আমার মতে, আমার যা মনে হচ্ছে, আমি যেরকম বুঝছি ইত্যাদি ইত্যাদি। অত:পর সে তার মনগড়া কথা বলতে থাকে। সে অন্যদের নাজেহাল করতে ছুটে যায়, তাদের ভুল ধরার ব্যাপারে সে মাত্রাতিরিক্ত রকমের পটু। যেন অন্যদের কোনো ভালো অর্জনই নেই। আবার সে নিজেই কিন্তু অন্যদের সমালোচনা বা ভুল সংশোধনে (তার নিজের) কর্ণপাত করতে রাজি নয়।
আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায় ফরযে আইন থেকে ফরযে কিফায়া বেশি ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। সে কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করছে যা হয়তো মানুষের খুব কমই কাজে আসবে। কিন্তু সে ইখলাস, আখলাক বা সচ্চরিত্রের ব্যাপারে কথা বলে না (মুখতাসার মিনহাজ আল-কাসিদীন বইটি দেখুন।) এটা একারণেই যে এসব তো সাধারণ মানুষের ব্যাপার স্যাপার।
তৃতীয় ব্যক্তির আবার বিতর্কের দিকে এবং লম্বা কথার দিকে ঝোঁক। কারও সাথে একটু লেগে গেলেই এই ব্যক্তি অভিশাপ দিয়ে বসে। এই খামাখা বিতর্কই হিদায়াতের পথ থেকে একটি গোষ্ঠিকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। বেশিরভাগ সময়েই এসব বিতর্ক হয়ে থাকে তথ্য ও ভাষার প্রদর্শনী। প্রচেষ্টা থাকে প্রতিপক্ষকে কথায় চেপে ধরা ও নাস্তানাবুদ করা – তার ত্রুটি ও অক্ষমতাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা, তার বিশ্বাসের ভুল নিয়ে মোচ্ছব করা। যখন সে প্রতিপক্ষের কাছে কোনো সঠিক কিছু শোনে তার অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়। হন্তদন্ত হয়ে সে প্রতিপক্ষকে বাধা দিতে চেষ্টা করে যাতে সে পিছু হটে। যদি দেখে যে প্রতিপক্ষ তার অবস্থানে অনড় তখন সে দাবী করতে থাকেঃ তোমার বরং উচিৎ আমার কথা, মাযহাব বা পথ অনুসারে চলা। যেন সে সত্যের পথে দেয়াল তৈরি করে রেখেছে – তার মধ্যস্থতা ছাড়া কেউ এই দেয়াল টপকাতে পারবে না। তার পথ ধরেই যেতে হবে, তাকে জেনে বুঝেই চলতে হবে।
অধিকাংশ বিতর্কই নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেয়া খবরের সত্যতাকে সাব্যস্ত করে যেখানে তিনি তিনটি ধ্বংসাত্মক আচরণের কথা বলেছেনঃ “কৃপণতা অবলম্বন, প্রবৃত্তির অনুসরণ ও প্রত্যেক মতপ্রদানকারীর নিজের মতের প্রতি অতি অনুরাগ” হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু দাউদ ও আত-তিরমিযি, শেষোক্তজনের মতে হাদীসটি হাসান গারীব।
একজন পূণ্যবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলোঃ পূর্বেকার লোকদের কথা আমাদের কথার বেশি উপকারী কেনো?
তিনি বললেনঃ কেননা তারা কথা বলতেন ইসলামের স্বার্থে, নিজেদের পরিত্রাণের জন্য ও পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টির নিমিত্তে – আর আমরা কথা বলি নিজেদের স্বার্থে, দুনিয়ার খোঁজে ও সৃষ্টিকে খুশি করার জন্য।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলছে বা অনুসন্ধান করছে যা খুবই বিচিত্র অথবা ইতিমধ্যে পরিত্যক্ত। যেনো সে কোনো গুটিয়ে নেয়া পথকে আবার চালু করতে চায়, এমন কোনো আইনকে পুনর্জীবিত করতে ইচ্ছুক যা রদ হয়ে গেছে। পন্ডিতেরা “তুবুলিয়াত” থেকে সতর্ক করে গেছেন। এটি হচ্ছে পরিত্যক্ত সেসব অদ্ভুত বিষয়াবলি যার জন্য ঢাক ঢোল পেটানো হয় (দেখুন আবু যায়দের হিলয়াতু তালেবিল-‘ইলম।)
অপরদিকে নেতার কথায় তাল দিয়ে চলতে দেখাটাও দুর্লভ নয়। প্রাণপনে সে লিডারের কথার সমর্থন দিয়ে চলে যাতে করে সেই নেতার কাছ থেকে নেতৃস্থানীয় কোনো আসন বাগিয়ে নেয়া যায়। সেই নেতার কথা যদি শরি’আ-বিরোধীও হয় বা ভুলও হয় তাতেও সে নিবৃত্ত হয় না।
ভক্তকূলের সংখ্যা বাড়ানো, তাদেরকে একাট্টা করা ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়া হলো অনুরূপ একটি সমস্যা। নিজেদের ঘিরে এরা অনেক সময় বদ্ধ দেয়াল তুলে দেয় – মৌলিক নয় এমন কিছু আলোচনাসাপেক্ষ ও মতামতনির্ভর ব্যাপারেও এই বদ্ধতাকে তারা উসকে দেয় “আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা”-র দোহাই দেখিয়ে।
ইমাম আয-যাহাবী বলেনঃ “তুমি নিজেই অত্যাচারী অথচ মনে করো যে তুমি অত্যাচারিত, হারাম তুমি নিজেই খাও অথচ মনে করো যে তুমি ধর্মভীরু, পাপী তুমিই অথচ তোমার মতে তুমি ন্যায়নিষ্ঠ, আদতে তুমি দুনিয়ার জন্যই জ্ঞান অর্জন করো অথচ তোমার ধারণা তুমি আল্লাহ্র জন্য করছো!” (সিয়ার আ’লাম আন-নুবালা)
ইমাম আহমাদ শুনলেন যে আবু দাউদ তার সুনান বইটির ব্যাপারে বলছেনঃ “এই কাজটি আমি আল্লাহ্র জন্যই করেছি।” তখন আহমাদ বললেনঃ “আল্লাহ্র জন্য – এটাতো বিরাট শক্ত দাবী। বরং বলো যে কাজটির প্রতি আমাকে ভালো লাগা তৈরি করে দেয়া হয়েছে, তাই করলাম।” অপর বর্ণনায় অবশ্য আছে যে ইমাম আহমাদ কথাটি নিজের ব্যাপারেই বলেছিলেন, যেমনটি পাওয়া যায় ইমাম ইবন তাইমিয়্যার কথায় (দ্রষ্টব্য মাসআলাতু ফীমা ইযা কানা ফীল-‘আবদ মাহাব্বাতুন লিমা হুওয়া খায়র ওয়াহাক্ক ওয়ামাহমুদ ফী নাফসিহ)
তাই মনের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকাই সত্যবাদিতার সবচেয়ে সূক্ষ্ণ দ্যোতনা।
[মূল লেখাটি এখানে পাওয়া যাবে। ]
Asif Shibgat Bhuiyan's Blog
- Asif Shibgat Bhuiyan's profile
- 9 followers

