আঁধারে আলো
সন্ধ্যা হব হব করছে। শীত গিয়ে দিন এখনো খুব বেশি বড় হয়নি। বসন্ত চলছে। হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে পড়ে।স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিতেই সন্ধ্যা হয়ে যায় লাবন্য আর অনন্যার। তাড়া না থাকায় ধীরে পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে ওরা।ফেরার পথে সাধারণত রিকশা নেয়না। বড় রাস্তা ধরে যাচ্ছে লাবন্যরা একটু পর পরই হুশ হাশ করে বাসগুলো ওদের পাশ কাটাচ্ছে।বুকটা মাঝে মধ্যেই ছ্যাৎ করে ওঠে। এই বুঝি গায়ের উপর উঠে গেল! পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে লাবন্য হাঁটছে আর অনন্যা ওর হাত ধরে আছে।হাঁটতে হাঁটতে আনমনা হয়ে রাস্তার দিকে পা বাড়ালেই অনন্যা টেনে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসছে।লাবন্যও পরম নির্ভরতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছে প্রিয় বন্ধুর হাতে। জানে, ওর বন্ধুটা ওকে ঠিকই আগলে রাখবে। লাবন্য আকাশের ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ভ্রম হয়।বুঝিবা সূর্যটা দুরের একসাড়ি সবুজ গাছের ওপর গলে গলে পড়ছে। হাঁটতে গিয়ে একটা মোড় পড়ে পথে।মোড়টা একটু তীক্ষ্ণ।ওপাশে কি আছে দেখা যায়না।লাবন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালে রাস্তায় চলে গেল।অনন্যা ওকে ফিরিয়ে আনবার আগেই সা করে মোড়ের ওপাশ থেকে একটা বাস ছুটে এল।একেবারেই আচমকা। মাত্র দশহাত দুরে বুনো ষাঁড়ের মত বাসটাকে ছুটে আসতে দেখে দুজনেই থমকে গেল। হাত পা নির্দেশ মানতে চাইছে না।লাবন্য স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে বাসটার দিকে। চোখে মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎই সংবিত ফিরে পেল অনন্যা।একঝটকায় স্থবির হয়ে যাওয়া লাবন্যকে টান দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। ওর মাত্র দুহাত দুর দিয়ে দুরন্ত গতিতে পাশ কাটাল মৃত্যুদানব। প্রচন্ড বাতাস ওদেরকে যেন রাস্তার আরো খানিকটা পাশে ঠেলে দেয়। কয়েকমূহুর্ত কোনো কথাই বলতে পারলনা লাবন্য।ফ্যালফ্যাল করে অন্যন্যার দিকে তাকিয়ে থাকল,এরপরই জাপটে ধরল ওকে। সারা শরীর বাঁশপাতার মত তিরতির করে কাঁপছে।অনন্যা স্বান্তনার একটা হাত রাখল লাবন্যর পিঠে। বেশ কিছুক্ষণ কাটল এভাবে। লাবন্য রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে থাকায় দেখতে না পেলেও অনন্যা রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতিটা যানবাহনের যাত্রীদের ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা দেখতে পাচ্ছে।দৃশ্যটা শেষ বিকেলের আলোয় খুবই অদ্ভুত দেখায়,রহস্যময়তা তৈরী করে। 'এই ছাড়না পাগলী,পরিবেশ হালকা করার জন্য বলে অনন্যা। ' 'কেন, ছাড়তে হবে কেন? ' 'রাস্তার মানুষজন দেখছে।' চট করে অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে, 'মৃদুকন্ঠে লাবন্য বলল, 'থ্যাঙ্কস রে। ' 'থাপ্পড় খাইছিস। ' কিছু বললনা লাবন্য।আবার হাঁটতে লাগল ওরা। 'বড়ই খাবি? 'একটু পর জিজ্ঞেস করল লাবন্য। 'বড়ই কোথায় পাব? ' 'সামনে সামাদ চাচার গাছ আছেনা? 'দুষ্টুমি ভর করেছে লাবন্যর চোখে। 'চুরি করবি? ' 'কেন জীবনে বোধহয় চুরি করা জিনিস খাসনি? ' 'খেয়েছি, তখন ছোট ছিলাম. . . 'ও আচ্ছা তুই তো আবার বড় হয়ে গেছিস,ভুলেই গিয়েছিলাম 'অনন্যার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল লাবন্য।'আচ্ছা যা, তোকে চুরি করা জিনিস খাওয়াবো না, ঠিকআছে? ' একটুপর গাছের নিচে এসে লাবন্য বলল,'ব্যাগটা একটু ধরতো। ' 'কি করবি? ' 'কেন বড়ই পারব। ' 'তুই একটু আগে না বললি চুরি করবিনা। ' 'চুরি করবনা বলিনি, বলেছি চুরি করা জিনিস তোকে খাওয়াব না। ' 'ও তারমানে তুই একা একাই খাবি?' 'সেটাও বলিনি। ' 'তাহলে? ' 'দেখ, তোর এত কথার জবাব আমি দিতে পারবনা। প্যাট প্যাট না করে ব্যাগটা ধর,'বলে ব্যাগটা অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকাল সামাদ চাচার খোঁজে।ৰুড়ো এই লোকটা খিটখিটে হলেও তার গাছের বড়ই এ গ্রামের মধ্যে সেরা। বুড়ো একাই থাকে রাস্তার পাশের টিনের একচালা ঘরটায়। বুড়ি মরে গেছে অনেক আগেই। একমাত্র ছেলে ঢাকায় ভাল একটা চাকরি করে।বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকে।বাপকে নিয়ে যেতে চেয়েছে অনেকবার কিন্তু সামাদ চাচা রাজি হয়নি।তার বেশকিছু জমি জিরাত আছে বর্গা দেয়া।এক মহিলা এসে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। এখন বুড়োর একমাত্র কাজ হল বাড়ির পেছনের এই বড়ই গাছটা পাহারা দেয়া।লাবন্য শুনেছে, গাছটা নাকি সামাদ চাচার বউ লাগিয়েছিল।একারণে কাউকে ধরতে দেয়না এগাছের বড়ই। এখন অবশ্য সামাদ চাচাকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও।ওড়নাটা কোমড়ে পেঁচিয়ে লাবন্য বহুবার গাছ বাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তরতর করে উঠে যেতে লাগল গাছটাতে। 'তোর বিয়ে না বাঁদরের সাথে দেয়া উচিৎ,' নিচ থেকে বলল অনন্যা।'বাঁদর আর বাঁদরীর বাসর হবে গাছের মগডালে হি.হি.!' 'এই ফাজিল কথা বলিসনা, বুড়ো দেখলে চিল্লানো শুরু করবে, 'চাপা গলায় অনন্যাকে সতর্ক করল লাবন্য। কিছুক্ষণ পর কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় ছাড়াই কোঁচড় ভর্তি বড়ই নিয়ে নেমে এল লাবন্য। 'আচ্ছা পেড়েই যখন ফেলেছিস, তো দে কয়েকটা।'কাচুমাচু হয়ে বলল অনন্যা। ' 'তখন অত ঢং করিছিলি কেনরে? ' 'আচ্ছা তুইই বল, এত বড়ই তুই একা খেতে পারবি? ' 'আমি চুরি করা বড়ই খেতে যাব কেন? ' 'তাহলে? এতগুলো বড়ই ফেলে দিবি? কেমন হাহাকার করে উঠল অনন্যার গলা। 'উউহু, এগুলো হালাল করে খাওয়া হবে, 'বলতে বলতে অনন্যার বিষ্মিত দৃষ্টির সামনে বড়ইগুলো নিয়ে সামাদ চাচার একচালা ঘরটার দিকে হাঁটা দিল লাবন্য।বিস্মিত অনন্যাও বাধ্য হয়ে লাবন্যর পথ ধরল। গিয়ে দেখা গেল সামাদ চাচা বারান্দায় বসে হুক্কা টানছে। মান্ধাতা আমলের হুক্কাটা ছিল সামাদ চাচার দাদার।বংশানুধারা বজায় রাখতে প্রায়ই হুক্কাটা নিয়ে বসে সামাদ চাচা।'কিরে তোর কারা? মতলব কী? ওদের দেখে খনখনে গলায় বলে ওঠে বুড়ো।বয়স হলেও এখনো বুড়োর গায়ে যে পরিমাণে জোর আছে সেটা অন্তত লাবন্যদের জন্য ভীতিকরই বটে! 'চাচা আমি শহীদের মেয়ে,'বলল লাবন্য। আসলে পচাত্তুরে বুড়োর লাবন্যর মত ক্লাস টেন পড়ুয়া ভাতিজি থাকার কথা না।তবে লাবন্যর দাদার চাইতেও বেশি বয়সী এই বৃদ্ধ কি করে যেন পুরো গ্রামের "চাচা "হয়ে গেছেন।সবাই চাচা ডাকে। 'শহীদের মাইয়া ভালকথা, তা এইখানে আসছস কেন? এইটা তো শহীদ মিনার না! ' ফিক করে হেসে ফেলল দুই বান্ধবী।লাবন্য আড়চোখে সামাদ চাচার দিকে তাকিয়ে দেখল, ঠিক কি কারণে হাসা হল সেটা বুঝতে না পেরে রাগ রাগ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে বুড়ো। 'চাচা ওই শহীদ না, ওই যে মোড়ে দোকান আছে যে। ' 'ও শহীদ মিয়া? সেইটা আগে কবি তো।কিজন্যে আইছোস তোরা? ' 'চাচা একটা ভুল হয়ে গেছে।আপনার কয়েকটা বড়ই ভুলে পেড়ে ফেলেছি। ' 'বড়ই আবার ভুলে পাড়ে ক্যামনে? ' 'আসলে ভুল না, ইচ্ছে করেই পেড়েছিলাম।এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি।তাই বড়ইগুলো আপনাকে দিতে এসেছি, ' বলে কামিজের কোঁচড়ে রাখা বড়ইগুলো চাচার সামনে ঢেলে দিল লাবন্য। সামাদ চাচা চোখে কম দেখেন। এতক্ষণ চেহারা দেখতে পাননি কিন্তু লাবন্য বড়ইগুলো দেবার জন্য কাছে আসতেই ওর দিকে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধ।লাবন্য মুখ তুলতেই সামাদ চাচাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল।বৃদ্ধের ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি।সে দৃষ্টির ভাষা লাবন্য পড়তে পারলনা। 'চাচা আমরা আসি,'বলে লাবন্য সরে এল সামাদ চাচার সামনে থেকে।তখনও নির্বাক তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ। 'তোর কাহিনী কি বলত? সামাদ চাচার উঠোন পেরোতেই ফুঁসে উঠল অনন্যা।'এতকষ্ট করে বড়ইগুলো পেড়ে বুড়োকে দেবার কি দরকার ছিল? ' 'আর বলিসনা, আমি ভেবেছিলাম বড়ইগুলো ফেরৎ দিলে বুড়ো বলবে, "আচ্ছা পেড়েছিস যখন, নিয়ে যা, সামনে যাতে এরকম না হয়, "কৈফিয়তের সুর ফুটল লাবন্যর গলায়। 'তুই মানুষ আর পেলিনা, তাইনা? ওই কংস বুড়ো তোকে এমনি এমনি বড়ই দিয়ে দেবে ভাবলি কি করে? আগে জানলে তো তোকে গাছে উঠতেই দিতাম না।তবে খুব বেশি খারাপও হয়নাই কাজটা। তোর জামাই খুঁজতে সুবিধা হবে, হি.হি.! ' 'এত হাসতে হবেনা।এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ তার উপর উনি হি হি করছেন।চল, বাড়ি চল। শুধু শুধু কষ্ট করলাম। ' বাড়িতে এসে যখন ওরা পৌছল তখন ভরা সন্ধ্যা। অনন্যা বিদায় নিয়ে ওর বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেল। লাবন্য কলপারে গিয়ে দাড়াল। হাতমুখ ধোবে। মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা মেরে সেন্ডেল খুলল।পায়ে অদ্ভুত একটা নকশা তৈরী করেছে সেন্ডেলের ফিতা আর গ্রাম্য পথের ধুলোরা মিলেমিশে। হাত পা ধুয়ে আঁজলা ভরে পানি নিল লাবন্য।ওর সবসময়ের অভ্যাস।কলপারে এলেই আঁজলা ভরে পানি নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। ঝাঁকড়া একটা আমগাছের নিচে কলটার অবস্থান হওয়াতেই বোধহয় আশ্চর্য শীতল এর পানি। একচুমুকই শীতল ধারা বইয়ে দেয় সারা শরীর জুড়ে। ভেজা সেন্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ঘরের দিকে এগোবে এমন সময় আমগাছটার নিচে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ওর। ওটা কে দাড়িয়ে? আঁধার ঘনিয়েছে তারওপর ঝাঁকড়া গাছটার নিচে অন্ধকারটা একটু বেশিই।গা ছমছমে একটা পরিবেশ। 'কে ওখানে? 'গলা চড়িয়ে জানতে চাইল লাবন্য। অন্ধকারে দাড়ানো মানুষটা এবার একটু নড়েচড়ে উঠল।এগিয়ে আসতেই ফুরিয়ে আসা আলোয় অস্পষ্ট দেখা গেল মানুষটাকে। লাবণ্য খানিকটা এগিয়ে যায় আগন্তুককে চিনতে পারার আশায়।কিছুদুর এগোতেই হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে পড়ল লাবন্য। চিনতে পেরেছে ও আগন্তুককে। 'আপনি? 'এর বেশি আর কোনো স্বর ফুটলনা লাবন্যর গলায়। আরেকটু এগিয়ে এল আগন্তুক 'ওই ছেমড়ি বড়ই ফালায়া থুইয়া আইলি কেন? আমারে ফকিরনী মনে করছস যে তোর পাড়া বড়ই আমি নিমু? বান্দর কুনহানকার! ধর এইখান, 'অগ্নিমুর্তি ধারণ করবার ব্যার্থ চেষ্টা করতে করতে বলল সামাদ চাচা। হাতে ধরা একটা ব্যাগ বাড়িয়ে ধরেছে লাবন্যর দিকে। এই প্রথম লাবন্য খেয়াল করল সামাদ চাচার হাতে একটা মাঝারি সাইজের বাজারের ব্যাগ।লাবন্য অবাক হয়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই বুঝতে পারল ব্যাগটা ভর্তি ওর পাড়া বড়ইয়ের না হলেও দশগুণ বেশি হবে! ওরা চলে আসার পর নিশ্চয়ই সামাদ চাচা নিজহাতে বড়ই পেড়ে কষ্ট করে এতটা পথ হেঁটে এসেছে। পৃথিবীতে এই আবেগ আর ভালবাসার অস্তিত্ব আছে বলেই মানুষ শত প্রতিকুলতাকে সঙ্গী করেও বাঁচতে চায়। হঠাৎ করেই সামনে দাড়ানো বুড়ো মানুষটার প্রতি প্রচন্ড মায়া অনুভব করল লাবন্য।নিঃসঙ্গ মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। লাবন্য কি এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরবে?
Published on October 05, 2013 21:54
No comments have been added yet.


