ভাদুড়ি, ভাদুড়ির গল্প এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাদের অল্প বয়স থাকার একটা ট্রেন্ড রয়েছে। ফেলুদার কথা বাদ, ব্যোমকেশেরও শুরুটা অল্প বয়সেই। এমনকি তার জনপ্রিয় গল্পগুলোতে ব্যোমকেশকে তুলনামূলক তরুণ বলেই পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ল্যাসিক গোয়েন্দা গল্পের সময়কালে প্রৌঢ় গোয়েন্দাদের একজন হলেন চারু ভাদুড়ি। তাকে এমনকি বৃদ্ধ বললেও ভুল হয় না। আর তার সঙ্গী দুজনের মধ্যে সদানন্দ বাবু তো রীতিমত বৃদ্ধ কিন্তু নিয়ম মেনে চলার কারণে শরীরটা তার মজবুত। আর কিরণ বাবুর চরিত্রটি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নিজের আদলে এঁকেছেন তা বলা বাহুল্য।

এহেন তিন চরিত্রকে নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ বেশকিছু গল্প ও উপন্যাসিকা লিখেছিলেন যার বেশিরভাগই সম্ভবত নানা পূজা সংখ্যায় প্রকাশ হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে চারটি উপন্যাসিকা নিয়ে ভাদুড়ি সমগ্রর প্রথম, ছয়টি নিয়ে দ্বিতীয় এবং সাতটি উপন্যাসিকা নিয়ে তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়।

ভাদুড়ি, ভাদুড়ির গল্প এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে সাধারণ আলোচনা করতে গেলে বলতে হয় গল্পগুলো বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ধারা অনুসরণ করেছে। এখানে খুন আছে কিন্তু সহিংসতা নেই। ধর্ষণের কিছু পাওয়া যায় না। তবে মানুষের জিঘাংসা, কাম প্রবৃত্তি এই গল্পগুলোতে এসেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাদুড়ি, কিরণ ও সদানন্দ বাবুর আলোচনায় সেসব উঠে আসে কিন্তু কোনো রগরগে পিলে চমকানো বর্ণনা নেই। সম্ভবত গোয়েন্দা প্রৌঢ় হলেও লেখা হয়েছিল কিশোরদের জন্য, সে কারণে এমনটা করা হয়েছে।

ভাদুড়ির গল্পে যে বিষয়টা ভালো লাগে তা হলো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গল্প বলার ধরণটা। প্রতিটি উপন্যাসিকায় একটি নিরেট গল্প আছে এবং সেটা যেভাবে নীরেন বাবু একটু একটু করে বলে যান তা পাঠককে ধরে রাখে। এর সঙ্গে আছে একটি পারিবারিক আবহ। কিরণ এবং সদানন্দ বাবু দুজনেই সংসারী। তাদের সংসারের চিত্র নানা সময়ে এই রহস্য গল্পের মধ্যে উঠে আসে। এছাড়া কলকাতায় ভাদুড়ি মশাই এসে ওঠেন তার বোনের বাসায়। সেখানে পুরোপুরি একটি পরিবারের দৈনন্দিন চিত্র উঠে আসে।

আরেকটি মজার বিষয় হলো গত শতকের আশি থেকে এই শতকের শুরুর দিকের কলকাতার মানুষের ভাষার একটা দারুণ উদাহরণ পাওয়া যায় ভাদুড়িতে। ক্যালকেশিয়ান অ্যাকসেন্ট যাকে বলে তার কয়েকটি ভার্সন তুলে এনেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সম্ভবত কবি ও সম্পাদক বলেই বিষয়টি এতো ভালো উপস্থাপন করেছেন। তবে রহস্য গল্পের পাঠকেরা কিছু কিছু জায়গায় বিরক্ত হবেন তাতে সন্দেহ নাই। তাছাড়া নানা সময়ে সাহিত্য পত্রিকায় লেখার কারণে একাধিক চরিত্রের পরিচয় তিনি বারবার দিয়েছেন। সংকলন সম্পাদনায় সেসব বাদ পড়ার কথা থাকলেও পড়েনি। তাই পুনরাবৃত্তি বলে বিরক্ত হতে হয়।

কিছু কিছু জায়গায় ভাদুড়ি ও চক্রবর্তী মশাই কিছু উপদেশ দিতে চান। অন্যথায় গল্পগুলো এগিয়েছে গল্পের মতো। কাহিনীগুলো পড়তে গিয়ে একটা উপরি লাভ হলো কবির চোখে নানা জায়গা ভ্রমণ। গল্পের প্লট অনুসারে সেসব জায়গার বেশ মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাই রহস্য গল্পের ক্ষেত্রে খুব উপাদেয় না হলেও একজন আগ্রহী পাঠকের আগ্রহের দাবী রাখে ভাদুড়ি।
2 likes ·   •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on May 15, 2022 11:41 Tags: ভ-দ-ড়, ভ-দ-ড়-সমগ-র
No comments have been added yet.