Abul Fatah's Blog
October 12, 2013
আঁচল
ক্রিং করে বেল বেজে উঠতেই পড়িমড়ি করে এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটল জহির।বেল বাজলে পিয়নদের এভাবেই ছুটে যেতে হয়।
খাতা কলমে বেতন দিয়ে জহিরকে পিয়ন হিসেবে রাখা হলেও ওর কাজের গন্ডি আরো বিস্তৃত।চাকরির শুরুতে জহির ভেবে নিয়েছিল কাজটা আসলে পানির মত সোজা হবে।সারাদিন বসে বসে ঝিমানো আর এক রুমের ফাইলপত্র আরেক রুমে পৌঁছে দেয়া, মাঝে মধ্যে অফিসের বাইরে কাগজপত্র নিয়ে সামান্য দৌড়াদৌড়ি। পিয়নের কাজ তো এগুলোই নাকি? চা বানানো তো বয় বেয়ারার কাজ।তার পদ ওদের চাইতে কত উঁচুতে!
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি মোটেও সেরকম নয়।তার পদ বয় বেয়ারারও নীচে। বয় বেয়ারাদের এমডি সাহেবের বাসার বাজার করা কিংবা ছেলে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতে হয়না কিন্তু জহিরকে এগুলোও করতে হয়।
কাজে জয়েন করার পরদিন পিয়নদের জন্য বরাদ্দ লিফট সাইজের রুমে বসে ওর একমাত্র সহকর্মী মইনের সাথে আলাপ করছিল জহির।এমন সময় বেল বাজল।এমডি স্যারের রুমের বেল আলাদা,পিয়নও আলাদা।জহির হল এমডি সাহেবের,যাকে বলে "খাস পিয়ন"।বেল বাজতেই জহির যখন এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল তখন যদি সে পেছন ফিরে তাকাত তাহলে দেখতে পেত মইনের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।বলা যায়না,করুণারও হতে পারে হাসিটা।
এমডি স্যারের প্রথম ডাক,বলতে গেলে একরকম দৌড়েই স্যারের রুমের দিকে রওনা হল জহির।রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন এমডি আকবর আলী।বিরাট ধনী মানুষ।ভাল ব্যাবসায়ীক বুদ্ধি রাখেন।প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটা শূন্য যুক্ত করেছেন।তবে এর কতটুকু ব্যাবসায়ীক বুদ্ধির জোরে আর কতটুকূ কিপ্টেমির জোরে সম্ভব হয়েছে সেটা নিয়ে বাজারে জোর গুজব চালু আছে।
আকবর আলী কিপ্টের চুড়ামনি!পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের ভাষায় "হাড় কেপ্পন"ও বলা চলে।তার অফিসের যতজন লোক কাজ করে মূলত তার দিগুন লোকের প্রয়োজন।কিন্তু আকবর আলী চলেন নিজের বুদ্ধিতে।তার অফিসের প্রত্যেককে দুজনের কাজ করতে হয়।
আকবর আলীর বাড়িতেও একই ব্যাবস্থা।তার বাড়িতে গেলে প্রায়ই ড্রাইভারকে দেখা যাবে বাগানে খুড়পি নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে!
আর আকবর আলীর কাছে যারা চাকরি করে তাদের এই চাকরি চট করে ছেড়ে দেবার মত পরিস্থিতি নেই। এই অসহায় লোকগুলোকেই কিভাবে যেন বেছে বেছে চাকরি দেন আকবর আলী।হয়ত এদের চেনাটাই আকবর আলীর সবচাইতে বড় বিজনেস সিক্রেট!
এমন লোকের পিয়ন সারাদিন বসে বসে ঝিমাবে এমনটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই।
জহির আকবর আলীর সামনে দাঁড়াতেই মাথা তুললেন আকবর আলী।সে মাথায় বিশাল একটা টাক।অশ্লীল রকমের চকচকে!
'এত দেরি হয় কেন?'
লে,দেরী করলাম কখন?! মনে মনে ভাবল জহির।'স্যার আমি তো বেল বাজার সাথে সাথেই চলে এলাম। '
'বেল বাজার সাথে সাথে আসলে তো চলবেনা।সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।বেল বাজা অবস্থায়ই দৌড় দিবা,আন্ডারস্ট্যান্ড? ভাল কথা, বাজার সদাই করতে পার কেমন?'
'ভাল স্যার।'
'মাঝে মাঝে আমার বাসার বাজার করে দিতে হবে।কী পারবানা?'
'জী পারব।'মনে মনে স্যারের "খাস পিয়ন" থেকে "খাস লোক"এ পরিণত হবার আনন্দে জহির তখন বিভোর।স্যারের "খাস লোক" হওয়া মানেই প্রমোশন,বোনাস!
জহির স্যারের "খাস লোক" হয়েছে ঠিকই তবে জহিরের অবস্থা এখন ছেড়ে দে আকবর কেঁদে বাঁচি!
তবে ছেড়ে দেবারও কোনো উপায় নেই।ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা ছাড়লে গুষ্টিশুদ্ধ বটতলায় এসে দাঁড়াতে হবে।অবশ্য গুষ্টি বলতে আছেই বা কে?যে আছে তাকে বললেই গাট্টি বোচকা নিয়ে গাছতলায় চলে আসবে।ওর বউ,আসমা।কী সুন্দর নাম! বউটাও কত লক্ষী!জহির তো মাঝে মধ্যে লক্ষ্মী বলেও ডাকে।এই লক্ষী!
বউয়ের কথা মনে পড়তেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায় জহিরের।তবে আকবর আলীর রুমের সামনে চলে আসাতে মধুর ভাবনায় জোর করে ছেদ টানে।সেদিন আকবর আলী বলার পর থেকে এখন বেল বাজার সাথে সাথেই দৌড় দেয় সে।
রুমে ঢুকতেই যথারীতি আকবর আলীর অশ্লীল রকমের চকচকে টাকটার দিকে চোখ চলে যায় জহিরের।লোকটা বোধহয় টাকে নিয়মিত তেল দেয়।নইলে এত চকচকে থাকে কী করে?জহির অনেক দিন ধরে একটা ইচ্ছে গোপনে লালন করে আসছে।
দেখা গেল কোনো একভাবে জহির প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। অনেক ক্ষমতা তার।হোমরা চোমরারা তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।একদিন আকবর আলীও একটা কাজ নিয়ে তার কাছে এল।জহির ঠিক করে রেখেছে, তখন সে আকবর আলীকে বলবে,'আচ্ছা আকবর সাহেব,আপনি কি টাকে তেল দেন?নিয়মিত?একটু কাছে আসেন তো চেক করি!
'কী হল ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?'
জহিরের চটকা ভাঙ্গে আকবর আলীর গলায়।চমকে ওঠার সাথে সাথে কিঞ্চিত ভয়ও পেল জহির।ও যে এতক্ষন আকবর আলীর টাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা কী আকবর আলী ধরতে পেরেছে?মনে হয়না।
'শোনো,একটু কাজ করতে হবে।"
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।'জী স্যার।'
একটা প্যাকেট বের করলেন আকবর আলী।'শোনো এখানে একটা শাড়ি আছে।তোমাদের ম্যাডামের জন্য কিনেছিলাম।কাল ভুলে বাসায় নেয়া হয় নাই।তোমাদের ম্যাডাম আজ বিকালে আবার একটা পার্টিতে যাবে।তুমি শাড়িটা আমার বাসায় দিয়ে আসো।'
এবার হাপ ছাড়ল জহির।এটাও গোপনে।তাও ভাল বাজার করতে দেয়নি।আকবর আলীর বাজার করতে যাওয়া মানেই একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং যন্ত্রনাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়া।পুরো বাজার খুঁজে সবচাইতে ভাল জিনিস সবচাইতে কম দামে আনতে হবে.আকবর আলীর জন্য!প্রতিবারই বাজারের টাকা থেকে অতি কষ্টে নিজের রিকশা ভাড়াটা বাঁচাতে সক্ষম হয় জহির।
এমনিতে আকবর আলীর বাজার করার দায়িত্ব বাসার কাজের লোকের।কিন্তু আকবর আলী হিসেব করে দেখেছে জহিরকে দিয়ে বাজার করালে লাভ অনেকগুলো।খুব ভাল কেনাকাটা করতে পারে সে।এজন্য প্রায় দিনই বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটতে হয় জহিরকে।
আকবর আলী শাড়ির প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল জহিরের দিকে।জহির ওটা নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রাইজ ট্যাগের দিকে চোখ পড়তেই অবিশ্বাসে কপাল কুঁচকে গেল জহিরের।শাড়িটার দাম পাঁচ হাজার টাকা!
না,দামটা আশ্চর্যের বিষয় না বিষয় হল এই শাড়ি আকবর আলী কী করে কেনে?
হঠাৎ জহিরের মনে পড়ল কাল একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক এমডি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল।হাতে বড়সড় একটা ব্যাগও ছিল।নিশ্চয়ই সেই লোকই শাড়িটা গিফট করেছে।অথচ ছোটলোকটা বলছে শাড়ি নাকি সেই কিনেছে।তোর বাপ জীবনে এতটাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছে রে!এরপর একটা কুতসিৎ গালি দিল জহির আকবর আলীর উদ্দেশ্যে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় প্যাকেটের এককোনা সামান্য উঁচু করল জহির।শাড়িটা দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।সত্যি বলতে জীবনে এর পাঁচভাগের এক ভাগ দামের শাড়িও ধরে দেখেনি জহির।
প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল চমৎকার আকাশি রঙের শাড়িটা।শুধু চমৎকার বলা এর যথার্থতা প্রকাশের জন্য অপ্রতুল।
হালকা আকাশি জমিনে বেশ ভারী কাজ করা হয়েছে। তবে সবচাইতে সুন্দর এর আঁচলটা।দেখলেই আকাশের কথা মনে পড়ে যায়!
জহির জানেনা এটা কী শাড়ি।জানার ইচ্ছেও নেই।এমন শাড়ি জীবনে কখনো কেনার প্রয়োজন পড়বেনা তার।তবে এটা ঠিক এই শাড়ির কারিগরের কল্পনায় কখনই আকবর আলীর ধুমসো বউ ছিলনা।ছিল আসমার মত মায়াবী সৌন্দর্যের কোনো লাজুক রমনী যে কিনা আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।একটু পর পরই আয়নায় দেখছে নিজেকে।আয়নার ছায়ায় পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে আঁড় চোখে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।এবার গোপনে নয়,একেবারে ভেতর থেকে।
পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি তো দুরের কথা,আসমার সাথে ওর দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে ওকে দুটো মাত্র শাড়ি দিতে পেরেছে জহির।সবচাইতে দামীটা বোধহয় সাড়ে ছয়শ টাকা দিয়ে কিনেছিল।
গত ঈদে তো সেটাও দিতে পারেনি।কিভাবে দেবে,ওর গোটা সংসারে অভাব প্রতিনিয়ত মুখ ব্যাদান করে থাকে।
আসমা অবশ্য কখনই কিছু চায়না জহিরের কাছে।এজন্যই তো বাঁচোয়া।
আজ ঘন ঘন আসমার কথা মনে হওয়াতে জহির ঠিক করল বাসা হয়ে এরপর আকবর আলীর বাড়িতে যাবে।সেই কখন থেকে ওর লক্ষীটাকে দেখেনা!
যেহেতু ম্যাডাম বিকেলে পার্টিতে যাবে সেহেতু একটু দেরী করলে কিছু হবেনা।আজ আকবর আলীর একটা জরুরী মিটিং আছে এক জায়গায়।সুতরাং সেদিক থেকেও ভয় নেই।অতএব নিশ্চিন্তে বাড়ির দিকে রওনা হল জহির।
আকবর আলীর মত ধনীরা যদি জানতে পারে জহির তার কবুতরের খোপের মত দেখতে বস্তুটাকে "বাসা " বলে তাহলে নিজেদের "বাসা" নিয়ে যথেষ্টই অপমানিতবোধ করত তারা।
দুহাজার টাকা দিয়ে টিনশেড এই খুপড়িটা ভাড়া নিয়েছে জহির।রুম একটাই।কেউ বেড়াতে টেড়াতে এলে আসমাকে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতে হয়।তবে এটাই জহিরের রাজ্য।এ রাজ্যে সে রাজা,আসমা রানী।চলেই তো যাচ্ছে বেশ।
দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে আওয়াজ এল,'কে'?
জহির সাড়া দিতেই দরজা খুলে দিল আসমা।রান্না করছিল বোধহয়, গরমে নাকের আগায় শিশিরের মত ঘাম জমেছে।শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে রাখায়।মুরব্বী মুরব্বী একটা ভাব চলে এসেছে মেয়েটার মধ্যে।
'আজ এই সময়? 'বোঝাই যায় অবাক হয়েছে আসমা।
'হুম।'ছোট্ট করে জবাব দিল জহির।
' কী হল এমন করে কী দেখতাছ?'জহিরকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন আসমার।
'আমার লক্ষীটাকে। '
'উঁউউহ,ঢং!'
জহির হেসে ফেলল,একটু পর আসমাও।
এই বাচ্চা বাচ্চা চেহারার শ্যামলা মেয়েটাকে জহির কী পরিমান ভালবাসে সেটা কেউ জানেনা।উহু,জানে একজন।আসমা জানে।
আসমার শখ বলতে একটাই,চোখে কাজল দেয়া।হরিনীর মত মায়াবী চোখদুটোয় যখন কাজলের ছোঁয়া লাগে তখন তাতে এক সমুদ্র ভালবাসা দেখতে পায় জহিরও।
'তুমি কি আজকে আমার সাথে খাবা?'কথাটা বলেই বড় বড় চোখে জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে আসমা।
"আমার সাথে খাবা" কথাটা শুনেই জহিরের বুকের ভেতর কেমন টনটন করে ওঠে।প্রতিদিন দুপুরে আসমাকে একা একা খেতে হয়।আকবর আলীর নিয়ম হল সবাইকে দুপুরের খাবার অফিসেই নিয়ে আসতে হবে।
প্রায়দিনই রাতে খোঁজ নিয়ে জহির জানতে পারে দুপুরে আসমা কিছু খায়নি।কারন জিজ্ঞেস করলে মাথা নীচু করে থাকে মেয়েটা।জবাব দেয়না। জহির বুঝতে পারে একা একা খেতে আসমার একটুও ভাল লাগেনা।
'হুম,'মাথা ঝাকাল জহির।
'সত্যি!'চাঁদের মত উজ্জল মুখটা পরক্ষনেই অমাবস্যার আঁধার ঢেকে নিল।'তেমন কিছু তো রান্না হয় নাই।শুধু বেগুন ভাজি।'
'আর কী লাগে পাগলী?! '
'আচ্ছা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো,আমি একটা ডিম ভাজি এই ফাঁকে।'
'একটা কেন,দুইটাই ভাজো।আজ আরাম করে খাই দুজন।'
'একটাই ডিম আছে।'মুখ কালো করে জবাব দিল আসমা।'
'আচ্ছা তুমি একটা ভাজতে থাক,আমি আরেকটা কিনে নিয়ে আসি।'
জহির প্যাকেটটা রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।যখন ফিরে এল তখন ওর জন্য বড় সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
হাতে একটা ডিম নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল আসমা শাড়িটা শালের মত করে গায়ে জড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।জহিরকে উপস্থিতি লক্ষ্য করে লজ্জা পেল মেয়েটা।'কত দিয়ে কিনছো?'
জহির বুঝতে পারল আসমা প্রাইজ ট্যাগটা দেখেনি।দেখলে ওটা ছোঁয়ারও সাহস পেতনা।সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরে জহিরের সারা শরীর অবশ হয়ে এল।আসমা ভেবেছে শাড়িটা জহির ওর জন্যই কিনেছে।মেয়েটা বুঝতেও পারেনি শাড়িটা এত দামি। বোঝার কথাও না অবশ্য।জহিরের মত আসমাও কখনো এত দামি শাড়ি দেখেনি।
'এইতো।' আর কিছু বলার মত খুঁজে পায়না জহির।
'খুব সুন্দর।'
জহির নিশ্চুপ।
আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আসমা।অপুর্ব লাগছে ওকে আকাশি রঙের শাড়িটাতে।যেন এক খন্ড আকাশ গায়ে জড়িয়ে আছে কোনো পরী।কালো চুলগুলো মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আঁচলে।
জহিরের ইচ্ছে হল এই আকাশে ভেসে বেড়াতে,মেঘে মুখ লুকোতে,আঁচলে আশ্রয় নিতে।একখন্ড আকাশ,একরাশ মেঘ,একটুকরো আঁচল।এই আকাশ,এই মেঘ,এই আঁচল শুধুই ওর,ওদের।
জহির খুব দ্রুত দুটো সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথমেই ওকে প্যাকেটটা থেকে গোপনে প্রাইজ ট্যাগটা সরিয়ে ফেলতে হবে।আসমাকে কোনোমতেই শাড়ির দাম জানতে দেয়া যাবেনা।
দ্বিতীয় কাজটা কিভাবে করবে,জহির জানেনা।শুধু এতটুকু জানে ওকে করতে হবে,করতেই হবে।একখন্ড আকাশ, একরাশ মেঘ আর একটুকরো আঁচলের জন্য...
উপসংহার
তিনদিন পর জহির যখন দেহে মারাত্মক এক ছুরিকাঘাত নিয়ে অফিসে হাজির হল তখন সবাই জানতে পারল তিনদিন আগে ভয়াবহ এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল সে। আরেকটু হলেই মারা যেতে পারত।
পুনশ্চঃ ভালবাসা এখন বন্দি ফেসবুক আর স্টুডেন্টদের সীমিত গন্ডিবদ্ধ জগতে।সে জগতের বাইরে,দরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যেও যে ভালবাসার আধার থাকতে পারে সে খবর কি আমরা রাখি?
উৎসর্গঃ
বেশ কিছুদিন আগে একটা কারণে লেখালেখি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় মাসখানেক একটা অক্ষরও লিখিনি।সে সময়ে একজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত বলেছে,আপনার লিখতে হবে,আপনাকে ফিরে আসতে হবে।
আমি লিখেছি,ফিরে এসেছি।
এই ফিরে আসার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য সেই মানুষটার আজ জন্মদিন। আমার পক্ষ থেকে এই গল্পটা তাকে উপহার।
শুভ জন্মদিন ইব্রাহিম বিন আজিজ।
খাতা কলমে বেতন দিয়ে জহিরকে পিয়ন হিসেবে রাখা হলেও ওর কাজের গন্ডি আরো বিস্তৃত।চাকরির শুরুতে জহির ভেবে নিয়েছিল কাজটা আসলে পানির মত সোজা হবে।সারাদিন বসে বসে ঝিমানো আর এক রুমের ফাইলপত্র আরেক রুমে পৌঁছে দেয়া, মাঝে মধ্যে অফিসের বাইরে কাগজপত্র নিয়ে সামান্য দৌড়াদৌড়ি। পিয়নের কাজ তো এগুলোই নাকি? চা বানানো তো বয় বেয়ারার কাজ।তার পদ ওদের চাইতে কত উঁচুতে!
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি মোটেও সেরকম নয়।তার পদ বয় বেয়ারারও নীচে। বয় বেয়ারাদের এমডি সাহেবের বাসার বাজার করা কিংবা ছেলে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতে হয়না কিন্তু জহিরকে এগুলোও করতে হয়।
কাজে জয়েন করার পরদিন পিয়নদের জন্য বরাদ্দ লিফট সাইজের রুমে বসে ওর একমাত্র সহকর্মী মইনের সাথে আলাপ করছিল জহির।এমন সময় বেল বাজল।এমডি স্যারের রুমের বেল আলাদা,পিয়নও আলাদা।জহির হল এমডি সাহেবের,যাকে বলে "খাস পিয়ন"।বেল বাজতেই জহির যখন এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল তখন যদি সে পেছন ফিরে তাকাত তাহলে দেখতে পেত মইনের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।বলা যায়না,করুণারও হতে পারে হাসিটা।
এমডি স্যারের প্রথম ডাক,বলতে গেলে একরকম দৌড়েই স্যারের রুমের দিকে রওনা হল জহির।রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন এমডি আকবর আলী।বিরাট ধনী মানুষ।ভাল ব্যাবসায়ীক বুদ্ধি রাখেন।প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটা শূন্য যুক্ত করেছেন।তবে এর কতটুকু ব্যাবসায়ীক বুদ্ধির জোরে আর কতটুকূ কিপ্টেমির জোরে সম্ভব হয়েছে সেটা নিয়ে বাজারে জোর গুজব চালু আছে।
আকবর আলী কিপ্টের চুড়ামনি!পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের ভাষায় "হাড় কেপ্পন"ও বলা চলে।তার অফিসের যতজন লোক কাজ করে মূলত তার দিগুন লোকের প্রয়োজন।কিন্তু আকবর আলী চলেন নিজের বুদ্ধিতে।তার অফিসের প্রত্যেককে দুজনের কাজ করতে হয়।
আকবর আলীর বাড়িতেও একই ব্যাবস্থা।তার বাড়িতে গেলে প্রায়ই ড্রাইভারকে দেখা যাবে বাগানে খুড়পি নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে!
আর আকবর আলীর কাছে যারা চাকরি করে তাদের এই চাকরি চট করে ছেড়ে দেবার মত পরিস্থিতি নেই। এই অসহায় লোকগুলোকেই কিভাবে যেন বেছে বেছে চাকরি দেন আকবর আলী।হয়ত এদের চেনাটাই আকবর আলীর সবচাইতে বড় বিজনেস সিক্রেট!
এমন লোকের পিয়ন সারাদিন বসে বসে ঝিমাবে এমনটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই।
জহির আকবর আলীর সামনে দাঁড়াতেই মাথা তুললেন আকবর আলী।সে মাথায় বিশাল একটা টাক।অশ্লীল রকমের চকচকে!
'এত দেরি হয় কেন?'
লে,দেরী করলাম কখন?! মনে মনে ভাবল জহির।'স্যার আমি তো বেল বাজার সাথে সাথেই চলে এলাম। '
'বেল বাজার সাথে সাথে আসলে তো চলবেনা।সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।বেল বাজা অবস্থায়ই দৌড় দিবা,আন্ডারস্ট্যান্ড? ভাল কথা, বাজার সদাই করতে পার কেমন?'
'ভাল স্যার।'
'মাঝে মাঝে আমার বাসার বাজার করে দিতে হবে।কী পারবানা?'
'জী পারব।'মনে মনে স্যারের "খাস পিয়ন" থেকে "খাস লোক"এ পরিণত হবার আনন্দে জহির তখন বিভোর।স্যারের "খাস লোক" হওয়া মানেই প্রমোশন,বোনাস!
জহির স্যারের "খাস লোক" হয়েছে ঠিকই তবে জহিরের অবস্থা এখন ছেড়ে দে আকবর কেঁদে বাঁচি!
তবে ছেড়ে দেবারও কোনো উপায় নেই।ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা ছাড়লে গুষ্টিশুদ্ধ বটতলায় এসে দাঁড়াতে হবে।অবশ্য গুষ্টি বলতে আছেই বা কে?যে আছে তাকে বললেই গাট্টি বোচকা নিয়ে গাছতলায় চলে আসবে।ওর বউ,আসমা।কী সুন্দর নাম! বউটাও কত লক্ষী!জহির তো মাঝে মধ্যে লক্ষ্মী বলেও ডাকে।এই লক্ষী!
বউয়ের কথা মনে পড়তেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায় জহিরের।তবে আকবর আলীর রুমের সামনে চলে আসাতে মধুর ভাবনায় জোর করে ছেদ টানে।সেদিন আকবর আলী বলার পর থেকে এখন বেল বাজার সাথে সাথেই দৌড় দেয় সে।
রুমে ঢুকতেই যথারীতি আকবর আলীর অশ্লীল রকমের চকচকে টাকটার দিকে চোখ চলে যায় জহিরের।লোকটা বোধহয় টাকে নিয়মিত তেল দেয়।নইলে এত চকচকে থাকে কী করে?জহির অনেক দিন ধরে একটা ইচ্ছে গোপনে লালন করে আসছে।
দেখা গেল কোনো একভাবে জহির প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। অনেক ক্ষমতা তার।হোমরা চোমরারা তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।একদিন আকবর আলীও একটা কাজ নিয়ে তার কাছে এল।জহির ঠিক করে রেখেছে, তখন সে আকবর আলীকে বলবে,'আচ্ছা আকবর সাহেব,আপনি কি টাকে তেল দেন?নিয়মিত?একটু কাছে আসেন তো চেক করি!
'কী হল ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?'
জহিরের চটকা ভাঙ্গে আকবর আলীর গলায়।চমকে ওঠার সাথে সাথে কিঞ্চিত ভয়ও পেল জহির।ও যে এতক্ষন আকবর আলীর টাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা কী আকবর আলী ধরতে পেরেছে?মনে হয়না।
'শোনো,একটু কাজ করতে হবে।"
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।'জী স্যার।'
একটা প্যাকেট বের করলেন আকবর আলী।'শোনো এখানে একটা শাড়ি আছে।তোমাদের ম্যাডামের জন্য কিনেছিলাম।কাল ভুলে বাসায় নেয়া হয় নাই।তোমাদের ম্যাডাম আজ বিকালে আবার একটা পার্টিতে যাবে।তুমি শাড়িটা আমার বাসায় দিয়ে আসো।'
এবার হাপ ছাড়ল জহির।এটাও গোপনে।তাও ভাল বাজার করতে দেয়নি।আকবর আলীর বাজার করতে যাওয়া মানেই একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং যন্ত্রনাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়া।পুরো বাজার খুঁজে সবচাইতে ভাল জিনিস সবচাইতে কম দামে আনতে হবে.আকবর আলীর জন্য!প্রতিবারই বাজারের টাকা থেকে অতি কষ্টে নিজের রিকশা ভাড়াটা বাঁচাতে সক্ষম হয় জহির।
এমনিতে আকবর আলীর বাজার করার দায়িত্ব বাসার কাজের লোকের।কিন্তু আকবর আলী হিসেব করে দেখেছে জহিরকে দিয়ে বাজার করালে লাভ অনেকগুলো।খুব ভাল কেনাকাটা করতে পারে সে।এজন্য প্রায় দিনই বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটতে হয় জহিরকে।
আকবর আলী শাড়ির প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল জহিরের দিকে।জহির ওটা নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রাইজ ট্যাগের দিকে চোখ পড়তেই অবিশ্বাসে কপাল কুঁচকে গেল জহিরের।শাড়িটার দাম পাঁচ হাজার টাকা!
না,দামটা আশ্চর্যের বিষয় না বিষয় হল এই শাড়ি আকবর আলী কী করে কেনে?
হঠাৎ জহিরের মনে পড়ল কাল একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক এমডি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল।হাতে বড়সড় একটা ব্যাগও ছিল।নিশ্চয়ই সেই লোকই শাড়িটা গিফট করেছে।অথচ ছোটলোকটা বলছে শাড়ি নাকি সেই কিনেছে।তোর বাপ জীবনে এতটাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছে রে!এরপর একটা কুতসিৎ গালি দিল জহির আকবর আলীর উদ্দেশ্যে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় প্যাকেটের এককোনা সামান্য উঁচু করল জহির।শাড়িটা দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।সত্যি বলতে জীবনে এর পাঁচভাগের এক ভাগ দামের শাড়িও ধরে দেখেনি জহির।
প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল চমৎকার আকাশি রঙের শাড়িটা।শুধু চমৎকার বলা এর যথার্থতা প্রকাশের জন্য অপ্রতুল।
হালকা আকাশি জমিনে বেশ ভারী কাজ করা হয়েছে। তবে সবচাইতে সুন্দর এর আঁচলটা।দেখলেই আকাশের কথা মনে পড়ে যায়!
জহির জানেনা এটা কী শাড়ি।জানার ইচ্ছেও নেই।এমন শাড়ি জীবনে কখনো কেনার প্রয়োজন পড়বেনা তার।তবে এটা ঠিক এই শাড়ির কারিগরের কল্পনায় কখনই আকবর আলীর ধুমসো বউ ছিলনা।ছিল আসমার মত মায়াবী সৌন্দর্যের কোনো লাজুক রমনী যে কিনা আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।একটু পর পরই আয়নায় দেখছে নিজেকে।আয়নার ছায়ায় পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে আঁড় চোখে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।এবার গোপনে নয়,একেবারে ভেতর থেকে।
পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি তো দুরের কথা,আসমার সাথে ওর দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে ওকে দুটো মাত্র শাড়ি দিতে পেরেছে জহির।সবচাইতে দামীটা বোধহয় সাড়ে ছয়শ টাকা দিয়ে কিনেছিল।
গত ঈদে তো সেটাও দিতে পারেনি।কিভাবে দেবে,ওর গোটা সংসারে অভাব প্রতিনিয়ত মুখ ব্যাদান করে থাকে।
আসমা অবশ্য কখনই কিছু চায়না জহিরের কাছে।এজন্যই তো বাঁচোয়া।
আজ ঘন ঘন আসমার কথা মনে হওয়াতে জহির ঠিক করল বাসা হয়ে এরপর আকবর আলীর বাড়িতে যাবে।সেই কখন থেকে ওর লক্ষীটাকে দেখেনা!
যেহেতু ম্যাডাম বিকেলে পার্টিতে যাবে সেহেতু একটু দেরী করলে কিছু হবেনা।আজ আকবর আলীর একটা জরুরী মিটিং আছে এক জায়গায়।সুতরাং সেদিক থেকেও ভয় নেই।অতএব নিশ্চিন্তে বাড়ির দিকে রওনা হল জহির।
আকবর আলীর মত ধনীরা যদি জানতে পারে জহির তার কবুতরের খোপের মত দেখতে বস্তুটাকে "বাসা " বলে তাহলে নিজেদের "বাসা" নিয়ে যথেষ্টই অপমানিতবোধ করত তারা।
দুহাজার টাকা দিয়ে টিনশেড এই খুপড়িটা ভাড়া নিয়েছে জহির।রুম একটাই।কেউ বেড়াতে টেড়াতে এলে আসমাকে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতে হয়।তবে এটাই জহিরের রাজ্য।এ রাজ্যে সে রাজা,আসমা রানী।চলেই তো যাচ্ছে বেশ।
দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে আওয়াজ এল,'কে'?
জহির সাড়া দিতেই দরজা খুলে দিল আসমা।রান্না করছিল বোধহয়, গরমে নাকের আগায় শিশিরের মত ঘাম জমেছে।শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে রাখায়।মুরব্বী মুরব্বী একটা ভাব চলে এসেছে মেয়েটার মধ্যে।
'আজ এই সময়? 'বোঝাই যায় অবাক হয়েছে আসমা।
'হুম।'ছোট্ট করে জবাব দিল জহির।
' কী হল এমন করে কী দেখতাছ?'জহিরকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন আসমার।
'আমার লক্ষীটাকে। '
'উঁউউহ,ঢং!'
জহির হেসে ফেলল,একটু পর আসমাও।
এই বাচ্চা বাচ্চা চেহারার শ্যামলা মেয়েটাকে জহির কী পরিমান ভালবাসে সেটা কেউ জানেনা।উহু,জানে একজন।আসমা জানে।
আসমার শখ বলতে একটাই,চোখে কাজল দেয়া।হরিনীর মত মায়াবী চোখদুটোয় যখন কাজলের ছোঁয়া লাগে তখন তাতে এক সমুদ্র ভালবাসা দেখতে পায় জহিরও।
'তুমি কি আজকে আমার সাথে খাবা?'কথাটা বলেই বড় বড় চোখে জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে আসমা।
"আমার সাথে খাবা" কথাটা শুনেই জহিরের বুকের ভেতর কেমন টনটন করে ওঠে।প্রতিদিন দুপুরে আসমাকে একা একা খেতে হয়।আকবর আলীর নিয়ম হল সবাইকে দুপুরের খাবার অফিসেই নিয়ে আসতে হবে।
প্রায়দিনই রাতে খোঁজ নিয়ে জহির জানতে পারে দুপুরে আসমা কিছু খায়নি।কারন জিজ্ঞেস করলে মাথা নীচু করে থাকে মেয়েটা।জবাব দেয়না। জহির বুঝতে পারে একা একা খেতে আসমার একটুও ভাল লাগেনা।
'হুম,'মাথা ঝাকাল জহির।
'সত্যি!'চাঁদের মত উজ্জল মুখটা পরক্ষনেই অমাবস্যার আঁধার ঢেকে নিল।'তেমন কিছু তো রান্না হয় নাই।শুধু বেগুন ভাজি।'
'আর কী লাগে পাগলী?! '
'আচ্ছা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো,আমি একটা ডিম ভাজি এই ফাঁকে।'
'একটা কেন,দুইটাই ভাজো।আজ আরাম করে খাই দুজন।'
'একটাই ডিম আছে।'মুখ কালো করে জবাব দিল আসমা।'
'আচ্ছা তুমি একটা ভাজতে থাক,আমি আরেকটা কিনে নিয়ে আসি।'
জহির প্যাকেটটা রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।যখন ফিরে এল তখন ওর জন্য বড় সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
হাতে একটা ডিম নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল আসমা শাড়িটা শালের মত করে গায়ে জড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।জহিরকে উপস্থিতি লক্ষ্য করে লজ্জা পেল মেয়েটা।'কত দিয়ে কিনছো?'
জহির বুঝতে পারল আসমা প্রাইজ ট্যাগটা দেখেনি।দেখলে ওটা ছোঁয়ারও সাহস পেতনা।সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরে জহিরের সারা শরীর অবশ হয়ে এল।আসমা ভেবেছে শাড়িটা জহির ওর জন্যই কিনেছে।মেয়েটা বুঝতেও পারেনি শাড়িটা এত দামি। বোঝার কথাও না অবশ্য।জহিরের মত আসমাও কখনো এত দামি শাড়ি দেখেনি।
'এইতো।' আর কিছু বলার মত খুঁজে পায়না জহির।
'খুব সুন্দর।'
জহির নিশ্চুপ।
আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আসমা।অপুর্ব লাগছে ওকে আকাশি রঙের শাড়িটাতে।যেন এক খন্ড আকাশ গায়ে জড়িয়ে আছে কোনো পরী।কালো চুলগুলো মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আঁচলে।
জহিরের ইচ্ছে হল এই আকাশে ভেসে বেড়াতে,মেঘে মুখ লুকোতে,আঁচলে আশ্রয় নিতে।একখন্ড আকাশ,একরাশ মেঘ,একটুকরো আঁচল।এই আকাশ,এই মেঘ,এই আঁচল শুধুই ওর,ওদের।
জহির খুব দ্রুত দুটো সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথমেই ওকে প্যাকেটটা থেকে গোপনে প্রাইজ ট্যাগটা সরিয়ে ফেলতে হবে।আসমাকে কোনোমতেই শাড়ির দাম জানতে দেয়া যাবেনা।
দ্বিতীয় কাজটা কিভাবে করবে,জহির জানেনা।শুধু এতটুকু জানে ওকে করতে হবে,করতেই হবে।একখন্ড আকাশ, একরাশ মেঘ আর একটুকরো আঁচলের জন্য...
উপসংহার
তিনদিন পর জহির যখন দেহে মারাত্মক এক ছুরিকাঘাত নিয়ে অফিসে হাজির হল তখন সবাই জানতে পারল তিনদিন আগে ভয়াবহ এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল সে। আরেকটু হলেই মারা যেতে পারত।
পুনশ্চঃ ভালবাসা এখন বন্দি ফেসবুক আর স্টুডেন্টদের সীমিত গন্ডিবদ্ধ জগতে।সে জগতের বাইরে,দরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যেও যে ভালবাসার আধার থাকতে পারে সে খবর কি আমরা রাখি?
উৎসর্গঃ
বেশ কিছুদিন আগে একটা কারণে লেখালেখি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় মাসখানেক একটা অক্ষরও লিখিনি।সে সময়ে একজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত বলেছে,আপনার লিখতে হবে,আপনাকে ফিরে আসতে হবে।
আমি লিখেছি,ফিরে এসেছি।
এই ফিরে আসার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য সেই মানুষটার আজ জন্মদিন। আমার পক্ষ থেকে এই গল্পটা তাকে উপহার।
শুভ জন্মদিন ইব্রাহিম বিন আজিজ।
Published on October 12, 2013 05:10
October 5, 2013
আঁধারে আলো
সন্ধ্যা হব হব করছে। শীত গিয়ে দিন এখনো খুব বেশি বড় হয়নি। বসন্ত চলছে। হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নেমে পড়ে।স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিতেই সন্ধ্যা হয়ে যায় লাবন্য আর অনন্যার। তাড়া না থাকায় ধীরে পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে ওরা।ফেরার পথে সাধারণত রিকশা নেয়না। বড় রাস্তা ধরে যাচ্ছে লাবন্যরা একটু পর পরই হুশ হাশ করে বাসগুলো ওদের পাশ কাটাচ্ছে।বুকটা মাঝে মধ্যেই ছ্যাৎ করে ওঠে। এই বুঝি গায়ের উপর উঠে গেল! পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে লাবন্য হাঁটছে আর অনন্যা ওর হাত ধরে আছে।হাঁটতে হাঁটতে আনমনা হয়ে রাস্তার দিকে পা বাড়ালেই অনন্যা টেনে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসছে।লাবন্যও পরম নির্ভরতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছে প্রিয় বন্ধুর হাতে। জানে, ওর বন্ধুটা ওকে ঠিকই আগলে রাখবে। লাবন্য আকাশের ঢলে পড়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ভ্রম হয়।বুঝিবা সূর্যটা দুরের একসাড়ি সবুজ গাছের ওপর গলে গলে পড়ছে। হাঁটতে গিয়ে একটা মোড় পড়ে পথে।মোড়টা একটু তীক্ষ্ণ।ওপাশে কি আছে দেখা যায়না।লাবন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালে রাস্তায় চলে গেল।অনন্যা ওকে ফিরিয়ে আনবার আগেই সা করে মোড়ের ওপাশ থেকে একটা বাস ছুটে এল।একেবারেই আচমকা। মাত্র দশহাত দুরে বুনো ষাঁড়ের মত বাসটাকে ছুটে আসতে দেখে দুজনেই থমকে গেল। হাত পা নির্দেশ মানতে চাইছে না।লাবন্য স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে বাসটার দিকে। চোখে মৃত্যুর ছায়া। হঠাৎই সংবিত ফিরে পেল অনন্যা।একঝটকায় স্থবির হয়ে যাওয়া লাবন্যকে টান দিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। ওর মাত্র দুহাত দুর দিয়ে দুরন্ত গতিতে পাশ কাটাল মৃত্যুদানব। প্রচন্ড বাতাস ওদেরকে যেন রাস্তার আরো খানিকটা পাশে ঠেলে দেয়। কয়েকমূহুর্ত কোনো কথাই বলতে পারলনা লাবন্য।ফ্যালফ্যাল করে অন্যন্যার দিকে তাকিয়ে থাকল,এরপরই জাপটে ধরল ওকে। সারা শরীর বাঁশপাতার মত তিরতির করে কাঁপছে।অনন্যা স্বান্তনার একটা হাত রাখল লাবন্যর পিঠে। বেশ কিছুক্ষণ কাটল এভাবে। লাবন্য রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে থাকায় দেখতে না পেলেও অনন্যা রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রতিটা যানবাহনের যাত্রীদের ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা দেখতে পাচ্ছে।দৃশ্যটা শেষ বিকেলের আলোয় খুবই অদ্ভুত দেখায়,রহস্যময়তা তৈরী করে। 'এই ছাড়না পাগলী,পরিবেশ হালকা করার জন্য বলে অনন্যা। ' 'কেন, ছাড়তে হবে কেন? ' 'রাস্তার মানুষজন দেখছে।' চট করে অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে, 'মৃদুকন্ঠে লাবন্য বলল, 'থ্যাঙ্কস রে। ' 'থাপ্পড় খাইছিস। ' কিছু বললনা লাবন্য।আবার হাঁটতে লাগল ওরা। 'বড়ই খাবি? 'একটু পর জিজ্ঞেস করল লাবন্য। 'বড়ই কোথায় পাব? ' 'সামনে সামাদ চাচার গাছ আছেনা? 'দুষ্টুমি ভর করেছে লাবন্যর চোখে। 'চুরি করবি? ' 'কেন জীবনে বোধহয় চুরি করা জিনিস খাসনি? ' 'খেয়েছি, তখন ছোট ছিলাম. . . 'ও আচ্ছা তুই তো আবার বড় হয়ে গেছিস,ভুলেই গিয়েছিলাম 'অনন্যার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল লাবন্য।'আচ্ছা যা, তোকে চুরি করা জিনিস খাওয়াবো না, ঠিকআছে? ' একটুপর গাছের নিচে এসে লাবন্য বলল,'ব্যাগটা একটু ধরতো। ' 'কি করবি? ' 'কেন বড়ই পারব। ' 'তুই একটু আগে না বললি চুরি করবিনা। ' 'চুরি করবনা বলিনি, বলেছি চুরি করা জিনিস তোকে খাওয়াব না। ' 'ও তারমানে তুই একা একাই খাবি?' 'সেটাও বলিনি। ' 'তাহলে? ' 'দেখ, তোর এত কথার জবাব আমি দিতে পারবনা। প্যাট প্যাট না করে ব্যাগটা ধর,'বলে ব্যাগটা অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকাল সামাদ চাচার খোঁজে।ৰুড়ো এই লোকটা খিটখিটে হলেও তার গাছের বড়ই এ গ্রামের মধ্যে সেরা। বুড়ো একাই থাকে রাস্তার পাশের টিনের একচালা ঘরটায়। বুড়ি মরে গেছে অনেক আগেই। একমাত্র ছেলে ঢাকায় ভাল একটা চাকরি করে।বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকে।বাপকে নিয়ে যেতে চেয়েছে অনেকবার কিন্তু সামাদ চাচা রাজি হয়নি।তার বেশকিছু জমি জিরাত আছে বর্গা দেয়া।এক মহিলা এসে রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। এখন বুড়োর একমাত্র কাজ হল বাড়ির পেছনের এই বড়ই গাছটা পাহারা দেয়া।লাবন্য শুনেছে, গাছটা নাকি সামাদ চাচার বউ লাগিয়েছিল।একারণে কাউকে ধরতে দেয়না এগাছের বড়ই। এখন অবশ্য সামাদ চাচাকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও।ওড়নাটা কোমড়ে পেঁচিয়ে লাবন্য বহুবার গাছ বাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তরতর করে উঠে যেতে লাগল গাছটাতে। 'তোর বিয়ে না বাঁদরের সাথে দেয়া উচিৎ,' নিচ থেকে বলল অনন্যা।'বাঁদর আর বাঁদরীর বাসর হবে গাছের মগডালে হি.হি.!' 'এই ফাজিল কথা বলিসনা, বুড়ো দেখলে চিল্লানো শুরু করবে, 'চাপা গলায় অনন্যাকে সতর্ক করল লাবন্য। কিছুক্ষণ পর কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় ছাড়াই কোঁচড় ভর্তি বড়ই নিয়ে নেমে এল লাবন্য। 'আচ্ছা পেড়েই যখন ফেলেছিস, তো দে কয়েকটা।'কাচুমাচু হয়ে বলল অনন্যা। ' 'তখন অত ঢং করিছিলি কেনরে? ' 'আচ্ছা তুইই বল, এত বড়ই তুই একা খেতে পারবি? ' 'আমি চুরি করা বড়ই খেতে যাব কেন? ' 'তাহলে? এতগুলো বড়ই ফেলে দিবি? কেমন হাহাকার করে উঠল অনন্যার গলা। 'উউহু, এগুলো হালাল করে খাওয়া হবে, 'বলতে বলতে অনন্যার বিষ্মিত দৃষ্টির সামনে বড়ইগুলো নিয়ে সামাদ চাচার একচালা ঘরটার দিকে হাঁটা দিল লাবন্য।বিস্মিত অনন্যাও বাধ্য হয়ে লাবন্যর পথ ধরল। গিয়ে দেখা গেল সামাদ চাচা বারান্দায় বসে হুক্কা টানছে। মান্ধাতা আমলের হুক্কাটা ছিল সামাদ চাচার দাদার।বংশানুধারা বজায় রাখতে প্রায়ই হুক্কাটা নিয়ে বসে সামাদ চাচা।'কিরে তোর কারা? মতলব কী? ওদের দেখে খনখনে গলায় বলে ওঠে বুড়ো।বয়স হলেও এখনো বুড়োর গায়ে যে পরিমাণে জোর আছে সেটা অন্তত লাবন্যদের জন্য ভীতিকরই বটে! 'চাচা আমি শহীদের মেয়ে,'বলল লাবন্য। আসলে পচাত্তুরে বুড়োর লাবন্যর মত ক্লাস টেন পড়ুয়া ভাতিজি থাকার কথা না।তবে লাবন্যর দাদার চাইতেও বেশি বয়সী এই বৃদ্ধ কি করে যেন পুরো গ্রামের "চাচা "হয়ে গেছেন।সবাই চাচা ডাকে। 'শহীদের মাইয়া ভালকথা, তা এইখানে আসছস কেন? এইটা তো শহীদ মিনার না! ' ফিক করে হেসে ফেলল দুই বান্ধবী।লাবন্য আড়চোখে সামাদ চাচার দিকে তাকিয়ে দেখল, ঠিক কি কারণে হাসা হল সেটা বুঝতে না পেরে রাগ রাগ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে বুড়ো। 'চাচা ওই শহীদ না, ওই যে মোড়ে দোকান আছে যে। ' 'ও শহীদ মিয়া? সেইটা আগে কবি তো।কিজন্যে আইছোস তোরা? ' 'চাচা একটা ভুল হয়ে গেছে।আপনার কয়েকটা বড়ই ভুলে পেড়ে ফেলেছি। ' 'বড়ই আবার ভুলে পাড়ে ক্যামনে? ' 'আসলে ভুল না, ইচ্ছে করেই পেড়েছিলাম।এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি।তাই বড়ইগুলো আপনাকে দিতে এসেছি, ' বলে কামিজের কোঁচড়ে রাখা বড়ইগুলো চাচার সামনে ঢেলে দিল লাবন্য। সামাদ চাচা চোখে কম দেখেন। এতক্ষণ চেহারা দেখতে পাননি কিন্তু লাবন্য বড়ইগুলো দেবার জন্য কাছে আসতেই ওর দিকে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধ।লাবন্য মুখ তুলতেই সামাদ চাচাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল।বৃদ্ধের ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি।সে দৃষ্টির ভাষা লাবন্য পড়তে পারলনা। 'চাচা আমরা আসি,'বলে লাবন্য সরে এল সামাদ চাচার সামনে থেকে।তখনও নির্বাক তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ। 'তোর কাহিনী কি বলত? সামাদ চাচার উঠোন পেরোতেই ফুঁসে উঠল অনন্যা।'এতকষ্ট করে বড়ইগুলো পেড়ে বুড়োকে দেবার কি দরকার ছিল? ' 'আর বলিসনা, আমি ভেবেছিলাম বড়ইগুলো ফেরৎ দিলে বুড়ো বলবে, "আচ্ছা পেড়েছিস যখন, নিয়ে যা, সামনে যাতে এরকম না হয়, "কৈফিয়তের সুর ফুটল লাবন্যর গলায়। 'তুই মানুষ আর পেলিনা, তাইনা? ওই কংস বুড়ো তোকে এমনি এমনি বড়ই দিয়ে দেবে ভাবলি কি করে? আগে জানলে তো তোকে গাছে উঠতেই দিতাম না।তবে খুব বেশি খারাপও হয়নাই কাজটা। তোর জামাই খুঁজতে সুবিধা হবে, হি.হি.! ' 'এত হাসতে হবেনা।এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ তার উপর উনি হি হি করছেন।চল, বাড়ি চল। শুধু শুধু কষ্ট করলাম। ' বাড়িতে এসে যখন ওরা পৌছল তখন ভরা সন্ধ্যা। অনন্যা বিদায় নিয়ে ওর বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেল। লাবন্য কলপারে গিয়ে দাড়াল। হাতমুখ ধোবে। মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা মেরে সেন্ডেল খুলল।পায়ে অদ্ভুত একটা নকশা তৈরী করেছে সেন্ডেলের ফিতা আর গ্রাম্য পথের ধুলোরা মিলেমিশে। হাত পা ধুয়ে আঁজলা ভরে পানি নিল লাবন্য।ওর সবসময়ের অভ্যাস।কলপারে এলেই আঁজলা ভরে পানি নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। ঝাঁকড়া একটা আমগাছের নিচে কলটার অবস্থান হওয়াতেই বোধহয় আশ্চর্য শীতল এর পানি। একচুমুকই শীতল ধারা বইয়ে দেয় সারা শরীর জুড়ে। ভেজা সেন্ডেলটা পায়ে গলিয়ে ঘরের দিকে এগোবে এমন সময় আমগাছটার নিচে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল ওর। ওটা কে দাড়িয়ে? আঁধার ঘনিয়েছে তারওপর ঝাঁকড়া গাছটার নিচে অন্ধকারটা একটু বেশিই।গা ছমছমে একটা পরিবেশ। 'কে ওখানে? 'গলা চড়িয়ে জানতে চাইল লাবন্য। অন্ধকারে দাড়ানো মানুষটা এবার একটু নড়েচড়ে উঠল।এগিয়ে আসতেই ফুরিয়ে আসা আলোয় অস্পষ্ট দেখা গেল মানুষটাকে। লাবণ্য খানিকটা এগিয়ে যায় আগন্তুককে চিনতে পারার আশায়।কিছুদুর এগোতেই হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে পড়ল লাবন্য। চিনতে পেরেছে ও আগন্তুককে। 'আপনি? 'এর বেশি আর কোনো স্বর ফুটলনা লাবন্যর গলায়। আরেকটু এগিয়ে এল আগন্তুক 'ওই ছেমড়ি বড়ই ফালায়া থুইয়া আইলি কেন? আমারে ফকিরনী মনে করছস যে তোর পাড়া বড়ই আমি নিমু? বান্দর কুনহানকার! ধর এইখান, 'অগ্নিমুর্তি ধারণ করবার ব্যার্থ চেষ্টা করতে করতে বলল সামাদ চাচা। হাতে ধরা একটা ব্যাগ বাড়িয়ে ধরেছে লাবন্যর দিকে। এই প্রথম লাবন্য খেয়াল করল সামাদ চাচার হাতে একটা মাঝারি সাইজের বাজারের ব্যাগ।লাবন্য অবাক হয়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই বুঝতে পারল ব্যাগটা ভর্তি ওর পাড়া বড়ইয়ের না হলেও দশগুণ বেশি হবে! ওরা চলে আসার পর নিশ্চয়ই সামাদ চাচা নিজহাতে বড়ই পেড়ে কষ্ট করে এতটা পথ হেঁটে এসেছে। পৃথিবীতে এই আবেগ আর ভালবাসার অস্তিত্ব আছে বলেই মানুষ শত প্রতিকুলতাকে সঙ্গী করেও বাঁচতে চায়। হঠাৎ করেই সামনে দাড়ানো বুড়ো মানুষটার প্রতি প্রচন্ড মায়া অনুভব করল লাবন্য।নিঃসঙ্গ মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। লাবন্য কি এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরবে?
Published on October 05, 2013 21:54
একজন আদর্শ স্বামী
এক
পয়ত্রিশ বছর বয়সে মেগাসিটি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে সিগারেট ধরাতে গিয়ে পনের বছর বয়সে গ্রামের আখখেতের আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরানোর মধ্যে অদ্ভুত এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করলাম।
সিগারেট ধরাতে চাচ্ছি কিন্তু পারছিনা।হাত কাঁপছে।এভাবেই কেঁপেছিল এখন থেকে মোটামুটি বছর বিশেক আগে সেই আখখেতে বসে জীবনে প্রথমবারের মত সিগারেট ধরানোর সময়।এরপর অসংখ্যবার কাজটা করা হলেও আজকের মত কখনোই হয়নি।
আমি আবাব্রো লাইটার ধরিয়ে মুখের কাছে আনতেই দেখতে পেলাম শিখাটা কাঁপছে।
বিশ বছর আগের সেই দিনটার সাথে আরো একটা ক্ষেত্রে মিল আছে আজকের দিনটার।সেদিন যেমন জীবনের প্রথম কোনও নিষিদ্ধ কাজ করার উত্তেজনায় হাত কেঁপে উঠেছিল আজও একই ব্যাপার।নিষিদ্ধ কাজগুলো বোধহয় সবসময়ই স্নায়ুকে এভাবেই শিথিল করে দেয়।প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই একটা অবসাদ এসে ভর করে শরীরে।
আমি আপাতত সিগারেট ধরানো বাদ দিয়ে ঘুরে খাটের উপর বসা নীলার দিকে তাকালাম।একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে ও।আমি তাকাতেই আমার দিকে কেমন একটা হাসি দিয়ে খাট থেকে নেমে পাশের রুমে চলে গেল।
আমি আবার সিগারেট ধরানোয় মন দিলাম।আশ্চর্য! এবার কোনো ধরনের কাঁপাকাঁপি ছাড়াই সিগারেটটা ধরাতে পারলাম।কষে একটা টান দিলাম সিগারেটে।এতক্ষণ ধরে এই সামান্য কাজটা করতে না পারার সম্পূর্ণ রাগটা ঝাড়লাম ক্যান্সার স্টিকটার উপর।আমার ধারণা নীলার উপস্থিতিই এতক্ষন আমার স্নায়ুর উপর বাড়তি চাপ ফেলছিল।
আমি উঠে গিয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ফেললাম।রুপা যেখানে সেখানে ছাই ফেলা একদমই পছন্দ করেনা।আমিও ওর অপছন্দের কাজগুলো মোটেই করিনা।একজন আদর্শ স্বামীর যোগ্য প্রতিচ্ছবি আমি।
খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যাই।রুপার রান্না করতে কষ্ট হবে বলে দুপুরের খাবার সকালে নেইনা।দুপুরে নিজেই এসে খেয়ে যাই।অফিস থেকে কখনই দেরী করে ফিরিনা।বাসায় ফিরে বউয়ের সাথে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসে যাই।মাঝে মাঝে যখন আবেগঘন দৃশ্য দেখে রুপা নাক টানতে থাকে তখন আস্তে করে রুমালটা বাড়িয়ে দেই ওর দিকে!
কখনই ওকে ওর বাবার বাড়ি যেতে নিষেধ করিনা।আমি যেতে না পারলেও ওকে একা একা যাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি।
মাসের শুরুতে বেতনটা এনে রুপার হাতে তুলে দিয়ে আমিও যেন একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।
সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হই।প্রেমিক প্রেমিকার মত করে একজন আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াই আমরা।ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঢুকে পড়ি কোনো রেস্টুরেন্টে।সেগুলোও বরাবরই অভিজাত হয়ে থাকে।কখনো কফির মগ,কখনো বা অন্য কোনো কিছু সামনে নিয়ে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।সে সময়টাতে রুপা নিশ্চয়ই নিজের স্বামী ভাগ্যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে।
একজন আদর্শ স্বামী হয়ে আমি নিজেও কম পাইনি রুপার কাছ থেকে।বরং কী পাইনি সে হিসেবেই তালগোল পাকিয়ে ফেলব।
এখনও রুপা পতিপ্রাণা স্ত্রীর মত আমাকে ছাড়া খায়না।প্রতিদিনই খাবারের টেবিলে আমার একটা না একটা পছন্দের উপস্থিতি পাই।রান্নাতেও যে কোনও মেয়ের ঈর্ষার পাত্রী রুপা।
আমার পূর্ব অনুমতি থাকলেও কোন কাজ আমাকে না বলে করেনা।সামান্য একটা কানের দুল কেনার আগেও আমার জানিয়ে নেবে।
আজ পর্যন্ত আমাদের কখনো ঝগড়া হয়েছে কিনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না আমার।রুপা অবশ্য বলতে পারবে।মেয়েটার দিন তারিখ মনে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ।আমার যেকোনো ভবিষ্যত কাজের কথা ওকে একবার বলে রাখলে আমাকে আর সেটা নিয়ে টেনশন করতে হয়না।মোবাইলের রিমাইন্ডারের মত ঠিকই সময় মত মনে করিয়ে দেবে।
এমন একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়ার পর আসলে আর কিছু চাইবার থাকতে পারেনা।কিন্তু জন্মগতভাবেই মানুষের রক্তের মধ্যে নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমার মনে হয়,নিষিদ্ধ কাজের সময় দেহে বাড়তি যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেটাই মুল আকর্ষণ।মানুষ রক্তে অ্যাড্রোনালিনের ছড়িয়ে পড়াটা বার বার উপভোগ করতে চায়।নয়ত রুপার মত স্ত্রী থাকতে নীলা কেন আমার শয্যার ভাগীদার হবে?
আমি দরজার খোলার শব্দে তাকিয়ে দেখি নীলা বেরিয়ে আসছে পাশের রুম থেকে।প্রথমেই আমার চোখ পড়ে গেল ওর কপালে।টিপটা ঠিকমত বসাতে পারেনি।একদিকে সরে গেছে।আমার মনে পড়ে গেল,ও ঘরে কোন আয়না নেই।টিপটার কথা বলতে হবে ওকে।
নীলার পরনে হালকা সবুজ রঙয়ের একটা শাড়ি।একটু আগে যেটা পড়া ছিল সেটাই।কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম,মাত্র আধঘন্টা আগেও এই শাড়িতে জড়ানো অবয়বটা আমার কাছে যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল,সে আকর্ষণের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
কেন হয় এমনটা? কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে পেয়ে যাবার প্রতিক্রিয়া?নাকি নিষিদ্ধ বস্তুগুলো এভাবেই দ্রুত তার আকর্ষণ হারায়?
‘আমি গেলাম,’আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল নীলা।একটা সন্ত্রস্তভাব লক্ষ্য করলাম ওর মধ্যে।একটু আগের সেই মদির কন্ঠ বেমালুম গায়েব!
‘এমনই হয়!’আমি মনে মনে বললাম।মুখে বললাম,‘হ্যা,যাও,রুপারও বোধহয় আসার সময় হয়ে গেছে।’
নীলা আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে হাঁটা দিল।
‘দরজা খোলার আগে কী হোল দিয়ে ভালভাবে দেখে নিও,’গলা চড়িয়ে বললাম আমি।ওকে দরজা পর্যন্ত বোধহয় এগিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল।ইচ্ছে করছেনা।
নীলা আমার কথার জবাব দিলনা।দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।একটু পরই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেলাম।‘ও তাহলে ভালভাবেই বাসায় ফিরতে পেরেছে,’ভাবলাম আমি।
নীলা আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে।একই ফ্লোর।স্বামী বিদেশে থাকে।নীলার সাথে শুধু ওর এক বিধবা ফুফু শাশুড়ি থাকে।দজ্জাল টাইপ মহিলা।তাঁর কারনেই নীলা এখনো পুরোপুরি উচ্ছনে যায়নি।স্বামী দেশের বাইরে থাকায় পাখির স্বভাব পেয়েছে সুদীপা।যেখানে সেখানে উড়ে বেড়ায়।গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও চেহারায় চটুলতার ছাপ স্পষ্ট।খুব ভাল ছলাকলা করতে জানে মেয়েটা।
ওকে আমি প্রথম দেখি লিফটে।দেখাটা তখন শুধু দেখাই ছিল।সেটাকে অন্য কিছুতে রুপান্তরিত করার কথা তখনো ভাবিনি,এখনও ভাবিনা।রুপার মত বউ ফেলে সেটা ভাবাটা অন্যায়ও বটে।আজকের ঘটনাটা স্রেফ সাময়িক একটা উত্তেজনার আকাঙ্ক্ষা থেকে ঘটে গিয়েছে।
হঠাত মাথায় প্রশ্ন এল,আমি কি রুপার উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি?রুপার সাথে সংসার করতে করতে কি আমি ক্লান্ত?
উত্তরটা সোজা না।বেশ কঠিন।শুধুমাত্র সাময়িক উত্তেজনার লোভে স্ত্রীর বিশ্বাসের জায়গাটাকে আস্তাকুড়ে পরিনত করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?তবে এটাও ঠিক রুপাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা।আর নীলাকে ভালবাসার তো কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।ওমন মেয়েকে শুধু ব্যাবহার করা যায়,ভালবাসা যায়না।
আচ্ছা,নীলাকে নিয়ে আমি যেমনটা ভাবছি রুপাকে নিয়েও এমনটা ভাবেনাতো কেউ?
ছিঃছিঃ এসব কি ভাবছি আমি?সম্ভবত একঘেয়ে নীরস জীবনযাপন ধীরে ধীরে আমার মানসিক বিকৃতি ঘটাচ্ছে।হয়ত কয়দিন পরই দেখা যাবে গভীররাতে হাতে ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছি।রাস্তাঘাটে মেয়েছেলে দেখলেই ধর্ষণ করার পর গলা দু ফাঁক করে দিচ্ছি।লন্ডনের সেই কুখ্যাত রহস্যময় সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্যা রিপারের মত।পত্রিকায় শিরোনাম আসবে,‘বাংলার জ্যাক দ্যা রিপারের আবির্ভাব,নৃশংসতার নতুন অধ্যায়!’
আমি বোধহয় সত্যি সত্যিই ম্যানিয়াকে পরিণত হচ্ছি।প্রতিজ্ঞা করলাম আজই শেষ।নিষিদ্ধ উত্তেজনার খোঁজ আমি আর কখনোই করবনা।
উত্তেজনা আমি নিজেই তৈরি করে নেব।আগামী মাসেই রুপাকে নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যাব।মাথায় মেঘের মুকুট পড়া আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালা আমার মধ্যে তৈরি করবে শিহরণ।দিনে সমুদ্রে ডুব দেব উত্তেজনার খোঁজে।রাতে রুপাতে,অন্য কিছুর খোঁজে।
সিদ্ধান্তটা নেবার সাথে সাথেই অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে গেল আমার গোটা অস্তিত্ব।ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল নীলাকে বাঁকা হয়ে থাকা টিপটার কথা বলা হয়নি।
দুই
রুপা বাসায় এল নীলা চলে যাবার প্রায় ঘন্টাখানেক পর।ও বাসায় ঢোকা মানেই বাসার মধ্যে একটা পাখির ঝাঁক ঢুকে পড়া।প্রচুর কথা বলে মেয়েটা।ভালই লাগে শুনতে।
বাসায় পা দিয়েই বলল,‘বুঝেছ,মা অনেক করে খেয়ে আসতে বলেছিল আমাকে।আমি বললাম তাই আবার হয় নাকি?তোমার জামাই বাসায় একা একা কি খাবে?মা অবশ্য বলেছিল তোমাকেও ফোন করে ডেকে পাঠাতে,আমি রাজি হইনি।ভাল করেছিনা?’
‘হুমম,অনেক ভাল করেছ।’মনে মনে বললাম,‘কতটা ভাল যে করেছ সেটা তুমি নিজেও জানোনা!’
‘এখন বল কী খাবে?আমি কিন্তু এই রাত করে বেশি ঝামেলা করতে পারবনা।চিকেন বিরিয়ানী করি?’
আমি হেসে ফেললাম।পাগলীটা বলে কী?বললাম,‘বিরিয়ানী তাহলে কী?’
‘আমি বোঝাতে চেয়েছি বিরিয়ানীর সাথে আর কিছু করতে পারবনা।বুঝতে পেরেছেন বস?’
‘জী ম্যাম,পেরেছি।যদি বিরিয়ানীটা ভাল হয় তাহলে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দেব তোমাকে।’
‘তাহলে সারপ্রাইজ দেবার জন্য রেডি থাকো।বিরিয়ানী অবশ্যই ভাল হবে।’
‘ইনশাল্লাহ বলো।’
‘ইনশাল্লাহ।আমি তাহলে রান্না বসিয়ে দিয়ে আসি।এরপর তোমাকে ফারজানার বিয়ের ভিডিও দেখাব।’
‘ফারজানাটা যেন কে?’
‘আরে ওই যে,আমার বান্ধবী।সেদিন ওর বিয়েতে গেলামনা?তুমি তো জরুরী মিটিং-এর কারণে আসতে পারলেনা।’
‘ও হ্যা,মনে পড়েছে।আচ্ছা তুমি রান্না চড়িয়ে দিয়ে এস এরপর তোমার বিয়ের ভিডিও দেখব।’
রুপা কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাড়াল।‘ওরে ফাজিল!আমার বিয়ের ভিডিও না?দাড়াও আজ বিরিয়ানীতে এমন ঝাল দেব!
‘তাহলে সারপ্রাইজ মিস করবে।’
‘সারপ্রাইজ তুমি আমাকে এমনিতেই দেবে আমি জানি।’
‘তা অবশ্য ভুল বলো নাই।’আমি বললাম।
রুপা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।সেদিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।যাক,নীলার ব্যাপারটা তাহলে বুঝতে পারেনি রুপা!
কিছুক্ষন পর রুপা যখন রান্না চাপিয়ে,পোশাক চেঞ্জ করে আমাদের বেডরুমে ঢুকল তখন আমি টিভি দেখছি।ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড।আমার প্রিয় অনুষ্ঠান।তবে অনুষ্ঠানের চাইতে অনুষ্ঠানের নামটা আমার কাছে বেশি প্রিয়।
প্রতিটা সংসারই যেন এক একটা বুনো জঙ্গল।আর আমরা প্রতিনিয়ত সেই জঙ্গলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি।অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
রুপা রুমে ঢুকে ওয়ারড্রোবের ওপর থেকে ওর মুভি ক্যামেরাটা নামাল।ওটা হাতে নিয়ে বলল,‘এই তুমি কি আমার ক্যামেরাটা নিয়েছিলে?’
‘না তো।কেন কি হয়েছে?’আমি টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে বললাম।
‘না তেমন কিছু হয়নি।আমি সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হবার আগে ফুল চার্জ দেখে গিয়েছিলাম,এখন দেখি একটুও চার্জ নেই।’
‘হয়ত ব্যাটারিতে প্রবলেম।’
রুপা উঠে গিয়ে স্পেয়ার ব্যাটারি নিয়ে এল।ব্যাটারি লাগিয়ে কিছুক্ষন খুট খাট করে বলল,‘তাই তো বলি এমনি এমনি চার্জ শেষ হয় কিভাবে?দেখনা,কী বোকামিটাই না করেছি।বাসা থেকে বের হবার আগে ভুলে ভিডিও চালু করে গিয়েছিলাম।ঘন্টা দুয়েক ভিডিও হবার পর চার্জ ফুরিয়ে ক্যামেরাটা একা একাই বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘ডিলিট করে দাও।’অন্যমনস্ক হয়ে বললাম কথাটা।ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল ক্যামেরাটা ওয়ারড্রোবের উপর রাখা ছিল।ওখান থেকে পুরো রুমের ভিউ পাওয়া যায়।তারমানে একটু আগের ঘটনা...
আমি ঝট করে পেছন ফিরলাম।রুপার দিকে এগোতে গিয়ে দেখি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ওর মুখভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে।চেহারায় ফুটে উঠেছে তীব্র অবিশ্বাস,বিষ্ময় আর...আর একরাশ বেদনা।
উপসংহার
ঘন্টাখানেক পর
রাত তখন বেশ গভীর হয়েছে।ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বাড়ি থেকে একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল রাস্তায়।একটু আগ পর্যন্ত বাড়িটার একটা ফ্ল্যাট থেকে প্রচন্ড ঝগড়া ঝাঁটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।এই মুহূর্তে সব নীরব,নিস্তব্ধ এবং নিথর!
ছায়ামূর্তিটা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে তার হাতে ধরা ছুড়িটা থেকে টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ল।
একসপ্তাহ পর পত্রিকার শিরোনাম-বাংলার জ্যাক দ্যা রিপারের আবির্ভাব,নৃশংসতার নতুন অধ্যায়...
পয়ত্রিশ বছর বয়সে মেগাসিটি ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে সিগারেট ধরাতে গিয়ে পনের বছর বয়সে গ্রামের আখখেতের আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরানোর মধ্যে অদ্ভুত এক সাদৃশ্য লক্ষ্য করলাম।
সিগারেট ধরাতে চাচ্ছি কিন্তু পারছিনা।হাত কাঁপছে।এভাবেই কেঁপেছিল এখন থেকে মোটামুটি বছর বিশেক আগে সেই আখখেতে বসে জীবনে প্রথমবারের মত সিগারেট ধরানোর সময়।এরপর অসংখ্যবার কাজটা করা হলেও আজকের মত কখনোই হয়নি।
আমি আবাব্রো লাইটার ধরিয়ে মুখের কাছে আনতেই দেখতে পেলাম শিখাটা কাঁপছে।
বিশ বছর আগের সেই দিনটার সাথে আরো একটা ক্ষেত্রে মিল আছে আজকের দিনটার।সেদিন যেমন জীবনের প্রথম কোনও নিষিদ্ধ কাজ করার উত্তেজনায় হাত কেঁপে উঠেছিল আজও একই ব্যাপার।নিষিদ্ধ কাজগুলো বোধহয় সবসময়ই স্নায়ুকে এভাবেই শিথিল করে দেয়।প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই একটা অবসাদ এসে ভর করে শরীরে।
আমি আপাতত সিগারেট ধরানো বাদ দিয়ে ঘুরে খাটের উপর বসা নীলার দিকে তাকালাম।একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে ও।আমি তাকাতেই আমার দিকে কেমন একটা হাসি দিয়ে খাট থেকে নেমে পাশের রুমে চলে গেল।
আমি আবার সিগারেট ধরানোয় মন দিলাম।আশ্চর্য! এবার কোনো ধরনের কাঁপাকাঁপি ছাড়াই সিগারেটটা ধরাতে পারলাম।কষে একটা টান দিলাম সিগারেটে।এতক্ষণ ধরে এই সামান্য কাজটা করতে না পারার সম্পূর্ণ রাগটা ঝাড়লাম ক্যান্সার স্টিকটার উপর।আমার ধারণা নীলার উপস্থিতিই এতক্ষন আমার স্নায়ুর উপর বাড়তি চাপ ফেলছিল।
আমি উঠে গিয়ে অ্যাশট্রেতে ছাই ফেললাম।রুপা যেখানে সেখানে ছাই ফেলা একদমই পছন্দ করেনা।আমিও ওর অপছন্দের কাজগুলো মোটেই করিনা।একজন আদর্শ স্বামীর যোগ্য প্রতিচ্ছবি আমি।
খুব সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যাই।রুপার রান্না করতে কষ্ট হবে বলে দুপুরের খাবার সকালে নেইনা।দুপুরে নিজেই এসে খেয়ে যাই।অফিস থেকে কখনই দেরী করে ফিরিনা।বাসায় ফিরে বউয়ের সাথে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসে যাই।মাঝে মাঝে যখন আবেগঘন দৃশ্য দেখে রুপা নাক টানতে থাকে তখন আস্তে করে রুমালটা বাড়িয়ে দেই ওর দিকে!
কখনই ওকে ওর বাবার বাড়ি যেতে নিষেধ করিনা।আমি যেতে না পারলেও ওকে একা একা যাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি।
মাসের শুরুতে বেতনটা এনে রুপার হাতে তুলে দিয়ে আমিও যেন একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে যাই।
সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হই।প্রেমিক প্রেমিকার মত করে একজন আরেকজনের হাত ধরে ঘুরে বেড়াই আমরা।ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঢুকে পড়ি কোনো রেস্টুরেন্টে।সেগুলোও বরাবরই অভিজাত হয়ে থাকে।কখনো কফির মগ,কখনো বা অন্য কোনো কিছু সামনে নিয়ে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।সে সময়টাতে রুপা নিশ্চয়ই নিজের স্বামী ভাগ্যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে।
একজন আদর্শ স্বামী হয়ে আমি নিজেও কম পাইনি রুপার কাছ থেকে।বরং কী পাইনি সে হিসেবেই তালগোল পাকিয়ে ফেলব।
এখনও রুপা পতিপ্রাণা স্ত্রীর মত আমাকে ছাড়া খায়না।প্রতিদিনই খাবারের টেবিলে আমার একটা না একটা পছন্দের উপস্থিতি পাই।রান্নাতেও যে কোনও মেয়ের ঈর্ষার পাত্রী রুপা।
আমার পূর্ব অনুমতি থাকলেও কোন কাজ আমাকে না বলে করেনা।সামান্য একটা কানের দুল কেনার আগেও আমার জানিয়ে নেবে।
আজ পর্যন্ত আমাদের কখনো ঝগড়া হয়েছে কিনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না আমার।রুপা অবশ্য বলতে পারবে।মেয়েটার দিন তারিখ মনে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ।আমার যেকোনো ভবিষ্যত কাজের কথা ওকে একবার বলে রাখলে আমাকে আর সেটা নিয়ে টেনশন করতে হয়না।মোবাইলের রিমাইন্ডারের মত ঠিকই সময় মত মনে করিয়ে দেবে।
এমন একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়ার পর আসলে আর কিছু চাইবার থাকতে পারেনা।কিন্তু জন্মগতভাবেই মানুষের রক্তের মধ্যে নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমার মনে হয়,নিষিদ্ধ কাজের সময় দেহে বাড়তি যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেটাই মুল আকর্ষণ।মানুষ রক্তে অ্যাড্রোনালিনের ছড়িয়ে পড়াটা বার বার উপভোগ করতে চায়।নয়ত রুপার মত স্ত্রী থাকতে নীলা কেন আমার শয্যার ভাগীদার হবে?
আমি দরজার খোলার শব্দে তাকিয়ে দেখি নীলা বেরিয়ে আসছে পাশের রুম থেকে।প্রথমেই আমার চোখ পড়ে গেল ওর কপালে।টিপটা ঠিকমত বসাতে পারেনি।একদিকে সরে গেছে।আমার মনে পড়ে গেল,ও ঘরে কোন আয়না নেই।টিপটার কথা বলতে হবে ওকে।
নীলার পরনে হালকা সবুজ রঙয়ের একটা শাড়ি।একটু আগে যেটা পড়া ছিল সেটাই।কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম,মাত্র আধঘন্টা আগেও এই শাড়িতে জড়ানো অবয়বটা আমার কাছে যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল,সে আকর্ষণের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।
কেন হয় এমনটা? কাঙ্ক্ষিত বস্তুটাকে পেয়ে যাবার প্রতিক্রিয়া?নাকি নিষিদ্ধ বস্তুগুলো এভাবেই দ্রুত তার আকর্ষণ হারায়?
‘আমি গেলাম,’আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল নীলা।একটা সন্ত্রস্তভাব লক্ষ্য করলাম ওর মধ্যে।একটু আগের সেই মদির কন্ঠ বেমালুম গায়েব!
‘এমনই হয়!’আমি মনে মনে বললাম।মুখে বললাম,‘হ্যা,যাও,রুপারও বোধহয় আসার সময় হয়ে গেছে।’
নীলা আর কোনো কথা না বলে দরজার দিকে হাঁটা দিল।
‘দরজা খোলার আগে কী হোল দিয়ে ভালভাবে দেখে নিও,’গলা চড়িয়ে বললাম আমি।ওকে দরজা পর্যন্ত বোধহয় এগিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল।ইচ্ছে করছেনা।
নীলা আমার কথার জবাব দিলনা।দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।একটু পরই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পেলাম।‘ও তাহলে ভালভাবেই বাসায় ফিরতে পেরেছে,’ভাবলাম আমি।
নীলা আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে।একই ফ্লোর।স্বামী বিদেশে থাকে।নীলার সাথে শুধু ওর এক বিধবা ফুফু শাশুড়ি থাকে।দজ্জাল টাইপ মহিলা।তাঁর কারনেই নীলা এখনো পুরোপুরি উচ্ছনে যায়নি।স্বামী দেশের বাইরে থাকায় পাখির স্বভাব পেয়েছে সুদীপা।যেখানে সেখানে উড়ে বেড়ায়।গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও চেহারায় চটুলতার ছাপ স্পষ্ট।খুব ভাল ছলাকলা করতে জানে মেয়েটা।
ওকে আমি প্রথম দেখি লিফটে।দেখাটা তখন শুধু দেখাই ছিল।সেটাকে অন্য কিছুতে রুপান্তরিত করার কথা তখনো ভাবিনি,এখনও ভাবিনা।রুপার মত বউ ফেলে সেটা ভাবাটা অন্যায়ও বটে।আজকের ঘটনাটা স্রেফ সাময়িক একটা উত্তেজনার আকাঙ্ক্ষা থেকে ঘটে গিয়েছে।
হঠাত মাথায় প্রশ্ন এল,আমি কি রুপার উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি?রুপার সাথে সংসার করতে করতে কি আমি ক্লান্ত?
উত্তরটা সোজা না।বেশ কঠিন।শুধুমাত্র সাময়িক উত্তেজনার লোভে স্ত্রীর বিশ্বাসের জায়গাটাকে আস্তাকুড়ে পরিনত করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?তবে এটাও ঠিক রুপাকে ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা।আর নীলাকে ভালবাসার তো কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।ওমন মেয়েকে শুধু ব্যাবহার করা যায়,ভালবাসা যায়না।
আচ্ছা,নীলাকে নিয়ে আমি যেমনটা ভাবছি রুপাকে নিয়েও এমনটা ভাবেনাতো কেউ?
ছিঃছিঃ এসব কি ভাবছি আমি?সম্ভবত একঘেয়ে নীরস জীবনযাপন ধীরে ধীরে আমার মানসিক বিকৃতি ঘটাচ্ছে।হয়ত কয়দিন পরই দেখা যাবে গভীররাতে হাতে ছুরি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছি।রাস্তাঘাটে মেয়েছেলে দেখলেই ধর্ষণ করার পর গলা দু ফাঁক করে দিচ্ছি।লন্ডনের সেই কুখ্যাত রহস্যময় সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্যা রিপারের মত।পত্রিকায় শিরোনাম আসবে,‘বাংলার জ্যাক দ্যা রিপারের আবির্ভাব,নৃশংসতার নতুন অধ্যায়!’
আমি বোধহয় সত্যি সত্যিই ম্যানিয়াকে পরিণত হচ্ছি।প্রতিজ্ঞা করলাম আজই শেষ।নিষিদ্ধ উত্তেজনার খোঁজ আমি আর কখনোই করবনা।
উত্তেজনা আমি নিজেই তৈরি করে নেব।আগামী মাসেই রুপাকে নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যাব।মাথায় মেঘের মুকুট পড়া আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালা আমার মধ্যে তৈরি করবে শিহরণ।দিনে সমুদ্রে ডুব দেব উত্তেজনার খোঁজে।রাতে রুপাতে,অন্য কিছুর খোঁজে।
সিদ্ধান্তটা নেবার সাথে সাথেই অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে গেল আমার গোটা অস্তিত্ব।ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল নীলাকে বাঁকা হয়ে থাকা টিপটার কথা বলা হয়নি।
দুই
রুপা বাসায় এল নীলা চলে যাবার প্রায় ঘন্টাখানেক পর।ও বাসায় ঢোকা মানেই বাসার মধ্যে একটা পাখির ঝাঁক ঢুকে পড়া।প্রচুর কথা বলে মেয়েটা।ভালই লাগে শুনতে।
বাসায় পা দিয়েই বলল,‘বুঝেছ,মা অনেক করে খেয়ে আসতে বলেছিল আমাকে।আমি বললাম তাই আবার হয় নাকি?তোমার জামাই বাসায় একা একা কি খাবে?মা অবশ্য বলেছিল তোমাকেও ফোন করে ডেকে পাঠাতে,আমি রাজি হইনি।ভাল করেছিনা?’
‘হুমম,অনেক ভাল করেছ।’মনে মনে বললাম,‘কতটা ভাল যে করেছ সেটা তুমি নিজেও জানোনা!’
‘এখন বল কী খাবে?আমি কিন্তু এই রাত করে বেশি ঝামেলা করতে পারবনা।চিকেন বিরিয়ানী করি?’
আমি হেসে ফেললাম।পাগলীটা বলে কী?বললাম,‘বিরিয়ানী তাহলে কী?’
‘আমি বোঝাতে চেয়েছি বিরিয়ানীর সাথে আর কিছু করতে পারবনা।বুঝতে পেরেছেন বস?’
‘জী ম্যাম,পেরেছি।যদি বিরিয়ানীটা ভাল হয় তাহলে বড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দেব তোমাকে।’
‘তাহলে সারপ্রাইজ দেবার জন্য রেডি থাকো।বিরিয়ানী অবশ্যই ভাল হবে।’
‘ইনশাল্লাহ বলো।’
‘ইনশাল্লাহ।আমি তাহলে রান্না বসিয়ে দিয়ে আসি।এরপর তোমাকে ফারজানার বিয়ের ভিডিও দেখাব।’
‘ফারজানাটা যেন কে?’
‘আরে ওই যে,আমার বান্ধবী।সেদিন ওর বিয়েতে গেলামনা?তুমি তো জরুরী মিটিং-এর কারণে আসতে পারলেনা।’
‘ও হ্যা,মনে পড়েছে।আচ্ছা তুমি রান্না চড়িয়ে দিয়ে এস এরপর তোমার বিয়ের ভিডিও দেখব।’
রুপা কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাড়াল।‘ওরে ফাজিল!আমার বিয়ের ভিডিও না?দাড়াও আজ বিরিয়ানীতে এমন ঝাল দেব!
‘তাহলে সারপ্রাইজ মিস করবে।’
‘সারপ্রাইজ তুমি আমাকে এমনিতেই দেবে আমি জানি।’
‘তা অবশ্য ভুল বলো নাই।’আমি বললাম।
রুপা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।সেদিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।যাক,নীলার ব্যাপারটা তাহলে বুঝতে পারেনি রুপা!
কিছুক্ষন পর রুপা যখন রান্না চাপিয়ে,পোশাক চেঞ্জ করে আমাদের বেডরুমে ঢুকল তখন আমি টিভি দেখছি।ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড।আমার প্রিয় অনুষ্ঠান।তবে অনুষ্ঠানের চাইতে অনুষ্ঠানের নামটা আমার কাছে বেশি প্রিয়।
প্রতিটা সংসারই যেন এক একটা বুনো জঙ্গল।আর আমরা প্রতিনিয়ত সেই জঙ্গলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি।অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
রুপা রুমে ঢুকে ওয়ারড্রোবের ওপর থেকে ওর মুভি ক্যামেরাটা নামাল।ওটা হাতে নিয়ে বলল,‘এই তুমি কি আমার ক্যামেরাটা নিয়েছিলে?’
‘না তো।কেন কি হয়েছে?’আমি টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে বললাম।
‘না তেমন কিছু হয়নি।আমি সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হবার আগে ফুল চার্জ দেখে গিয়েছিলাম,এখন দেখি একটুও চার্জ নেই।’
‘হয়ত ব্যাটারিতে প্রবলেম।’
রুপা উঠে গিয়ে স্পেয়ার ব্যাটারি নিয়ে এল।ব্যাটারি লাগিয়ে কিছুক্ষন খুট খাট করে বলল,‘তাই তো বলি এমনি এমনি চার্জ শেষ হয় কিভাবে?দেখনা,কী বোকামিটাই না করেছি।বাসা থেকে বের হবার আগে ভুলে ভিডিও চালু করে গিয়েছিলাম।ঘন্টা দুয়েক ভিডিও হবার পর চার্জ ফুরিয়ে ক্যামেরাটা একা একাই বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘ডিলিট করে দাও।’অন্যমনস্ক হয়ে বললাম কথাটা।ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল ক্যামেরাটা ওয়ারড্রোবের উপর রাখা ছিল।ওখান থেকে পুরো রুমের ভিউ পাওয়া যায়।তারমানে একটু আগের ঘটনা...
আমি ঝট করে পেছন ফিরলাম।রুপার দিকে এগোতে গিয়ে দেখি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ওর মুখভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে যাচ্ছে।চেহারায় ফুটে উঠেছে তীব্র অবিশ্বাস,বিষ্ময় আর...আর একরাশ বেদনা।
উপসংহার
ঘন্টাখানেক পর
রাত তখন বেশ গভীর হয়েছে।ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বাড়ি থেকে একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল রাস্তায়।একটু আগ পর্যন্ত বাড়িটার একটা ফ্ল্যাট থেকে প্রচন্ড ঝগড়া ঝাঁটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।এই মুহূর্তে সব নীরব,নিস্তব্ধ এবং নিথর!
ছায়ামূর্তিটা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল।রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে তার হাতে ধরা ছুড়িটা থেকে টুপ করে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ল।
একসপ্তাহ পর পত্রিকার শিরোনাম-বাংলার জ্যাক দ্যা রিপারের আবির্ভাব,নৃশংসতার নতুন অধ্যায়...
Published on October 05, 2013 21:51
নিঃশব্দ ঘাতক
পুলিশের গাড়িতে চেপে বিশিষ্ট হার্ট স্পেশালিস্ট ড. রকিব আহমেদের বাসায় উপস্থিত হল শখের গোয়েন্দা তারেক ফয়সাল।সঙ্গে আছে ওর বন্ধু গুলশান থানার এস আই মাহফুজ।
হাতে কাজ না থাকলে প্রায়ই থানায় এসে মাহফুজের সাথে বিভিন্ন কেস নিয়ে আলোচনা করে তারেক।থানাটা ওর বাসার কাছেই কিনা।থানার ওসি সাহেবও তারেককে অনেক স্নেহ করেন।বেশ কিছু কেসে পুলিশকে সাহায্য করেছে তারেক।
আজ সকালে জগিং সেরে আর বাসায় যায়নি তারেক।থানায় বসে কিছুদিন আগে সলভ করা একটা কেস নিয়ে মাহফুজের সাথে আলোচনা করছিল।এমন সময় ফোনটা এল।
ওপাশ থেকে একটা নারীকন্ঠ জানাল,তার স্বামী ড.রকিব গতরাতে খুন হয়েছেন।
মাহফুজ ফোনে তাকে বলল,‘ঠিকআছে,আমরা আসছি।কোনো কিছুতে যেন হাত দেয়া না হয়।
‘কী যাবি?ফোন রেখে তারেককে বলে মাহফুজ।
হাতে তেমন কোনো কাজ নেই।নাস্তাও থানাতেই আনিয়ে খেয়ে নিয়েছে,সুতরাং আপত্তি করার কোনো কারণ দেখতে পেলনা তারেক।এমনিতেই ওর কাছে সব কেস আসে বাসী হয়ে যাবার পর।অপরাধ ঘটার সাথে সাথেই অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ।সময়ের সাথে সাথে সেটা কঠিন হয়ে আসে।বলল,‘চল,দেখি তোর খুনীকে ধরা যায় কিনা।
রকিব সাহেবের আলিশান বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তারেক অস্ফুটে বলল,‘বাঙ্গালীদের হার্ট যে কতটা দুর্বল সে্টা রকিব সাহেবের বাড়িটা দেখেই বোঝা যায়!’
দুজন কনস্টেবল আর ডিবির একজন ফরেনসিক এক্সপার্টকে সাথে নিয়ে এসেছে মাহফুজ।লাশের প্রাথমিক পরীক্ষা করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা সম্ভব।
পাঁচজনের দলটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখা গেল যুবক বয়সী একজন বসে আছে।পরিচয় হতে জানা গেল লোকটার নাম মামুন।রকিব সাহেবের কম্পাউন্ডার।এ বাড়িতেই থাকেন।অনেকটা রকিব সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারীও বলা যায় তাকে।
‘আমাদের ফোন করেছিলেন যিনি,অর্থাৎ রকিব সাহেবের স্ত্রী,তিনি কোথায়?’মাহফুজ প্রশ্ন করল মামুনকে।
‘উনি ভেতরের রুমে আছেন।দাড়ান আমি ডেকে নিয়ে আসছি,’বলে ভেতরে চলে গেল মামুন।
বাড়িটা দোতলা।ডুপ্লেক্স।ভেতর দিয়েই দোতলায় ওঠার ব্যাবস্থা আছে।তারেক ভালমত চারদিকে নজর বুলাতে লাগল।
একটু পরই মিসেস রকিবকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল মামুন।
রকিব সাহেবের স্ত্রী শক্ত ধাতের মহিলা।শোকের ছাপ তেমন একটা পড়েনি তার চেহারায়।তিনি রুমে ঢুকতেই মাহফুজ বলল,‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।’
পুলিশের কাজে বাগড়া দেয়া তারেকের স্বভাব নয়,কিন্তু এই মুহুর্তে মাহফুজের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,‘আগে লাশটা দেখে আসা উচিত,তাহলে বোঝা যাবে কী প্রশ্ন করতে হবে আমাদের।এখন শুধু জিজ্ঞেস কর,মৃতদেহটা তিনি কখন দেখতে পেয়েছেন,’
মাহফুজ মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল তারেকের কথায়।ওর উপর আস্থা আছে মাহফুজের।জিজ্ঞেস করল,‘আচ্ছা,ম্যাডাম,আপনি কখন জানতে পারেন আপনার স্বামী মারা গেছেন?’
‘এইতো ঘন্টা খানেক আগে।’
তারেক মনে মনে হিসেব কষে ফেলল।এখন বাজে সকাল আটটা।তারমানে তিনি সকাল সাতটার দিকে লাশটা পেয়েছেন।এবং ফোন করেছেন সাড়ে সাতটারও পরে।ওদের এখানে আস্তে বিশ মিনিটের বেশি লাগেনি।
তারেক প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল,তার আগেই মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘লাশ দেখার পর আমাদের জানাতে এত দেরী হল যে?’
‘সেটাই কী স্বাভাবিক নয়,অফিসার?বাড়ির কর্তা মারা গেলে সবাই তো একটু দিশেহারা বোধ করবেই,তাইনা?’জবাবটা দিল মামুন।
মাহফুজ তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,’প্রশ্নটা আপনাকে করা হয়নি।’
‘সরি।’
‘আচ্ছা,আমরা আগে লাশটা দেখে আসি এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করার আছে।’
মামুনই পথ দেখিয়ে ওদের উপরতলায় নিয়ে এল।বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দলটা।একজন কন্সটেবলকে নীচে রেখে আসা হয়েছে।
বিছানায় রকিব আহমেদের লাশ পড়ে আছে।বয়স চল্লিশের মত হবে।একটা সাদা রং-এর নাইট ড্রেস পরনে।বুকের কাছটা রক্তে লাল হয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে,গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাকে।চেহারায় যন্ত্রনার একটা ছাপ পরিষ্কার।মৃত্যুর যন্ত্রনা।
মৃত্যু সব সময়ই কষ্ট দেয় তারেককে।লাশের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলনা ও।দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পুরো ঘরটা দেখায় মনোযোগ দিল।
বেশ বড় আকারের ঘর।দামী আসবাবে সজ্জিত।এমনিতে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই অবশ্য।
থাটের মাথার কাছে ছোট্ট একটা ওষুধের বোতল।বোতলটা দিয়ে ভাঁজ করা একটা কাগজ চাপা দেয়া।কাগজটা পড়ে দেখল তারেক।বোতলটাও উল্টে পাল্টে দেখল। এরপর মেঝেতে বিছানো কার্পেট আর দরজার নবটা ভাল মত দেখল।
এদিকে মাহফুজ ফরেনসিক এক্সপার্টকে লাশের পরীক্ষা করার কাজে লাগিয়ে দিয়ে কনস্টেবলকে নিয়ে রুমটা তল্লাশি করছে।
রুমের একমাত্র জানালাটার সামনে দাড়িয়ে মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘আচ্ছা তারেক,এমন কী হতে পারেনা,পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ স্নাইপার দিয়ে গুলি করেছে ড.রকিবকে?’
তারেক মুচকি হেসে বলল,‘ইদানীং হলিউডের মুভি দেখিস বোধহয় খুব বেশি।ডাক্তার রকিব এমন কোনো মানুষ না যে তাকে স্নাইপার দিয়ে মারতে হবে।তাছাড়া দেখছিস না রুমে এসি চলছে।তারমানে এই জানালাটা রাতে বন্ধ থাকে।গুলি বাইরে থেকে এলে জানালার কাঁচ এখন অক্ষত থাকত না। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে।হয়ত রুমের ভেতর থেকে নয়ত ওই ব্যালকনি থেকে।’ এরপর বিরতি দিয়ে বলল,’এখানে আর দেখার মত তেমন কিছুই নেই।’
মাহফুজও সায় জানিয়ে বলল,‘হ্যাঁ,জাফর সাহেব লাশটা পরীক্ষা করুক আমরা বরং নীচে যাই।’
ফরেনসিক এক্সপার্ট জাফর সাহেবকে উপরে রেখে নীচে চলে এল সবাই।তারেক আর মাহফুজ একটা রুমে
বসল।বাড়ির কাজের লোকজনসহ বাকী সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়েছে। এক এক করে ডেকে নিয়ে প্রশ্ন করা হবে।এখন ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. জাফরের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা।তার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানার পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে।বাড়ির লোকদের কনস্টেবল দুজন পাহারা দিচ্ছে।
একটু পরই রুমে ঢুকলেন ড. জাফর।বললেন,‘ভিকটিম রাত তিনটার দিকে মারা গেছেন।গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে।সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন ভিকটিম।পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ অর্থাৎ খুব কাছ থেকে গুলিটা করা হয়েছে।সম্ভবত একেবারে বুকের সাথে ঠেকিয়ে।কারণ ক্ষতের আশেপাশে গান পাউডার পাওয়া গেছে।.৪৫ ক্যালিবারের বুলেট বলেই আমার বিশ্বাস।পোস্টমর্টেম করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
‘হুমম,তারমানে তোর কথাই ঠিক। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে। আচ্ছা এখন তাহলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যাক।’
প্রথমেই মিসেস রকিবকে ডাকা হল।ভদ্রমহিলা সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন।
‘ম্যাডাম,আপনার নামটা?’
‘আসমা আহমেদ।’
‘ওকে। আপনার হাজবেন্ডকে রাত তিনটার দিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।আপনি কী রাতে কিছু টের পেয়েছিলেন?’
‘না তো। ’
‘আপনার পাশে আপনার স্বামীকে গুলী করে হত্যা করা হল,আর আপন কিছুই টের পেলেননা?’
‘খুনী সম্ভবত সাইলেন্সার ব্যাবহার করেছে।সেক্ষেত্রে তো আমার টের পাবার কথা না।’
‘রকিব সাহেবের কোনো আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন?’
‘সেটা সম্ভব নয়।তখন বললাম না,গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে। দুসেকেন্ডের মধ্যেই মারা গেছেন ভদ্রলোক।কোনো ধরনের আর্তনাদ করার সুযোগই পাননি।’ জবাবটা দিলেন ড. জাফর।
‘ও আচ্ছা, তা কে আপনার স্বামীকে হত্যা করতে পারে বলে মনে হয় আপনার?আইমিন,কোনও শত্রু?’
‘তেমন কাউকে তো মনে পড়ে না,তবে…’
‘তবে কী?’
‘না মানে,আমার হাজবেন্ডের একটা লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল।পিস্তলটা মামুনকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন উনি,পিস্তলটা নাকি হারিয়ে ফেলেছে মামুন।ওটা দিয়ে তো বাড়ির যে কেউ খুন করতে পারে।’
‘পিস্তলটা কত ক্যালিবারের বলতে পারবেন?’
‘না।’
‘লাইসেন্সের কাগজপত্র নিশ্চয়ই আছে।ওগুলো দিয়ে মামুন সাহেবকে পাঠিয়ে দেবেন।আপাতত আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন নেই।প্রয়োজন হলে ডাকা হবে।’
মিসেস রকিব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।একটু পরই মামুন ঢুকল রুমে।হাতে পিস্তলের কাগজপত্র।
‘দেখি,’বলে হাত বাড়িয়ে দিল মাহফুজ।কাগজটা দেখে মাথা দুলিয়ে বলল,‘হুমম,পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ ক্যালিবার।’এরপর মামুনের দিকে তাকিয়ে বলল,‘গতকাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘এ বাড়িতেই থাকি আমি।নীচতলায় আমার রুমে ছিলাম। ’
‘রাতে কিছু শুনতে পাননি?’
‘না,ম্যাডামই শুনতে পাননি,আমি কিভাবে পাব?’
‘রকিব সাহেব নাকি তার পিস্তলটা আপনাকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন শুনলাম?’
কথা না বলে মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল মামুন।
‘পিস্তলটা এখন কোথায়?’
‘আমার রুমে।’
‘কী!আপনার রুমে?’মাহফুজসহ রুমের সবাই অবাক হয়েছে।‘কিন্তু একটু আগে মিসেস রকিব বলে গেলেন পিস্তলটা নাকি আপনি হারিয়ে ফেলেছেন?’
‘হ্যাঁ,প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমার রুম থেকে পিস্তলটা গায়েব হয়ে যায়।কাল হঠাৎ দেখি আমার জানালার নীচে বাগানে পড়ে আছে পিস্তলটা।সম্ভবত পিস্তলটা পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দিয়েছিলাম তখনই পড়ে যায়।আমারও মনে ছিলনা। যখন পিস্তলটা হারিয়েছিল,তখন রুমের সব জায়গায় খুঁজলেও ওখানে খোঁজা হয়নি।কাল স্যার একটা কাজে বাগানে পাঠিয়েছিলেন,তখনই পিস্তলটা দেখতে পাই।’
‘কিন্তু মিসেস রকিব তো আমাদের বললেন না যে,আপনি পিস্তলটা পেয়েছেন?’
‘তিনি জানেননা।আমি যখন স্যারকে জানাই,তখন ম্যাডাম বাসায় ছিলেননা।ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।তবে পরে রকিব সাহেব বলে থাকতে পারেন,কিন্তু এখন আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে তিনি আসলেই জানেননা।’
‘পিস্তলটা একটু নিয়ে আসুন তো। ’
মামুন উঠে চলে গেল।একটু পরই একটা বক্সে করে পিস্তলটা নিয়ে ফিরল।
মাহফুজ পিস্তলটা নিয়ে ড.জাফরের হাতে তুলে দিলেন।ড.জাফর পিস্তলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।ব্যারেলটা নাকের কাছে ধরে বললেন,গত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পিস্তলটা থেকে গুলি চালানো হয়েছে।ব্যারেলে গান পাউডারের দাগ দেখা যাচ্ছে।বারুদের হালকা গন্ধও আছে।আমার ধারণা এটাই মার্ডার ওয়েপন।’
‘হুমম,তা মিষ্টার মামুন,আপনাকে পিস্তল পরিষ্কার করতে দেয়ার কী কারণ?অভিজ্ঞতা আছে নাকি আগের?’
কেমন ইতস্তত করতে লাগল মামুন। এতগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নীচু করে ফেলল।বলল,‘আমি একজন শুটার চ্যাম্পিয়ান। ’
‘আচ্ছা!’এমনভাবে কথাটা বলল মাহফুজ যেন কেসটা এইমাত্র সলভ করে ফেলেছে ও।‘আচ্ছা,আপনি যান।আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই আপাতত। ’
মামুন বেরিয়ে যেতেই মাহফুজ বলে উঠল,‘দোস্ত তোর সাথে থাকতে থাকতে আমারও মাথা খুলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কেসটা সলভ করতে পারব ভাবিনি।’
‘তাইনাকি?কি রকম?’মুচকি হেসে প্রশ্ন করল তারেক।
‘খুনটা বাড়ির লোকই করেছে,মানে এই মামুন ব্যাটাই খুনটা করেছে।লোকটা এমনিতেই শুটার চ্যাম্পিয়ান। তার পক্ষে গুলি চালানো খুব সহজ। নিশ্চই রকিব সাহেবের বেডরুমের মাস্টার কী-ও যোগার করেছিল। রাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলে রকিব সাহেবকে হত্যা করে সে। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় তার স্ত্রী টের পাননি,’ব্যাখ্যা দিল মাহফুজ।
‘কিন্তু বন্ধু তোমার ব্যাখ্যায় একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।সেক্ষেত্রে লোকটা মার্ডার ওয়েপন আমাদের হাতে তুলে দিল কেন?’
‘সহজ,যাতে আমরা তার পিস্তল হারানো এবং ফিরে পাবার গল্পটা বিশ্বাস করি।’
‘উল্টোটাই কিন্তু ঘটেছে।তুই তাকে অবিশ্বাস করছিস।সে যদি বলত পিস্তলটা এখনও নিখোঁজ,তাহলে সেটাই তার জন্য বেশি উপকারি ও বিশ্বাস্য হত।কারণ তার পিস্তল পাবার সাক্ষী এমন একজন যে আর এখন সাক্ষ্য দেবার অবস্থায় নেই,রকিব সাহেব।
তাছাড়া তোর কথা যদি মেনেও নেই,খুন মামুন করেছে,তাহলে পিস্তলটা এতক্ষণে পরিষ্কার করে ফেলত সে। খুন হবার পর থেকে লাশ আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত প্রায় চার ঘন্টা সময় পেয়েছে মামুন।সেক্ষেত্রে আমরা জানতেও পারতামনা এই পিস্তলটা দিয়ে গত চব্বিশ ঘন্টায় গুলি চালানো হয়েছে। ’
‘তাইতো,’মাহফুজকে চিন্তিত দেখালো। ‘তাহলে?’
‘তোর একটা কথা কিন্তু আংশিক ঠিক।রকিব সাহেবকে তার বাড়ির লোকই খুন করেছে।আমি এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করতে চাই,শুধু তার বাড়ির লোকই নয়,বরং তার ঘরের লোক।’
‘মানে তার স্ত্রী?!’ বিস্ময় প্রকাশ পেল মাহফুজের গলায়। ড.জাফরও বেশ অবাক হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ,একটি সুনিপুন প্ল্যান করেছিলেন তিনি।এবং এই প্ল্যানের অংশ হিসেবেই সপ্তাহ খানেক আগে পিস্তলটা মামুনের রুম থেকে চুরি করেন।এরপর গতকাল মামুনের জানালার নীচে বাগানের মধ্যে ফেলে রাখেন পিস্তলটা,যাতে করে মামুন সেটা খুঁজে পায়।’
‘কিন্তু তারেক,মামুন কিন্তু পিস্তলটা কাকতালীয়ভাবে খুঁজে পায়।রকিব সাহেব যদি তাকে না পাঠাতেন…’
‘উঁহু কাকতালীয় নয়,’ মাহফুজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল তারেক। ‘আমি নিশ্চিত,মিসেস রকিবই কাজের ছুতোয় স্বামীকে দিয়ে বলিয়ে মামুনকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন। এবং ওই সময়টাতে ইচ্ছে করেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন যাতে করে সবাই ভাবে তিনি পিস্তল পাবার ঘটনা জানেন না।আর এই না জানার ভাণ করে পিস্তল হারাবার গল্প আমাদেরকে বলে দিয়ে সব সন্দেহ মামুনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বেচারা শুটার চ্যাম্পিয়ান হওয়াতে সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।’
‘কিন্তু পিস্তলটা তো গতরাতে মামুনের কাছে ছিল,তাহলে সেটা দিয়ে মিসেস রকিব কিভাবে খুন করবে রকিব সাহেবকে?’
‘পিস্তল কি পৃথিবীতে একটাই?পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের মত কমন একটা পিস্তল যোগার করা মিসেস রকিবের মত ধনী মানুষদের পক্ষে কঠিন কিছুনা। আর রকিব সাহেবের পিস্তলটা বাগানে ফেলে রাখবার আগে তিনি সেটা দিয়ে একবার ফাঁকা গুলী করেছিলেন যার ফলে আমাদের ধারণা হয়েছে ওটাই আসলে মার্ডার ওয়েপন। কিন্তু আসল মার্ডার ওয়েপন হল একই ক্যালিবারের আরেকটি পিস্তল। খুবই চতুর মহিলা।’
‘হুমম,সেটা তো দেখাই যাচ্ছে।কিন্তু এতক্ষণ যা বললি তা প্রমাণ করতে পারবি?’
‘হ্যাঁ পারব। মিসেস রকিব তখন বলেছিলেন আততায়ী সাইলেন্সার ব্যাবহার করায় তিনি কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু সাইলেন্সার লাগালে যে একেবারেই শব্দ হয়না তা তো না।হালকা একটা শব্দ হয়ই যেটা,দশ বারো ফুট দুর থেকে অনায়াসেই শোনা যায়।’
‘সেটা ঠিক আছে,কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন একজন মানুষের পক্ষে সেটা না শোনাই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু মানুষটার যদি অনিদ্রা রোগ থাকে?’
‘অনিদ্রা রোগ?’
‘হ্যাঁ।মিসেস রকিবের ইনসমনিয়া আছে।গতকাল ডাক্তারের কাছেও তিনি এজন্যই গিয়েছিলেন। তাকে একটা ঘুমের অষুধ পেসক্রাইব করা হয়।কিন্তু রাতে জেগে থাকবার জন্য অষুধটা তিনি গতরাতে খাননি।বোতলের সিলটা এখনো অক্ষত আছে।এটা একটা ভাল প্রমাণ হতে পারে কোর্টে। এছাড়া সত্যিকারের মার্ডার ওয়েপনটা আমার ধারণা,খুঁজলে এবাড়িতেই পাওয়া যাবে।কারণ খুন করার পর থেকে মিসেস রকিব বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ পাননি।তাহলে বাড়ির কাজের লোকজন তাকেই সন্দেহ করে বসত।’
‘কিন্তু মোটিভ?কী উদ্দেশ্যে খুনটা করলেন তিনি?সম্পত্তির লোভ?’
‘সেটা বের করার দায়িত্ব তোদের।আমি আমার কাজ করেছি।খুনীকে ধরিয়ে দিয়েছি।আমি আসলে দোতলায় থাকতে ওষুধের বোতলটা দেখেই বুঝে ফেলি আসলে কে খুনী। কিন্তু পুলিশের কাজে বাধা দিতে চাইনি বলেই এতক্ষন কিছু বলিনি।
ওই অষুধের বোতলটাই মিসেস রকিবের সুনিপুন প্ল্যানের একমাত্র ভুল।অবশ্য তাকেও দোষ দেয়া যায়না। প্রফেশনাল ক্রিমিনালরাই এরচাইতে বড় ভুল করে বসে।
আসলে প্রত্যেক অপরাধীর মন ছোট হয় তো যার ফলে প্রত্যেকেই ভুল করে থাকে। সেই ভুলটা খুঁজে বের করতে পারলেই অপরাধী ধরা পড়তে বাধ্য।’
হাতে কাজ না থাকলে প্রায়ই থানায় এসে মাহফুজের সাথে বিভিন্ন কেস নিয়ে আলোচনা করে তারেক।থানাটা ওর বাসার কাছেই কিনা।থানার ওসি সাহেবও তারেককে অনেক স্নেহ করেন।বেশ কিছু কেসে পুলিশকে সাহায্য করেছে তারেক।
আজ সকালে জগিং সেরে আর বাসায় যায়নি তারেক।থানায় বসে কিছুদিন আগে সলভ করা একটা কেস নিয়ে মাহফুজের সাথে আলোচনা করছিল।এমন সময় ফোনটা এল।
ওপাশ থেকে একটা নারীকন্ঠ জানাল,তার স্বামী ড.রকিব গতরাতে খুন হয়েছেন।
মাহফুজ ফোনে তাকে বলল,‘ঠিকআছে,আমরা আসছি।কোনো কিছুতে যেন হাত দেয়া না হয়।
‘কী যাবি?ফোন রেখে তারেককে বলে মাহফুজ।
হাতে তেমন কোনো কাজ নেই।নাস্তাও থানাতেই আনিয়ে খেয়ে নিয়েছে,সুতরাং আপত্তি করার কোনো কারণ দেখতে পেলনা তারেক।এমনিতেই ওর কাছে সব কেস আসে বাসী হয়ে যাবার পর।অপরাধ ঘটার সাথে সাথেই অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ।সময়ের সাথে সাথে সেটা কঠিন হয়ে আসে।বলল,‘চল,দেখি তোর খুনীকে ধরা যায় কিনা।
রকিব সাহেবের আলিশান বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তারেক অস্ফুটে বলল,‘বাঙ্গালীদের হার্ট যে কতটা দুর্বল সে্টা রকিব সাহেবের বাড়িটা দেখেই বোঝা যায়!’
দুজন কনস্টেবল আর ডিবির একজন ফরেনসিক এক্সপার্টকে সাথে নিয়ে এসেছে মাহফুজ।লাশের প্রাথমিক পরীক্ষা করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা সম্ভব।
পাঁচজনের দলটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখা গেল যুবক বয়সী একজন বসে আছে।পরিচয় হতে জানা গেল লোকটার নাম মামুন।রকিব সাহেবের কম্পাউন্ডার।এ বাড়িতেই থাকেন।অনেকটা রকিব সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারীও বলা যায় তাকে।
‘আমাদের ফোন করেছিলেন যিনি,অর্থাৎ রকিব সাহেবের স্ত্রী,তিনি কোথায়?’মাহফুজ প্রশ্ন করল মামুনকে।
‘উনি ভেতরের রুমে আছেন।দাড়ান আমি ডেকে নিয়ে আসছি,’বলে ভেতরে চলে গেল মামুন।
বাড়িটা দোতলা।ডুপ্লেক্স।ভেতর দিয়েই দোতলায় ওঠার ব্যাবস্থা আছে।তারেক ভালমত চারদিকে নজর বুলাতে লাগল।
একটু পরই মিসেস রকিবকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল মামুন।
রকিব সাহেবের স্ত্রী শক্ত ধাতের মহিলা।শোকের ছাপ তেমন একটা পড়েনি তার চেহারায়।তিনি রুমে ঢুকতেই মাহফুজ বলল,‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।’
পুলিশের কাজে বাগড়া দেয়া তারেকের স্বভাব নয়,কিন্তু এই মুহুর্তে মাহফুজের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,‘আগে লাশটা দেখে আসা উচিত,তাহলে বোঝা যাবে কী প্রশ্ন করতে হবে আমাদের।এখন শুধু জিজ্ঞেস কর,মৃতদেহটা তিনি কখন দেখতে পেয়েছেন,’
মাহফুজ মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল তারেকের কথায়।ওর উপর আস্থা আছে মাহফুজের।জিজ্ঞেস করল,‘আচ্ছা,ম্যাডাম,আপনি কখন জানতে পারেন আপনার স্বামী মারা গেছেন?’
‘এইতো ঘন্টা খানেক আগে।’
তারেক মনে মনে হিসেব কষে ফেলল।এখন বাজে সকাল আটটা।তারমানে তিনি সকাল সাতটার দিকে লাশটা পেয়েছেন।এবং ফোন করেছেন সাড়ে সাতটারও পরে।ওদের এখানে আস্তে বিশ মিনিটের বেশি লাগেনি।
তারেক প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল,তার আগেই মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘লাশ দেখার পর আমাদের জানাতে এত দেরী হল যে?’
‘সেটাই কী স্বাভাবিক নয়,অফিসার?বাড়ির কর্তা মারা গেলে সবাই তো একটু দিশেহারা বোধ করবেই,তাইনা?’জবাবটা দিল মামুন।
মাহফুজ তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,’প্রশ্নটা আপনাকে করা হয়নি।’
‘সরি।’
‘আচ্ছা,আমরা আগে লাশটা দেখে আসি এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করার আছে।’
মামুনই পথ দেখিয়ে ওদের উপরতলায় নিয়ে এল।বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দলটা।একজন কন্সটেবলকে নীচে রেখে আসা হয়েছে।
বিছানায় রকিব আহমেদের লাশ পড়ে আছে।বয়স চল্লিশের মত হবে।একটা সাদা রং-এর নাইট ড্রেস পরনে।বুকের কাছটা রক্তে লাল হয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে,গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাকে।চেহারায় যন্ত্রনার একটা ছাপ পরিষ্কার।মৃত্যুর যন্ত্রনা।
মৃত্যু সব সময়ই কষ্ট দেয় তারেককে।লাশের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলনা ও।দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পুরো ঘরটা দেখায় মনোযোগ দিল।
বেশ বড় আকারের ঘর।দামী আসবাবে সজ্জিত।এমনিতে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই অবশ্য।
থাটের মাথার কাছে ছোট্ট একটা ওষুধের বোতল।বোতলটা দিয়ে ভাঁজ করা একটা কাগজ চাপা দেয়া।কাগজটা পড়ে দেখল তারেক।বোতলটাও উল্টে পাল্টে দেখল। এরপর মেঝেতে বিছানো কার্পেট আর দরজার নবটা ভাল মত দেখল।
এদিকে মাহফুজ ফরেনসিক এক্সপার্টকে লাশের পরীক্ষা করার কাজে লাগিয়ে দিয়ে কনস্টেবলকে নিয়ে রুমটা তল্লাশি করছে।
রুমের একমাত্র জানালাটার সামনে দাড়িয়ে মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘আচ্ছা তারেক,এমন কী হতে পারেনা,পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ স্নাইপার দিয়ে গুলি করেছে ড.রকিবকে?’
তারেক মুচকি হেসে বলল,‘ইদানীং হলিউডের মুভি দেখিস বোধহয় খুব বেশি।ডাক্তার রকিব এমন কোনো মানুষ না যে তাকে স্নাইপার দিয়ে মারতে হবে।তাছাড়া দেখছিস না রুমে এসি চলছে।তারমানে এই জানালাটা রাতে বন্ধ থাকে।গুলি বাইরে থেকে এলে জানালার কাঁচ এখন অক্ষত থাকত না। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে।হয়ত রুমের ভেতর থেকে নয়ত ওই ব্যালকনি থেকে।’ এরপর বিরতি দিয়ে বলল,’এখানে আর দেখার মত তেমন কিছুই নেই।’
মাহফুজও সায় জানিয়ে বলল,‘হ্যাঁ,জাফর সাহেব লাশটা পরীক্ষা করুক আমরা বরং নীচে যাই।’
ফরেনসিক এক্সপার্ট জাফর সাহেবকে উপরে রেখে নীচে চলে এল সবাই।তারেক আর মাহফুজ একটা রুমে
বসল।বাড়ির কাজের লোকজনসহ বাকী সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়েছে। এক এক করে ডেকে নিয়ে প্রশ্ন করা হবে।এখন ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. জাফরের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা।তার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানার পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে।বাড়ির লোকদের কনস্টেবল দুজন পাহারা দিচ্ছে।
একটু পরই রুমে ঢুকলেন ড. জাফর।বললেন,‘ভিকটিম রাত তিনটার দিকে মারা গেছেন।গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে।সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন ভিকটিম।পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ অর্থাৎ খুব কাছ থেকে গুলিটা করা হয়েছে।সম্ভবত একেবারে বুকের সাথে ঠেকিয়ে।কারণ ক্ষতের আশেপাশে গান পাউডার পাওয়া গেছে।.৪৫ ক্যালিবারের বুলেট বলেই আমার বিশ্বাস।পোস্টমর্টেম করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
‘হুমম,তারমানে তোর কথাই ঠিক। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে। আচ্ছা এখন তাহলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যাক।’
প্রথমেই মিসেস রকিবকে ডাকা হল।ভদ্রমহিলা সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন।
‘ম্যাডাম,আপনার নামটা?’
‘আসমা আহমেদ।’
‘ওকে। আপনার হাজবেন্ডকে রাত তিনটার দিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।আপনি কী রাতে কিছু টের পেয়েছিলেন?’
‘না তো। ’
‘আপনার পাশে আপনার স্বামীকে গুলী করে হত্যা করা হল,আর আপন কিছুই টের পেলেননা?’
‘খুনী সম্ভবত সাইলেন্সার ব্যাবহার করেছে।সেক্ষেত্রে তো আমার টের পাবার কথা না।’
‘রকিব সাহেবের কোনো আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন?’
‘সেটা সম্ভব নয়।তখন বললাম না,গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে। দুসেকেন্ডের মধ্যেই মারা গেছেন ভদ্রলোক।কোনো ধরনের আর্তনাদ করার সুযোগই পাননি।’ জবাবটা দিলেন ড. জাফর।
‘ও আচ্ছা, তা কে আপনার স্বামীকে হত্যা করতে পারে বলে মনে হয় আপনার?আইমিন,কোনও শত্রু?’
‘তেমন কাউকে তো মনে পড়ে না,তবে…’
‘তবে কী?’
‘না মানে,আমার হাজবেন্ডের একটা লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল।পিস্তলটা মামুনকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন উনি,পিস্তলটা নাকি হারিয়ে ফেলেছে মামুন।ওটা দিয়ে তো বাড়ির যে কেউ খুন করতে পারে।’
‘পিস্তলটা কত ক্যালিবারের বলতে পারবেন?’
‘না।’
‘লাইসেন্সের কাগজপত্র নিশ্চয়ই আছে।ওগুলো দিয়ে মামুন সাহেবকে পাঠিয়ে দেবেন।আপাতত আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন নেই।প্রয়োজন হলে ডাকা হবে।’
মিসেস রকিব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।একটু পরই মামুন ঢুকল রুমে।হাতে পিস্তলের কাগজপত্র।
‘দেখি,’বলে হাত বাড়িয়ে দিল মাহফুজ।কাগজটা দেখে মাথা দুলিয়ে বলল,‘হুমম,পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ ক্যালিবার।’এরপর মামুনের দিকে তাকিয়ে বলল,‘গতকাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘এ বাড়িতেই থাকি আমি।নীচতলায় আমার রুমে ছিলাম। ’
‘রাতে কিছু শুনতে পাননি?’
‘না,ম্যাডামই শুনতে পাননি,আমি কিভাবে পাব?’
‘রকিব সাহেব নাকি তার পিস্তলটা আপনাকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন শুনলাম?’
কথা না বলে মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল মামুন।
‘পিস্তলটা এখন কোথায়?’
‘আমার রুমে।’
‘কী!আপনার রুমে?’মাহফুজসহ রুমের সবাই অবাক হয়েছে।‘কিন্তু একটু আগে মিসেস রকিব বলে গেলেন পিস্তলটা নাকি আপনি হারিয়ে ফেলেছেন?’
‘হ্যাঁ,প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমার রুম থেকে পিস্তলটা গায়েব হয়ে যায়।কাল হঠাৎ দেখি আমার জানালার নীচে বাগানে পড়ে আছে পিস্তলটা।সম্ভবত পিস্তলটা পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দিয়েছিলাম তখনই পড়ে যায়।আমারও মনে ছিলনা। যখন পিস্তলটা হারিয়েছিল,তখন রুমের সব জায়গায় খুঁজলেও ওখানে খোঁজা হয়নি।কাল স্যার একটা কাজে বাগানে পাঠিয়েছিলেন,তখনই পিস্তলটা দেখতে পাই।’
‘কিন্তু মিসেস রকিব তো আমাদের বললেন না যে,আপনি পিস্তলটা পেয়েছেন?’
‘তিনি জানেননা।আমি যখন স্যারকে জানাই,তখন ম্যাডাম বাসায় ছিলেননা।ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।তবে পরে রকিব সাহেব বলে থাকতে পারেন,কিন্তু এখন আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে তিনি আসলেই জানেননা।’
‘পিস্তলটা একটু নিয়ে আসুন তো। ’
মামুন উঠে চলে গেল।একটু পরই একটা বক্সে করে পিস্তলটা নিয়ে ফিরল।
মাহফুজ পিস্তলটা নিয়ে ড.জাফরের হাতে তুলে দিলেন।ড.জাফর পিস্তলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।ব্যারেলটা নাকের কাছে ধরে বললেন,গত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পিস্তলটা থেকে গুলি চালানো হয়েছে।ব্যারেলে গান পাউডারের দাগ দেখা যাচ্ছে।বারুদের হালকা গন্ধও আছে।আমার ধারণা এটাই মার্ডার ওয়েপন।’
‘হুমম,তা মিষ্টার মামুন,আপনাকে পিস্তল পরিষ্কার করতে দেয়ার কী কারণ?অভিজ্ঞতা আছে নাকি আগের?’
কেমন ইতস্তত করতে লাগল মামুন। এতগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নীচু করে ফেলল।বলল,‘আমি একজন শুটার চ্যাম্পিয়ান। ’
‘আচ্ছা!’এমনভাবে কথাটা বলল মাহফুজ যেন কেসটা এইমাত্র সলভ করে ফেলেছে ও।‘আচ্ছা,আপনি যান।আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই আপাতত। ’
মামুন বেরিয়ে যেতেই মাহফুজ বলে উঠল,‘দোস্ত তোর সাথে থাকতে থাকতে আমারও মাথা খুলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কেসটা সলভ করতে পারব ভাবিনি।’
‘তাইনাকি?কি রকম?’মুচকি হেসে প্রশ্ন করল তারেক।
‘খুনটা বাড়ির লোকই করেছে,মানে এই মামুন ব্যাটাই খুনটা করেছে।লোকটা এমনিতেই শুটার চ্যাম্পিয়ান। তার পক্ষে গুলি চালানো খুব সহজ। নিশ্চই রকিব সাহেবের বেডরুমের মাস্টার কী-ও যোগার করেছিল। রাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলে রকিব সাহেবকে হত্যা করে সে। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় তার স্ত্রী টের পাননি,’ব্যাখ্যা দিল মাহফুজ।
‘কিন্তু বন্ধু তোমার ব্যাখ্যায় একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।সেক্ষেত্রে লোকটা মার্ডার ওয়েপন আমাদের হাতে তুলে দিল কেন?’
‘সহজ,যাতে আমরা তার পিস্তল হারানো এবং ফিরে পাবার গল্পটা বিশ্বাস করি।’
‘উল্টোটাই কিন্তু ঘটেছে।তুই তাকে অবিশ্বাস করছিস।সে যদি বলত পিস্তলটা এখনও নিখোঁজ,তাহলে সেটাই তার জন্য বেশি উপকারি ও বিশ্বাস্য হত।কারণ তার পিস্তল পাবার সাক্ষী এমন একজন যে আর এখন সাক্ষ্য দেবার অবস্থায় নেই,রকিব সাহেব।
তাছাড়া তোর কথা যদি মেনেও নেই,খুন মামুন করেছে,তাহলে পিস্তলটা এতক্ষণে পরিষ্কার করে ফেলত সে। খুন হবার পর থেকে লাশ আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত প্রায় চার ঘন্টা সময় পেয়েছে মামুন।সেক্ষেত্রে আমরা জানতেও পারতামনা এই পিস্তলটা দিয়ে গত চব্বিশ ঘন্টায় গুলি চালানো হয়েছে। ’
‘তাইতো,’মাহফুজকে চিন্তিত দেখালো। ‘তাহলে?’
‘তোর একটা কথা কিন্তু আংশিক ঠিক।রকিব সাহেবকে তার বাড়ির লোকই খুন করেছে।আমি এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করতে চাই,শুধু তার বাড়ির লোকই নয়,বরং তার ঘরের লোক।’
‘মানে তার স্ত্রী?!’ বিস্ময় প্রকাশ পেল মাহফুজের গলায়। ড.জাফরও বেশ অবাক হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ,একটি সুনিপুন প্ল্যান করেছিলেন তিনি।এবং এই প্ল্যানের অংশ হিসেবেই সপ্তাহ খানেক আগে পিস্তলটা মামুনের রুম থেকে চুরি করেন।এরপর গতকাল মামুনের জানালার নীচে বাগানের মধ্যে ফেলে রাখেন পিস্তলটা,যাতে করে মামুন সেটা খুঁজে পায়।’
‘কিন্তু তারেক,মামুন কিন্তু পিস্তলটা কাকতালীয়ভাবে খুঁজে পায়।রকিব সাহেব যদি তাকে না পাঠাতেন…’
‘উঁহু কাকতালীয় নয়,’ মাহফুজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল তারেক। ‘আমি নিশ্চিত,মিসেস রকিবই কাজের ছুতোয় স্বামীকে দিয়ে বলিয়ে মামুনকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন। এবং ওই সময়টাতে ইচ্ছে করেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন যাতে করে সবাই ভাবে তিনি পিস্তল পাবার ঘটনা জানেন না।আর এই না জানার ভাণ করে পিস্তল হারাবার গল্প আমাদেরকে বলে দিয়ে সব সন্দেহ মামুনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বেচারা শুটার চ্যাম্পিয়ান হওয়াতে সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।’
‘কিন্তু পিস্তলটা তো গতরাতে মামুনের কাছে ছিল,তাহলে সেটা দিয়ে মিসেস রকিব কিভাবে খুন করবে রকিব সাহেবকে?’
‘পিস্তল কি পৃথিবীতে একটাই?পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের মত কমন একটা পিস্তল যোগার করা মিসেস রকিবের মত ধনী মানুষদের পক্ষে কঠিন কিছুনা। আর রকিব সাহেবের পিস্তলটা বাগানে ফেলে রাখবার আগে তিনি সেটা দিয়ে একবার ফাঁকা গুলী করেছিলেন যার ফলে আমাদের ধারণা হয়েছে ওটাই আসলে মার্ডার ওয়েপন। কিন্তু আসল মার্ডার ওয়েপন হল একই ক্যালিবারের আরেকটি পিস্তল। খুবই চতুর মহিলা।’
‘হুমম,সেটা তো দেখাই যাচ্ছে।কিন্তু এতক্ষণ যা বললি তা প্রমাণ করতে পারবি?’
‘হ্যাঁ পারব। মিসেস রকিব তখন বলেছিলেন আততায়ী সাইলেন্সার ব্যাবহার করায় তিনি কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু সাইলেন্সার লাগালে যে একেবারেই শব্দ হয়না তা তো না।হালকা একটা শব্দ হয়ই যেটা,দশ বারো ফুট দুর থেকে অনায়াসেই শোনা যায়।’
‘সেটা ঠিক আছে,কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন একজন মানুষের পক্ষে সেটা না শোনাই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু মানুষটার যদি অনিদ্রা রোগ থাকে?’
‘অনিদ্রা রোগ?’
‘হ্যাঁ।মিসেস রকিবের ইনসমনিয়া আছে।গতকাল ডাক্তারের কাছেও তিনি এজন্যই গিয়েছিলেন। তাকে একটা ঘুমের অষুধ পেসক্রাইব করা হয়।কিন্তু রাতে জেগে থাকবার জন্য অষুধটা তিনি গতরাতে খাননি।বোতলের সিলটা এখনো অক্ষত আছে।এটা একটা ভাল প্রমাণ হতে পারে কোর্টে। এছাড়া সত্যিকারের মার্ডার ওয়েপনটা আমার ধারণা,খুঁজলে এবাড়িতেই পাওয়া যাবে।কারণ খুন করার পর থেকে মিসেস রকিব বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ পাননি।তাহলে বাড়ির কাজের লোকজন তাকেই সন্দেহ করে বসত।’
‘কিন্তু মোটিভ?কী উদ্দেশ্যে খুনটা করলেন তিনি?সম্পত্তির লোভ?’
‘সেটা বের করার দায়িত্ব তোদের।আমি আমার কাজ করেছি।খুনীকে ধরিয়ে দিয়েছি।আমি আসলে দোতলায় থাকতে ওষুধের বোতলটা দেখেই বুঝে ফেলি আসলে কে খুনী। কিন্তু পুলিশের কাজে বাধা দিতে চাইনি বলেই এতক্ষন কিছু বলিনি।
ওই অষুধের বোতলটাই মিসেস রকিবের সুনিপুন প্ল্যানের একমাত্র ভুল।অবশ্য তাকেও দোষ দেয়া যায়না। প্রফেশনাল ক্রিমিনালরাই এরচাইতে বড় ভুল করে বসে।
আসলে প্রত্যেক অপরাধীর মন ছোট হয় তো যার ফলে প্রত্যেকেই ভুল করে থাকে। সেই ভুলটা খুঁজে বের করতে পারলেই অপরাধী ধরা পড়তে বাধ্য।’
Published on October 05, 2013 21:47
কল্পবিলাস
প্রথমদিনই আমার সম্ভাব্য রুমমেটকে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।উসকো খুসকো চুল, চোখদুটো লাল হয়ে থাকে সারাক্ষণ। চোখ লাল হয়ে থাকবার কারণটা অবশ্য আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। খোঁচাখোঁচা দাড়িতে অনেক ছেলেকে ভাল দেখালেও শুভকে দেখাত বন্য বন্য।প্রথম দেখাতেই ধারনা হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা নেশাখোর।মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় পড়তে এসে একজন নেশাখোরকে রুমমেট হিসেবে পাওয়া সুখকর কিছুনা। ছাত্র রাজনীতির নোংরামোতে না জড়ানোয় হোস্টেলে সিট পাইনি। আমি তখন প্রায় দিশেহারা। একা একটা রুম নিয়ে থাকব সে আর্থিক সঙ্গতিও আমার ছিলনা। আমার এক দুসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়িতে সাতদিনের জন্য উঠেছি।ঢাকায় ওই দুসম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া পরিচিত আর কেউই নেই আমার।এক একটা দিন কমছে আর সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে আমার দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে। এমনসময় এক বন্ধু শুভর খোঁজ দিল।সুমন জানালো শুভ নামে একটা ছেলে একরুমের একটা মেসে থাকে।মেস না বলে একরুমের একটা বাসাও বলা চলে।বাথরুম, কিচেন, ব্যালকনি সবই আছে। দুজন মানুষ অনায়াসেই থাকতে পারবে।একমাত্র বেডরুমটাও বেশ বড়।শুভ একাই থাকে ওখানে। একদিন সুমন বলল, 'চল, শুভকে বলে দেখি রুম শেয়ার করতে রাজি হয় কিনা।হবেনা বোধহয়।বড়লোকের ছেলেতো, সামান্য টাকা বাঁচাবার জন্য খাল কেটে কুমির আনবে বলে মনে হয়না! ' 'কি বললি? আমাকে কি কুমিরের মত দেখা যায়? ' সুমন আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, 'ওইতো শুভ বসে আছে। চল গিয়ে কথা বলি। ' আমি সুমনের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম ক্যাম্পাসের মাঠে রোদের মধ্যে একটা ছেলে বসে আছে।স্রেফ বসে আছে।চোখে কেমন উদভ্রান্তের দৃষ্টি। আমি আর সুমন গিয়ে ওর পাশে বসলাম। 'কেমন আছ শুভ? ' 'ভাল, 'আমাদের দিকে না তাকিয়েই বলল অদ্ভুত ছেলেটা।তখনই আমি ধরে নেই এই ছেলে নির্ঘাত নেশা করে।বড়লোকের ছেলে,করতেই পারে। সুমন আমার ব্যাপারে সব খুলে বলল শুভকে।আমি মোটামুটি নিশ্চিত শুভ রাজি হবেনা। কেন হবে?উটকো একজন এসে রাজত্ব দখল করবে এটা মেনে নেয়ার কোনো কারণই নেই।তারওপর ছেলেটা করে নেশা।আমি থাকলে সমস্যা তো কিছু হবেই। সুমনের কথা শেষ হতে এই প্রথমবারের মত আমার দিকে মনোযোগ দিল শুভ।এমনভাবে আমার আপাদমস্তক দেখতে লাগল যেন তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে আমার একেবারে ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নেবে। আমি চুপ করে রইলাম।আমাকে এবং সুমনকে অবাক করে দিয়ে শুভ বলল, 'কবে উঠতে চাও? ' আমি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।এরপর তড়িঘড়ি করে জবাব দিলাম, 'সমস্যা না হলে আজই।'শুভকে আসলে আমার কি সম্বোধন করা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছিলামনা,তাই ভাববাচ্যে কথাটা বললাম। 'ওকে, মালপত্র নিয়ে সন্ধ্যায় উঠে পড়ো।আমি সন্ধ্যায় নাও থাকতে পারি। এই নাও চাবি। ' আমি পুরোপুরিই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, ছেলেটা নেশা করে। কালরাতে বোধহয় "মালটা "একটু বেশিই টেনে ফেলেছে। হ্যাংওভার কাটেনি এখনো। টাকা পয়সা কত কি দিতে হবে, ওর সাথে থাকতে হলে কি কি নিয়ম মানতে হবে,এসব কিচ্ছুনা।অপরিচিত একটা ছেলের হাতে নিজের ঘরের চাবি তুলে দিল? আজব তো ছেলেটা! তবে কথা না বাড়িয়ে চাবিটা হাতে নিলাম।সেদিনই আমার যৎসামান্য জিনিসপত্র নিয়ে উঠে গেলাম শুভর বাসায়।শুভ ওর কথামত গায়েব। উত্তেজনার প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যেতেই মনে হল, কাজটা কি ঠিক হল? একটা নেশাখোরের সাথে একছাদের নীচে থাকা কোনো কাজের কথা না। তবে আমার আশংকা কিছুদিনের মধ্যেই অমূলক প্রমাণিত হল।খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম শুভ খুবই মেধাবী এবং ওর ডিপার্টমেন্টের সেরা ছাত্র।নেশা তো দুরের কথা, সিগারেট পর্যন্ত খায়না। আর চেহারা সুরত এমন উদভ্রান্তের মত হয়ে থাকবার কারণটা অন্য,শুভ রাতে ঘুমায়না।কেন ঘুমায় না সে ব্যাপারে পরে আসছি। মানুষ হিসেবেও খুব ভাল ছেলেটা।কারও সাতে পাঁচে নেই। ও কেমন ভাল, সেটা বুঝতে পারলাম একমাস পর যখন বাসার ভাড়া বাবদ কিছু টাকা ওর হাতে দিতে গেলাম। 'কিসের টাকা এটা? ' 'ইয়ে মানে . . .বাসা ভাড়া। ' 'বাসা ভাড়া মানে? আমি কি বাড়িওয়ালা নাকি? ' আমি ভাবলাম, টাকার পরিমাণ বোধহয় কম হয়ে গেছে। মুখ কাচুমাচু করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম তার আগেই শুভ বলে উঠল, 'দেখো, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে বলে আমার সাথে থাকতে বলেছি, ভাড়া দেইনি,আন্ডারস্ট্যান্ড? ' আমি বললাম, 'কেন? ' 'কী কেন? ' 'আমাকে ভাল লাগার কারণ কি তোমার? ' 'সেটা তো কখনো ভেবে দেখিনি। যদি ভাবতে বলো, তাহলে আরো অনেক কিছুই ভেবে দেখতে হবে।অঝোর বৃষ্টি কেন ভাল লাগে, বিশাল আকাশে মেঘের লুকোচুরি দেখলে কেন বুকটা দুলে ওঠে, পাখির রংয়ে কেন মুগ্ধ হই,ইত্যাদি ইত্যাদি।এত ভাবার সময় আছে? ' আমি সেদিন আর কোনো কথা বলিনি। এর কিছুদিন পর শুভ সম্পর্কে নতুন একটা তথ্য জানা গেল। শুভ নাকি অসাধারণ কবিতা লেখে।মানে লিখত আরকি।কি এক অজ্ঞাত কারণে এখন আর লিখতে দেখা যায়না ওকে। আমার এই বিশাল হৃদয়ের অধিকারী রহস্যময় বন্ধুর সাথে ভালই দিন কেটে যাচ্ছিল। উঁহু ভুল বললাম, ভালই না, অসাধারণ কেটে যাচ্ছিল।এক বুয়া এসে রান্নাবান্না আর ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়।আমি অবসর সময়টুকু বই পড়ে কাটিয়ে দেই।খাওয়া ঘুম আর পড়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই।আমাকে বিরক্ত করার মতও কেউ নেই।শুভ খুবই চাপা স্বভাবের ছেলে। প্রায় দুমাস হতে চলল ওর সাথে আছি, এখন পর্যন্ত ওর পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনা।এমনিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে টুকটাক কথা হলেও ওর পারিবারিক বিষয় উঠলেই একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে নিত। তবে আমারও খুব বেশি সমস্যা হচ্ছিল না।ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও অন্তর্মুখী।বই পড়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। বলা যেতে পারে আমি না, শুভই আমার সাথে থাকতে এসেছে! সারাদিন বাইরে বাইরেই থাকত। শুধু রাতে আসত ঘুমাতে। আরেকটা ভুল বলে ফেললাম।শুভ রাতে ঘুমাতে নয়, ফোনে কথা বলতে আসত। হুমম্,সারারাত চাপা স্বরে কথা বলত কার সাথে যেন।কথা শুনে অবশ্য ফোনের ওপাশের মানুষটার সাথে ওর সম্পর্ক খানিকটা আঁচ করা যেত। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে যেত আমার।অন্যায় জেনেও কান পাততাম।শুনতে শুনতে হঠাৎ হঠাৎ বুকের কোথাও চিন চিন করে উঠত। শুভ ফোনের সাউন্ড একেবারেই কমিয়ে কথা বলত।রাতের নিস্তব্ধতাও কখনো ভেঙে পড়তনা ওপাশের রিনঝিন হাসির শব্দে।আমি অবশ্য ওপাশের মানুষটার কথা শুনতে তেমন আগ্রহী ছিলামনা।শুভর মৃদুগলায় বলা কথাগুলো শুনতেই ভাল লাগত।আমি শুভর কথা শুনে শুনে ওপাশের কথাগুলো কল্পনা করে নিতাম।এ যেন এক মজার খেলা। খেলাটার নমুনা দেয়া যাক। শুভ প্রতিদিন ফোন ধরেই বলত, 'ওয়ালাইকুম আসসালাম। ' আমি বুঝতাম মেয়েটা ওপাশ থেকে সালাম দিয়েছে। সালামের উত্তর দিয়ে শুভ বলত, 'কেমন আছ? ' ওপাশঃ 'ভাল, তুমি? ' শুভঃ 'ভাল।রাতে খেয়েছে? ' ওপাশঃ'হুমম।তুমি খেয়েছ? ' শুভঃ 'হুমম। ' ওপাশঃ'কী দিয়ে খেলে? ' শুভঃ'ব্যাচেলর মানুষ আর কি দিয়ে খাবে? ' ওপাশঃ 'মানে? ' শুভঃ 'একটা বউ থাকলে তো ভালমন্দ রেঁধে খাওয়াত। ' এরপর ওদের খুনসুটি শুরু হয়ে যেত।আমি কখনো শুনতাম, কখোনো শুনতামনা। মাঝমধ্যে কোনো এক রসিকতায় হেসে উঠত দুজনেই। আমি শুধু শুভর উচ্ছল হাসি শুনতে পেতাম।আর ওপাশেরটা আমাকে কল্পনা করে নিতে হত। কখনো কখোনো ঘটত সম্পুর্ন বিপরীত ঘটনা।মাঝরাতে উঠে আমি কাঁদতে দেখতাম শুভকে।ছোটবাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত।জানিনা কেন, তখন আমার বুকটাও দুমড়ে যেতে চাইত। আবার কখনো একেবারেই নীরব হয়ে যেত শুভ।ওর গভীর শ্বাস প্রশ্বাস দেখে ধারণা করতাম ওপাশের কণ্ঠটাও এ মূহুর্তে স্তব্ধ।একজনের গভীর নিশ্বাস ইথারে ভেসে চলে যাচ্ছে আরেকজনের কাছে। সেই সময়টাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ঘুমানোর আয়োজন করতাম। কখনো বা আবার ওদের কথা চলে যেত চুড়ান্ত রোমান্টিকতার দিকে। আমি তখন কানে বালিশ চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শুতাম! শুভ কখনোই এববিষয় নিয়ে আমার সাথে কথা বলেনি আর আমিও কখনো এবিষয়ে ওকে কিছু বলিনি। হয়ত ভয় কাজ করত, ওকে জানালে আমার "কল্পবিলাস " খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। ও ভাল কথা, আমি এই খেলাটার একটা নামও দিয়েছি, "কল্পবিলাস "। আমি আমার পড়াশোনা, বই পড়া আর "কল্পবিলাস "খেলা নিয়ে ভালই কাটিয়ে দিচ্ছি সময়। *** সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার।বর্ষণ হবার জন্য মুখিয়ে আছে। এমন মেঘলা দিনে আমার মত ঘরকুঁনো মানুষের জন্য কাঁথার নীচে শুয়ে শুয়ে ভুতের গল্প পড়ার মত আনন্দ আর কিছুই হতে পারেনা। তবে এই আনন্দ বিসর্জন দিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে হল।আজ খুবই গুরুতপূর্ণ একটা ক্লাস আছে। সামনেই পরীক্ষা,এ অবস্থায় ক্লাসটা মিস করা কিছুতেই উচিৎ হবেনা। ক্লাস শেষ করে বের হতেই শুরু হল এতক্ষণ ধরে থমকে থাকা আকাশের বর্ষণ।তুমুল বৃষ্টি, সঙ্গে ঝড়ো বাতাস মনে করিয়ে দিল, সময়টা বৈশাখ! বছরের প্রথম কালবৈশাখী। বিকেলের দিকে বৃষ্টির দমক খানিকটা কমল। আমি ভার্সিটি থেকে বের হব এমন সময় মনে পড়ল আমাদের বুয়াটা দেশের বাড়ি গেছে।গত দুদিন ধরে বাইরে থেকে খাবার আনতে হচ্ছে।দুপুর তো কোনমতে কেটে গেল, রাতের ব্যবস্থাটা করতে হবে। শুভকে ফোন দিয়ে জানা দরকার খাবারের ব্যবস্থা কি ওই করবে নাকি আমি নিয়ে যাব। ফোন দিচ্ছি, সুইচড অফ। প্রায় দশবারো বার ফোন দিয়েও একই অবস্থা।বাসার দিকে যেতে যেতে ভাবলাম, খাবার নিয়েই যাই। বাঁচলে কাল সকালে ব্যবস্থা করা যাবে। বাসায় গিয়ে দেখি শুভ রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে।কারেন্ট নেই। 'কি ব্যাপার, তোমার ফোন বন্ধ কেন? 'বললাম আমি। 'ফোনে চার্জ নেই। ' 'কারেন্ট গেছে কখন? ' 'বিকেলে। লাইনে কি একটা সমস্যা হয়েছে, আজ রাতে কারেন্ট নাও আসতে পারে।' 'সর্বনাশ! ' আমি আর কথা না বাড়িয়ে রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। শীতল পরিবেশ শুতে না শুতেই ঘুম পাড়িয়ে দিল। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার।দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। পাশের খাট থেকে শুভর গলা শুনতে পেলাম।ওপাশের কন্ঠটার সাথে কথা কি নিয়ে যেন কথা বলছে।মনে হচ্ছে বৃষ্টি বিষয়ক আলোচনা চলছে। আমি আমার "কল্পবিলাস"খেলা শুরু করতে যাব এমনসময় বুকটা কেঁপে উঠল ভয়ঙ্করভাবে।মাথাটা ঝিমঝিম করে লাগল।বিদ্যুৎ চমকের মত একটা কথা মনে পড়ে গেছে আমার। চারপাশটা এখনও অন্ধকার। তারমানে কারেন্ট এখনো আসেনি।তাহলে শুভ কথা বলছে কিভাবে? ওর মোবাইলটা না চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে? আমি সন্তর্পনে আমার ফোনটা হাতে নিলাম।কাঁথার নীচ থেকেই ডায়াল করলাম শুভর নাম্বারে। নারী কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল স্পীকার থেকে, 'দুঃখিত, এই মূহুর্তে আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা. . . পরিশিষ্টঃ এঘটনার পর আমি শুভর পুরনো বন্ধু বান্ধবদের খুঁজে বের করি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি,একটা মেয়েকে ভালবাসত শুভ। প্রতিদিন রাতে কথা হত ওদের দুজনের। গত একবছর আগে মেয়েটার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শুভর। এরপর থেকেই মানসিক বৈকল্য দেখা দেয় ওর মধ্যে। এমনিতে সবসময় স্বাভাবিক থাকলেও রাতের বেলায় ওর অডিটরি হ্যালুসিনেশন হতে লাগল।সারারাত কাল্পনিক কোনো একজনের সাথে কথা বলত।খেলত "কল্পবিলাস"। তবে বহু চেষ্টা করেও জানতে পারিনি সেই মেয়েটার পরিচয় কী। কেনই বা যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল ওদের মধ্যে। হতে পারে মেয়েটা এখন অন্য কারো "কল্পবিলাসী "। কিংবা সে এখন এমন এক জগতের বাসিন্দা যেখান থেকে যোগাযোগের একটাই উপায়,"কল্পবিলাস "।
Published on October 05, 2013 21:22
শেষ হাসি
উদভ্রান্তের মত বসে আছি নিজের অফিসে।চোখে কেমন যেন অন্ধকার দেখছি।এটা অবশ্য অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।গত কয়েকদিন ধরে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করা হয়ে যাচ্ছে।ড্রিঙ্ক করার পর সাময়িক একটা মানসিক স্থিরতা লাভ হয়।ওটার লোভেই পেগের পর পেগ মদ গিলছি ইদানীং।মানসিক শান্তি এখন আমার খুব বেশি প্রয়োজন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাবার্ড থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করলাম।বিদেশী জিনিষ।মাঝে মধ্যেই বিদেশী ক্লায়েন্টরা আসে।তাদের আপ্যায়ন করতে প্রয়োজন হয়।আমি সাধারনত এখান থেকে খাইনা,তবে অফিসে আর কোনো বোতল না থাকায় এখানে হাত দিতে হল।
বোতলটা নিয়ে আমার চেয়ারে চলে এলাম।গ্লাসে ঢালতে ইচ্ছে করছেনা।ছিপি খুলে সরাসরিই গলায় ঢাললাম তরল আগুন।পুড়তে পুড়তে পাকস্থলিতে নেমে গেল তরল বস্তুটা।অস্থির ভাব কিছুটা কমল।
ঘোলাটে চোখে আমার সেল ফোনটার দিকে তাকালাম।ওটাকে আমার কাছে জলজ্যান্ত একটা আপদ মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।উপায় থাকলে চারতলা অফিস থেকে নীচে ফেলে দিতাম।গত কয়েকদিন ধরে আমাকে একের পর এক খারাপ সংবাদই শুধু দিয়ে যাচ্ছে হতচ্ছাড়া ফোনটা।
এই তো একটু আগেই খবর পেলাম তিনকোটি টাকার যে অর্ডারটা প্রায় আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল সেটা আমাদের চির প্রতিদ্বন্দী রয়েল গ্রুপ হাতিয়ে নিয়েছে।
আমি আর আমার প্রিয় বন্ধু নাসের মিলে আমাদের এই বিশাল গারমেন্টসের ব্যবসাটা প্রায় চার বছরের পরিশ্রমে দাঁড় করিয়েছি।শুরু থেকেই আমাদের প্রতিদ্বন্দী রয়েল গ্রুপ।ওদের অনেক রকম ব্যবসা থাকলেও গারমেন্টসই হল মূল ব্যবসা।রয়েল গ্রুপের কর্ণধার কামাল শেখ খুবই ধূর্ত প্রকৃতির হলেও গারমেন্টস সেক্টরে আমাদের সাথে কখনোই কুলিয়ে উঠতে পারেনি।কিন্তু গত এক বছর ধরে একের পর এক অর্ডার আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে ওরা।আমরা যে ডিলই শুরু করতে যাইনা কেন কিভাবে যেন আগে ভাগেই সেটার খবর পেয়ে যায় কামাল শেখ।এরপর ওরা পার্টিকে আমাদের চাইতে কম খরচে একই প্রোডাক্ট দেয়ার অফার দেয়।বলাই বাহুল্য অর্ডারটা পেয়ে যায় রয়েল গ্রুপ।
আমরা যত কম অফার করি ওরা তার চাইতে কম অফার করে।প্রচুর অর্ডার থাকায় লাভও হয় ওদের।
আর আমাদের?গত একবছর ধরে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে আমাদের কোম্পানী।এভাবে কিছুদিন চললে ব্যবসাপাতি লাটে উঠবে।শেষ ভরসা ছিল নরওয়ের তিনকোটি টাকার এই ডিলটা।এটা পেলে আমরা আবার ঘুরে দাড়াতে পারতাম।কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল,এটাও আমাদের হাতছাড়া।
পর পর তিন পেগ হুইস্কি গলায় ঢাললাম।মাথা কিছুটা কাজ করছে।খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম উত্তেজিত হয়ে কিছু করা যাবেনা।যা করার ভেবে চিন্তে করতে হবে।যদিও এই মুহূর্তে আমার মাথায় কোনো আইডিয়া নেই এরপরও সিদ্ধান্তটা নেবার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
আমার বন্ধু এবং পার্টনার নাসের তিনদিন আগে চিটাগং গিয়েছে ব্যবসায়িক একটা কাজে।কাল চলে আসবে।ও এলে ওর সাথে একটা পরামর্শ করে সামনে এগোতে হবে।দেখা যাক দু বন্ধু মিলে চেষ্টা করে আবার ঘুরে দাড়াতে পারি কিনা।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।বিশাল জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছি।রাত গভীর হয়েছে।পুরো চারতলা বিল্ডিংটাতে শুধু আমার রুমেই আলো জ্বলছে।গারমেন্টসে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে।সেজন্য ওভারটাইমেরও বালাই নেই।সবাই চলে গেছে সন্ধ্যা হতে না হতেই।শুধু রয়ে গেছি আমি একা।বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা।অবশ্য আকর্ষণ করার মত কোনো কিছু আমার বাসায় নেইও।এখনো বিয়ে করিনি আমি।নাসেরও না।প্ল্যান করেছিলাম এ বছরই দুবন্ধুতে একসাথে বিয়ে করব।কিন্তু ব্যবসার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছেনা সহসা বিয়ে আমার ভাগ্যে আছে।
হঠাত রিংটোনের শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গল।ফোনটা বাজছে।আমি এগিয়ে গিয়ে ফোন তুলে নিলাম।অপরিচিত নাম্বার।আবার কোন দুঃসংবাদ কে জানে!ফোনটা রিসিভ করলাম।আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে নাসের বলল,‘দোস্ত তুই এখন কোথায়?’ওর গলায় বেশ উত্তেজনা টের পাচ্ছি।কারনটা অবশ্য জানা নেই।
‘অফিসে।কেন,তুই কোথায়?এটা কার নাম্বার?’
‘নাম্বার বাদ দে।আমি সন্ধ্যার সময় ঢাকা এসেছি।আসার কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম দুঃসংবাদটা।’
‘তোর না কাল আসার কথা?’
‘কাজ শেষ হয়ে গেল।শোন,একটা সু খবর আছে।তুই কোথাও যাসনা।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।আমার সাথে কামাল শেখও আসবে।’
আমি যারপরনাই বিষ্মিত হলাম।এত রাতে নাসের অফিসে আসছে আমাদের চির শত্রু কামাল শেখকে সাথে নিয়ে?‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।এখন বাজে রাত সাড়ে বারটা।এত রাতে কামালকে নিয়ে এখানে কি রাজ্য উদ্ধার করতে আসবি?’
‘ঠিকই বলেছিস,রাজ্য উদ্ধার করতেই আসছি।কামালকে আমি রাজি করিয়েছি আসার জন্য।ও অলরেডি রওনা হয়েও গেছে ওর অফিস থেকে।ওর সাথে আমাদের একটা চুক্তি হবে আজ।’
‘কী ধরনের চুক্তি?’আমি জানতে চাইলাম।
‘আচ্ছা সংক্ষেপে বলছি।দেখ,আমরা যে ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করি সেটা আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।সেগুলোও তেমন মান সম্মত না।সুতরাং ধরতে গেলে আমরা এবং রয়েল গ্রুপই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দী।এখন আমরা যদি একটা সমঝোতায় আসি যে আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে সমস্ত অর্ডার ভাগাভাগি করে নেব,তাহলেই কিন্তু আমরা এখন যেমন একজন আরেকজনকে টেক্কা দিতে গিয়ে কম মুনাফা পাচ্ছি সেটা কাটিয়ে উঠতে পারব।তখন চাইলেই বেশি দাম হাকতে পারব আমাদের ক্লায়েনটদের কাছে।অনেকটা সিন্ডিকেটের মত?’
‘বুদ্ধিটা তো খুবই ভাল,কিন্তু কামাল রাজি হবে?’
‘সে জন্যই তো ওকে আসতে বলেছি।আমরা দুজন মিলে রাজি করাব ওকে।আর রাজি না হবার তো কোনও কারণ নেই।চুক্তি হলে এখন যে মুনাফা পাচ্ছে সে একই মুনাফা এর চাইতে কম প্রোডাক্টে পাবে ওরা।’
মানতেই হচ্ছে নাসের খুব ভাল একটা বুদ্ধি করেছে।আমি মনে মনে অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠলাম।বললাম,‘ওকে,তাহলে কামালকে নিয়ে চলে আয়,আমি আছি।’
‘আচ্ছা শোন,আমরা অফিসে আসছি এটা যেন কেউ না জানে।তুই নাইট গার্ডকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আধঘন্টার জন্য কোথাও পাঠিয়ে দে।’
‘কেন?জানলে কী সমস্যা?’
‘আরে বুদ্ধু,চুক্তির ব্যাপার গোপণ রাখতে হবে।আমরা আর রয়েল গ্রুপ সেই “চিরপ্রতিদ্বন্দী”র ভূমিকাই পালন করে যাব।নয়ত চুক্তির ব্যাপার জানাজানি হলে আমরা বেশি দাম চাইতে পারবনা।এই সুযোগে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
আমি নাসেরের বুদ্ধিতে সত্যিই অভিভুত হয়ে গেলাম।‘বুঝতে পেরেছি।তুই চিন্তা করিসনা,আমি গার্ডকে কিছুক্ষনের জন্য সরিয়ে দিচ্ছি গেট থেকে।তোর কাছে চাবি তো আছেই,গেট খুলে চলে আসিস।’
নাসের সম্মতি জানাতে আমি ফোন রেখে দিলাম।এরপর গার্ডকে ফোন করে বলে দিলাম ও যেন ঘন্টা খানেকের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসে।গার্ডটা অনেকদিন ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠানে আছে।কোনো রকম উচ্চবাচ্য না করেই সায় জানাল।
প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হতেই শরীর জুড়ে কেমন একটা স্বস্তির ধারা বয়ে গেল।কামালের সাথে চুক্তিটা হয়ে গেলে আমাদের ব্যবসাটা আবার চাঙ্গা হয়ে যাবে।আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
দশ মিনিট যেতে না যেতেই অফিসের দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম।চারতলা পুরোটা জুড়েই আমাদের কর্পোরেট অফিস।নাসেরের রুম আমার পাশেই।
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আমি আমার কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম।করিডর ধরে নাসের আর কামালকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।নাসেরের বয়স আমার মতই ত্রিশ বত্রিশ হবে।কামাল শেখ খানিকটা বয়স্ক।চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মত।ঝানু ব্যাবসায়ী।রয়েল গ্রুপ পুরোটা বলতে গেলে সে একাই চালায়।কামাল শেখ না থাকলে রয়েল গ্রুপের পুরো সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়বে অল্পদিনেই।
ওরা এসে আমার সামনে দাড়াতে আমি কামাল শেখের সাথে কুশল বিনিময় করে আমার রুমে নিয়ে গেলাম ওদের।
হুইস্কির বোতল এখনো অর্ধেকটা ভরা।তিনটে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দুটো বাড়িয়ে দিলাম কামাল আর নাসেরের দিকে।ওরা দুজন বসেছে আমার টেবিলের সামনের দুটো চেয়ারে।কামাল হাতে একটা গ্লাস তুলে নিল।নাসেরও বাকি গ্লাসটা তুলে উঠে দাড়াল।আমি ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতে ও বলল,‘তোরা আলোচনা শুরু কর আমি এখানেই আছি।’
নাসের গ্লাসটা নিয়ে আমার পেছনে চলে এল।জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে।আমি দেরী না করে কাজের কথা পাড়লাম,‘তা মি.কামাল,নাসের বোধহয় আপনাকে সব বলেছে?’
আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই কামাল শেখের মাথা প্রচন্ডভাবে ঝাকি খেল।তবে সেটা আমার কথার সম্মতিতে নয়,বুকে গুলি খেয়ে!
আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম।চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কামাল শেখের ধবধবে সাদা শার্টটা গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করছে আস্তে আস্তে।ক্ষত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে।
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি নাসের একটা পিস্তল বাড়িয়ে ধরেছে।ব্যারেল থেকে এখনো হালকা হালকা ধোঁয়া উড়ছে।তবে পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো থাকায় প্রায় নিঃশব্দে গুলি বের হয়েছে।
আমি ঝট করে উঠে দাড়ালাম।নাসেরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,‘তুই এটা কী করলি?মাথা ঠিক আছে তোর?’আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু কথা খুঁজে পেলামনা।
নাসের হুইস্কির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে নির্বিকার স্বরে বলল,‘মাথা ঠান্ডা করে বোস,বলছি সব।’
প্রচন্ড উত্তেজিত হলেও সেটাকে সামলে নিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে নাসেরের মুখোমুখি বসলাম।অজান্তেই একবার কামাল শেখের দিকে চোখ চলে গেল।বেচারা সরাসরি হৃৎপিণ্ডে গুলি খেয়েছে।সাথে সাথে মৃত্যু হয়েছে।
নাসের সেই আগের মত নির্লিপ্ত গলায় বলতে লাগল,‘দোস্ত,পুরো ব্যাপারটাই একটা প্ল্যান।আমিই আমাদের সমস্ত ডিলের খবর পরিচয় গোপণ রেখে কামাল শেখকে জানিয়ে দিতাম।ফলে রয়েল গ্রুপ আমাদের চাইতে লোভনীয় অফার দিয়ে ডিলটা হাতিয়ে নিত বরাবর।’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।পাগলটা বলে কী!‘নিজের পায়ে কুড়াল মেরে তোর কী লাভ হল?’
‘লাভ তো অবশ্যই হয়েছে।লাভ ছাড়া কেউ কিছু করে নাকি?লাভটা হল এখন সবাই জানে আমরা আর রয়েল গ্রুপ পরস্পরের শত্রু।’
আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা।চুপ করে থাকলাম।দেখি উন্মাদটা আর কী কী বলে।
নাসের বলতে লাগল,‘কামাল শেখ মারা যাওয়াতে রয়েল গ্রুপ শীঘ্রই পটল তুলবে।আর এর ফায়দা উঠাবো আমি।
‘রয়েল গ্রুপ পটল তুলবে আর আমরা খুব বাঁচা বেঁচে যাব তাইনা?’
‘উহু,আমরা না,শুধু আমি।তুইও কিছুক্ষনের মধ্যে পটল তুলতে যাচ্ছিস।’অবলীলায় ভয়ঙ্কর কথাটা বলেই উন্মাদের মত হেসে উঠল নাসের।‘কাল পুলিশ এসে দেখবে এই রুমে দুটো লাশ পড়ে আছে।দুজনের হাতেই দুটো পিস্তল।তার উপর এরা হল পরস্পরের জাতশত্রু।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে নিশ্চয়ই দেরী করবেনা পুলিশ?ওরা ধরে নেবে ব্যবসায়িক দ্বন্দের কারণে একজন আরেকজনকে খুন করেছে।’
আমার হঠাত করেই প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়ে গেল।স্পষ্ট বুঝতে পারছি নাসের যা বলছে ও তা করবেই।মরিয়া হয়ে বললাম,‘তুই বেঁচে যাবি সেটা ভাবছিস কেন?পুলিশ আমার পার্টনার হিসেবে তোকে সন্দেহ করবেনা?’
‘কেন করবে বন্ধু?সবাই জানে আমি এখনো চিটাগং।আমার ঢাকা আসার কথা কেউ জানেনা।তোকে আর কামালকে যে নাম্বার দিয়ে ফোন দিয়েছি ওটাও আমার না।আমি আজ রাতেই আবার চিটাগং ফিরে যাব।এরপর কাল আমার প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে হা পিত্যেশ করতে করতে ছুটে আসব,হা হা হা!’ আবার সেই উন্মাদের হাসি হাসল নাসের।
কোনোও ফাঁকই রাখেনি উন্মাদটা।মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে একটা।বললাম,‘এসব কেন করলি তুই?’
‘এখনো বুঝতে পারিসনি?আমাদের ব্যবসার শুরুতে কী চুক্তি হয়েছিল মনে আছে?একজন মারা গেলে অপরজন সমস্ত ব্যবসার মালিক হয়ে যাবে।এখন তোর অবর্তমানে পুরো ব্যবসাটার মালিক হব আমি।এদিকে রয়েল গ্রুপ আমার পথে বাগড়া না দেয়ায় খুব শীঘ্রই দেশের অন্যতম বিজনেস টাইকুনের নাম হতে যাচ্ছে নাসের আহমেদ।’হাতের হুইস্কির গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নাসের।
পুরো ব্যাপারটা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা।আমার প্রিয় বন্ধু স্রেফ টাকার লোভে এতটা নীচে নামতে পারে বলে আমার ধারণাও ছিলনা।আমি নাসেরের পিস্তলের মুখে বিমুঢ়ের মত বসে রইলাম।
‘দোস্ত তোকে তো আর সময় দেয়া যাচ্ছেনা,’বলেই পকেট থেকে আরেকটা পিস্তল বের করল।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম।আঘাতের প্রচন্ডতায় চেয়ার উলটে পড়ার দশা হল।দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।এরই মাঝে দেখতে পাচ্ছি নাসের কামালের হাতে একটা পিস্তল গুজে দিচ্ছে।আরেকটা আমার হাতে তুলে দিলেই ওর কাজ শেষ।আমার সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করে শেষ হাসি হাসবে ও।
বুঝতে পারছি আমি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মারা যাচ্ছি।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মনে পড়ে গেল।
আমি আগেই ধারণা করতে পেরেছিলাম আমাদের ভেতরের কেউই রয়েল গ্রুপের কাছে তথ্য পাচার করছে।সেজন্য মাত্র গতকালই আমাদের কর্পোরেট অফিসের প্রতিটা কামরায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি!নাসের চিটাগং থাকায় ওকে জানানো হয়নি ক্যামেরার কথা।
এতক্ষন ধরে পুরো ঘটনাটা রেকর্ড হয়ে গেছে।কাল নিশ্চয়ই পুলিশ ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে দেখবে।আর তাহলেই......নাহ,শেষ হাসি তাহলে আমিই হাসলাম!
আমি উঠে দাঁড়িয়ে কাবার্ড থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করলাম।বিদেশী জিনিষ।মাঝে মধ্যেই বিদেশী ক্লায়েন্টরা আসে।তাদের আপ্যায়ন করতে প্রয়োজন হয়।আমি সাধারনত এখান থেকে খাইনা,তবে অফিসে আর কোনো বোতল না থাকায় এখানে হাত দিতে হল।
বোতলটা নিয়ে আমার চেয়ারে চলে এলাম।গ্লাসে ঢালতে ইচ্ছে করছেনা।ছিপি খুলে সরাসরিই গলায় ঢাললাম তরল আগুন।পুড়তে পুড়তে পাকস্থলিতে নেমে গেল তরল বস্তুটা।অস্থির ভাব কিছুটা কমল।
ঘোলাটে চোখে আমার সেল ফোনটার দিকে তাকালাম।ওটাকে আমার কাছে জলজ্যান্ত একটা আপদ মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।উপায় থাকলে চারতলা অফিস থেকে নীচে ফেলে দিতাম।গত কয়েকদিন ধরে আমাকে একের পর এক খারাপ সংবাদই শুধু দিয়ে যাচ্ছে হতচ্ছাড়া ফোনটা।
এই তো একটু আগেই খবর পেলাম তিনকোটি টাকার যে অর্ডারটা প্রায় আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল সেটা আমাদের চির প্রতিদ্বন্দী রয়েল গ্রুপ হাতিয়ে নিয়েছে।
আমি আর আমার প্রিয় বন্ধু নাসের মিলে আমাদের এই বিশাল গারমেন্টসের ব্যবসাটা প্রায় চার বছরের পরিশ্রমে দাঁড় করিয়েছি।শুরু থেকেই আমাদের প্রতিদ্বন্দী রয়েল গ্রুপ।ওদের অনেক রকম ব্যবসা থাকলেও গারমেন্টসই হল মূল ব্যবসা।রয়েল গ্রুপের কর্ণধার কামাল শেখ খুবই ধূর্ত প্রকৃতির হলেও গারমেন্টস সেক্টরে আমাদের সাথে কখনোই কুলিয়ে উঠতে পারেনি।কিন্তু গত এক বছর ধরে একের পর এক অর্ডার আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে ওরা।আমরা যে ডিলই শুরু করতে যাইনা কেন কিভাবে যেন আগে ভাগেই সেটার খবর পেয়ে যায় কামাল শেখ।এরপর ওরা পার্টিকে আমাদের চাইতে কম খরচে একই প্রোডাক্ট দেয়ার অফার দেয়।বলাই বাহুল্য অর্ডারটা পেয়ে যায় রয়েল গ্রুপ।
আমরা যত কম অফার করি ওরা তার চাইতে কম অফার করে।প্রচুর অর্ডার থাকায় লাভও হয় ওদের।
আর আমাদের?গত একবছর ধরে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে আমাদের কোম্পানী।এভাবে কিছুদিন চললে ব্যবসাপাতি লাটে উঠবে।শেষ ভরসা ছিল নরওয়ের তিনকোটি টাকার এই ডিলটা।এটা পেলে আমরা আবার ঘুরে দাড়াতে পারতাম।কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল,এটাও আমাদের হাতছাড়া।
পর পর তিন পেগ হুইস্কি গলায় ঢাললাম।মাথা কিছুটা কাজ করছে।খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম উত্তেজিত হয়ে কিছু করা যাবেনা।যা করার ভেবে চিন্তে করতে হবে।যদিও এই মুহূর্তে আমার মাথায় কোনো আইডিয়া নেই এরপরও সিদ্ধান্তটা নেবার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম।
আমার বন্ধু এবং পার্টনার নাসের তিনদিন আগে চিটাগং গিয়েছে ব্যবসায়িক একটা কাজে।কাল চলে আসবে।ও এলে ওর সাথে একটা পরামর্শ করে সামনে এগোতে হবে।দেখা যাক দু বন্ধু মিলে চেষ্টা করে আবার ঘুরে দাড়াতে পারি কিনা।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।বিশাল জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছি।রাত গভীর হয়েছে।পুরো চারতলা বিল্ডিংটাতে শুধু আমার রুমেই আলো জ্বলছে।গারমেন্টসে কাজ প্রায় নেই বললেই চলে।সেজন্য ওভারটাইমেরও বালাই নেই।সবাই চলে গেছে সন্ধ্যা হতে না হতেই।শুধু রয়ে গেছি আমি একা।বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা।অবশ্য আকর্ষণ করার মত কোনো কিছু আমার বাসায় নেইও।এখনো বিয়ে করিনি আমি।নাসেরও না।প্ল্যান করেছিলাম এ বছরই দুবন্ধুতে একসাথে বিয়ে করব।কিন্তু ব্যবসার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছেনা সহসা বিয়ে আমার ভাগ্যে আছে।
হঠাত রিংটোনের শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গল।ফোনটা বাজছে।আমি এগিয়ে গিয়ে ফোন তুলে নিলাম।অপরিচিত নাম্বার।আবার কোন দুঃসংবাদ কে জানে!ফোনটা রিসিভ করলাম।আমাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে নাসের বলল,‘দোস্ত তুই এখন কোথায়?’ওর গলায় বেশ উত্তেজনা টের পাচ্ছি।কারনটা অবশ্য জানা নেই।
‘অফিসে।কেন,তুই কোথায়?এটা কার নাম্বার?’
‘নাম্বার বাদ দে।আমি সন্ধ্যার সময় ঢাকা এসেছি।আসার কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম দুঃসংবাদটা।’
‘তোর না কাল আসার কথা?’
‘কাজ শেষ হয়ে গেল।শোন,একটা সু খবর আছে।তুই কোথাও যাসনা।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।আমার সাথে কামাল শেখও আসবে।’
আমি যারপরনাই বিষ্মিত হলাম।এত রাতে নাসের অফিসে আসছে আমাদের চির শত্রু কামাল শেখকে সাথে নিয়ে?‘তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।এখন বাজে রাত সাড়ে বারটা।এত রাতে কামালকে নিয়ে এখানে কি রাজ্য উদ্ধার করতে আসবি?’
‘ঠিকই বলেছিস,রাজ্য উদ্ধার করতেই আসছি।কামালকে আমি রাজি করিয়েছি আসার জন্য।ও অলরেডি রওনা হয়েও গেছে ওর অফিস থেকে।ওর সাথে আমাদের একটা চুক্তি হবে আজ।’
‘কী ধরনের চুক্তি?’আমি জানতে চাইলাম।
‘আচ্ছা সংক্ষেপে বলছি।দেখ,আমরা যে ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করি সেটা আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।সেগুলোও তেমন মান সম্মত না।সুতরাং ধরতে গেলে আমরা এবং রয়েল গ্রুপই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দী।এখন আমরা যদি একটা সমঝোতায় আসি যে আমরা নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে সমস্ত অর্ডার ভাগাভাগি করে নেব,তাহলেই কিন্তু আমরা এখন যেমন একজন আরেকজনকে টেক্কা দিতে গিয়ে কম মুনাফা পাচ্ছি সেটা কাটিয়ে উঠতে পারব।তখন চাইলেই বেশি দাম হাকতে পারব আমাদের ক্লায়েনটদের কাছে।অনেকটা সিন্ডিকেটের মত?’
‘বুদ্ধিটা তো খুবই ভাল,কিন্তু কামাল রাজি হবে?’
‘সে জন্যই তো ওকে আসতে বলেছি।আমরা দুজন মিলে রাজি করাব ওকে।আর রাজি না হবার তো কোনও কারণ নেই।চুক্তি হলে এখন যে মুনাফা পাচ্ছে সে একই মুনাফা এর চাইতে কম প্রোডাক্টে পাবে ওরা।’
মানতেই হচ্ছে নাসের খুব ভাল একটা বুদ্ধি করেছে।আমি মনে মনে অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠলাম।বললাম,‘ওকে,তাহলে কামালকে নিয়ে চলে আয়,আমি আছি।’
‘আচ্ছা শোন,আমরা অফিসে আসছি এটা যেন কেউ না জানে।তুই নাইট গার্ডকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আধঘন্টার জন্য কোথাও পাঠিয়ে দে।’
‘কেন?জানলে কী সমস্যা?’
‘আরে বুদ্ধু,চুক্তির ব্যাপার গোপণ রাখতে হবে।আমরা আর রয়েল গ্রুপ সেই “চিরপ্রতিদ্বন্দী”র ভূমিকাই পালন করে যাব।নয়ত চুক্তির ব্যাপার জানাজানি হলে আমরা বেশি দাম চাইতে পারবনা।এই সুযোগে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।’
আমি নাসেরের বুদ্ধিতে সত্যিই অভিভুত হয়ে গেলাম।‘বুঝতে পেরেছি।তুই চিন্তা করিসনা,আমি গার্ডকে কিছুক্ষনের জন্য সরিয়ে দিচ্ছি গেট থেকে।তোর কাছে চাবি তো আছেই,গেট খুলে চলে আসিস।’
নাসের সম্মতি জানাতে আমি ফোন রেখে দিলাম।এরপর গার্ডকে ফোন করে বলে দিলাম ও যেন ঘন্টা খানেকের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসে।গার্ডটা অনেকদিন ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠানে আছে।কোনো রকম উচ্চবাচ্য না করেই সায় জানাল।
প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হতেই শরীর জুড়ে কেমন একটা স্বস্তির ধারা বয়ে গেল।কামালের সাথে চুক্তিটা হয়ে গেলে আমাদের ব্যবসাটা আবার চাঙ্গা হয়ে যাবে।আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
দশ মিনিট যেতে না যেতেই অফিসের দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম।চারতলা পুরোটা জুড়েই আমাদের কর্পোরেট অফিস।নাসেরের রুম আমার পাশেই।
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আমি আমার কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম।করিডর ধরে নাসের আর কামালকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।নাসেরের বয়স আমার মতই ত্রিশ বত্রিশ হবে।কামাল শেখ খানিকটা বয়স্ক।চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মত।ঝানু ব্যাবসায়ী।রয়েল গ্রুপ পুরোটা বলতে গেলে সে একাই চালায়।কামাল শেখ না থাকলে রয়েল গ্রুপের পুরো সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়বে অল্পদিনেই।
ওরা এসে আমার সামনে দাড়াতে আমি কামাল শেখের সাথে কুশল বিনিময় করে আমার রুমে নিয়ে গেলাম ওদের।
হুইস্কির বোতল এখনো অর্ধেকটা ভরা।তিনটে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দুটো বাড়িয়ে দিলাম কামাল আর নাসেরের দিকে।ওরা দুজন বসেছে আমার টেবিলের সামনের দুটো চেয়ারে।কামাল হাতে একটা গ্লাস তুলে নিল।নাসেরও বাকি গ্লাসটা তুলে উঠে দাড়াল।আমি ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতে ও বলল,‘তোরা আলোচনা শুরু কর আমি এখানেই আছি।’
নাসের গ্লাসটা নিয়ে আমার পেছনে চলে এল।জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে।আমি দেরী না করে কাজের কথা পাড়লাম,‘তা মি.কামাল,নাসের বোধহয় আপনাকে সব বলেছে?’
আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই কামাল শেখের মাথা প্রচন্ডভাবে ঝাকি খেল।তবে সেটা আমার কথার সম্মতিতে নয়,বুকে গুলি খেয়ে!
আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম।চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কামাল শেখের ধবধবে সাদা শার্টটা গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করছে আস্তে আস্তে।ক্ষত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে।
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি নাসের একটা পিস্তল বাড়িয়ে ধরেছে।ব্যারেল থেকে এখনো হালকা হালকা ধোঁয়া উড়ছে।তবে পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো থাকায় প্রায় নিঃশব্দে গুলি বের হয়েছে।
আমি ঝট করে উঠে দাড়ালাম।নাসেরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,‘তুই এটা কী করলি?মাথা ঠিক আছে তোর?’আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু কথা খুঁজে পেলামনা।
নাসের হুইস্কির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে নির্বিকার স্বরে বলল,‘মাথা ঠান্ডা করে বোস,বলছি সব।’
প্রচন্ড উত্তেজিত হলেও সেটাকে সামলে নিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে নাসেরের মুখোমুখি বসলাম।অজান্তেই একবার কামাল শেখের দিকে চোখ চলে গেল।বেচারা সরাসরি হৃৎপিণ্ডে গুলি খেয়েছে।সাথে সাথে মৃত্যু হয়েছে।
নাসের সেই আগের মত নির্লিপ্ত গলায় বলতে লাগল,‘দোস্ত,পুরো ব্যাপারটাই একটা প্ল্যান।আমিই আমাদের সমস্ত ডিলের খবর পরিচয় গোপণ রেখে কামাল শেখকে জানিয়ে দিতাম।ফলে রয়েল গ্রুপ আমাদের চাইতে লোভনীয় অফার দিয়ে ডিলটা হাতিয়ে নিত বরাবর।’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।পাগলটা বলে কী!‘নিজের পায়ে কুড়াল মেরে তোর কী লাভ হল?’
‘লাভ তো অবশ্যই হয়েছে।লাভ ছাড়া কেউ কিছু করে নাকি?লাভটা হল এখন সবাই জানে আমরা আর রয়েল গ্রুপ পরস্পরের শত্রু।’
আমার মাথায় কিছু ঢুকছেনা।চুপ করে থাকলাম।দেখি উন্মাদটা আর কী কী বলে।
নাসের বলতে লাগল,‘কামাল শেখ মারা যাওয়াতে রয়েল গ্রুপ শীঘ্রই পটল তুলবে।আর এর ফায়দা উঠাবো আমি।
‘রয়েল গ্রুপ পটল তুলবে আর আমরা খুব বাঁচা বেঁচে যাব তাইনা?’
‘উহু,আমরা না,শুধু আমি।তুইও কিছুক্ষনের মধ্যে পটল তুলতে যাচ্ছিস।’অবলীলায় ভয়ঙ্কর কথাটা বলেই উন্মাদের মত হেসে উঠল নাসের।‘কাল পুলিশ এসে দেখবে এই রুমে দুটো লাশ পড়ে আছে।দুজনের হাতেই দুটো পিস্তল।তার উপর এরা হল পরস্পরের জাতশত্রু।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে নিশ্চয়ই দেরী করবেনা পুলিশ?ওরা ধরে নেবে ব্যবসায়িক দ্বন্দের কারণে একজন আরেকজনকে খুন করেছে।’
আমার হঠাত করেই প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়ে গেল।স্পষ্ট বুঝতে পারছি নাসের যা বলছে ও তা করবেই।মরিয়া হয়ে বললাম,‘তুই বেঁচে যাবি সেটা ভাবছিস কেন?পুলিশ আমার পার্টনার হিসেবে তোকে সন্দেহ করবেনা?’
‘কেন করবে বন্ধু?সবাই জানে আমি এখনো চিটাগং।আমার ঢাকা আসার কথা কেউ জানেনা।তোকে আর কামালকে যে নাম্বার দিয়ে ফোন দিয়েছি ওটাও আমার না।আমি আজ রাতেই আবার চিটাগং ফিরে যাব।এরপর কাল আমার প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে হা পিত্যেশ করতে করতে ছুটে আসব,হা হা হা!’ আবার সেই উন্মাদের হাসি হাসল নাসের।
কোনোও ফাঁকই রাখেনি উন্মাদটা।মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে একটা।বললাম,‘এসব কেন করলি তুই?’
‘এখনো বুঝতে পারিসনি?আমাদের ব্যবসার শুরুতে কী চুক্তি হয়েছিল মনে আছে?একজন মারা গেলে অপরজন সমস্ত ব্যবসার মালিক হয়ে যাবে।এখন তোর অবর্তমানে পুরো ব্যবসাটার মালিক হব আমি।এদিকে রয়েল গ্রুপ আমার পথে বাগড়া না দেয়ায় খুব শীঘ্রই দেশের অন্যতম বিজনেস টাইকুনের নাম হতে যাচ্ছে নাসের আহমেদ।’হাতের হুইস্কির গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নাসের।
পুরো ব্যাপারটা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা।আমার প্রিয় বন্ধু স্রেফ টাকার লোভে এতটা নীচে নামতে পারে বলে আমার ধারণাও ছিলনা।আমি নাসেরের পিস্তলের মুখে বিমুঢ়ের মত বসে রইলাম।
‘দোস্ত তোকে তো আর সময় দেয়া যাচ্ছেনা,’বলেই পকেট থেকে আরেকটা পিস্তল বের করল।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম।আঘাতের প্রচন্ডতায় চেয়ার উলটে পড়ার দশা হল।দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।এরই মাঝে দেখতে পাচ্ছি নাসের কামালের হাতে একটা পিস্তল গুজে দিচ্ছে।আরেকটা আমার হাতে তুলে দিলেই ওর কাজ শেষ।আমার সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করে শেষ হাসি হাসবে ও।
বুঝতে পারছি আমি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মারা যাচ্ছি।নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকের মত কথাটা মনে পড়ে গেল।
আমি আগেই ধারণা করতে পেরেছিলাম আমাদের ভেতরের কেউই রয়েল গ্রুপের কাছে তথ্য পাচার করছে।সেজন্য মাত্র গতকালই আমাদের কর্পোরেট অফিসের প্রতিটা কামরায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি!নাসের চিটাগং থাকায় ওকে জানানো হয়নি ক্যামেরার কথা।
এতক্ষন ধরে পুরো ঘটনাটা রেকর্ড হয়ে গেছে।কাল নিশ্চয়ই পুলিশ ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে দেখবে।আর তাহলেই......নাহ,শেষ হাসি তাহলে আমিই হাসলাম!
Published on October 05, 2013 02:08
সর্পরহস্য
এক
মোটাসোটা মানুষ সাজেদা বেগম।অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। একটু পর পরই পানি খাওয়া তার অভ্যেস।রান্না করার সময়ও বড়সড় একটা পানির বোতল পাশে নিয়ে রাখেন।আজ গরমটা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি।বিরাট আকারের বোতলের পানিও তলানিতে এসে ঠেকেছে।কাজের ছেলে টিটু দোকানে গেছে।ওকে দিয়ে পানি আনার কোন উপায় আপাতত না থাকায় সাজেদা বেগম নিজেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ফিল্টারের সামনে দাড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢাললেন।গ্লাস থেকে পানিটা যখন গলায় ঢালতে যাবেন তখনই তার চোখের কোনে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। অর্ধেক খাওয়া গ্লাসটা নামিয়ে সেদিকে তাকালেন। ওদিকটাতে শুধু একটা টেবিল রাখা।যতদুর মনে হয় টেবিলটার আশেপাশেই নড়াচড়াটা দেখেছিলেন তিনি।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পরও কোন ধরনের বৈসাদূশ্য তার চোখে ধরা পড়লনা। গ্লাসটা আবার তুললেন মুখের কাছে, ঠিক তখনই টেবিলের নিচে ফের নড়াচড়া।তাকালেন তিনি, এবং ভয়ঙ্কর জিনিসটা এবার স্পষ্টই দেখতে পেলেন। মিশমিশে কালো রংএর একটা সাপ! লম্বায় চার ফুট তো হবেই।কুন্ডলী পাকাচ্ছে। এই বাড়িতে সাপ কোত্থেকে আসবে সে ভাবনা চিন্তা করার আগেই চিল চিৎকার ছাড়লেন সাজেদা বেগম,'বাচাও!সাআআআপ!'প্রলম্বিত আত্মচিৎকার। 'কি হইছে আম্মা? 'হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তের বছর বয়সী টিটু। দোকানে গিয়েছিল লবন কিনতে। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই শুনতে পায় তার আম্মা চিৎকার করছে। টিটু এতিম মানুষ।ছোটবেলা থেকেই আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম দম্পতির কাছে মানুষ।তাদের দুই ছেলেই দেশের বাইরে থাকায় টিটুর প্রতি তাদের মমতা একটু অন্যরকম।টিটুও এই মধ্যবয়সী দম্পতিকে নিজের বাবা মায়ের মতই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।তাই সাজেদা বেগমের চিৎকার শুনেই ছুটে এল। 'সাপ,সাপ! 'শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। টিটু হাতের লবনের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে একদৌড়ে স্টোররুমে চলে গেল।খুঁজে পেতে একটা শক্তপোক্ত লাঠি মুঠোয় করে ফিরে এল ডাইনিং রুমে। 'সাপ কোন জায়গায় আম্মা? ' সাজেদা বেগম হাত ইশারায় শুধু.টেবিলটাই দেখাতে পারলেন টিটুকে।বাক এখনও রুদ্ধ। সাপটা ইতোমধ্যে সাজেদা বেগমের চিৎকারে জায়গা বদল করেছে ফেলেছে।টেবিলের নিচটা এখন শুন্য। টিটু হাতের লাঠিটা বাড়িয়ে ধরে সামনে এগোতে লাগল। 'সাবধানে যাস বাবা,' এতক্ষণে কথা বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। 'চিন্তা কইরেন না আম্মা। ছোডকালে কত সাপ ধইরা ধইরা গিট্টু দিয়া ছাইড়া দিছি। ' 'এটা কিন্তু বিষাক্ত হবার সম্ভবনা আছে। ' সাজেদা বেগমের এ কথাটার জবাব দিলনা টিটু।টেবিলের সামনে এসে হামা দিয়ে নিচটা দেখল।না, সাপটা ওখানে নেই। উঠে দাড়িয়ে সতর্ক চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। ঘরের একমাত্র জানালাটা অনেক বড়।জানালার চাইতে পর্দাটা আরো বড়।একেবারে মেঝে পর্যন্ত ঝুল। পর্দাটা আচমকা নড়ে উঠতেই টিটু পর্দার দিকে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে গেল।ঝটকা দিয়ে পর্দাটা সরাতেই কুন্ডলী পাকানো সাপটা দেখা গেল। গায়ের রং কুচকুচে কালো।কেমন একটা হিমশীতল ভাব।গা শিউরে ওঠে দেখলে। টিটুকে দেখে সাপটা ফনা তোলার উপক্রম করল।টিটু অবশ্য সে সুযোগ সাপটাকে দিলনা।লাঠিটা দিয়ে কষে একটা বাড়ি বসাল সাপটার পিঠে।জায়গামতো পড়েছে বাড়িটা।ফোঁসফোঁস করে উঠল সাপটা।গোটা দেহ মোচড় খেতে লাগল। টিটু বাড়ি দিয়ে লাঠিটা ওঠায়নি।মেঝের সাথে চেপে ধরে আছে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর কেমন নেতিয়ে গেল সাপটা।তবে মরেনি যে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে নড়তে থাকা লেজটা দেখে। টিটু লাঠিটা ওঠাল।উঠিয়ে আরেকটা যুৎসই বাড়ি দেবার ইচ্ছা।লাঠিটা ওঠাতেই নেতিয়ে পড়া সাপটা স্বরুপে ফিরে গেল।বিদ্যুৎবেগে ছোবল বসাল টিটুর পা লক্ষ্য করে। সতর্ক থাকায় অল্পের জন্য বেঁচে গেল টিটু।সাপের মাথাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।টিটুর পায়ে গা শিউরানো একটা স্পর্শ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টিটুর দ্বিতীয় বাড়ি আছড়ে পড়ল আগের জায়গায়। এবার আগের চাইতেও বেশি জোরে। এবার আর ভান নয়, সত্যি সত্যিই পটল তুলল সাপটা।শিড়দাড়া গুড়িয়ে গেছে। টিটু লাঠির আগাটা দিয়ে মাথায় আঘাত করে সাপটার মৃত্যু নিশ্চিত করল। 'আম্মা চান্দু শ্যাষ! ' লাঠির আগায় সাপটা তোলার কসরত করতে করতে বলল টিটু।মুখে একগাল হাসি, যেন বিশ্ব জয় করে এইমাত্র ঘোড়া থেকে নামল আলেকজান্ডার। 'বাসার পেছনে পুঁতে দিয়ে আয়। ভালমত গর্ত করিস, নয়ত আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে।' 'জে আম্মা। 'সাপটাকে দোলাতে দোলাতে বাইরে নিয়ে গেল টিটু। এতক্ষণে হাপ ছাড়লেন সাজেদা বেগম। উত্তেজনার প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যেতেই তিনি অনুভব করলেন, তার প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।অর্ধেক ভরা গ্লাসটা মুখে তোলার আগেই নাকে পোড়া গন্ধ পেলেন। সর্বনাশ! চুলার তরকারি পুড়ে খাক হচ্ছে!
দুই
গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় আফজাল সাহেব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় আবিষ্কার করলেন বাড়ির চারপাশটা বেশ জঙ্গল হয়ে আছে।পরিষ্কার করাতে হবে লোক এনে। তিনি তার ডাক্তারি পেশা নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় সাংসারিক ব্যাপারে তেমন মনোযোগ দিতে পারেননা।তার প্রবাসী দুই ছেলে প্রতিমাসে যথেষ্ঠ পরিমাণে টাকা পাঠালেও তিনি তার পেশাটাকে ছাড়তে পারেননি।পৃথিবীতে কাজের মানুষের খুব অভাব।আফজাল সাহেব একজন সত্যিকারের কাজের মানুষ।আজকাল দরিদ্র রোগীদের ফ্রীতেই দেখেন তিনি। দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চাপ দিলেন তিনি।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল টিটু।বোধহয় তৈরী হয়েই ছিল। 'খালু জানেন আইজ কি হইছিল?' দরজা খুলেই প্রশ্ন করল টিটু। উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে। টিটুর উত্তেজনা অবশ্য আফজাল সাহেবকে ছুঁতে পারলনা।বাচ্চারা তো কত কিছুতেই উত্তেজিত হয়।নিরাসক্ত গলায় বললেন, 'কিভাবে জানব? তোরা তো কেউ বলিসনি।' 'আর বলোনা, আজ সন্ধ্যায় বিশাল এক সাপ ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে।ভাগ্যিস সময়মত টিটু মারতে পেরেছিল।'আফজাল সাহেবের গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন সাজেদা বেগম।তরকারি পুড়ে যাওয়ায় এখনো রান্নাঘরের পাট চুকাতে পারেননি।আবার রাধতে হচ্ছে। 'তাইনাকি! ' ভ্রু কুঁচকে বললেন আফজাল সাহেব। 'তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো, খেতে খেতে শুনবে। ' আফজাল সাহেব কথা না বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন। আজ গরমটা পড়েছে মারাত্মক। গোসল করলে ভাল হতো। 'টিটু, আমার লুঙ্গি আর গামছাটা দিয়ে যা তো বাবা, 'হাক ছাড়লেন আফজাল সাহেব। বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপটা পুরো ছেড়ে দিলেন।বালতিতে গোসল করে অভ্যেস আফজাল সাহেবের। ঝর্ণা দিয়ে গোসল করে ঠিক তৃপ্তি পাননা তিনি। পানি পড়ে তো পড়েনা। বালতিটা ভরা হতেই একমগ পানি গায়ে ঢাললেন।পানির ধারাটা সারাদিনের ক্লান্ত দেহে শীতল একটা পরশ দিয়ে গেল। আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আফজাল সাহেব।চোখ বন্ধ করেই আরেক মগ পানির জন্য বালতিতে মগ ডুবাতেই কিসের যেন স্পর্শ পেলেন হাতে।ঝট করে চোখ খুলে দেখেন বড়সড় লাল বালতিটাতে একটা বিরাটাকারের সাপ কিলবিল করছে। লম্বায় চারহাতের মত হবে। চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ থেকে পানির কনাগুলো মুছে ঝাপসা দৃষ্টি স্বচ্ছ করে নিয়ে আবার তাকালেন।এবারের চমকটা আগের চাইতেও তীব্র। বালতি পুরো খালি! তাহলে একটু আগে কি ভুল দেখলেন? ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন? তাহলে হাতের স্পর্শটা? বালতির পুরো পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে ভরে নিলেন।এই পানি আর ব্যবহার করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলেন খাবার দেয়া হয়েছে।তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন। আফজাল সাহেবের বাসায় দামী একটা ডাইনিং টেবিল থাকলেও সেটা শোভাবর্ধন ছাড়া আর কোনো কাজে আসেনা।আফজাল সাহেব মাটিতে বসে খান।নবীজীর সা.সুন্নত।তাছাড়া আফজাল সাহেব লক্ষ করে দেখেছেন মাটিতে ছড়িয়ে বসে খাওয়ার আনন্দের ধারে কাছেও ডাইনিং টেবিলের স্থান নেই। মাটিতে বসে খাবার নিয়মে সবচাইতে বেশি খুশি টিটু।খাওয়ার সময় ওর বসা দেখলে মনে হতে পারে খাওয়ার চাইতে বসায় বেশি আনন্দ পাচ্ছে ছেলেটা। 'কি হয়েছিল বলতো। 'প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে জানতে চাইলেন আফজাল সাহেব। সাজেদা বেগম যখন বিতং বর্ননা শেষে সাপটার বর্ননায় এলেন তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, 'সাপটা কেমন? চারহাত লম্বা, কালো রংয়ের? ' 'হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে? 'বিস্ময়ের সাথে বললেন সাজেদা বেগম। আফজাল সাহেব তার কথার জবাব দিলেননা।কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেননা তিনি। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, বাথরুমে তার ভ্রম হয়েছিল,তাহলে একটু আগের মৃত সাপটার সাথে তার "ভ্রম "মিলে গেল কিভাবে? এত কাকতালীয় ঘটনা কী পৃথিবীতে ঘটে? অর্ধেক খেয়েই উঠে পড়লেন আফজাল সাহেব।সাপটা দেখার পর থেকেই তার গা ঘিনঘিন করছে।
তিন
সিলিংএর ফ্যানটা সর্বশক্তি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।এরপরও যে ঘরের গুমোট গরমটা দুর করতে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারছে সেটা বলা যাবেনা। আফজাল সাহেবের কোল্ড অ্যালার্জি থাকায় এসি লাগাননি ঘরে। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল সাজেদা বেগমের।কয়েকমূহুর্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারলেননা তিনি। ঘুম ভাঙ্গার কারণটাও পরিষ্কার না। হঠাৎ করে মাথার কাছে হিসহিস আওয়াজ হতেই ফিরে তাকিয়ে দেখেন হাতচারেক লম্বা একটা কালো সাপ ফনা তুলে আছে! সাজেদা বেগম ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই সাপটা হিলহিল করে খাট থেকে মেঝেতে নেমে গেল। সাজেদা বেগম সাপটার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মেঝেতে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঝকঝকে সাদা টাইলসের মেঝে সম্পুর্ন খালি। সাপটা উধাও! সাজেদা বেগম স্বামীকে ডাক দিতে যাবেন এমন সময় টিটুর ভয়ার্ত আত্মচিৎকার শোনা গেল পাশের রুম থেকে।সে চিৎকার আফজাল সাহেবের ঘুমটাও ভাঙ্গিয়ে দিল। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পাশের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলেন তিনি, পেছন পেছন সাজেদা বেগম। টিটুর রুমে এসে লাইট জ্বালাতেই ওকে বিছানায় বসে থাকতে দেখা গেল। দুচোখে নগ্ন আতংক।'খালু আমারে বাচান। ' আফজাল সাহেবদের দেখে বলে উঠল টিটু। 'কি হয়েছে? ' 'খালু তহন যে সাপটারে মারছি সেইটার বউ "পুরতিশুধ "নিতে আইছে! ' টিটুর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলার যথেষ্ঠ কারণ থাকা সত্বেও হাসতে পারলেন না আফজাল সাহেব। 'কোথায় সাপটা? ' 'খাটের নিচে হান্দাইছে। ' আফজাল সাহেব উবু হয়ে খাটের নিচে তাকালেন।যা ভেবেছিলেন,সেটাই।খাটের নিচটা পুরো ফাঁকা।ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়ত খুঁজে দেখতেন আশপাশটা। কিন্তু তিনি জানেন সাপটাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। টিটুকে মশা না থাকা সত্বেও মশারি টানাবার পরামর্শ দিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলেন আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম। রুমে এসে সাজেদা বেগমকে ড্রয়ার থেকে মশারি বের করতে দেখে আফজাল সাহেব বললেন, 'তুমিও একটু আগে দেখেছ সাপটাকে, তাইনা? ' জবাবে কথা না বলে সম্মতিসূচক মাথা ঝাকালেন সাজেদা বেগম। পরেরদিন সামনে একজন রোগী নিয়ে চেম্বারে বসে আছেন আফজাল সাহেব।সামনে যে রোগীটা বসে আছে সে যেকোনো মূহুর্তে প্রপাত ধরনীতল হতে পারে।হলে কি করা উচিৎ সেটা নিয়ে তিনি খানিক চিন্তিত। লোকটা তার চেম্বারে একাই এসেছে টলতে টলতে।সাপের ফনার মত শরীরটা দুলছে তার। হঠাৎ করেই বিরক্তবোধ করলেন আফজাল সাহেব।তিনি এসব কি ভাবছেন।সাপের ফনার মত দুলতে যাবে কেন একজন মানুষ। গতকালের ব্যাপারটা বেশ প্রভাব ফেলেছে তার মনে। খারাপ প্রভাব। মোবাইলটা বেজে উঠতে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল আফজাল সাহেবের। ডিসপ্লেতে রমজান আলির নাম ভেসে আছে।তিনি চেম্বারে আসার আগে তিনজন লোক ঠিক করে দিয়ে এসেছেন বাড়ির চারপাশটা সাফাই করার জন্য।রমজান হল তাদের লিডার।আফজাল সাহেবের পূর্ব পরিচিত। 'বলো, রমজান, 'ফোন রিসিভ করে বললেন আফজাল সাহেব। এরপর হড়বড় করে রমজান আলি যা বলল তার সারমর্ম হল, সে এবং তার লোকরা জঙ্গল সাফ করতে গিয়ে বারবার সাপ দেখে ভিড়মি খাচ্ছে।সাপগুলোও ভারী বদ।এই আছে, এই নেই! আফজাল সাহেব বাড়তি টাকা দেবার আশ্বাস দিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করলেন। ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।অন্য সময় হলে ভাবতেন অদৃশ্য সাপের আজগুবি গল্গ ফেঁদে বাড়তি টাকা নেয়ার ফন্দি করছে রমজান আলি।এখন সেটা ভাবছেননা। তিনি জানেন কোথাও কোনো গড়বড় হয়ে গেছে।রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে বাড়িটাতে।দ্রুত কিছু একটা করা উচিৎ,কোনো অঘটন ঘটবার আগেই।
চার
মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।কিছু কিছু মানুষ থাকেনই এমন।সৌম্য দর্শন চেহারা।ধবধবে সাদা চাপদাড়ি তার মধ্যে এনে দিয়েছে একধরনের গাম্ভীর্য।ষাটোর্দ্ধ এই বৃদ্ধ হলেন আফজাল সাহেবদের মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম।খুবই কামেল লোক।প্রতিদিন বহু মানুষ নানান ধরনের সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসেন।রহস্যময় সব সমস্যা। আফজাল সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়লেও ইমাম সাহেবের সাথে তার বিশেষ পরিচয় নেই। দেখা হলে "কেমন আছেন, ভাল আছি " পর্যন্তই তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ,অন্তত এতদিন ছিল।এইমূহুর্তে তিনি ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। সকালের দিকে রমজান আলির কথা শোনার পর আজ আগেভাগেই চেম্বার ছেড়েছেন তিনি।এখন মাগরিবের নামাজ শেষ করে ইমাম সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছেন। মসজিদে আপাতত তিনি আর ইমাম সাহেব ছাড়া কেউ নেই।নামাজ শেষে সবাই চলে গেছে।ইমাম সাহেব দীর্ঘক্ষণ ধরে নফল নামাজ পড়েন।আফজাল সাহেব গিয়ে দেখা করলে হয়ত তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন, কিন্তু আফজাল সাহেব সেটা করলেন না।তার হাতে সময় আছে।তিনি আপাতত তার চলমান সমস্যাটা নিয়ে ভাবছেন। আফজাল সাহেব নিজে পেশায় একজন ডাক্তার হওয়ায় সারাজীবন সমস্ত ঘটনার পেছনে কার্যকারণ খুঁজে এসেছেন। পৃথিবীতে রহস্যময় ঘটনা ঘটে, তিনি সেটা স্বীকারও করেন।সব ঘটনার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনা।তবে রহস্যময় ঘটনা ঘটার পেছনেও তো একটা কার্যকারণ থাকতে বাধ্য।কিন্তু তাদের সাথে ঘটা রহস্যময় ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?একটা মৃত সাপ কেন বারবার ফিরে আসবে? পৃথিবীতে,বিশেষ করে বাংলাদেশে এই কিলবিলে প্রাণীটাকে নিয়ে যত ধরনের রহস্যময় ঘটনা প্রচলিত আছে আর কোনো প্রাণী সম্পর্কে এতটা নেই।এদেশে সাপ যতটা না একটা সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী তারচাইতে বেশি একটা রহস্যময় প্রাণী। বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা এই প্রাণীটাকে নিজেদের স্বার্থে একটি অতিলৌকিক রুপ দান করেছে।যেমন,কালনাগিনী সাপের মানুষের রুপ ধারণ করা, শনি আর মঙ্গলবারে ঢোড়া সাপের বিষ আসা, জোড়া সাপের একটাকে মারলে অপরটা বাড়ি চিনে হত্যাকারীকে উপর প্রতিশোধ নেয়া, বিণ বাজালে সাপ এসে ধরা দেয়া কিংবা বাজনার তালে তালে নাচা, ,ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য গুজব। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আফজাল সাহেব জানেন এগুলোর প্রায় সবই মিথ্যের জালে আবৃত। কালনাগিনীকে খুবই বিষাক্ত এবং অলৌকিক একটা প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।অবশ্য সুন্দরবন এলাকায় কালনাগিনী নামে এক প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়াও যায়। মজার ব্যাপারটা হল এই কালনাগিনী খুবই নিরীহ এবং নির্বিষ একটা সাপ।নিরীহ এই সাপের মানুষের রুপ ধারন করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। এরপর ধরা যাক জোড়া সাপের কথা।এটাও একটা গুজব।সাপের দৃষ্টিশক্তি খুবই কম,প্রায় না থাকার মতোই।সুতরাং সঙ্গীর হত্যাকারীকে ভালমত দেখাই সাপের পক্ষে সম্ভব না, বাড়ি চিনে প্রতিশোধ নেয়া তো হাস্যকর। দৃষ্টিশক্তির মত সাপের শ্রবনশক্তিও খুবই দুর্বল। জিহ্বাটাই হল তার শ্রবণযন্ত্র। যেটা একটু পর পর মুখ থেকে বের করে সে শোনার কাজ চালায়। এত দুর্বল শ্রবনযন্ত্র দিয়ে মাইলকে মাইল দুরের বিণের আওয়াজ শোনার কোন যৌক্তিক কারণ নেই সাপের।বিণের তালে তালে নাচ দেখিয়ে বেদেরা যে টাকা পয়সা নেয় এর পেছনেও রয়েছে সুক্ষ কারসাজি।বেদেরা যখন বিণ বাজায় তখন সাপ সেটা শুনতে পায়না, বরং আগে থেকে ট্রেনিং দেয়ার ফলে বেদের হাতের নড়াচড়া দেখে সাপও নিজের ফণা তোলা দেহ নাচায়। দেখলে মনে হয় বুঝি বিণের মায়াবী সুরেই. . .! মানুষ সবচাইতে বেশি যে ব্যাপারটাতে বিভ্রান্ত হয় সেটা হল, অলৌকিক গাছ! বেদেরা দাবি করে এসব গাছের যেকোনো অংশ সাথে থাকলে তাকে আর সাপ ছোবল দিতে পারবেনা।প্রমাণ হিসেবে তারা দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে হাতে একটা গাছের ছোট্ট টুকরো ধরিয়ে দিয়ে সাপের কাছে নিতে বলে হাতটাকে।এরপর দেখা যায় সাপটা তার হাত দেখে ভয়ে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে। এটাও বেদেদের আরেকটা ধোকাবাজি।তারা প্রথমে সাপ ধরে ধরে লোহার শিক দিয়ে ছ্যাঁকা দেয় সাপের গায়ে। পরবর্তীতে সাপটা এমনই ভীতু হয়ে পড়ে, তখন কেউ তার দিকে হাত বাড়ালেই সে ছ্যাঁকা খাবার ভয়ে মাথা সরিয়ে নেয়।আর বেদেরা এই সুযোগে সাধারণ মানুষের কাছে গাছের আজেবাজে ছাল বিক্রি করে। সাপ সম্পর্কে যতগুলো গুজব প্রচলিত আছে তার সবগুলোর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাই আফজাল সাহেব জানেন।কিন্তু তার সাথে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে নেই।দেখা যাক ইমাম সাহেবের কাছে আছে কিনা। ইমাম সাহেবের নামাজ শেষ। তিনি জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাড়াতে আফজাল সাহেবও উঠে দাড়ালেন। 'কেমন আছেন আফজাল সাহেব? ' আফজাল সাহেবকে দেখে ভরাট গলায় বলে উঠলেন ইমাম সাহেব। 'জী ভাল, আপনি? ' 'আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন ? ' 'জী ' 'তো সেটা আগে বলবেন তো। আমি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতাম ' 'না, কোনো অসুবিধা নেই, আমার হাতে সময় আছে। ' 'তা কি সমস্যা আপনার? ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন। তিনি তো বলেননি তার কোনো সমস্যা আছে। ইমাম সাহেব যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই বললেন,'ভাবছেন, আমি কিভাবে জানলাম? না না, কোনো জ্বীন টীন এসে বলে যায়নি আমাকে।আসলে সমস্যা ছাড়া কেউ তেমন একটা আসেনা আমার কাছে,'বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন ইমাম সাহেব। এবার আফজাল সাহেব যথেষ্ঠ লজ্জিত হলেন। সত্যিই তো, মানুষটার সাথে এতদিন হল পরিচয়, কখোনো তো তেমনভাবে কথাও বলেননি।আজ যেই সমস্যা দেখা দিয়েছে,অমনি এসে হাজির। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেননা তিনি, এমনসময় ইমাম সাহেব তাকে উদ্ধার করলেন, 'চলুন, আমার রুমে গিয়ে কথা বলি। ' তারা দুজনে মসজিদ সংলগ্ন ইমাম সাহেবের কামরায় এলেন। রুমটাতে ইমাম সাহেব নামাজের আগে পরে বিশ্রাম নেন।ঘর ভর্তি দেশী বিদেশী বই, বেশিরভাগই আরবী। খানিক বাদেই আফজাল সাহেবের আপত্তি সত্বেও মসজিদের খাদেম চা নাস্তা দিয়ে গেল। 'অসুবিধা না থাকলে আপনার সমস্যাটা এবার বলতে পারেন, 'চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব শুরু করলেন। কিছুই বাদ দিলেন না।সাপটাকে মারার পর থেকে কিভাবে মৃত সাপটাকে বারবার দেখা যেতে লাগল সেটাও বিস্তারিত বলে গেলেন। শুনে ইমাম সাহেব কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন, 'হুমম্ সমস্যাটা বোধহয় আমি বুঝতে পারছি। ' 'কী সেটা? ' 'বলব, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।আজ তো রাত হয়ে গেছে, আজ আর হবেনা। আপনি কাল সাপটা যেখানে পোঁতা হয়েছিল সে জায়গাটা খুড়ে দেখবেন মৃত সাপটা এখনো সেখানে আছে কিনা। ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন।এটা কি বলছেন ইমাম সাহেব? 'হুজুর, আপনি কি ভাবছেন সাপটা ভূত হয়ে. . .' 'আমি কিছুই ভাবছিনা, এটা শুধুমাত্র আমার কৌতুহল বলতে পারেন।আপনি কাল ব্যাপারটা দেখে আসুন, আমি ইনশাআল্লাহ সমাধান দেবার চেষ্টা করব। ' আফজাল সাহেব আর তেমন কথা বাড়ালেননা। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন। মনটা কেমন খুতখুত করছে। ইমাম সাহেবও তাহলে ভূতে বিশ্বাস করেন! বাসায় এসে তিনি আর আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারলেননা।টিটুকে একটা শাবল নিয়ে বাইরে আসতে বললেন।টিটু শাবল আনতে তিনি বললেন, 'সাপটাকে কোথায় পুঁতেছিলি দেখা তো একটু। ' 'কেন খালু? ' 'আছে, দরকার আছে। তুই দেখিয়ে দে।' টিটু বাড়ির পেছনে এসে একটা জায়গা দেখাল,'উই যে। ' জায়গাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকাল খোঁড়া হয়েছিল।এরপরও নিশ্চিত হবার জন্য বললেন, 'শিওর তুই? ' 'এক্কেরে শিউর। "হানডেডে হানডেড! " আফজাল সাহেব মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন।সেটা দেখে টিটু বলে উঠল, 'খালু এইডা কি করেন? ' 'দেখতে থাক, 'মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই জবাব দিলেন আফজাল সাহেব। প্রায় দেড় হাতের মত খোঁড়ার পরও সাপ তো দুরের কথা, একটা কেঁচোও দেখা গেলনা।এতক্ষণে টিটুও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। বলল, 'খালু, মাটি তো এতো খুড়ছিলাম না। আধা হাত খুইড়াই হান্দাইয়া থুইছিলাম।চান্দু গেলো কুনহানে? আমার মনে কয় চান্দু মরে নাই।কব্বর থিকা বাইর হইয়া আইছে। "পুরতিশুধ" নিবো,গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে লাগল টিটু। আফজাল সাহেব টিটুর কথার জবাব দিলেন না।তিনি খুব বেশি অবাক হননি।যেন জানতেন এটাই ঘটবে। তবে রহস্যটা তাতে এতটুকুও পরিষ্কার হয়নি, আরো ঘোলাটে হয়েছে।
পাঁচ
চারদিকটা এখনো আঁধারে ঢাকা।দিগন্তের কাছে একটা শুভ্র রেখা জানান দিচ্ছে আঁধারের আয়ু কমে আসছে। আফজাল সাহেব মসজিদের দিকে চলছেন।তার ইচ্ছে করছে একছুটে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে বলেন। গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বেশ ভালমত মশারী টানানো হয়েছিল। আফজাল সাহেব চেম্বার থেকে ফেরার পথে এক বোতল কার্বলিক এসিড নিয়ে এসেছিলেন। সেটারও সদ্ব্যবহার করা হয়। যদিও আফজাল সাহেব নিশ্চিত ছিলেননা একটা ভূতুড়ে সাপের বিরুদ্ধে এগুলো কতটা কাজে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা। একটা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই বিছানায় যান তিনি।এর আগের রাতেও তেমন ভাল ঘুম হয়নি। গতকাল তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যান আফজাল সাহেব।ঘুম ভাঙ্গে বুকের উপর একটা চাপ অনুভূত হওয়ায়। চোখ খুলে একমূহুর্ত আবছা আঁধারে কিছুই ঠাহর করতে পারেননা আফজাল সাহেব।একটু পরই অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখতে পান মৃত সাপটা তার বুকের উপর বসে আছে! আফজাল সাহেবকে চোখ মেলতে দেখেই কিনা, সাপটা ফণা তুলল। এক্ষুনি ছোবল দেবে! আফজাল সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন আতঙ্কে। এক এক করে দশটা সেকেন্ড পার হয়ে গেল।প্রতিটা সেকেন্ড যেন এক একটা ঘন্টা।দেহের কোথায় কোন তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করতে না পেরে চোখ মেললেন তিনি।সাপটা অদৃশ্য হয়েছে। বাকি রাতটা আর ঘুম আসেনি তার।আজ ফজরের আজান দিতে না দিতেই মসজিদের পথ ধরেছেন তিনি। ফজরের নামাজ শেষ। ইমাম সাহেব সম্ভবত কোনো দোয়া পড়ছেন। মুসল্লীরা একে একে উঠে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। ইশারায় তার পিছু পিছু যেতে বললেন আফজাল সাহেবকে। ইমাম সাহেবের রুমে মুখোমুখি বসলেন দুজন। 'তারপর বলুন,কি অবস্থা আপনার? 'বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব সব খুলে বললেন।গতরাতের ঘটনাটাও। 'বুঝতে পেরেছি, 'মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। কিছু বললেন না আফজাল সাহেব। একটা ব্যাখ্যার আশায় আছেন। 'আপনাকে একটা হাদীস শোনাই, তাহলেই আশা করি রহস্যটা পরিষ্কার হবে আপনার কাছে। ' তার এই অদ্ভুত সমস্যার সাথে হাদীসের কি সম্পর্ক সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলেন আফজাল সাহেব। 'হাদীসের সবচাইতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ "মুসলিম শরীফের "একটা হাদীস এটা। পুরো ঘটনাটা বেশ বড়, আমি সংক্ষেপে মূল ঘটনাটা বলছি।ঘটনাটা খন্দকের যুদ্ধের সময়।ওই সময় এক সদ্য বিবাহিত যুবকও যুদ্ধে অংশ নেয়।সে প্রতিদিন দুপুর বেলা রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে বলে নিজের বাড়িতে আসতো।একদিন দুপুরবেলা বাড়ি এসে দেখে তার সদ্য পরীনিতা স্ত্রী বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে আছে।যুবক খানিকটা রেগে যায় এতে।বকাঝকা শুরু করে স্ত্রীকে।তখন তার স্ত্রী কী ঘটেছে সেটা ভেতরে গিয়ে তাকে দেখে আসতে বলে। যুবক তখন ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে বিরাট এক সাপ বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। সে তখন হাতের বর্শাটা দিয়ে আঘাত করে সাপটাকে।সাপটাও এই আঘাতে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।যুবক ধরে নেয় সাপটা মারা গেছে।সে সাপটাকে বর্শায় গেঁথে বাইরে নিয়ে আসে, ঠিক তখনই আহত সাপ তাকে ছোবল দেয়।এরপর হাদীসের ভাষায় এভাবে লেখা আছে, 'এরপর তাদের মধ্যে কে আগে মারা গেল, সাপ নাকি যুবক, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ' 'কী ভয়ঙ্কর! 'শিউরে উঠলেন আফজাল সাহেব। 'হুমম্ ভয়ঙ্কর।তারপর যুবকের পরিবার পরিজন রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করে তিনি যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করে যুবককে বাঁচিয়ে তোলেন।তাদের ধারণা ছিল সাপে কাটা ব্যাক্তিকে বোধহয় বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব।মজার ব্যাপার কি জানেন আফজাল সাহেব? এই সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগের ভুল ধারণা কিন্তু এখনো আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আছে। মানুষ ভাবে সাপে কাটা মানুষকে বোধহয় ওঝারা বাঁচিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা.সেদিন বলেছিলেন, 'তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা কর।' অর্থাৎ ইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুবকটি মারা গেছে। এরপর তিনি যা বললেন সেটাই হল আমাদের আলোচ্য বিষয়। 'এপর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন ইমাম সাহেব। মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ সব শুনছিলেন আফজাল সাহেব। 'এরপর রাসূল সা.যা বললেন তার মর্মার্থ হল,'কিছু কিছু বাড়িতে সাপের রুপ ধারণ করে জ্বীনেরা বসবাস করে।আরবীতে এদের "আওয়ামের "বলা হয়।এদের দেখামাত্র তিনবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিতে হবে।যদি চলে যায় তাহলে ভাল।বুঝতে হবে এটা ভাল জ্বীন।আর যদি না যায় তখন ধরে নিতে হবে এটা সত্যিকারের সাপ অথবা দুষ্ট জ্বীন।সেক্ষেত্রে অতিদ্রুত সাপটাকে মেরে ফেলতে হবে। এই নিয়মের কারণ হল, যদি ভুলে একটা ভাল জ্বীনকে কোনো ধরনের সতর্ক করা ছাড়াই মেরে ফেলা হয় তাহলে তার স্বজনরা হত্যাকারীর নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে।এবার নিশ্চয়ই সব বুঝতে পেরেছেন? ' মাথা ঝাঁকালেন আফজাল সাহেব, বুঝতে পেরেছেন তিনি সবই। 'তারমানে সেদিন যে সাপটা মারা হয়েছিল সেটা সাপ ছিলনা, সাপরুপী একটা জ্বীন ছিল?আর এখন যে সাপটা আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি সেটা আসলে মৃত জ্বীনের কোনো স্বজন?সতর্ক না করেই তাদের বন্ধুকে মেরে ফেলায় আমাদের ভয় দেখিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ' 'সম্ভবত, কারণ জ্বীনেরা সবচাইতে বেশি কালো সাপের আকার ধারণ করতে পছন্দ করে।আর মৃত সাপটা ছিল কালো। 'সাপটা কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করছেনা, বারবার শুধু দেখা দিয়েই অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ' 'যদ্দুর মনে হচ্ছে এটা কোনো ভাল জ্বীনই হবে, তাই শুধু ভয় দেখাচ্ছে। খারাপ জ্বীন হলে কি ঘটত বলা যাচ্ছেনা। ' 'এখন তাহলে কি করতে পারি আমরা? ' 'দাড়ান, আপনাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, 'বলে একটা ড্রয়ার খুলে ইমাম সাহেব চারটা পেড়েক আফজাল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিলেন।' বাড়িতে গিয়েই এই চারটা পেড়েক বাড়ির চারকোনায় পুঁতে দেবেন। আর রাতে শোবার সময় আয়াতুল কুরসী পড়ে শোবেন, ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবেনা।' আফজাল সাহেব আরো দু একটা কথা বলে বিদায় নিলেন। দরজার কাছে গিয়ে একটা কথা মনে হতে ফিরে তাকিয়ে বললেন, 'আচ্ছা হুজুর, সাপটাকে যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সে জায়গাটা খালি কেন? কোথায় গেল সাপটা? ' 'ধারণা করছি তার স্বজনরা নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও সম্মানের সাথে দাফন করেছে তাকে। ' আফজাল সাহেব ফিরে আসতে লাগলেন। মনটা হঠাৎ করেই খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে তার।
উপসংহার
টানা দু রাত প্রায় নির্ঘুম কাটাবার পর আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আফজাল সাহেবের ছোট্ট পরিবার। তবে যদি এই মূহুর্তে কেউ জেগে থাকত তাহলে দেখতে পেত. . .
মোটাসোটা মানুষ সাজেদা বেগম।অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। একটু পর পরই পানি খাওয়া তার অভ্যেস।রান্না করার সময়ও বড়সড় একটা পানির বোতল পাশে নিয়ে রাখেন।আজ গরমটা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি।বিরাট আকারের বোতলের পানিও তলানিতে এসে ঠেকেছে।কাজের ছেলে টিটু দোকানে গেছে।ওকে দিয়ে পানি আনার কোন উপায় আপাতত না থাকায় সাজেদা বেগম নিজেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ফিল্টারের সামনে দাড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢাললেন।গ্লাস থেকে পানিটা যখন গলায় ঢালতে যাবেন তখনই তার চোখের কোনে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। অর্ধেক খাওয়া গ্লাসটা নামিয়ে সেদিকে তাকালেন। ওদিকটাতে শুধু একটা টেবিল রাখা।যতদুর মনে হয় টেবিলটার আশেপাশেই নড়াচড়াটা দেখেছিলেন তিনি।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পরও কোন ধরনের বৈসাদূশ্য তার চোখে ধরা পড়লনা। গ্লাসটা আবার তুললেন মুখের কাছে, ঠিক তখনই টেবিলের নিচে ফের নড়াচড়া।তাকালেন তিনি, এবং ভয়ঙ্কর জিনিসটা এবার স্পষ্টই দেখতে পেলেন। মিশমিশে কালো রংএর একটা সাপ! লম্বায় চার ফুট তো হবেই।কুন্ডলী পাকাচ্ছে। এই বাড়িতে সাপ কোত্থেকে আসবে সে ভাবনা চিন্তা করার আগেই চিল চিৎকার ছাড়লেন সাজেদা বেগম,'বাচাও!সাআআআপ!'প্রলম্বিত আত্মচিৎকার। 'কি হইছে আম্মা? 'হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তের বছর বয়সী টিটু। দোকানে গিয়েছিল লবন কিনতে। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই শুনতে পায় তার আম্মা চিৎকার করছে। টিটু এতিম মানুষ।ছোটবেলা থেকেই আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম দম্পতির কাছে মানুষ।তাদের দুই ছেলেই দেশের বাইরে থাকায় টিটুর প্রতি তাদের মমতা একটু অন্যরকম।টিটুও এই মধ্যবয়সী দম্পতিকে নিজের বাবা মায়ের মতই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।তাই সাজেদা বেগমের চিৎকার শুনেই ছুটে এল। 'সাপ,সাপ! 'শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। টিটু হাতের লবনের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে একদৌড়ে স্টোররুমে চলে গেল।খুঁজে পেতে একটা শক্তপোক্ত লাঠি মুঠোয় করে ফিরে এল ডাইনিং রুমে। 'সাপ কোন জায়গায় আম্মা? ' সাজেদা বেগম হাত ইশারায় শুধু.টেবিলটাই দেখাতে পারলেন টিটুকে।বাক এখনও রুদ্ধ। সাপটা ইতোমধ্যে সাজেদা বেগমের চিৎকারে জায়গা বদল করেছে ফেলেছে।টেবিলের নিচটা এখন শুন্য। টিটু হাতের লাঠিটা বাড়িয়ে ধরে সামনে এগোতে লাগল। 'সাবধানে যাস বাবা,' এতক্ষণে কথা বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। 'চিন্তা কইরেন না আম্মা। ছোডকালে কত সাপ ধইরা ধইরা গিট্টু দিয়া ছাইড়া দিছি। ' 'এটা কিন্তু বিষাক্ত হবার সম্ভবনা আছে। ' সাজেদা বেগমের এ কথাটার জবাব দিলনা টিটু।টেবিলের সামনে এসে হামা দিয়ে নিচটা দেখল।না, সাপটা ওখানে নেই। উঠে দাড়িয়ে সতর্ক চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। ঘরের একমাত্র জানালাটা অনেক বড়।জানালার চাইতে পর্দাটা আরো বড়।একেবারে মেঝে পর্যন্ত ঝুল। পর্দাটা আচমকা নড়ে উঠতেই টিটু পর্দার দিকে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে গেল।ঝটকা দিয়ে পর্দাটা সরাতেই কুন্ডলী পাকানো সাপটা দেখা গেল। গায়ের রং কুচকুচে কালো।কেমন একটা হিমশীতল ভাব।গা শিউরে ওঠে দেখলে। টিটুকে দেখে সাপটা ফনা তোলার উপক্রম করল।টিটু অবশ্য সে সুযোগ সাপটাকে দিলনা।লাঠিটা দিয়ে কষে একটা বাড়ি বসাল সাপটার পিঠে।জায়গামতো পড়েছে বাড়িটা।ফোঁসফোঁস করে উঠল সাপটা।গোটা দেহ মোচড় খেতে লাগল। টিটু বাড়ি দিয়ে লাঠিটা ওঠায়নি।মেঝের সাথে চেপে ধরে আছে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর কেমন নেতিয়ে গেল সাপটা।তবে মরেনি যে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে নড়তে থাকা লেজটা দেখে। টিটু লাঠিটা ওঠাল।উঠিয়ে আরেকটা যুৎসই বাড়ি দেবার ইচ্ছা।লাঠিটা ওঠাতেই নেতিয়ে পড়া সাপটা স্বরুপে ফিরে গেল।বিদ্যুৎবেগে ছোবল বসাল টিটুর পা লক্ষ্য করে। সতর্ক থাকায় অল্পের জন্য বেঁচে গেল টিটু।সাপের মাথাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।টিটুর পায়ে গা শিউরানো একটা স্পর্শ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টিটুর দ্বিতীয় বাড়ি আছড়ে পড়ল আগের জায়গায়। এবার আগের চাইতেও বেশি জোরে। এবার আর ভান নয়, সত্যি সত্যিই পটল তুলল সাপটা।শিড়দাড়া গুড়িয়ে গেছে। টিটু লাঠির আগাটা দিয়ে মাথায় আঘাত করে সাপটার মৃত্যু নিশ্চিত করল। 'আম্মা চান্দু শ্যাষ! ' লাঠির আগায় সাপটা তোলার কসরত করতে করতে বলল টিটু।মুখে একগাল হাসি, যেন বিশ্ব জয় করে এইমাত্র ঘোড়া থেকে নামল আলেকজান্ডার। 'বাসার পেছনে পুঁতে দিয়ে আয়। ভালমত গর্ত করিস, নয়ত আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে।' 'জে আম্মা। 'সাপটাকে দোলাতে দোলাতে বাইরে নিয়ে গেল টিটু। এতক্ষণে হাপ ছাড়লেন সাজেদা বেগম। উত্তেজনার প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যেতেই তিনি অনুভব করলেন, তার প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।অর্ধেক ভরা গ্লাসটা মুখে তোলার আগেই নাকে পোড়া গন্ধ পেলেন। সর্বনাশ! চুলার তরকারি পুড়ে খাক হচ্ছে!
দুই
গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় আফজাল সাহেব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় আবিষ্কার করলেন বাড়ির চারপাশটা বেশ জঙ্গল হয়ে আছে।পরিষ্কার করাতে হবে লোক এনে। তিনি তার ডাক্তারি পেশা নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় সাংসারিক ব্যাপারে তেমন মনোযোগ দিতে পারেননা।তার প্রবাসী দুই ছেলে প্রতিমাসে যথেষ্ঠ পরিমাণে টাকা পাঠালেও তিনি তার পেশাটাকে ছাড়তে পারেননি।পৃথিবীতে কাজের মানুষের খুব অভাব।আফজাল সাহেব একজন সত্যিকারের কাজের মানুষ।আজকাল দরিদ্র রোগীদের ফ্রীতেই দেখেন তিনি। দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চাপ দিলেন তিনি।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল টিটু।বোধহয় তৈরী হয়েই ছিল। 'খালু জানেন আইজ কি হইছিল?' দরজা খুলেই প্রশ্ন করল টিটু। উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে। টিটুর উত্তেজনা অবশ্য আফজাল সাহেবকে ছুঁতে পারলনা।বাচ্চারা তো কত কিছুতেই উত্তেজিত হয়।নিরাসক্ত গলায় বললেন, 'কিভাবে জানব? তোরা তো কেউ বলিসনি।' 'আর বলোনা, আজ সন্ধ্যায় বিশাল এক সাপ ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে।ভাগ্যিস সময়মত টিটু মারতে পেরেছিল।'আফজাল সাহেবের গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন সাজেদা বেগম।তরকারি পুড়ে যাওয়ায় এখনো রান্নাঘরের পাট চুকাতে পারেননি।আবার রাধতে হচ্ছে। 'তাইনাকি! ' ভ্রু কুঁচকে বললেন আফজাল সাহেব। 'তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো, খেতে খেতে শুনবে। ' আফজাল সাহেব কথা না বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন। আজ গরমটা পড়েছে মারাত্মক। গোসল করলে ভাল হতো। 'টিটু, আমার লুঙ্গি আর গামছাটা দিয়ে যা তো বাবা, 'হাক ছাড়লেন আফজাল সাহেব। বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপটা পুরো ছেড়ে দিলেন।বালতিতে গোসল করে অভ্যেস আফজাল সাহেবের। ঝর্ণা দিয়ে গোসল করে ঠিক তৃপ্তি পাননা তিনি। পানি পড়ে তো পড়েনা। বালতিটা ভরা হতেই একমগ পানি গায়ে ঢাললেন।পানির ধারাটা সারাদিনের ক্লান্ত দেহে শীতল একটা পরশ দিয়ে গেল। আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আফজাল সাহেব।চোখ বন্ধ করেই আরেক মগ পানির জন্য বালতিতে মগ ডুবাতেই কিসের যেন স্পর্শ পেলেন হাতে।ঝট করে চোখ খুলে দেখেন বড়সড় লাল বালতিটাতে একটা বিরাটাকারের সাপ কিলবিল করছে। লম্বায় চারহাতের মত হবে। চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ থেকে পানির কনাগুলো মুছে ঝাপসা দৃষ্টি স্বচ্ছ করে নিয়ে আবার তাকালেন।এবারের চমকটা আগের চাইতেও তীব্র। বালতি পুরো খালি! তাহলে একটু আগে কি ভুল দেখলেন? ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন? তাহলে হাতের স্পর্শটা? বালতির পুরো পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে ভরে নিলেন।এই পানি আর ব্যবহার করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলেন খাবার দেয়া হয়েছে।তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন। আফজাল সাহেবের বাসায় দামী একটা ডাইনিং টেবিল থাকলেও সেটা শোভাবর্ধন ছাড়া আর কোনো কাজে আসেনা।আফজাল সাহেব মাটিতে বসে খান।নবীজীর সা.সুন্নত।তাছাড়া আফজাল সাহেব লক্ষ করে দেখেছেন মাটিতে ছড়িয়ে বসে খাওয়ার আনন্দের ধারে কাছেও ডাইনিং টেবিলের স্থান নেই। মাটিতে বসে খাবার নিয়মে সবচাইতে বেশি খুশি টিটু।খাওয়ার সময় ওর বসা দেখলে মনে হতে পারে খাওয়ার চাইতে বসায় বেশি আনন্দ পাচ্ছে ছেলেটা। 'কি হয়েছিল বলতো। 'প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে জানতে চাইলেন আফজাল সাহেব। সাজেদা বেগম যখন বিতং বর্ননা শেষে সাপটার বর্ননায় এলেন তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, 'সাপটা কেমন? চারহাত লম্বা, কালো রংয়ের? ' 'হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে? 'বিস্ময়ের সাথে বললেন সাজেদা বেগম। আফজাল সাহেব তার কথার জবাব দিলেননা।কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেননা তিনি। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, বাথরুমে তার ভ্রম হয়েছিল,তাহলে একটু আগের মৃত সাপটার সাথে তার "ভ্রম "মিলে গেল কিভাবে? এত কাকতালীয় ঘটনা কী পৃথিবীতে ঘটে? অর্ধেক খেয়েই উঠে পড়লেন আফজাল সাহেব।সাপটা দেখার পর থেকেই তার গা ঘিনঘিন করছে।
তিন
সিলিংএর ফ্যানটা সর্বশক্তি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।এরপরও যে ঘরের গুমোট গরমটা দুর করতে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারছে সেটা বলা যাবেনা। আফজাল সাহেবের কোল্ড অ্যালার্জি থাকায় এসি লাগাননি ঘরে। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল সাজেদা বেগমের।কয়েকমূহুর্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারলেননা তিনি। ঘুম ভাঙ্গার কারণটাও পরিষ্কার না। হঠাৎ করে মাথার কাছে হিসহিস আওয়াজ হতেই ফিরে তাকিয়ে দেখেন হাতচারেক লম্বা একটা কালো সাপ ফনা তুলে আছে! সাজেদা বেগম ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই সাপটা হিলহিল করে খাট থেকে মেঝেতে নেমে গেল। সাজেদা বেগম সাপটার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মেঝেতে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঝকঝকে সাদা টাইলসের মেঝে সম্পুর্ন খালি। সাপটা উধাও! সাজেদা বেগম স্বামীকে ডাক দিতে যাবেন এমন সময় টিটুর ভয়ার্ত আত্মচিৎকার শোনা গেল পাশের রুম থেকে।সে চিৎকার আফজাল সাহেবের ঘুমটাও ভাঙ্গিয়ে দিল। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পাশের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলেন তিনি, পেছন পেছন সাজেদা বেগম। টিটুর রুমে এসে লাইট জ্বালাতেই ওকে বিছানায় বসে থাকতে দেখা গেল। দুচোখে নগ্ন আতংক।'খালু আমারে বাচান। ' আফজাল সাহেবদের দেখে বলে উঠল টিটু। 'কি হয়েছে? ' 'খালু তহন যে সাপটারে মারছি সেইটার বউ "পুরতিশুধ "নিতে আইছে! ' টিটুর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলার যথেষ্ঠ কারণ থাকা সত্বেও হাসতে পারলেন না আফজাল সাহেব। 'কোথায় সাপটা? ' 'খাটের নিচে হান্দাইছে। ' আফজাল সাহেব উবু হয়ে খাটের নিচে তাকালেন।যা ভেবেছিলেন,সেটাই।খাটের নিচটা পুরো ফাঁকা।ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়ত খুঁজে দেখতেন আশপাশটা। কিন্তু তিনি জানেন সাপটাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। টিটুকে মশা না থাকা সত্বেও মশারি টানাবার পরামর্শ দিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলেন আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম। রুমে এসে সাজেদা বেগমকে ড্রয়ার থেকে মশারি বের করতে দেখে আফজাল সাহেব বললেন, 'তুমিও একটু আগে দেখেছ সাপটাকে, তাইনা? ' জবাবে কথা না বলে সম্মতিসূচক মাথা ঝাকালেন সাজেদা বেগম। পরেরদিন সামনে একজন রোগী নিয়ে চেম্বারে বসে আছেন আফজাল সাহেব।সামনে যে রোগীটা বসে আছে সে যেকোনো মূহুর্তে প্রপাত ধরনীতল হতে পারে।হলে কি করা উচিৎ সেটা নিয়ে তিনি খানিক চিন্তিত। লোকটা তার চেম্বারে একাই এসেছে টলতে টলতে।সাপের ফনার মত শরীরটা দুলছে তার। হঠাৎ করেই বিরক্তবোধ করলেন আফজাল সাহেব।তিনি এসব কি ভাবছেন।সাপের ফনার মত দুলতে যাবে কেন একজন মানুষ। গতকালের ব্যাপারটা বেশ প্রভাব ফেলেছে তার মনে। খারাপ প্রভাব। মোবাইলটা বেজে উঠতে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল আফজাল সাহেবের। ডিসপ্লেতে রমজান আলির নাম ভেসে আছে।তিনি চেম্বারে আসার আগে তিনজন লোক ঠিক করে দিয়ে এসেছেন বাড়ির চারপাশটা সাফাই করার জন্য।রমজান হল তাদের লিডার।আফজাল সাহেবের পূর্ব পরিচিত। 'বলো, রমজান, 'ফোন রিসিভ করে বললেন আফজাল সাহেব। এরপর হড়বড় করে রমজান আলি যা বলল তার সারমর্ম হল, সে এবং তার লোকরা জঙ্গল সাফ করতে গিয়ে বারবার সাপ দেখে ভিড়মি খাচ্ছে।সাপগুলোও ভারী বদ।এই আছে, এই নেই! আফজাল সাহেব বাড়তি টাকা দেবার আশ্বাস দিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করলেন। ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।অন্য সময় হলে ভাবতেন অদৃশ্য সাপের আজগুবি গল্গ ফেঁদে বাড়তি টাকা নেয়ার ফন্দি করছে রমজান আলি।এখন সেটা ভাবছেননা। তিনি জানেন কোথাও কোনো গড়বড় হয়ে গেছে।রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে বাড়িটাতে।দ্রুত কিছু একটা করা উচিৎ,কোনো অঘটন ঘটবার আগেই।
চার
মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।কিছু কিছু মানুষ থাকেনই এমন।সৌম্য দর্শন চেহারা।ধবধবে সাদা চাপদাড়ি তার মধ্যে এনে দিয়েছে একধরনের গাম্ভীর্য।ষাটোর্দ্ধ এই বৃদ্ধ হলেন আফজাল সাহেবদের মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম।খুবই কামেল লোক।প্রতিদিন বহু মানুষ নানান ধরনের সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসেন।রহস্যময় সব সমস্যা। আফজাল সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়লেও ইমাম সাহেবের সাথে তার বিশেষ পরিচয় নেই। দেখা হলে "কেমন আছেন, ভাল আছি " পর্যন্তই তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ,অন্তত এতদিন ছিল।এইমূহুর্তে তিনি ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। সকালের দিকে রমজান আলির কথা শোনার পর আজ আগেভাগেই চেম্বার ছেড়েছেন তিনি।এখন মাগরিবের নামাজ শেষ করে ইমাম সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছেন। মসজিদে আপাতত তিনি আর ইমাম সাহেব ছাড়া কেউ নেই।নামাজ শেষে সবাই চলে গেছে।ইমাম সাহেব দীর্ঘক্ষণ ধরে নফল নামাজ পড়েন।আফজাল সাহেব গিয়ে দেখা করলে হয়ত তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন, কিন্তু আফজাল সাহেব সেটা করলেন না।তার হাতে সময় আছে।তিনি আপাতত তার চলমান সমস্যাটা নিয়ে ভাবছেন। আফজাল সাহেব নিজে পেশায় একজন ডাক্তার হওয়ায় সারাজীবন সমস্ত ঘটনার পেছনে কার্যকারণ খুঁজে এসেছেন। পৃথিবীতে রহস্যময় ঘটনা ঘটে, তিনি সেটা স্বীকারও করেন।সব ঘটনার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনা।তবে রহস্যময় ঘটনা ঘটার পেছনেও তো একটা কার্যকারণ থাকতে বাধ্য।কিন্তু তাদের সাথে ঘটা রহস্যময় ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?একটা মৃত সাপ কেন বারবার ফিরে আসবে? পৃথিবীতে,বিশেষ করে বাংলাদেশে এই কিলবিলে প্রাণীটাকে নিয়ে যত ধরনের রহস্যময় ঘটনা প্রচলিত আছে আর কোনো প্রাণী সম্পর্কে এতটা নেই।এদেশে সাপ যতটা না একটা সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী তারচাইতে বেশি একটা রহস্যময় প্রাণী। বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা এই প্রাণীটাকে নিজেদের স্বার্থে একটি অতিলৌকিক রুপ দান করেছে।যেমন,কালনাগিনী সাপের মানুষের রুপ ধারণ করা, শনি আর মঙ্গলবারে ঢোড়া সাপের বিষ আসা, জোড়া সাপের একটাকে মারলে অপরটা বাড়ি চিনে হত্যাকারীকে উপর প্রতিশোধ নেয়া, বিণ বাজালে সাপ এসে ধরা দেয়া কিংবা বাজনার তালে তালে নাচা, ,ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য গুজব। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আফজাল সাহেব জানেন এগুলোর প্রায় সবই মিথ্যের জালে আবৃত। কালনাগিনীকে খুবই বিষাক্ত এবং অলৌকিক একটা প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।অবশ্য সুন্দরবন এলাকায় কালনাগিনী নামে এক প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়াও যায়। মজার ব্যাপারটা হল এই কালনাগিনী খুবই নিরীহ এবং নির্বিষ একটা সাপ।নিরীহ এই সাপের মানুষের রুপ ধারন করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। এরপর ধরা যাক জোড়া সাপের কথা।এটাও একটা গুজব।সাপের দৃষ্টিশক্তি খুবই কম,প্রায় না থাকার মতোই।সুতরাং সঙ্গীর হত্যাকারীকে ভালমত দেখাই সাপের পক্ষে সম্ভব না, বাড়ি চিনে প্রতিশোধ নেয়া তো হাস্যকর। দৃষ্টিশক্তির মত সাপের শ্রবনশক্তিও খুবই দুর্বল। জিহ্বাটাই হল তার শ্রবণযন্ত্র। যেটা একটু পর পর মুখ থেকে বের করে সে শোনার কাজ চালায়। এত দুর্বল শ্রবনযন্ত্র দিয়ে মাইলকে মাইল দুরের বিণের আওয়াজ শোনার কোন যৌক্তিক কারণ নেই সাপের।বিণের তালে তালে নাচ দেখিয়ে বেদেরা যে টাকা পয়সা নেয় এর পেছনেও রয়েছে সুক্ষ কারসাজি।বেদেরা যখন বিণ বাজায় তখন সাপ সেটা শুনতে পায়না, বরং আগে থেকে ট্রেনিং দেয়ার ফলে বেদের হাতের নড়াচড়া দেখে সাপও নিজের ফণা তোলা দেহ নাচায়। দেখলে মনে হয় বুঝি বিণের মায়াবী সুরেই. . .! মানুষ সবচাইতে বেশি যে ব্যাপারটাতে বিভ্রান্ত হয় সেটা হল, অলৌকিক গাছ! বেদেরা দাবি করে এসব গাছের যেকোনো অংশ সাথে থাকলে তাকে আর সাপ ছোবল দিতে পারবেনা।প্রমাণ হিসেবে তারা দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে হাতে একটা গাছের ছোট্ট টুকরো ধরিয়ে দিয়ে সাপের কাছে নিতে বলে হাতটাকে।এরপর দেখা যায় সাপটা তার হাত দেখে ভয়ে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে। এটাও বেদেদের আরেকটা ধোকাবাজি।তারা প্রথমে সাপ ধরে ধরে লোহার শিক দিয়ে ছ্যাঁকা দেয় সাপের গায়ে। পরবর্তীতে সাপটা এমনই ভীতু হয়ে পড়ে, তখন কেউ তার দিকে হাত বাড়ালেই সে ছ্যাঁকা খাবার ভয়ে মাথা সরিয়ে নেয়।আর বেদেরা এই সুযোগে সাধারণ মানুষের কাছে গাছের আজেবাজে ছাল বিক্রি করে। সাপ সম্পর্কে যতগুলো গুজব প্রচলিত আছে তার সবগুলোর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাই আফজাল সাহেব জানেন।কিন্তু তার সাথে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে নেই।দেখা যাক ইমাম সাহেবের কাছে আছে কিনা। ইমাম সাহেবের নামাজ শেষ। তিনি জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাড়াতে আফজাল সাহেবও উঠে দাড়ালেন। 'কেমন আছেন আফজাল সাহেব? ' আফজাল সাহেবকে দেখে ভরাট গলায় বলে উঠলেন ইমাম সাহেব। 'জী ভাল, আপনি? ' 'আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন ? ' 'জী ' 'তো সেটা আগে বলবেন তো। আমি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতাম ' 'না, কোনো অসুবিধা নেই, আমার হাতে সময় আছে। ' 'তা কি সমস্যা আপনার? ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন। তিনি তো বলেননি তার কোনো সমস্যা আছে। ইমাম সাহেব যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই বললেন,'ভাবছেন, আমি কিভাবে জানলাম? না না, কোনো জ্বীন টীন এসে বলে যায়নি আমাকে।আসলে সমস্যা ছাড়া কেউ তেমন একটা আসেনা আমার কাছে,'বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন ইমাম সাহেব। এবার আফজাল সাহেব যথেষ্ঠ লজ্জিত হলেন। সত্যিই তো, মানুষটার সাথে এতদিন হল পরিচয়, কখোনো তো তেমনভাবে কথাও বলেননি।আজ যেই সমস্যা দেখা দিয়েছে,অমনি এসে হাজির। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেননা তিনি, এমনসময় ইমাম সাহেব তাকে উদ্ধার করলেন, 'চলুন, আমার রুমে গিয়ে কথা বলি। ' তারা দুজনে মসজিদ সংলগ্ন ইমাম সাহেবের কামরায় এলেন। রুমটাতে ইমাম সাহেব নামাজের আগে পরে বিশ্রাম নেন।ঘর ভর্তি দেশী বিদেশী বই, বেশিরভাগই আরবী। খানিক বাদেই আফজাল সাহেবের আপত্তি সত্বেও মসজিদের খাদেম চা নাস্তা দিয়ে গেল। 'অসুবিধা না থাকলে আপনার সমস্যাটা এবার বলতে পারেন, 'চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব শুরু করলেন। কিছুই বাদ দিলেন না।সাপটাকে মারার পর থেকে কিভাবে মৃত সাপটাকে বারবার দেখা যেতে লাগল সেটাও বিস্তারিত বলে গেলেন। শুনে ইমাম সাহেব কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন, 'হুমম্ সমস্যাটা বোধহয় আমি বুঝতে পারছি। ' 'কী সেটা? ' 'বলব, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।আজ তো রাত হয়ে গেছে, আজ আর হবেনা। আপনি কাল সাপটা যেখানে পোঁতা হয়েছিল সে জায়গাটা খুড়ে দেখবেন মৃত সাপটা এখনো সেখানে আছে কিনা। ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন।এটা কি বলছেন ইমাম সাহেব? 'হুজুর, আপনি কি ভাবছেন সাপটা ভূত হয়ে. . .' 'আমি কিছুই ভাবছিনা, এটা শুধুমাত্র আমার কৌতুহল বলতে পারেন।আপনি কাল ব্যাপারটা দেখে আসুন, আমি ইনশাআল্লাহ সমাধান দেবার চেষ্টা করব। ' আফজাল সাহেব আর তেমন কথা বাড়ালেননা। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন। মনটা কেমন খুতখুত করছে। ইমাম সাহেবও তাহলে ভূতে বিশ্বাস করেন! বাসায় এসে তিনি আর আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারলেননা।টিটুকে একটা শাবল নিয়ে বাইরে আসতে বললেন।টিটু শাবল আনতে তিনি বললেন, 'সাপটাকে কোথায় পুঁতেছিলি দেখা তো একটু। ' 'কেন খালু? ' 'আছে, দরকার আছে। তুই দেখিয়ে দে।' টিটু বাড়ির পেছনে এসে একটা জায়গা দেখাল,'উই যে। ' জায়গাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকাল খোঁড়া হয়েছিল।এরপরও নিশ্চিত হবার জন্য বললেন, 'শিওর তুই? ' 'এক্কেরে শিউর। "হানডেডে হানডেড! " আফজাল সাহেব মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন।সেটা দেখে টিটু বলে উঠল, 'খালু এইডা কি করেন? ' 'দেখতে থাক, 'মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই জবাব দিলেন আফজাল সাহেব। প্রায় দেড় হাতের মত খোঁড়ার পরও সাপ তো দুরের কথা, একটা কেঁচোও দেখা গেলনা।এতক্ষণে টিটুও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। বলল, 'খালু, মাটি তো এতো খুড়ছিলাম না। আধা হাত খুইড়াই হান্দাইয়া থুইছিলাম।চান্দু গেলো কুনহানে? আমার মনে কয় চান্দু মরে নাই।কব্বর থিকা বাইর হইয়া আইছে। "পুরতিশুধ" নিবো,গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে লাগল টিটু। আফজাল সাহেব টিটুর কথার জবাব দিলেন না।তিনি খুব বেশি অবাক হননি।যেন জানতেন এটাই ঘটবে। তবে রহস্যটা তাতে এতটুকুও পরিষ্কার হয়নি, আরো ঘোলাটে হয়েছে।
পাঁচ
চারদিকটা এখনো আঁধারে ঢাকা।দিগন্তের কাছে একটা শুভ্র রেখা জানান দিচ্ছে আঁধারের আয়ু কমে আসছে। আফজাল সাহেব মসজিদের দিকে চলছেন।তার ইচ্ছে করছে একছুটে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে বলেন। গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বেশ ভালমত মশারী টানানো হয়েছিল। আফজাল সাহেব চেম্বার থেকে ফেরার পথে এক বোতল কার্বলিক এসিড নিয়ে এসেছিলেন। সেটারও সদ্ব্যবহার করা হয়। যদিও আফজাল সাহেব নিশ্চিত ছিলেননা একটা ভূতুড়ে সাপের বিরুদ্ধে এগুলো কতটা কাজে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা। একটা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই বিছানায় যান তিনি।এর আগের রাতেও তেমন ভাল ঘুম হয়নি। গতকাল তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যান আফজাল সাহেব।ঘুম ভাঙ্গে বুকের উপর একটা চাপ অনুভূত হওয়ায়। চোখ খুলে একমূহুর্ত আবছা আঁধারে কিছুই ঠাহর করতে পারেননা আফজাল সাহেব।একটু পরই অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখতে পান মৃত সাপটা তার বুকের উপর বসে আছে! আফজাল সাহেবকে চোখ মেলতে দেখেই কিনা, সাপটা ফণা তুলল। এক্ষুনি ছোবল দেবে! আফজাল সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন আতঙ্কে। এক এক করে দশটা সেকেন্ড পার হয়ে গেল।প্রতিটা সেকেন্ড যেন এক একটা ঘন্টা।দেহের কোথায় কোন তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করতে না পেরে চোখ মেললেন তিনি।সাপটা অদৃশ্য হয়েছে। বাকি রাতটা আর ঘুম আসেনি তার।আজ ফজরের আজান দিতে না দিতেই মসজিদের পথ ধরেছেন তিনি। ফজরের নামাজ শেষ। ইমাম সাহেব সম্ভবত কোনো দোয়া পড়ছেন। মুসল্লীরা একে একে উঠে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। ইশারায় তার পিছু পিছু যেতে বললেন আফজাল সাহেবকে। ইমাম সাহেবের রুমে মুখোমুখি বসলেন দুজন। 'তারপর বলুন,কি অবস্থা আপনার? 'বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব সব খুলে বললেন।গতরাতের ঘটনাটাও। 'বুঝতে পেরেছি, 'মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। কিছু বললেন না আফজাল সাহেব। একটা ব্যাখ্যার আশায় আছেন। 'আপনাকে একটা হাদীস শোনাই, তাহলেই আশা করি রহস্যটা পরিষ্কার হবে আপনার কাছে। ' তার এই অদ্ভুত সমস্যার সাথে হাদীসের কি সম্পর্ক সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলেন আফজাল সাহেব। 'হাদীসের সবচাইতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ "মুসলিম শরীফের "একটা হাদীস এটা। পুরো ঘটনাটা বেশ বড়, আমি সংক্ষেপে মূল ঘটনাটা বলছি।ঘটনাটা খন্দকের যুদ্ধের সময়।ওই সময় এক সদ্য বিবাহিত যুবকও যুদ্ধে অংশ নেয়।সে প্রতিদিন দুপুর বেলা রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে বলে নিজের বাড়িতে আসতো।একদিন দুপুরবেলা বাড়ি এসে দেখে তার সদ্য পরীনিতা স্ত্রী বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে আছে।যুবক খানিকটা রেগে যায় এতে।বকাঝকা শুরু করে স্ত্রীকে।তখন তার স্ত্রী কী ঘটেছে সেটা ভেতরে গিয়ে তাকে দেখে আসতে বলে। যুবক তখন ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে বিরাট এক সাপ বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। সে তখন হাতের বর্শাটা দিয়ে আঘাত করে সাপটাকে।সাপটাও এই আঘাতে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।যুবক ধরে নেয় সাপটা মারা গেছে।সে সাপটাকে বর্শায় গেঁথে বাইরে নিয়ে আসে, ঠিক তখনই আহত সাপ তাকে ছোবল দেয়।এরপর হাদীসের ভাষায় এভাবে লেখা আছে, 'এরপর তাদের মধ্যে কে আগে মারা গেল, সাপ নাকি যুবক, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ' 'কী ভয়ঙ্কর! 'শিউরে উঠলেন আফজাল সাহেব। 'হুমম্ ভয়ঙ্কর।তারপর যুবকের পরিবার পরিজন রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করে তিনি যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করে যুবককে বাঁচিয়ে তোলেন।তাদের ধারণা ছিল সাপে কাটা ব্যাক্তিকে বোধহয় বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব।মজার ব্যাপার কি জানেন আফজাল সাহেব? এই সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগের ভুল ধারণা কিন্তু এখনো আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আছে। মানুষ ভাবে সাপে কাটা মানুষকে বোধহয় ওঝারা বাঁচিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা.সেদিন বলেছিলেন, 'তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা কর।' অর্থাৎ ইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুবকটি মারা গেছে। এরপর তিনি যা বললেন সেটাই হল আমাদের আলোচ্য বিষয়। 'এপর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন ইমাম সাহেব। মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ সব শুনছিলেন আফজাল সাহেব। 'এরপর রাসূল সা.যা বললেন তার মর্মার্থ হল,'কিছু কিছু বাড়িতে সাপের রুপ ধারণ করে জ্বীনেরা বসবাস করে।আরবীতে এদের "আওয়ামের "বলা হয়।এদের দেখামাত্র তিনবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিতে হবে।যদি চলে যায় তাহলে ভাল।বুঝতে হবে এটা ভাল জ্বীন।আর যদি না যায় তখন ধরে নিতে হবে এটা সত্যিকারের সাপ অথবা দুষ্ট জ্বীন।সেক্ষেত্রে অতিদ্রুত সাপটাকে মেরে ফেলতে হবে। এই নিয়মের কারণ হল, যদি ভুলে একটা ভাল জ্বীনকে কোনো ধরনের সতর্ক করা ছাড়াই মেরে ফেলা হয় তাহলে তার স্বজনরা হত্যাকারীর নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে।এবার নিশ্চয়ই সব বুঝতে পেরেছেন? ' মাথা ঝাঁকালেন আফজাল সাহেব, বুঝতে পেরেছেন তিনি সবই। 'তারমানে সেদিন যে সাপটা মারা হয়েছিল সেটা সাপ ছিলনা, সাপরুপী একটা জ্বীন ছিল?আর এখন যে সাপটা আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি সেটা আসলে মৃত জ্বীনের কোনো স্বজন?সতর্ক না করেই তাদের বন্ধুকে মেরে ফেলায় আমাদের ভয় দেখিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ' 'সম্ভবত, কারণ জ্বীনেরা সবচাইতে বেশি কালো সাপের আকার ধারণ করতে পছন্দ করে।আর মৃত সাপটা ছিল কালো। 'সাপটা কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করছেনা, বারবার শুধু দেখা দিয়েই অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ' 'যদ্দুর মনে হচ্ছে এটা কোনো ভাল জ্বীনই হবে, তাই শুধু ভয় দেখাচ্ছে। খারাপ জ্বীন হলে কি ঘটত বলা যাচ্ছেনা। ' 'এখন তাহলে কি করতে পারি আমরা? ' 'দাড়ান, আপনাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, 'বলে একটা ড্রয়ার খুলে ইমাম সাহেব চারটা পেড়েক আফজাল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিলেন।' বাড়িতে গিয়েই এই চারটা পেড়েক বাড়ির চারকোনায় পুঁতে দেবেন। আর রাতে শোবার সময় আয়াতুল কুরসী পড়ে শোবেন, ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবেনা।' আফজাল সাহেব আরো দু একটা কথা বলে বিদায় নিলেন। দরজার কাছে গিয়ে একটা কথা মনে হতে ফিরে তাকিয়ে বললেন, 'আচ্ছা হুজুর, সাপটাকে যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সে জায়গাটা খালি কেন? কোথায় গেল সাপটা? ' 'ধারণা করছি তার স্বজনরা নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও সম্মানের সাথে দাফন করেছে তাকে। ' আফজাল সাহেব ফিরে আসতে লাগলেন। মনটা হঠাৎ করেই খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে তার।
উপসংহার
টানা দু রাত প্রায় নির্ঘুম কাটাবার পর আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আফজাল সাহেবের ছোট্ট পরিবার। তবে যদি এই মূহুর্তে কেউ জেগে থাকত তাহলে দেখতে পেত. . .
Published on October 05, 2013 02:06
রঙিন ছায়া
এক
রাতুলের মন এত ভাল শেষ কবে ছিল মনে করতে পারছেনা ও।ওর জীবনে বড় আনন্দের প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। ছোট ছোট আনন্দ নিয়েই ওর বসবাস।এরপরও এই ক্ষুদে আনন্দগুলো যে অহরহ ওর জীবনে আসে তাও না। এজন্যই শেষ আনন্দের মুহুর্তটা মনে করতে গিয়ে মোটামুটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ওকে।
যতদুর মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে যেদিন ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠল সেদিনও এরকমই আনন্দ হয়েছিল ওর। অনেক বড় বড় মনে হয়েছিল নিজেকে। তবে এটাই একমাত্র কারন ছিল না।
রাতুল ধরেই নিয়েছিল, ফাইভ পাশ করার পর ওকেও ওর বেশিরভাগ বন্ধুর মত হোটেলের বয় কিংবা টেম্পুর হেলপার হতে হবে।
হোটেলের ওয়েটার বা, লোকাল বাসের হেলপার হতে হলে আগে এসব করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, রাতুল জানে। ওর বন্ধুরা ওকে বলে। ও আরো জানে ড্রাইভার
কিংবা ওয়েটারদের "ওস্তাদ "বলে ডাকতে হয়।
হামিদ অবশ্য কিভাবে কিভাবে যেন প্রথমবারেই একটা লোকাল বাসের হেলপার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ওর অন্যরকম একটা দাম আছে। ইনকামটাও ওর একটু বেশি। মাঝে মধ্যেই স্টার সিগারেট খাওয়ায় ওদের। রাতুল অবশ্য সিগারেট খায়না। ওর বন্ধুদের খেতে দেখে একদিন একটা টান দিয়েছিল।টান দেয়ার পরবর্তী কয়েকমিনিট ওর মাথা ঝিম ধরে থাকায় আর কখনো ও
জিনিসে হাত দেয়নি। তবে হামিদ, শরীফ, বিকাশ, মোমেন ওরা দিব্যি টেনে যায়। সিগারেট খেলে নাকি ক্লান্তি দুর হয়,টেনশন থাকেনা, আরো কী কী সব হাবিজাবি বলে ওরা।
রাতুলের এসব বিশ্বাস হয়না। এই অভ্যেস আসলে বাইরে কাজ করতে গিয়ে হয়েছে ওদের। রাতুল যদি ওদের মত কাজ করত তাহলে হয়ত ওরও এমনটাই মনে হত।
"ওস্তাদের "দেখা দেখি ও-ও সিগারেট টেনে যেত দ্বিদ্ধাহীন।কিন্তু এমনটা হয়নি।
ওদের স্কুলে যেদিন ভর্তি শুরু হয় ও সেদিন ইচ্ছে করেই যায়নি ভর্তি হতে।
রাতেরবেলা ওর বাবা রিকশা চালিয়ে এসে বলে, 'কিরে, ইস্কুলে ভর্তি হইতে গেলি না কেন? '
রাতুল কথা না বলে মাথা নীচু করে রাখে।
'পড়াশোনা না কইরা লায়েক হবি? এই সব টাল্টি বাল্টি চলবনা।কাইল সকালেই ইস্কুলে যাবি। 'এরপর ওর মা'র দিকে তাকিয়ে বলে, 'সালেহা, ও জানি কাইল ইস্কুলে ভর্তি হয়, এইটা দেখার দায়িত্ব তুমার। আমরা গাধা হইছি দেইখা পোলাডাও গাধা হইব,এইটা তো কুনো কথা না...ওই হাসোছ কেন তুই?'
'হাসি না তো আব্বা! 'বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলে রাতুল।
সেদিন যেমন আনন্দ হয়েছিল আজকের আনন্দটাও ওই রকমই।একটু বেশিই বরং।
কাল ঈদ।ওর বন্ধুরা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ঈদের। এক ধরনের সিগারেট নাকি আছে, যেটাতে দুর্গন্ধ নেই।টানলে কেমন যেন এলাচির সুবাস পাওয়া যায়। এক এক শলা পনেরো টাকা করে। ওর বন্ধুরা ঈদ উপলক্ষে ওরই এক প্যাকেট নিজেরা নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে কিনেছে। ঈদের দিন রাতে খাওয়া হবে। এছাড়াও দিনের বেলা সবাই একসাথে পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরতে বের হবে।পরিকল্পনা হয়েছে,সবার পাঞ্জাবী একই রকম হবে।
সবার পাঞ্জাবী জোগাড় হয়ে গেছে, রাতুলেরটা ছাড়া। পাঞ্জাবীটা খুব বেশি দামি তা না।মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু এই সামান্য টাকা রাতুলের রিকশাচালক বাবার জন্য অনেক বেশি কিছু।
দিব,দিচ্ছি করে করে পুরোটা রমজান চলে গেছে।পাঞ্জাবীটা আর পাওয়া হয়নি রাতুলের। তবে ওর বাবা কথা দিয়েছে ওর জন্য আজ পাঞ্জাবী অবশ্যই কেনা হবে।বাবা আজ রিকশা নিয়ে বেরই হয়েছে রাতুলের পাঞ্জাবীর টাকা জোগার করতে।ওর কাছে কিছু টাকা আছে,সেটা দিয়ে কাল হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারবে,এখন শুধু পাঞ্জাবীর অপেক্ষা।
রাতুল অনেক খুশি।
দুই
'খচ্চরের গুষ্টি কুনহানকার! 'বলে একদলা থুথু সামনে দিয়ে পাই পাই করে ছুটে যাওয়া একটা অটো রিকশার গায়ে লাগাতে গিয়েও ব্যার্থ হল ফারুক মিয়া। বিড়বিড় করে চাইনিজদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল সে।
এই "খচ্চর" জাতি এক ধরনের ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা আবিস্কার করল, সেটা এ দেশে আমদানি হল আর রিকশাওয়ালাদের পেটে লাথি পড়ল।
একটা অটো রিকশাতে গাদাগাদি করে মোটামুটি একটা মাইক্রোর চাইতে বেশি মানুষ নেয়া হয়!
ভাড়া রিকশার চাইতে তিনগুন কম। গতিও বেশি।ক'জনের অমন তালুকদারি আছে অটো রিকশা রেখে তার রিকশাতে উঠবে?
এবার রোজা ত্রিশটা হচ্ছে। কাল নিশ্চিত ঈদ। অথচ এখনো অনেক অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে ফারুক মিয়াকে।
সারাটা রোজার মাস ধরে এই দিনটার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে ফারুক। সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকা হয়।ঈদের একটা দিন তো ভাল মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে হয়ই। এজন্য টাকা জমিয়েছে ফারুক। পোলাও, মুরগি আর সেমাই কেনা হবে এটাকা দিয়ে। একেবারে হিসেব করা টাকা। এখান থেকে ছেলেটাকে চারশ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনে দিলে কালকের দিনটাও প্রতিদিনের মত কাটবে তাদের।
আজ অনেক সকালে বের হয়েছে ফারুক। ভেবেছিল সারাদিন রিকশা চালালে রাতুলের পাঞ্জাবী কেনার টাকাটা জোগার হয়ে যাবে। ছেলেটা কখনো কিছু চায়না, এবার ঈদে একটা পাঞ্জাবীই শুধু চেয়েছে।কিন্তু মনে হচ্ছেনা সেটা দিতে পারবে ফারুক। মাত্র শ দেড়েক টাকা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোগার করতে পেরেছে। ঈদের আগে কেউ টাকা ধার দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখতে পাচ্ছেনা।
ফারুক এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিল বাজারের টাকা দিয়েই রাতুলের পাঞ্জাবী কিনে দেবে সে। ৩৬৪ দিন আধ পেটা খেয়ে থাকতে পারলে আর একটা দিনও পারবে। রাতুল যে পাঞ্জাবী চেয়েছে সেটাই কিনে দেবে সে। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নয়।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগে। একটা মসজিদ থেকে ইফতারি করে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সে একটু আগেই।
এতক্ষন উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশা চালিয়ে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফারুক।পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনও বলা যাবেনা।ঈদের আগের দিন এসব এলাকায় ভাড়া পাওয়ার সম্ভবনা আছে।
হঠাত ফারুক খেয়াল করে দেখল সে একটা নির্জন রাস্তায় এসে পড়েছে। যতদুর দেখতে পাচ্ছে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই।
যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফারুক রিকশা ঘুরিয়ে নিতেই সাথে সাথে বুকটা ছ্যাত করে উঠল তার।
রাস্তার পাশের অন্ধকার কোণ থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয়বারের মত রিকশা ঘুরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ছায়ামুর্তি দুটো ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
বুক পকেটে রাখা টাকাগুলোর দিকে একবার তাকাল ফারুক মিয়া। রিকশার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরল।
তিন
রাতুলের মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছেনা। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে ও।চাইলেই কি কাঁদা যায়?
তবে কতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারবে ও জানেনা। মা 'ও বেশ কিছুক্ষন ধরেই ছটফট করছে। রাত প্রায় বারটা বাজে।বাবা কখনোই এত রাত করেনা। আজ তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা।
ওদের বস্তিতে ঈদ শুরু হয়ে গেছে। কেউই বোধহয় ঘরে নেই।সবাই বাইরে এসে দল বেধে গল্প করছে। ছোটরা হইচই করছে।একটু পর পরই বেসুরো গলায় "রমজানের ওই রোজার শেষে" গান গেয়ে উঠছে। অবশ্য কারো কাছেই এই মুহুর্তে গানটাকে "বেসুরো" মনে হচ্ছেনা। ব্যাতিক্রম শুধু সালেহা আর রাতুল।
রাতুলের বন্ধুরা কয়েকবার করে ডেকে গেছে ওকে, ও যায়নি।
ও মনে প্রাণে চাইছে মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখতে। নিজের মনেঈ আউড়ে যাচ্ছে"আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক চলে আসবে।"
এরপরও যখনই বাইরে থেকে হইচই-এর আওয়াজ বেড়ে যায় সাথে সাথে রাতুলের বুকটাও চিলিক দিয়ে ওঠে অজানা শংকায়।
"মা, আব্বা কখন আসবো?"
"আমি কী জানি। "অকারণেই ঝাঁজিয়ে ওঠে সালেহা।
রাতুল চুপ মেরে যায়। এখন আর রাতুলের পাঞ্জাবীর একটুও দরকার নেই, ওর শুধু। বাবাকে খুব প্রয়োজন।
বাবা এলে ও মা'কে বলবে ওর পুরনো পাঞ্জাবীটা ভাল করে ধুয়ে দিতে। রাতের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। কাল সকালে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনলে কেউ বুঝতেই পারবেনা পাঞ্জাবীটা পুরনো। হাতার কাছে একটু ছেঁড়া আছে অবশ্য।হাতাটা গুটিয়ে নিলেই হবে।
এক রকম পাঞ্জাবী না হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে ঘুরতে না নিলেও সমস্যা নেই। ও বাসায় বসে থাকবে সারাদিন।এরপরও বাবাকে ভীষন প্রয়োজন রাতুলের। ভী-ষ-ন।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে,আরো গভীর...
উপসংহার
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতুল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাবার মুখটাকে চোখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। বাবাই ঘুম ভাঙিয়েছে ওর।
রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। 'কী হইছিল আব্বা তোমার? ' ইশ এত ভাল লাগছে রাতুলের!
'আরে আর কইস না রে ব্যাটা। দুইটা পোলা ঈদের পরেরদিন কী অনুষ্ঠানের লিগা বন্ধু বান্ধবরে দাওয়াত দিব তাই আমারে ভাড়া করল। সেই সন্ধ্যা থিকা রাইত একটা পর্যন্ত দুনিয়া ঘুইরা বেড়াইলাম। ম্যালা ট্যাকা ভাড়া দিছে। বখশিশও পাইছি।এরপর বাজার সদাই কইরা আইতে আইতেই দেরী হইয়া গেল।এই যে তোর পাঞ্জাবী। ' বলতে বলতে একটা প্যাকেট রাতুলের হাতে ধরিয়ে দেয় ফারুক।
রাতুল কোনো কথা বলতে পারলনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
এক ধরনের ছায়া পড়েছে রাতুলের দু চোখে।রঙিন ছায়া।
রাতুলের মন এত ভাল শেষ কবে ছিল মনে করতে পারছেনা ও।ওর জীবনে বড় আনন্দের প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। ছোট ছোট আনন্দ নিয়েই ওর বসবাস।এরপরও এই ক্ষুদে আনন্দগুলো যে অহরহ ওর জীবনে আসে তাও না। এজন্যই শেষ আনন্দের মুহুর্তটা মনে করতে গিয়ে মোটামুটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ওকে।
যতদুর মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে যেদিন ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠল সেদিনও এরকমই আনন্দ হয়েছিল ওর। অনেক বড় বড় মনে হয়েছিল নিজেকে। তবে এটাই একমাত্র কারন ছিল না।
রাতুল ধরেই নিয়েছিল, ফাইভ পাশ করার পর ওকেও ওর বেশিরভাগ বন্ধুর মত হোটেলের বয় কিংবা টেম্পুর হেলপার হতে হবে।
হোটেলের ওয়েটার বা, লোকাল বাসের হেলপার হতে হলে আগে এসব করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, রাতুল জানে। ওর বন্ধুরা ওকে বলে। ও আরো জানে ড্রাইভার
কিংবা ওয়েটারদের "ওস্তাদ "বলে ডাকতে হয়।
হামিদ অবশ্য কিভাবে কিভাবে যেন প্রথমবারেই একটা লোকাল বাসের হেলপার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ওর অন্যরকম একটা দাম আছে। ইনকামটাও ওর একটু বেশি। মাঝে মধ্যেই স্টার সিগারেট খাওয়ায় ওদের। রাতুল অবশ্য সিগারেট খায়না। ওর বন্ধুদের খেতে দেখে একদিন একটা টান দিয়েছিল।টান দেয়ার পরবর্তী কয়েকমিনিট ওর মাথা ঝিম ধরে থাকায় আর কখনো ও
জিনিসে হাত দেয়নি। তবে হামিদ, শরীফ, বিকাশ, মোমেন ওরা দিব্যি টেনে যায়। সিগারেট খেলে নাকি ক্লান্তি দুর হয়,টেনশন থাকেনা, আরো কী কী সব হাবিজাবি বলে ওরা।
রাতুলের এসব বিশ্বাস হয়না। এই অভ্যেস আসলে বাইরে কাজ করতে গিয়ে হয়েছে ওদের। রাতুল যদি ওদের মত কাজ করত তাহলে হয়ত ওরও এমনটাই মনে হত।
"ওস্তাদের "দেখা দেখি ও-ও সিগারেট টেনে যেত দ্বিদ্ধাহীন।কিন্তু এমনটা হয়নি।
ওদের স্কুলে যেদিন ভর্তি শুরু হয় ও সেদিন ইচ্ছে করেই যায়নি ভর্তি হতে।
রাতেরবেলা ওর বাবা রিকশা চালিয়ে এসে বলে, 'কিরে, ইস্কুলে ভর্তি হইতে গেলি না কেন? '
রাতুল কথা না বলে মাথা নীচু করে রাখে।
'পড়াশোনা না কইরা লায়েক হবি? এই সব টাল্টি বাল্টি চলবনা।কাইল সকালেই ইস্কুলে যাবি। 'এরপর ওর মা'র দিকে তাকিয়ে বলে, 'সালেহা, ও জানি কাইল ইস্কুলে ভর্তি হয়, এইটা দেখার দায়িত্ব তুমার। আমরা গাধা হইছি দেইখা পোলাডাও গাধা হইব,এইটা তো কুনো কথা না...ওই হাসোছ কেন তুই?'
'হাসি না তো আব্বা! 'বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলে রাতুল।
সেদিন যেমন আনন্দ হয়েছিল আজকের আনন্দটাও ওই রকমই।একটু বেশিই বরং।
কাল ঈদ।ওর বন্ধুরা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ঈদের। এক ধরনের সিগারেট নাকি আছে, যেটাতে দুর্গন্ধ নেই।টানলে কেমন যেন এলাচির সুবাস পাওয়া যায়। এক এক শলা পনেরো টাকা করে। ওর বন্ধুরা ঈদ উপলক্ষে ওরই এক প্যাকেট নিজেরা নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে কিনেছে। ঈদের দিন রাতে খাওয়া হবে। এছাড়াও দিনের বেলা সবাই একসাথে পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরতে বের হবে।পরিকল্পনা হয়েছে,সবার পাঞ্জাবী একই রকম হবে।
সবার পাঞ্জাবী জোগাড় হয়ে গেছে, রাতুলেরটা ছাড়া। পাঞ্জাবীটা খুব বেশি দামি তা না।মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু এই সামান্য টাকা রাতুলের রিকশাচালক বাবার জন্য অনেক বেশি কিছু।
দিব,দিচ্ছি করে করে পুরোটা রমজান চলে গেছে।পাঞ্জাবীটা আর পাওয়া হয়নি রাতুলের। তবে ওর বাবা কথা দিয়েছে ওর জন্য আজ পাঞ্জাবী অবশ্যই কেনা হবে।বাবা আজ রিকশা নিয়ে বেরই হয়েছে রাতুলের পাঞ্জাবীর টাকা জোগার করতে।ওর কাছে কিছু টাকা আছে,সেটা দিয়ে কাল হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারবে,এখন শুধু পাঞ্জাবীর অপেক্ষা।
রাতুল অনেক খুশি।
দুই
'খচ্চরের গুষ্টি কুনহানকার! 'বলে একদলা থুথু সামনে দিয়ে পাই পাই করে ছুটে যাওয়া একটা অটো রিকশার গায়ে লাগাতে গিয়েও ব্যার্থ হল ফারুক মিয়া। বিড়বিড় করে চাইনিজদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল সে।
এই "খচ্চর" জাতি এক ধরনের ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা আবিস্কার করল, সেটা এ দেশে আমদানি হল আর রিকশাওয়ালাদের পেটে লাথি পড়ল।
একটা অটো রিকশাতে গাদাগাদি করে মোটামুটি একটা মাইক্রোর চাইতে বেশি মানুষ নেয়া হয়!
ভাড়া রিকশার চাইতে তিনগুন কম। গতিও বেশি।ক'জনের অমন তালুকদারি আছে অটো রিকশা রেখে তার রিকশাতে উঠবে?
এবার রোজা ত্রিশটা হচ্ছে। কাল নিশ্চিত ঈদ। অথচ এখনো অনেক অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে ফারুক মিয়াকে।
সারাটা রোজার মাস ধরে এই দিনটার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে ফারুক। সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকা হয়।ঈদের একটা দিন তো ভাল মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে হয়ই। এজন্য টাকা জমিয়েছে ফারুক। পোলাও, মুরগি আর সেমাই কেনা হবে এটাকা দিয়ে। একেবারে হিসেব করা টাকা। এখান থেকে ছেলেটাকে চারশ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনে দিলে কালকের দিনটাও প্রতিদিনের মত কাটবে তাদের।
আজ অনেক সকালে বের হয়েছে ফারুক। ভেবেছিল সারাদিন রিকশা চালালে রাতুলের পাঞ্জাবী কেনার টাকাটা জোগার হয়ে যাবে। ছেলেটা কখনো কিছু চায়না, এবার ঈদে একটা পাঞ্জাবীই শুধু চেয়েছে।কিন্তু মনে হচ্ছেনা সেটা দিতে পারবে ফারুক। মাত্র শ দেড়েক টাকা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোগার করতে পেরেছে। ঈদের আগে কেউ টাকা ধার দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখতে পাচ্ছেনা।
ফারুক এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিল বাজারের টাকা দিয়েই রাতুলের পাঞ্জাবী কিনে দেবে সে। ৩৬৪ দিন আধ পেটা খেয়ে থাকতে পারলে আর একটা দিনও পারবে। রাতুল যে পাঞ্জাবী চেয়েছে সেটাই কিনে দেবে সে। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নয়।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগে। একটা মসজিদ থেকে ইফতারি করে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সে একটু আগেই।
এতক্ষন উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশা চালিয়ে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফারুক।পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনও বলা যাবেনা।ঈদের আগের দিন এসব এলাকায় ভাড়া পাওয়ার সম্ভবনা আছে।
হঠাত ফারুক খেয়াল করে দেখল সে একটা নির্জন রাস্তায় এসে পড়েছে। যতদুর দেখতে পাচ্ছে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই।
যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফারুক রিকশা ঘুরিয়ে নিতেই সাথে সাথে বুকটা ছ্যাত করে উঠল তার।
রাস্তার পাশের অন্ধকার কোণ থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয়বারের মত রিকশা ঘুরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ছায়ামুর্তি দুটো ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
বুক পকেটে রাখা টাকাগুলোর দিকে একবার তাকাল ফারুক মিয়া। রিকশার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরল।
তিন
রাতুলের মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছেনা। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে ও।চাইলেই কি কাঁদা যায়?
তবে কতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারবে ও জানেনা। মা 'ও বেশ কিছুক্ষন ধরেই ছটফট করছে। রাত প্রায় বারটা বাজে।বাবা কখনোই এত রাত করেনা। আজ তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা।
ওদের বস্তিতে ঈদ শুরু হয়ে গেছে। কেউই বোধহয় ঘরে নেই।সবাই বাইরে এসে দল বেধে গল্প করছে। ছোটরা হইচই করছে।একটু পর পরই বেসুরো গলায় "রমজানের ওই রোজার শেষে" গান গেয়ে উঠছে। অবশ্য কারো কাছেই এই মুহুর্তে গানটাকে "বেসুরো" মনে হচ্ছেনা। ব্যাতিক্রম শুধু সালেহা আর রাতুল।
রাতুলের বন্ধুরা কয়েকবার করে ডেকে গেছে ওকে, ও যায়নি।
ও মনে প্রাণে চাইছে মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখতে। নিজের মনেঈ আউড়ে যাচ্ছে"আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক চলে আসবে।"
এরপরও যখনই বাইরে থেকে হইচই-এর আওয়াজ বেড়ে যায় সাথে সাথে রাতুলের বুকটাও চিলিক দিয়ে ওঠে অজানা শংকায়।
"মা, আব্বা কখন আসবো?"
"আমি কী জানি। "অকারণেই ঝাঁজিয়ে ওঠে সালেহা।
রাতুল চুপ মেরে যায়। এখন আর রাতুলের পাঞ্জাবীর একটুও দরকার নেই, ওর শুধু। বাবাকে খুব প্রয়োজন।
বাবা এলে ও মা'কে বলবে ওর পুরনো পাঞ্জাবীটা ভাল করে ধুয়ে দিতে। রাতের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। কাল সকালে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনলে কেউ বুঝতেই পারবেনা পাঞ্জাবীটা পুরনো। হাতার কাছে একটু ছেঁড়া আছে অবশ্য।হাতাটা গুটিয়ে নিলেই হবে।
এক রকম পাঞ্জাবী না হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে ঘুরতে না নিলেও সমস্যা নেই। ও বাসায় বসে থাকবে সারাদিন।এরপরও বাবাকে ভীষন প্রয়োজন রাতুলের। ভী-ষ-ন।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে,আরো গভীর...
উপসংহার
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতুল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাবার মুখটাকে চোখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। বাবাই ঘুম ভাঙিয়েছে ওর।
রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। 'কী হইছিল আব্বা তোমার? ' ইশ এত ভাল লাগছে রাতুলের!
'আরে আর কইস না রে ব্যাটা। দুইটা পোলা ঈদের পরেরদিন কী অনুষ্ঠানের লিগা বন্ধু বান্ধবরে দাওয়াত দিব তাই আমারে ভাড়া করল। সেই সন্ধ্যা থিকা রাইত একটা পর্যন্ত দুনিয়া ঘুইরা বেড়াইলাম। ম্যালা ট্যাকা ভাড়া দিছে। বখশিশও পাইছি।এরপর বাজার সদাই কইরা আইতে আইতেই দেরী হইয়া গেল।এই যে তোর পাঞ্জাবী। ' বলতে বলতে একটা প্যাকেট রাতুলের হাতে ধরিয়ে দেয় ফারুক।
রাতুল কোনো কথা বলতে পারলনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
এক ধরনের ছায়া পড়েছে রাতুলের দু চোখে।রঙিন ছায়া।
Published on October 05, 2013 02:00
একজন অভ্র এবং এককাপ অমৃত
এক
আমার মত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো পাবলিকের জন্য রাস্তার পাশের টং দোকানগুলো হচ্ছে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের মত।হাঁটতে হাঁটতে মাশরাফির মত পায়ের লিগামেন্ট ছেঁড়ার উপক্রম হল তো একটা টং-এ ঢুকে দুটাকার একটা টোস্ট আর একটা চা খেয়ে ফের হন্টন। আজকাল অবশ্য দুটাকায় টোস্ট পাওয়া যাচ্ছেনা।তিন টাকা হয়ে গেছে।দুটাকায় এক ধরনের চারকোনা নোনতা বিস্কুট পাওয়া যায় যেটার সাইজ দেখলেই অসহায় বোধ করতে হয়!
বাস যথা সম্ভব এড়িয়ে চলি বলে এই অবকাশ যাপন খরচে পুষিয়ে যায়। আমার মত মধ্যবিত্তদের সবার আগে,সবকিছুর আগে খরচের হিসাব কষে ফেলতে হয়।
এই হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমার নিয়মিত যাত্রা পথের অধিকাংশ দোকানের হাড়ির খবর আমার নখদর্পণে।কোন দোকানে চা'কে রসগোল্লার সিরাতে পরিনত করা হয়,কোন দোকানে চিনির পরিবর্তে শুধুমাত্র কনডেন্স মিল্ক দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া হয়,কোন দোকানের কাঁচা পাত্তি দিয়ে বানানো চা অমৃততুল্য, কোন দোকানের মালাই চা খেলে মনে হবে এখনই মরে যাই, ইত্যাদি সব মোটামুটি পরীক্ষার আগের রাতের পড়ার মত মুখস্ত করে ফেলেছি।
এছাড়াও দোকানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও জ্ঞান খারাপ না।যেমন এক দোকানের বিস্কুটগুলো কী এক অজ্ঞাত কারনে যেন সব সময়েই নেতিয়ে থাকে।টোস্টে কামড় দিলে মনে হয় পাউরুটি চাবাচ্ছি!
আরেক দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসতে হলে দুবার ভেবে নেয়া আবশ্যক।বেঞ্চির একটা পায়া ভাঙ্গা।তিনটা ইট দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে।যখন তখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশংকা।
তবে এই মুহুর্তে যে দোকানে ঢোকার চিন্তা ভাবনা আমি করছি সেই দোকানটা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছিনা।কারন এর আগে কখনো আসিনি এখানে।
পিজিতে যাচ্ছি।এখন কারওয়ান বাজারে।যেহেতু এটা আমার নিয়মিত রুট নয় সেহেতু এদিকের চায়ের দোকানও ভাল চিনিনা।
মোটামুটি বৃদ্ধ টাইপের এক লোক চুলার দিকে উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।যদ্দুর মনে হয় তার নজর আকাশ পানে উড়াল দেয়া সাদা ধোঁয়ার দিকে।তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে দোকান তেমন একটা চলেনা তার।দোকানের ঢং ঢাং বেশি সুবিধার না।দারিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।প্রতিটা জিনিসেরই বাহ্যিক রুপের গুরুত্ব আছে।এমন দোকানে বসে কেউ আগ্রহ নিয়ে চুক চুক করে চা খাবে এমনটা ভাবার কোনো কারন নেই।তবে সুখের কথা হল আমি চা খেতে আসিনি এখানে। একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি পিজিতে।আমার এক বন্ধুর মা খুবই অসুস্থ।গত দুদিন ধরে বন্ধুটা মা'র পাশে বসে আছে।একমুহুর্তের জন্যও নড়ার উপায় নেই।চোখের আড়াল হলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেন ওর মা।ওর বাবা থাকে বিদেশে। ভাইবোন না থাকায় ওরই দেখা শোনা করতে হচ্ছে মাকে।আমাকে বলেছে আমি যেন কয়েক ঘন্টার জন্য হাসপাতালে গিয়ে ওর মা'র পাশে বসে থাকি।ও এই ফাকে বাসায় গিয়ে গোসল টোসল করে আসবে।
আমিও "তথাস্তু"বলে বেরিয়ে পড়লাম।
উত্তরা থেকে ফার্মগেটের টিকিট কাটলাম ইচ্ছে করেই।গাড়ি ফার্মগেটে এসে জ্যামে পড়তেই আমি টুপ করে নেমে গেলাম।জ্যাম পার হয়ে আবার বাসে ওঠার ইচ্ছা।না উঠলেও অবশ্য চলে।এখান থেকে হেটে পিজিতে চলে যাওয়া আমার কাছে বাথরুমে যাবার মত!
আমি এই দোকানে এসেছি দুটো সিগারেট কিনতে।আরিফকে সিগারেটখোর না বলে সিগারেট খাদ্য বলা চলে!ও সিগারেট খায়না সিগারেট ওকে খায়।পুরোপুরি চেইনস্মোকার।এই দুদিন সিগারেট খেতে পেরেছে কিনা কে জানে।মনে হয় পারেনি।আমি চেইনস্মোকার না হয়েও বুঝতে পারছি ব্যাপার কতটা ভয়াবহ।
অমৃত নিয়ে আমার গবেষনা বলে,প্রচন্ড চাহিদা নিয়ে যে খাবারটা খাওয়া হয় সেটাই হল অমৃত।তারমানে এই মুহুর্তে আরিফের জন্য দুটো সিগারেট মানে দু টুকরো অমৃত।আমি এই দোকানে অমৃত কিনতেই এসেছি।হঠাৎ মনে পড়ল আরিফ কী সিগারেট খায় আমি জানিনা।জেনে নেয়া যায়।তবে তাতে করে আরিফ জেনে যাবে ওর জন্য সিগারেট আসছে।সারপ্রাইজটা আর দেয়া যাবেনা।একজন মানুষের আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকা চেহারা দেখার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
অন্য রাস্তা ধরতে হবে।দেখা যাক কাজ হয় কিনা। আমি কল দিলাম আরিফকে।দুবার রিং হতেই আরিফের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।'কী হল,আসবিনা?'
'আসতে ইচ্ছে করছেনা।' কথা সত্য। হাসপাতালে কেউ শখ করে রোগী দেখতে যায়না।আরিফ আর কিছু বলার আগেই আমি বললাম,'দোস্ত একটা জরুরি বিষয় জানার জন্য ফোন দিলাম।'
'কী?'বোঝাই যাচ্ছে বেশ হতাশ হয়েছে আরিফ।
'বুঝেছিস,রাস্তায় হাটছিলাম হঠাৎ করে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল।কোন সিগারেট ভাল হবে?জানিসই তো সিগারেট ফিগারেটের ব্যাপারে আমার ধারণা শূন্যের ঘরে।'
'এই তোর জরুরি বিষয়?'
'হুম,কেন তোর কাছে জরুরি মনে হচ্ছেনা?'
'না,আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হচ্ছে।'
'আমি কি ঠিক করেছি জানিস?যেহেতু তোর কথা রাখতে পারিনি তাই তোর সম্মানে আজ তোর পছন্দের সিগারেট খাওয়া হবে।এই আইডিয়াটাও কি তোর ফালতু মনে হচ্ছে?'
'আইডিয়া না আমার কাছে তোকেই ফালতু মনে হচ্ছে।যা ভাগ!'ফোন কেটে দিল আরিফ।
প্ল্যান কাজ করেনি।আচ্ছা এক কাজ করা যেতে পারে।বেনসনই নিয়ে যাই।আরিফ নিশ্চয়ই খুশি হবে।আমার তো ধারনা এখন ময়মনসিংহের "বগা বিড়ি"পেলেও আরিফ খুশিতে পিজির ছাদ থেকে লাফ মেরে বসবে।
'চাচা,দুটো বেনসন দেন তো।'
চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বেনসনের প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আমি একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম চাচার দিকে।চাচা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল দুটো সিগারেট।
প্রচুর সময় নিয়ে চাচা টাকাটা ভাঙাল।প্রত্যেকটা নোট দুবার করে গুনল,এরপর ফেরত দিল।এই বুড়োর কাছ থেকে ভুলেও কারো কোনোদিন এক টাকা বেশি পাবার সম্ভবনা নেই।না থাকাই ভাল।টাকা ভাল করে গুনে নেয়া নবীজীর সা. সুন্নত।তবে এই বুড়ো বোধহয় সুন্নত হিসেবে এতবার টাকা গোনেনা।গোনে ভয়ে।দারিদ্রতার ভয়।
আমি টাকাগুলো হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম বুড়ো কি করে যেন আমাকে দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছে।
আমি আস্তে করে টাকাগুলো পকেটে ভরে হাঁটা দিলাম জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে।
দুই
পিজির তিন নাম্বার ওয়ার্ডে আছে আরিফ আর ওর মা।খুঁজে পেতে চলে এলাম তিন নাম্বার ওয়ার্ডে।দরজা থেকেই দেখতে পাচ্ছি ওয়ার্ডের একেবারে ওই মাথায় আরিফ একটা বেডের পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি সেই চা ওয়ালা চাচার মতই উদাসী।
বেডে আরিফের মা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন।আরিফ আমাকে দেখেনি।আমি আস্তে করে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। ওর ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখতেই ফিরে তাকাল আমার দিকে।চোখের নীচে কালি ফেলে টেলে একেবারে কাহিল অবস্থা।
'তোর অবস্থা তো একেবারে কেরোসিন রে।' খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম।
প্রথম কয়েক মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আরিফ।'তুই না বললি তুই আসবিনা?'
'আসব না বলিনি,বলেছি আসতে ইচ্ছে করছেনা।'
'তুই এত অদ্ভুত কেন? 'আরিফ বোধহয় বুঝতে পারেনি এমন পরিবেশে ওর কথাটাই বরং অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম,'আমি আইডিয়া অনুযায়ী তিনটা সিগারেট কিনেছিলাম। টানতে গিয়ে দেখি অবস্থা তোর মতই কেরোসিন।তাই বাকিদুটো নিয়ে এসেছি তোর জন্য।এই নে,এখন টানতে টানতে বাড়ি যা।নাওয়া খাওয়া সেরে একটা ঘুম দে।আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি খালাম্মার পাশে।
'থাপরায়ে দাঁত ফেলে দেব।মিথ্যে বলছিস কেন,সিগারেট তুই আমার জন্যই কিনেছিস।'এটা ঠিক প্রশ্ন না,মন্তব্য।জবাব না দিলেও চলে।আরিফের চোখে এখন যে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসা ফুটে রয়েছে তার দাম কয় পৃথিবী আমি জানিনা।
বললাম,'ও ভাল কথা,খালাম্মার কী হয়েছে?'
'এত করে বলি,একটা কাজের লোক রাখো।তা না,উনি নিজেই সব করবে।বলে কিনা দুজন মানুষের জন্য কাজের লোক রেখে কী হবে?কাজ করতে করতে প্রেশার চড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে।আরো দুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।'
'এই গাধা ওকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছিস কেন?'মিহি গলায় বলে উঠলেন আরিফের মা।এতক্ষন জাগা ছিলেন না ঘুমিয়ে ছিলেন বুঝতে পারলাম না।'তোকে না কতবার বলেছি একটা বিয়ে কর।তাহলেই তো আর আমাকে এত কাজ করতে হয়না।'
'খালাম্মা,আপনি যেভাবে বলছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ওকে কয়েকটা বিয়ে করানোর চিন্তা ভাবনা আছে আপনার,আপাতত একটা করলেই চলবে।'বললাম।আরিফের মা আমাকে ভাল মতই চেনে।
'একটাই করতে চায়না,হু!' মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা।
'একটাই তো,করে ফেলবে।তা,খালাম্মা আমি আপাতত আছি আপনার পাশে,ও একটু গোসল টোসল করে আসুক বাসা থেকে।'
ভদ্রমহিলার শুকনো মুখ চোখ আরো শুকিয়ে গেল।তবে রাজি হয়ে গেলেন।
আরিফ চলে গেল। যাবার আগে সেই কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসার দৃষ্টি ওর চোখে আবার দেখতে পেলাম আমি।
তিন
সন্ধ্যা হয়েছে।একটু আগেই বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।এখন হাঁটছি।ইচ্ছে করেই বাসে উঠিনি।জরুরি কাজ আছে সেই "চা-চাচার" কাছে।"চা-চাচা"হল গিয়ে"চা ওয়ালা চাচা"র সংক্ষিপ্ত রুপ।
টাকা দশটা ফেরত দিতে হবে তাকে।ইচ্ছে করলে তখনই দিতে পারতাম কিন্তু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করেছি আমি।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে।একটা ভয় ছিল দোকানটা খোলা পাই কিনা।না,খোলা আছে।
আমি দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চা-চাচা আমার দিকে তাকাল।
'কেমন আছেন? 'ভুবন ভোলানো হাসির সাথে বললাম।বুড়ো চিনতে পেরেছে বলে মনে হলনা। 'চাচা,দুপুরে আপনার কাছ থেকে দুটো সিগারেট নিয়েছিলাম।আপনি দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছিলেন।এই যে ধরেন দশটাকা।'
চা-চাচা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন দুই মাথাওয়ালা কোনো এলিয়েন দশটাকা দিয়ে স্পেসশিপের জন্য এক লিটার জ্বালানি চেয়েছে।
'আপনে আমার ট্যাকা দেওনের জন্য এত কষ্ট কইরা ফেরত আইছেন?'
আমি বৃদ্ধের চোখে দেখতে পেলাম,বিষ্ময়,ভালবাসা,শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং আরো অনেক অনুভুতির মিলমিশ। একই সাথে। আমার উদ্দেশ্য সফল।বৃদ্ধকে তখনই টাকাটা দিয়ে দিলে নিশ্চিতভাবেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেতামনা।বৃদ্ধ খুব স্বাভাবিকভাবে টাকাটা গ্রহন করত।এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য সামান্য ছলনার আশ্রয় নেয়াতে এতটুকু অনুশোচনা আমার হলনা।
'না ঠিক ফেরত দেয়ার জন্য আসিনি,এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।'
'সেইটাই আর কয়জন করে।আইজ তুমারে আমার সাথে বইয়া এককাপ চা খাওনই লাগব।'
হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেল চা-চাচা। এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি।যেমন আফরীনদের বাড়ির গার্ড সোলেমান ভাইয়ের কথাই ধরা যাক।সবাইকে স্যার স্যার করলেও কী এক অজ্ঞাত কারণে যেন আমাকে ভাই বলে ডাকে।এই বুড়োরও দেখি একই কাহিনি।দুম করে আপনি থেকে তুমি।আমার চেহারাটাই বোধহয় গোবেচারা ধরনের।সবাই নিজের ভাই বেরাদার মনে করে।যাক,এটাও খারাপ না।আমি বসে পড়লাম চা খেতে। আজ সারাদিনে এক কাপও খাওয়া হয়নি।
চা-চাচা আমার সাথে টুক টুক করে গল্প করতে করতে চা বানাতে লাগল।উনার চা বানাতে বানাতে আমি জেনে গেলাম,উনার আমার বয়সী এক ছেলে আছে,বিয়ের কথা বার্তা চলছে তার কিন্তু টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা।ছেলে কিছুদিন হল গার্মেন্টসে পিচ্চি একটা চাকরি নিয়েছে।অভাবের সংসার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা-চাচা আমার হাতে এক চা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপে ফুরুত করে চুমুক দিল।
আমিও ফুরুত করে একটা চুমুক দিলাম।সাথে সাথে মাথাটা ভো করে উঠল।মুখটা অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে হল।এতক্ষনে বুঝলাম দোকানের করুণ অবস্থাই চা-চাচার ব্যাবসা খারাপ হবার একমাত্র কারণ না।উনি আমার হাতে যে বস্তুটা ধরিয়ে দিয়েছে সেটাকে আর যাই হোক 'চা' বলার কোনো কারনই নেই।বাচ্চাদের প্রস্রাবের সাথে এক চামচ চিনি মেশালে এরকমই স্বাদ হবার কথা!
আমি একটা হাসি কোনোমতে ম্যানেজ করে চা-চাচাকে উপহার দিলাম।খারাপ লাগছে খুব।এই বৃদ্ধ পয়সার অভাবে ছেলের বিয়ে দিতে পারছেনা।খরচ কমাতেই বোধহয় চায়ে পরিমানমত সরঞ্জামও দিতে পারেনা।
আচমকা মনে হল,উনার তো মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা,ছেলের বিয়ে হচ্ছে।টাকার অভাবে আবার ছেলের বিয়ে আটকে থাকে কিভাবে?বিশেষ করে উনাদের শ্রেনীতে তো যৌতুক নিয়ে অহরহ ছেলের বিয়ে হয়।চা-চাচার ছেলে কি প্রতিবন্ধী টতিবন্ধী নাকি?
'চাচা,আপনার ছেলে দেখতে কেমন?'
'দেখবা?'বৃদ্ধের চোখ চকচক করে উঠল।হাতড়ে হাতড়ে ক্যাশ বাক্সের ভেতর থেকে একটা ফুল সাইজ রঙিন ছবি বের করে আমার হাতে দিল।
এবার আমার অবাক হবার পালা।এই ছেলে প্রতিবন্ধী তো নয়ই বরং এক হিসেবে তাকে রাজপুত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।বেশ সুপুরুষ ছেলে।এমন ছেলের বিয়ে টাকার অভাবে আটকে রয়েছে ব্যাপারটা অষ্টমাশ্চর্যের কাছাকাছি।বললাম,'চাচা আপনার ছেলে তো মাশআল্লাহ।যৌতুক টৌতুক নিলে বিয়েটাও হত আর আপনার দোকানটাও দাঁড়িয়ে...'
আর কিছু বলতে পারলামনা।বৃদ্ধ ফুঁসে উঠল।'কী কইলা বাবা,আমি যৌতুক নিয়া ওর বিয়া দিমু?মইরা গেলেও না।দরকার হয় না খায়া থাকুম এরপরো আমি আমার পোলারে বিক্রি করতে পারুমনা।'কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার দুচোখে। আত্মসম্মান যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার গোটা অবয়ব দিয়ে।
হঠাৎ করেই আমার হাতে ধরা চায়ের স্বাদ বদলে গেল।এমন একজন পবিত্র মানুষের হাতে বানানো চা'কে অমৃত ছাড়া অন্য কিছু বলার নিয়ম নেই।
এক কাপ অমৃত!
আমার মত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো পাবলিকের জন্য রাস্তার পাশের টং দোকানগুলো হচ্ছে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের মত।হাঁটতে হাঁটতে মাশরাফির মত পায়ের লিগামেন্ট ছেঁড়ার উপক্রম হল তো একটা টং-এ ঢুকে দুটাকার একটা টোস্ট আর একটা চা খেয়ে ফের হন্টন। আজকাল অবশ্য দুটাকায় টোস্ট পাওয়া যাচ্ছেনা।তিন টাকা হয়ে গেছে।দুটাকায় এক ধরনের চারকোনা নোনতা বিস্কুট পাওয়া যায় যেটার সাইজ দেখলেই অসহায় বোধ করতে হয়!
বাস যথা সম্ভব এড়িয়ে চলি বলে এই অবকাশ যাপন খরচে পুষিয়ে যায়। আমার মত মধ্যবিত্তদের সবার আগে,সবকিছুর আগে খরচের হিসাব কষে ফেলতে হয়।
এই হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমার নিয়মিত যাত্রা পথের অধিকাংশ দোকানের হাড়ির খবর আমার নখদর্পণে।কোন দোকানে চা'কে রসগোল্লার সিরাতে পরিনত করা হয়,কোন দোকানে চিনির পরিবর্তে শুধুমাত্র কনডেন্স মিল্ক দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া হয়,কোন দোকানের কাঁচা পাত্তি দিয়ে বানানো চা অমৃততুল্য, কোন দোকানের মালাই চা খেলে মনে হবে এখনই মরে যাই, ইত্যাদি সব মোটামুটি পরীক্ষার আগের রাতের পড়ার মত মুখস্ত করে ফেলেছি।
এছাড়াও দোকানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও জ্ঞান খারাপ না।যেমন এক দোকানের বিস্কুটগুলো কী এক অজ্ঞাত কারনে যেন সব সময়েই নেতিয়ে থাকে।টোস্টে কামড় দিলে মনে হয় পাউরুটি চাবাচ্ছি!
আরেক দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসতে হলে দুবার ভেবে নেয়া আবশ্যক।বেঞ্চির একটা পায়া ভাঙ্গা।তিনটা ইট দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে।যখন তখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশংকা।
তবে এই মুহুর্তে যে দোকানে ঢোকার চিন্তা ভাবনা আমি করছি সেই দোকানটা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছিনা।কারন এর আগে কখনো আসিনি এখানে।
পিজিতে যাচ্ছি।এখন কারওয়ান বাজারে।যেহেতু এটা আমার নিয়মিত রুট নয় সেহেতু এদিকের চায়ের দোকানও ভাল চিনিনা।
মোটামুটি বৃদ্ধ টাইপের এক লোক চুলার দিকে উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।যদ্দুর মনে হয় তার নজর আকাশ পানে উড়াল দেয়া সাদা ধোঁয়ার দিকে।তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে দোকান তেমন একটা চলেনা তার।দোকানের ঢং ঢাং বেশি সুবিধার না।দারিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।প্রতিটা জিনিসেরই বাহ্যিক রুপের গুরুত্ব আছে।এমন দোকানে বসে কেউ আগ্রহ নিয়ে চুক চুক করে চা খাবে এমনটা ভাবার কোনো কারন নেই।তবে সুখের কথা হল আমি চা খেতে আসিনি এখানে। একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি পিজিতে।আমার এক বন্ধুর মা খুবই অসুস্থ।গত দুদিন ধরে বন্ধুটা মা'র পাশে বসে আছে।একমুহুর্তের জন্যও নড়ার উপায় নেই।চোখের আড়াল হলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেন ওর মা।ওর বাবা থাকে বিদেশে। ভাইবোন না থাকায় ওরই দেখা শোনা করতে হচ্ছে মাকে।আমাকে বলেছে আমি যেন কয়েক ঘন্টার জন্য হাসপাতালে গিয়ে ওর মা'র পাশে বসে থাকি।ও এই ফাকে বাসায় গিয়ে গোসল টোসল করে আসবে।
আমিও "তথাস্তু"বলে বেরিয়ে পড়লাম।
উত্তরা থেকে ফার্মগেটের টিকিট কাটলাম ইচ্ছে করেই।গাড়ি ফার্মগেটে এসে জ্যামে পড়তেই আমি টুপ করে নেমে গেলাম।জ্যাম পার হয়ে আবার বাসে ওঠার ইচ্ছা।না উঠলেও অবশ্য চলে।এখান থেকে হেটে পিজিতে চলে যাওয়া আমার কাছে বাথরুমে যাবার মত!
আমি এই দোকানে এসেছি দুটো সিগারেট কিনতে।আরিফকে সিগারেটখোর না বলে সিগারেট খাদ্য বলা চলে!ও সিগারেট খায়না সিগারেট ওকে খায়।পুরোপুরি চেইনস্মোকার।এই দুদিন সিগারেট খেতে পেরেছে কিনা কে জানে।মনে হয় পারেনি।আমি চেইনস্মোকার না হয়েও বুঝতে পারছি ব্যাপার কতটা ভয়াবহ।
অমৃত নিয়ে আমার গবেষনা বলে,প্রচন্ড চাহিদা নিয়ে যে খাবারটা খাওয়া হয় সেটাই হল অমৃত।তারমানে এই মুহুর্তে আরিফের জন্য দুটো সিগারেট মানে দু টুকরো অমৃত।আমি এই দোকানে অমৃত কিনতেই এসেছি।হঠাৎ মনে পড়ল আরিফ কী সিগারেট খায় আমি জানিনা।জেনে নেয়া যায়।তবে তাতে করে আরিফ জেনে যাবে ওর জন্য সিগারেট আসছে।সারপ্রাইজটা আর দেয়া যাবেনা।একজন মানুষের আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকা চেহারা দেখার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
অন্য রাস্তা ধরতে হবে।দেখা যাক কাজ হয় কিনা। আমি কল দিলাম আরিফকে।দুবার রিং হতেই আরিফের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।'কী হল,আসবিনা?'
'আসতে ইচ্ছে করছেনা।' কথা সত্য। হাসপাতালে কেউ শখ করে রোগী দেখতে যায়না।আরিফ আর কিছু বলার আগেই আমি বললাম,'দোস্ত একটা জরুরি বিষয় জানার জন্য ফোন দিলাম।'
'কী?'বোঝাই যাচ্ছে বেশ হতাশ হয়েছে আরিফ।
'বুঝেছিস,রাস্তায় হাটছিলাম হঠাৎ করে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল।কোন সিগারেট ভাল হবে?জানিসই তো সিগারেট ফিগারেটের ব্যাপারে আমার ধারণা শূন্যের ঘরে।'
'এই তোর জরুরি বিষয়?'
'হুম,কেন তোর কাছে জরুরি মনে হচ্ছেনা?'
'না,আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হচ্ছে।'
'আমি কি ঠিক করেছি জানিস?যেহেতু তোর কথা রাখতে পারিনি তাই তোর সম্মানে আজ তোর পছন্দের সিগারেট খাওয়া হবে।এই আইডিয়াটাও কি তোর ফালতু মনে হচ্ছে?'
'আইডিয়া না আমার কাছে তোকেই ফালতু মনে হচ্ছে।যা ভাগ!'ফোন কেটে দিল আরিফ।
প্ল্যান কাজ করেনি।আচ্ছা এক কাজ করা যেতে পারে।বেনসনই নিয়ে যাই।আরিফ নিশ্চয়ই খুশি হবে।আমার তো ধারনা এখন ময়মনসিংহের "বগা বিড়ি"পেলেও আরিফ খুশিতে পিজির ছাদ থেকে লাফ মেরে বসবে।
'চাচা,দুটো বেনসন দেন তো।'
চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বেনসনের প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আমি একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম চাচার দিকে।চাচা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল দুটো সিগারেট।
প্রচুর সময় নিয়ে চাচা টাকাটা ভাঙাল।প্রত্যেকটা নোট দুবার করে গুনল,এরপর ফেরত দিল।এই বুড়োর কাছ থেকে ভুলেও কারো কোনোদিন এক টাকা বেশি পাবার সম্ভবনা নেই।না থাকাই ভাল।টাকা ভাল করে গুনে নেয়া নবীজীর সা. সুন্নত।তবে এই বুড়ো বোধহয় সুন্নত হিসেবে এতবার টাকা গোনেনা।গোনে ভয়ে।দারিদ্রতার ভয়।
আমি টাকাগুলো হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম বুড়ো কি করে যেন আমাকে দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছে।
আমি আস্তে করে টাকাগুলো পকেটে ভরে হাঁটা দিলাম জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে।
দুই
পিজির তিন নাম্বার ওয়ার্ডে আছে আরিফ আর ওর মা।খুঁজে পেতে চলে এলাম তিন নাম্বার ওয়ার্ডে।দরজা থেকেই দেখতে পাচ্ছি ওয়ার্ডের একেবারে ওই মাথায় আরিফ একটা বেডের পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি সেই চা ওয়ালা চাচার মতই উদাসী।
বেডে আরিফের মা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন।আরিফ আমাকে দেখেনি।আমি আস্তে করে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। ওর ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখতেই ফিরে তাকাল আমার দিকে।চোখের নীচে কালি ফেলে টেলে একেবারে কাহিল অবস্থা।
'তোর অবস্থা তো একেবারে কেরোসিন রে।' খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম।
প্রথম কয়েক মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আরিফ।'তুই না বললি তুই আসবিনা?'
'আসব না বলিনি,বলেছি আসতে ইচ্ছে করছেনা।'
'তুই এত অদ্ভুত কেন? 'আরিফ বোধহয় বুঝতে পারেনি এমন পরিবেশে ওর কথাটাই বরং অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম,'আমি আইডিয়া অনুযায়ী তিনটা সিগারেট কিনেছিলাম। টানতে গিয়ে দেখি অবস্থা তোর মতই কেরোসিন।তাই বাকিদুটো নিয়ে এসেছি তোর জন্য।এই নে,এখন টানতে টানতে বাড়ি যা।নাওয়া খাওয়া সেরে একটা ঘুম দে।আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি খালাম্মার পাশে।
'থাপরায়ে দাঁত ফেলে দেব।মিথ্যে বলছিস কেন,সিগারেট তুই আমার জন্যই কিনেছিস।'এটা ঠিক প্রশ্ন না,মন্তব্য।জবাব না দিলেও চলে।আরিফের চোখে এখন যে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসা ফুটে রয়েছে তার দাম কয় পৃথিবী আমি জানিনা।
বললাম,'ও ভাল কথা,খালাম্মার কী হয়েছে?'
'এত করে বলি,একটা কাজের লোক রাখো।তা না,উনি নিজেই সব করবে।বলে কিনা দুজন মানুষের জন্য কাজের লোক রেখে কী হবে?কাজ করতে করতে প্রেশার চড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে।আরো দুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।'
'এই গাধা ওকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছিস কেন?'মিহি গলায় বলে উঠলেন আরিফের মা।এতক্ষন জাগা ছিলেন না ঘুমিয়ে ছিলেন বুঝতে পারলাম না।'তোকে না কতবার বলেছি একটা বিয়ে কর।তাহলেই তো আর আমাকে এত কাজ করতে হয়না।'
'খালাম্মা,আপনি যেভাবে বলছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ওকে কয়েকটা বিয়ে করানোর চিন্তা ভাবনা আছে আপনার,আপাতত একটা করলেই চলবে।'বললাম।আরিফের মা আমাকে ভাল মতই চেনে।
'একটাই করতে চায়না,হু!' মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা।
'একটাই তো,করে ফেলবে।তা,খালাম্মা আমি আপাতত আছি আপনার পাশে,ও একটু গোসল টোসল করে আসুক বাসা থেকে।'
ভদ্রমহিলার শুকনো মুখ চোখ আরো শুকিয়ে গেল।তবে রাজি হয়ে গেলেন।
আরিফ চলে গেল। যাবার আগে সেই কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসার দৃষ্টি ওর চোখে আবার দেখতে পেলাম আমি।
তিন
সন্ধ্যা হয়েছে।একটু আগেই বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।এখন হাঁটছি।ইচ্ছে করেই বাসে উঠিনি।জরুরি কাজ আছে সেই "চা-চাচার" কাছে।"চা-চাচা"হল গিয়ে"চা ওয়ালা চাচা"র সংক্ষিপ্ত রুপ।
টাকা দশটা ফেরত দিতে হবে তাকে।ইচ্ছে করলে তখনই দিতে পারতাম কিন্তু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করেছি আমি।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে।একটা ভয় ছিল দোকানটা খোলা পাই কিনা।না,খোলা আছে।
আমি দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চা-চাচা আমার দিকে তাকাল।
'কেমন আছেন? 'ভুবন ভোলানো হাসির সাথে বললাম।বুড়ো চিনতে পেরেছে বলে মনে হলনা। 'চাচা,দুপুরে আপনার কাছ থেকে দুটো সিগারেট নিয়েছিলাম।আপনি দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছিলেন।এই যে ধরেন দশটাকা।'
চা-চাচা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন দুই মাথাওয়ালা কোনো এলিয়েন দশটাকা দিয়ে স্পেসশিপের জন্য এক লিটার জ্বালানি চেয়েছে।
'আপনে আমার ট্যাকা দেওনের জন্য এত কষ্ট কইরা ফেরত আইছেন?'
আমি বৃদ্ধের চোখে দেখতে পেলাম,বিষ্ময়,ভালবাসা,শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং আরো অনেক অনুভুতির মিলমিশ। একই সাথে। আমার উদ্দেশ্য সফল।বৃদ্ধকে তখনই টাকাটা দিয়ে দিলে নিশ্চিতভাবেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেতামনা।বৃদ্ধ খুব স্বাভাবিকভাবে টাকাটা গ্রহন করত।এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য সামান্য ছলনার আশ্রয় নেয়াতে এতটুকু অনুশোচনা আমার হলনা।
'না ঠিক ফেরত দেয়ার জন্য আসিনি,এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।'
'সেইটাই আর কয়জন করে।আইজ তুমারে আমার সাথে বইয়া এককাপ চা খাওনই লাগব।'
হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেল চা-চাচা। এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি।যেমন আফরীনদের বাড়ির গার্ড সোলেমান ভাইয়ের কথাই ধরা যাক।সবাইকে স্যার স্যার করলেও কী এক অজ্ঞাত কারণে যেন আমাকে ভাই বলে ডাকে।এই বুড়োরও দেখি একই কাহিনি।দুম করে আপনি থেকে তুমি।আমার চেহারাটাই বোধহয় গোবেচারা ধরনের।সবাই নিজের ভাই বেরাদার মনে করে।যাক,এটাও খারাপ না।আমি বসে পড়লাম চা খেতে। আজ সারাদিনে এক কাপও খাওয়া হয়নি।
চা-চাচা আমার সাথে টুক টুক করে গল্প করতে করতে চা বানাতে লাগল।উনার চা বানাতে বানাতে আমি জেনে গেলাম,উনার আমার বয়সী এক ছেলে আছে,বিয়ের কথা বার্তা চলছে তার কিন্তু টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা।ছেলে কিছুদিন হল গার্মেন্টসে পিচ্চি একটা চাকরি নিয়েছে।অভাবের সংসার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা-চাচা আমার হাতে এক চা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপে ফুরুত করে চুমুক দিল।
আমিও ফুরুত করে একটা চুমুক দিলাম।সাথে সাথে মাথাটা ভো করে উঠল।মুখটা অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে হল।এতক্ষনে বুঝলাম দোকানের করুণ অবস্থাই চা-চাচার ব্যাবসা খারাপ হবার একমাত্র কারণ না।উনি আমার হাতে যে বস্তুটা ধরিয়ে দিয়েছে সেটাকে আর যাই হোক 'চা' বলার কোনো কারনই নেই।বাচ্চাদের প্রস্রাবের সাথে এক চামচ চিনি মেশালে এরকমই স্বাদ হবার কথা!
আমি একটা হাসি কোনোমতে ম্যানেজ করে চা-চাচাকে উপহার দিলাম।খারাপ লাগছে খুব।এই বৃদ্ধ পয়সার অভাবে ছেলের বিয়ে দিতে পারছেনা।খরচ কমাতেই বোধহয় চায়ে পরিমানমত সরঞ্জামও দিতে পারেনা।
আচমকা মনে হল,উনার তো মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা,ছেলের বিয়ে হচ্ছে।টাকার অভাবে আবার ছেলের বিয়ে আটকে থাকে কিভাবে?বিশেষ করে উনাদের শ্রেনীতে তো যৌতুক নিয়ে অহরহ ছেলের বিয়ে হয়।চা-চাচার ছেলে কি প্রতিবন্ধী টতিবন্ধী নাকি?
'চাচা,আপনার ছেলে দেখতে কেমন?'
'দেখবা?'বৃদ্ধের চোখ চকচক করে উঠল।হাতড়ে হাতড়ে ক্যাশ বাক্সের ভেতর থেকে একটা ফুল সাইজ রঙিন ছবি বের করে আমার হাতে দিল।
এবার আমার অবাক হবার পালা।এই ছেলে প্রতিবন্ধী তো নয়ই বরং এক হিসেবে তাকে রাজপুত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।বেশ সুপুরুষ ছেলে।এমন ছেলের বিয়ে টাকার অভাবে আটকে রয়েছে ব্যাপারটা অষ্টমাশ্চর্যের কাছাকাছি।বললাম,'চাচা আপনার ছেলে তো মাশআল্লাহ।যৌতুক টৌতুক নিলে বিয়েটাও হত আর আপনার দোকানটাও দাঁড়িয়ে...'
আর কিছু বলতে পারলামনা।বৃদ্ধ ফুঁসে উঠল।'কী কইলা বাবা,আমি যৌতুক নিয়া ওর বিয়া দিমু?মইরা গেলেও না।দরকার হয় না খায়া থাকুম এরপরো আমি আমার পোলারে বিক্রি করতে পারুমনা।'কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার দুচোখে। আত্মসম্মান যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার গোটা অবয়ব দিয়ে।
হঠাৎ করেই আমার হাতে ধরা চায়ের স্বাদ বদলে গেল।এমন একজন পবিত্র মানুষের হাতে বানানো চা'কে অমৃত ছাড়া অন্য কিছু বলার নিয়ম নেই।
এক কাপ অমৃত!
Published on October 05, 2013 01:58
October 4, 2013
জগলুল সাহেবের শখ
চেম্বারের বাইরে রোগীদের বিশাল সিরিয়াল,তাদের অসংখ্য অভিযোগ,আর সামনে বসে থাকা বিরক্তিকর চরিত্র,মেজাজ খিচড়ে দেবার জন্য আর কী লাগে?
সরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান আমি।প্রতিদিন আউটডোরে রোগী দেখতে হয়।রুমের বাইরে বিশাল এক লাইন নিয়ে দিন শুরু করি দিন শেষে সে লাইনের দৈর্ঘ আরো বড় হয়।
এটাই হল মফস্বল শহর।অধিকাংশ মানুষেরই কাজ কর্ম নেই।হাসপাতালে,আমার ধারনা,হাওয়া খেতে আসে এরা।সরকারি হাসপাতাল,টিকিট মাত্র দশটাকা।বেশিরভাগ অষুধ তো ফ্রি-ই।সস্তা পেয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে-সকালে উঠে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে তো একটু হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি!
অনেকদিন সাদা এপ্রোন পড়া মেয়ে ডাক্তার দেখিনা,হাসপাতালে ঢু মেরে আসা যাক! টিকিট মাত্র দশ টাকা।
ইদানিং অবশ্য আমি নতুন একটা ট্রিক্স আবিষ্কার করেছি।যেগুলোকে দেখে ত্যাদোর কিসিমের পাবলিক মনে হয় ওদের এমন ওষুধ লিখে দেই যেটা হাসপাতালের ফার্মেসীতে নেই।বেশ কাজ হচ্ছে এতে।একবার যাকে এই “ওষুধ” দেয়া হয় কারণ ছাড়া দ্বিতীয়বার আর হাসপাতালে আসার সম্ভবনা নেই তার।
তবে সামনে বসা এই লোকটাকে কী করে ঘাড় থেকে নামানো যায় বুঝতে পারছিনা।টিকিটে নাম লেখা আছে জগলুল হোসেন,বয়স ৪২।টিকিটে রোগের বিবরন লেখা থাকে।সেখানে দেখতে পাচ্ছি এই লোক মাথাব্যাথার সমস্যা নিয়ে এসেছে।
লোকটা ঢোকার পর আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দেরি না করে বললাম,’মাথাব্যাথাটা ঠিক কী ধরনের আপনার?’
টিকিটে লেখা দেখার পরও "আপনার কী সমস্যা" বলা আমার স্বভাবে নেই।
আমার প্রশ্নটা শুনে জগলুল হোসেন কিছুক্ষন আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন।যেন বুঝতে পারছেননা তাকে কোন মাথাব্যাথার কথা বলা হচ্ছে।এবং আমাকে চুড়ান্ত অবাক করে দিয়ে সে সত্যি সত্যিই বলে বসলেন‘কিসের মাথা ব্যাথা?’
আমার রেগে যাওয়া উচিৎ।বদরাগী বলে আমার একটা কুখ্যাতি পরিচিত মহলে আছে।অন্তত খ্যাতিটা ধরে রাখবার জন্য হলেও আমার রেগে যাওয়া উচিত।কিন্তু আমি এই লোকটার উপর রাগলাম না,কিংবা বলা ভাল,রাগতে পারলাম না।লোকটার চেহারায় একটা মায়া আছে।মায়া সাধারণত থাকে তরুনী এবং শিশুদের চেহারায়।কিছু কিছু বৃদ্ধও আছে দেখলেই মায়া লাগে।কিন্তু জগলুল হোসেনকে কোনো শ্রেনীতেই ফেলা যাচ্ছেনা।তারপরও এর চেহারায় এমন একটা কিছু আছে যার কারনে এর উপর রাগও করা যাচ্ছেনা।আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,'এখানে দেখতে পাচ্ছি আপনি মাথা বাথ্যার সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছেন।তা সমস্যাটা কী ধরনের জানতে পারি?'
জগলুল সাহেব কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন,'ও আচ্ছা।একটু পরে বলি?'
'কী পরে বলবেন?'মেজাজটা আবার খিচড়ে যেতে চাইছে।
'আমার সমস্যার কথা।আমি এখানে অপেক্ষা করছি।আপনি একটু ফ্রি হলেই আমরা কথা বলব।'
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।যেন আমি না,এই জগলুল হোসেনই আসলে ডাক্তার।মানসিক ডাক্তার।আর আমি হলাম পুরোপুরি নেংটা পাগল।তবে এবারও মাথা ঠান্ডা করে বললাম,‘এখন বললে কী সমস্যা?’
'জী আছে একটু সমস্যা।'
এবার আমার সন্দেহ হতে লাগল।ব্যাটা যৌন রোগের চিকিৎসার জন্য আসেনি তো?যৌন রোগীরা ডাক্তারের কাছে রোগের কথা বলতে শরম পায়।যতই ভাবলাম ধারনাটা পোক্ত হল।নিশ্চয়ই কাউন্টারের ছাগলটা গুলিয়ে ফেলেছে।“চর্ম এবং যৌন” রোগের রোগীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।ছাগলটা এমন কাজ আগেও করেছে।না,এবার একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসল ব্যাপারটা ধরতে পারার সাথে সাথেই বিরক্তিভাবটা চলে গেল।আমি হাসি হাসি মুখে বললাম,‘আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি।আপনি এক কাজ করুন।এখান থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে সোজা গেলেই ২৫৪ নাম্বার রুম দেখতে পাবেন।ওটাই “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের রুম।’
জগলুল সাহেবের মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে গেল।‘চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের কাছে কেন যাব?আপনি ডাক্তার আনোয়ার না?’
হঠাৎ করে লজ্জা পেয়ে গেলাম।এই লোক তো মনে হচ্ছে আমার কাছেই এসেছে।নাম ধাম জেনে ভূল লোকের কাছে আসার কোনো কারন নেই।পন্ডিতি করে “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের ঠিকানা দেবার কী দরকার ছিল?ছিহঃকী লজ্জা!
আমতা আমতা করে বললাম,‘ইয়ে মানে...আপনি সমস্যা বলতে ইতস্তত করছিলেন তো তাই...’
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন।‘বুঝতে পেরেছি।আপনি রোগী দেখুন।বেলা একটার সময় তো আপনার ডিউটি শেষ তাইনা?তখন বলব আমার সমস্যার কথা।’
মাথায় ঢুকছে না কিছু।এই লোক বলে কী?আমি রোগী দেখব আর এ গ্যাট হয়ে চেম্বারে বসে থাকবে?সাফ নিষেধ করে দেব ভাবছি এমন সময় দেখলাম কম্পাউন্ডারের অসহায় মুখ দরজার ফাঁকে।রোগীরা বোধহয় গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছে।আমি কিছু না বলে হাক ছাড়লাম,'নেক্সট!'
'ডাক্তার সাহেব,আজকের পেপারটা দেখা যাবে?'
আধঘন্টা পার হয়ে গেছে অদ্ভুত মানুষটা রুমে ঢোকার পর থেকে।তবে সুখের কথা হল লোকটা বিরক্ত করছেনা।চুপচাপ রুমের এক কোনায় বসে আছে।এখন বারোটা বাজে,একটার সময় আউটডোর বন্ধ হয়ে যাবে। একজন রোগীকে বিদায় করে পরের জনকে পাঠাতে বলব এমন সময় কথাটা বলে উঠলেন জগলুল সাহেব।
'কী বললেন?'
'বললাম,আজকের পত্রিকাটা দেখা যাবে?'
আমি টেবিলের উপর থেকে পত্রিকা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।জগলুল সাহেব চুপচাপ পেপার পড়তে লাগলেন।
একটু পর আবার বললেন,'ডাক্তার সাহেব,একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?'
আমার ক্ষীন সন্দেহ হল,লোকটা বোধহয় আমাকে ইচ্ছে করেই জ্বালাচ্ছে।কেন জ্বালাবে?মোটিভ কী?
আমি নিজেই উঠে ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি এনে দিলাম তাকে।কেন দিলাম?মোটিভ কী?
একটার সময় আজানের আওয়াজ শুনে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম।যাক,আর লোকটার বেগার খাটতে হবেনা!আমি তার দিকে ফিরে বললাম,'তো জগলুল সাহেব,এবার বলুন আপনার সমস্যা।'
'আপনি মানুষটা অনেক ভাল।'
'এটাই কী আপনার সমস্যা?'
জগলুল সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন।জিভে কামড় দিয়ে বললেন,'না না, তা হবে কেন?আমি এটা বোঝাতে চাইনি।আচ্ছা,ডাক্তার সাহেব আপনি দুপুরে কোথায় খাবার খান?'
'বাসায়।ওখান থেকে আবার আমার প্রাইভেট চেম্বারে যেতে হবে।' ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম,তার সাথে বসে খোশগল্প করার মত সময় আমার নাই।ইঙ্গিতটা ধরতে পারলে হয়!
'আজ কি আমার সাথে খাবেন? '
'আপনার সাথে খাব মানে?কোথায়?'
'জী এখানে।আমি খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছি।খেতে খেতে আরাম করে গল্প করা যাবে।'
আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম জগলুল সাহেবের হাতে একটা ব্যাগ আছে।তবে তিনি যে সাথে খাবার দাবার নিয়ে ঘুরে বেড়ান সেটা কে জানত?'আপনি কি প্রায়ই খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসেন "গল্প" করতে?'
'না,এই প্রথম এলাম।আপনি হাত ধুয়ে আসুন।প্লেট আমার সাথেই আছে।'
লোকটার মতিগতি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তবে এটাও ঠিক,তার কথাগুলো শোনার খুব কৌতুহল হচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে এটাচ বাথরুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হতে।মিনিট পাঁচেক পর বের হয়ে দেখি জগলুল সাহেব বেসিন থেকে ধোয়ার কাজ টাজ সেরে প্লেট নিয়ে বসে আছেন।আমাকে দেখেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন,'আয়োজন সামান্যই।আমার ওয়াইফ রেঁধেছে।ওর রান্নার হাত মাশআল্লাহ খারাপ না।'
আয়োজন "সামান্য " বলা হলেও দেখে মনে হচ্ছে "অসামান্য"।বিশাল টিফিন ক্যারিয়ারের চার বাটি ভর্তি খাবার।নীচের বাটিতে ঠেসে ভাত দেয়া হয়েছে।উপরেরটাতে করলা আর আলুর মিক্স ভাজি,পটল ভাজি আর বেগুন ভাজি।নেক্সটে আছে ভর্তা। আলু, বেগুন আর কালো জিরার ভর্তা। সবার উপরেরটাতে রয়েছে গরু ভূনা। হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল হাজার বছর ধরে আমি ক্ষুধার্ত!
কথা ছিল খেতে খেতে কথা হবে। কিন্তু আমি খাওয়াতে এতই ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম জগলুল সাহেব বোধহয় লজ্জা পেয়েই পুরোটা সময় নীরব থেকে এটা ওটা বাড়িয়ে দিতে লাগলেন আমার দিকে। বুকে হাত রেখে বলতে পারব,এমন চমৎকার রান্না কখনোই খাইনি।
খেয়ে দেয়ে মুখে লেগে থাকা তৃপ্তি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম।একটা পান খেতে পারলে ষোলকলা পূর্ন হত।কম্পাউন্ডারকে বিদায় করে দিয়েছি বলে ষোলকলা পূর্ন করা গেলনা।
জগলুল সাহেব গোছগাছ করছেন।তার হাতের কাজ শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলাম,'সবই তো হল,এবার বলুন কেন এসেছেন?'
'বলছি।আমি এত ভনিতা করলাম কেন জানেন?আসলে কথাটা কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই সময় বের করার জন্যই এত কান্ড।'
'সমস্যা নেই,বলে ফেলুন।'
'ডাক্তার সাহেব আমার একটা শখ আছে।শখ না বলে ইচ্ছাও বলতে পারেন।'
এতক্ষনে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হল আমার কাছে।অনেকের থাকে এমন শখ।যেমন,কারো শখ থাকে মানুষের একসেট কংকালের,কারো বা আবার অপুর্ন ভ্রুনের।কেমিক্যাল ভর্তি কাঁচের জারে মানুষের অপুর্ন ভ্রুন সংরক্ষন করে রেখে দেয়। কী বিচ্ছিরি!
লোকটার কথা না শুনে খাবারগুলো খাওয়াই উচিত হয়নি।এখন কিভাবে মুখের উপর বলব যে এসব আমার দ্বারা হবে টবেনা?তবুও আমি জিজ্ঞেস করলাম,'কী শখ?'
এরপর জগলুল সাহেব যা বললেন তাতে করে আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম।বলে কী এই লোকটা!' কী বললেন,আপনি চোখের সামনে মানুষের মৃত্যু দেখতে চান?'
'জী।'নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন জগলুল সাহেব।
'আপনি কী জানেন,আপনি একটা অদ্ভুত কথা বলছেন?'
'জানি।'
'তা আপনার এমন শখের কারনটা কী?'
'ডাক্তার সাহেব,ছোটবেলায়ই আমার বাবা মারা যান।আমার তখন ছয় সাত বছর হবে।এপেন্ডিসাইটিসে মারা যান তিনি। অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি আর বাঁচবেন না।এ কারণেই আমাকে তার মৃত্যুশয্যার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।যখন যাবার অনুমতি দেয়া হয় তখন তিনি শেষ যাত্রায় রওনা দিয়ে দিয়েছেন।
ব্যাপারটা আমার উপর খুব প্রভাব ফেলে।আমার ধারনা হয় মৃত্য বোধহয় খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার যে কারণে আমাকে বাবার শেষ সময়ে তার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।তখন থেকেই আমার মধ্যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়।এরপর অনেক মৃত মানুষ দেখলেও কখনো চোখের সামনে কাউকে মৃত্যুবরন করতে দেখনি।আমি দেখতে চাই একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের চোখে কিসের আকুতি ফুটে থাকে।শেষ কয়টা মুহুর্ত তারা পৃথিবীটাকে কিভাবে দেখতে চায়।দেখতে চাই মৃত্যুর ভয়াবহ যন্ত্রনা নাকি বিদায়ের অবর্ণনীয় কষ্ট তাদের বেশি ব্যাথিত করে।'
আমি আচমকা ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলাম।আমার এই পেশায় আমি প্রচুর মৃত্যু দেখেছি।কখনো স্বাভাবিকভাবে, কখনো সামান্য দুঃখ নিয়ে,অবিশাস্য হলেও সত্য,কখনো হাসি মুখে।কিন্তু কখনোই মৃত্যুকে এত গভীরতা নিয়ে দেখিনি।মৃত্য আমার কাছে স্রেফ চলে যাওয়া।পাশের সিটে বসা সহযাত্রীর চলে যাবার মতই।
মৃত্যু দেখলে প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, পরে মানিয়ে নিয়েছি।আমাদের মানিয়ে নিতে হয়।কিন্তু আমি বহুবার দেখেছি কয়েকটা মিনিট বাড়তি আয়ু পাবার জন্য একজন মৃত্যুপথযাত্রী কতটা মরিয়া হয়ে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনায় একজন মানুষের গোটা দেহ কিভাবে মোচড় খায়।এখন মনে হচ্ছে সেটা চলে যাবার কষ্টেও হতে পারে।
জগলুল সাহেবের ইচ্ছেটাকেও এখন আর "উদ্ভট" মনে হচ্ছেনা।আসলেই,এ দৃশ্য বড়ই অদ্ভুত, অপার্থিব।
'তা আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? '
'কেউ পারলে আপনিই পারবেন।হাসপাতালে তো অনেক রোগী মারা যান।এমন কারো মৃত্যুর সময় আপনি কি আমাকে উপস্থিত থাকবার ব্যাবস্থা করে দিতে পারবেন? '
আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।এর মধ্যে যতই আধ্যাত্মিক ব্যাপার স্যাপার থাকুক না কেন সাদা চোখে এটা স্রেফ পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়।হুট করে এরকম একটা বিষয়ে কথা দেয়া তো সম্ভব না।একজন মানুষ কখন মারা যাবে তার কি ঠিক আছে?আর সরকারি হাসপাতালে অনিদৃষ্টকালের জন্য আন অথোরাইজড পার্সনকে অবস্থান করতে দেয়াটা খুবই জটিল ব্যাপার।তারউপর যদি কেউ জগলুল সাহেবের শখের ব্যাপারটা জেনে ফেলে তাহলে তার সাথে সাথে আমার স্থানও হবে এই হাসপাতাল থেকে সোজা পাবনায়।ডাক্তার হিসেবে নয়,রোগী হিসেবে!
তবে সরাসরি নিষেধও করতে পারছিনা।বেচারা এত ভাল খাবার খাইয়েছে!
বললাম,'দেখুন জগলুল সাহেব,এটা তো সরকারি হাসপাতাল, চাইলেই কিছু করা যায়না।তবে আমি আপনার ইচ্ছেটাকে মূল্যায়ন করছি।আপনি এক কাজ করুন,এক সপ্তাহ পর আমার সাথে যোগাযোগ করুন,আমি এর মধ্যে দেখছি কী করা যায়।'আমার ইচ্ছে এক সপ্তাহ পর এলে তাকে বুঝিয়ে বলব যে,আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছেনা।
'জী অবশ্যই।আপনি আমাকে পাগল ঠাউরে বসেননি তাতেই আমি খুশি।আমি আসব,
একসপ্তাহ পরেই আসব।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।'বলে চেয়ার ছাড়লেন তিনি।
'বাই দ্যা ওয়ে,আপনার উচিত আপনার স্ত্রীর হাত স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করে দেয়া।'
জগলুল সাহেব হেসে ফেললেন। 'সামর্থ্য থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।'
আমিও প্রতিউত্তরে পাল্টা হাসি দিলাম।
'ডাক্তার সাহেব,আমি তাহলে আসি।এক সপ্তাহ পর আসব।'জগলুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
জগলুল সাহেব এক সপ্তাহ পর আসেননি।
***
জগলুল সাহেবের সাথে আমার দেখা হল ঠিক দুবছর পর।রাতে চেম্বার থেকে হেঁটেই বাসায় ফিরি।সেদিনও ফিরছিলাম হঠাৎ রাস্তার ওপাশে স্ট্রিট লাইটের আলোয় জগলুল সাহেবকে হেঁটে যেতে দেখলাম।এ'কদিনে আরো বুড়িয়ে গেছেন তিনি।কাধদুটো ঝুলে পড়েছে।প্রথমবার চিনতে পারিনি। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফেলতে হল।চেনার সাথে সাথেই গলা চড়িয়ে ডাক দিলাম আমি,'জগলুল সাহেব!'
ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।ইতিউতি তাকিয়ে আমাকে খুঁজে পেলেন।
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।জানতে ইচ্ছে করছে কেন তিনি আর এলেন না।
রাস্তা প্রায় পার হয়ে গিয়েছি।আর কয়েক পা এগোলেই তার কাছে পৌঁছে যাব এমন সময় দেখতে পেলাম জগলুল সাহেবের চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলাম।ধাক্কাটা আমাকে ছিটকে কয়েক হাত দুরে,রাস্তায় নিয়ে ফেলল।
সাথে সাথে সমস্ত শরীর খিচুনি দিতে লাগল।অবশ হয়ে যাচ্ছে গোটা দেহ।মাথায় উষ্ণ তরলের একটা প্রসবন অনুভব করতে পারছি।আস্তে আস্তে আরো ঘোলাটে হতে থাকা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলাম জগলুল সাহেব দৌড়ে আমার দিকে আসছেন।
অবশেষে তার শখ পূরন হতে চলেছে...
সরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান আমি।প্রতিদিন আউটডোরে রোগী দেখতে হয়।রুমের বাইরে বিশাল এক লাইন নিয়ে দিন শুরু করি দিন শেষে সে লাইনের দৈর্ঘ আরো বড় হয়।
এটাই হল মফস্বল শহর।অধিকাংশ মানুষেরই কাজ কর্ম নেই।হাসপাতালে,আমার ধারনা,হাওয়া খেতে আসে এরা।সরকারি হাসপাতাল,টিকিট মাত্র দশটাকা।বেশিরভাগ অষুধ তো ফ্রি-ই।সস্তা পেয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে-সকালে উঠে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে তো একটু হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি!
অনেকদিন সাদা এপ্রোন পড়া মেয়ে ডাক্তার দেখিনা,হাসপাতালে ঢু মেরে আসা যাক! টিকিট মাত্র দশ টাকা।
ইদানিং অবশ্য আমি নতুন একটা ট্রিক্স আবিষ্কার করেছি।যেগুলোকে দেখে ত্যাদোর কিসিমের পাবলিক মনে হয় ওদের এমন ওষুধ লিখে দেই যেটা হাসপাতালের ফার্মেসীতে নেই।বেশ কাজ হচ্ছে এতে।একবার যাকে এই “ওষুধ” দেয়া হয় কারণ ছাড়া দ্বিতীয়বার আর হাসপাতালে আসার সম্ভবনা নেই তার।
তবে সামনে বসা এই লোকটাকে কী করে ঘাড় থেকে নামানো যায় বুঝতে পারছিনা।টিকিটে নাম লেখা আছে জগলুল হোসেন,বয়স ৪২।টিকিটে রোগের বিবরন লেখা থাকে।সেখানে দেখতে পাচ্ছি এই লোক মাথাব্যাথার সমস্যা নিয়ে এসেছে।
লোকটা ঢোকার পর আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দেরি না করে বললাম,’মাথাব্যাথাটা ঠিক কী ধরনের আপনার?’
টিকিটে লেখা দেখার পরও "আপনার কী সমস্যা" বলা আমার স্বভাবে নেই।
আমার প্রশ্নটা শুনে জগলুল হোসেন কিছুক্ষন আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন।যেন বুঝতে পারছেননা তাকে কোন মাথাব্যাথার কথা বলা হচ্ছে।এবং আমাকে চুড়ান্ত অবাক করে দিয়ে সে সত্যি সত্যিই বলে বসলেন‘কিসের মাথা ব্যাথা?’
আমার রেগে যাওয়া উচিৎ।বদরাগী বলে আমার একটা কুখ্যাতি পরিচিত মহলে আছে।অন্তত খ্যাতিটা ধরে রাখবার জন্য হলেও আমার রেগে যাওয়া উচিত।কিন্তু আমি এই লোকটার উপর রাগলাম না,কিংবা বলা ভাল,রাগতে পারলাম না।লোকটার চেহারায় একটা মায়া আছে।মায়া সাধারণত থাকে তরুনী এবং শিশুদের চেহারায়।কিছু কিছু বৃদ্ধও আছে দেখলেই মায়া লাগে।কিন্তু জগলুল হোসেনকে কোনো শ্রেনীতেই ফেলা যাচ্ছেনা।তারপরও এর চেহারায় এমন একটা কিছু আছে যার কারনে এর উপর রাগও করা যাচ্ছেনা।আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,'এখানে দেখতে পাচ্ছি আপনি মাথা বাথ্যার সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছেন।তা সমস্যাটা কী ধরনের জানতে পারি?'
জগলুল সাহেব কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন,'ও আচ্ছা।একটু পরে বলি?'
'কী পরে বলবেন?'মেজাজটা আবার খিচড়ে যেতে চাইছে।
'আমার সমস্যার কথা।আমি এখানে অপেক্ষা করছি।আপনি একটু ফ্রি হলেই আমরা কথা বলব।'
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।যেন আমি না,এই জগলুল হোসেনই আসলে ডাক্তার।মানসিক ডাক্তার।আর আমি হলাম পুরোপুরি নেংটা পাগল।তবে এবারও মাথা ঠান্ডা করে বললাম,‘এখন বললে কী সমস্যা?’
'জী আছে একটু সমস্যা।'
এবার আমার সন্দেহ হতে লাগল।ব্যাটা যৌন রোগের চিকিৎসার জন্য আসেনি তো?যৌন রোগীরা ডাক্তারের কাছে রোগের কথা বলতে শরম পায়।যতই ভাবলাম ধারনাটা পোক্ত হল।নিশ্চয়ই কাউন্টারের ছাগলটা গুলিয়ে ফেলেছে।“চর্ম এবং যৌন” রোগের রোগীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।ছাগলটা এমন কাজ আগেও করেছে।না,এবার একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসল ব্যাপারটা ধরতে পারার সাথে সাথেই বিরক্তিভাবটা চলে গেল।আমি হাসি হাসি মুখে বললাম,‘আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি।আপনি এক কাজ করুন।এখান থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে সোজা গেলেই ২৫৪ নাম্বার রুম দেখতে পাবেন।ওটাই “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের রুম।’
জগলুল সাহেবের মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে গেল।‘চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের কাছে কেন যাব?আপনি ডাক্তার আনোয়ার না?’
হঠাৎ করে লজ্জা পেয়ে গেলাম।এই লোক তো মনে হচ্ছে আমার কাছেই এসেছে।নাম ধাম জেনে ভূল লোকের কাছে আসার কোনো কারন নেই।পন্ডিতি করে “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের ঠিকানা দেবার কী দরকার ছিল?ছিহঃকী লজ্জা!
আমতা আমতা করে বললাম,‘ইয়ে মানে...আপনি সমস্যা বলতে ইতস্তত করছিলেন তো তাই...’
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন।‘বুঝতে পেরেছি।আপনি রোগী দেখুন।বেলা একটার সময় তো আপনার ডিউটি শেষ তাইনা?তখন বলব আমার সমস্যার কথা।’
মাথায় ঢুকছে না কিছু।এই লোক বলে কী?আমি রোগী দেখব আর এ গ্যাট হয়ে চেম্বারে বসে থাকবে?সাফ নিষেধ করে দেব ভাবছি এমন সময় দেখলাম কম্পাউন্ডারের অসহায় মুখ দরজার ফাঁকে।রোগীরা বোধহয় গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছে।আমি কিছু না বলে হাক ছাড়লাম,'নেক্সট!'
'ডাক্তার সাহেব,আজকের পেপারটা দেখা যাবে?'
আধঘন্টা পার হয়ে গেছে অদ্ভুত মানুষটা রুমে ঢোকার পর থেকে।তবে সুখের কথা হল লোকটা বিরক্ত করছেনা।চুপচাপ রুমের এক কোনায় বসে আছে।এখন বারোটা বাজে,একটার সময় আউটডোর বন্ধ হয়ে যাবে। একজন রোগীকে বিদায় করে পরের জনকে পাঠাতে বলব এমন সময় কথাটা বলে উঠলেন জগলুল সাহেব।
'কী বললেন?'
'বললাম,আজকের পত্রিকাটা দেখা যাবে?'
আমি টেবিলের উপর থেকে পত্রিকা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।জগলুল সাহেব চুপচাপ পেপার পড়তে লাগলেন।
একটু পর আবার বললেন,'ডাক্তার সাহেব,একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?'
আমার ক্ষীন সন্দেহ হল,লোকটা বোধহয় আমাকে ইচ্ছে করেই জ্বালাচ্ছে।কেন জ্বালাবে?মোটিভ কী?
আমি নিজেই উঠে ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি এনে দিলাম তাকে।কেন দিলাম?মোটিভ কী?
একটার সময় আজানের আওয়াজ শুনে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম।যাক,আর লোকটার বেগার খাটতে হবেনা!আমি তার দিকে ফিরে বললাম,'তো জগলুল সাহেব,এবার বলুন আপনার সমস্যা।'
'আপনি মানুষটা অনেক ভাল।'
'এটাই কী আপনার সমস্যা?'
জগলুল সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন।জিভে কামড় দিয়ে বললেন,'না না, তা হবে কেন?আমি এটা বোঝাতে চাইনি।আচ্ছা,ডাক্তার সাহেব আপনি দুপুরে কোথায় খাবার খান?'
'বাসায়।ওখান থেকে আবার আমার প্রাইভেট চেম্বারে যেতে হবে।' ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম,তার সাথে বসে খোশগল্প করার মত সময় আমার নাই।ইঙ্গিতটা ধরতে পারলে হয়!
'আজ কি আমার সাথে খাবেন? '
'আপনার সাথে খাব মানে?কোথায়?'
'জী এখানে।আমি খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছি।খেতে খেতে আরাম করে গল্প করা যাবে।'
আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম জগলুল সাহেবের হাতে একটা ব্যাগ আছে।তবে তিনি যে সাথে খাবার দাবার নিয়ে ঘুরে বেড়ান সেটা কে জানত?'আপনি কি প্রায়ই খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসেন "গল্প" করতে?'
'না,এই প্রথম এলাম।আপনি হাত ধুয়ে আসুন।প্লেট আমার সাথেই আছে।'
লোকটার মতিগতি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তবে এটাও ঠিক,তার কথাগুলো শোনার খুব কৌতুহল হচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে এটাচ বাথরুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হতে।মিনিট পাঁচেক পর বের হয়ে দেখি জগলুল সাহেব বেসিন থেকে ধোয়ার কাজ টাজ সেরে প্লেট নিয়ে বসে আছেন।আমাকে দেখেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন,'আয়োজন সামান্যই।আমার ওয়াইফ রেঁধেছে।ওর রান্নার হাত মাশআল্লাহ খারাপ না।'
আয়োজন "সামান্য " বলা হলেও দেখে মনে হচ্ছে "অসামান্য"।বিশাল টিফিন ক্যারিয়ারের চার বাটি ভর্তি খাবার।নীচের বাটিতে ঠেসে ভাত দেয়া হয়েছে।উপরেরটাতে করলা আর আলুর মিক্স ভাজি,পটল ভাজি আর বেগুন ভাজি।নেক্সটে আছে ভর্তা। আলু, বেগুন আর কালো জিরার ভর্তা। সবার উপরেরটাতে রয়েছে গরু ভূনা। হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল হাজার বছর ধরে আমি ক্ষুধার্ত!
কথা ছিল খেতে খেতে কথা হবে। কিন্তু আমি খাওয়াতে এতই ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম জগলুল সাহেব বোধহয় লজ্জা পেয়েই পুরোটা সময় নীরব থেকে এটা ওটা বাড়িয়ে দিতে লাগলেন আমার দিকে। বুকে হাত রেখে বলতে পারব,এমন চমৎকার রান্না কখনোই খাইনি।
খেয়ে দেয়ে মুখে লেগে থাকা তৃপ্তি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম।একটা পান খেতে পারলে ষোলকলা পূর্ন হত।কম্পাউন্ডারকে বিদায় করে দিয়েছি বলে ষোলকলা পূর্ন করা গেলনা।
জগলুল সাহেব গোছগাছ করছেন।তার হাতের কাজ শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলাম,'সবই তো হল,এবার বলুন কেন এসেছেন?'
'বলছি।আমি এত ভনিতা করলাম কেন জানেন?আসলে কথাটা কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই সময় বের করার জন্যই এত কান্ড।'
'সমস্যা নেই,বলে ফেলুন।'
'ডাক্তার সাহেব আমার একটা শখ আছে।শখ না বলে ইচ্ছাও বলতে পারেন।'
এতক্ষনে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হল আমার কাছে।অনেকের থাকে এমন শখ।যেমন,কারো শখ থাকে মানুষের একসেট কংকালের,কারো বা আবার অপুর্ন ভ্রুনের।কেমিক্যাল ভর্তি কাঁচের জারে মানুষের অপুর্ন ভ্রুন সংরক্ষন করে রেখে দেয়। কী বিচ্ছিরি!
লোকটার কথা না শুনে খাবারগুলো খাওয়াই উচিত হয়নি।এখন কিভাবে মুখের উপর বলব যে এসব আমার দ্বারা হবে টবেনা?তবুও আমি জিজ্ঞেস করলাম,'কী শখ?'
এরপর জগলুল সাহেব যা বললেন তাতে করে আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম।বলে কী এই লোকটা!' কী বললেন,আপনি চোখের সামনে মানুষের মৃত্যু দেখতে চান?'
'জী।'নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন জগলুল সাহেব।
'আপনি কী জানেন,আপনি একটা অদ্ভুত কথা বলছেন?'
'জানি।'
'তা আপনার এমন শখের কারনটা কী?'
'ডাক্তার সাহেব,ছোটবেলায়ই আমার বাবা মারা যান।আমার তখন ছয় সাত বছর হবে।এপেন্ডিসাইটিসে মারা যান তিনি। অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি আর বাঁচবেন না।এ কারণেই আমাকে তার মৃত্যুশয্যার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।যখন যাবার অনুমতি দেয়া হয় তখন তিনি শেষ যাত্রায় রওনা দিয়ে দিয়েছেন।
ব্যাপারটা আমার উপর খুব প্রভাব ফেলে।আমার ধারনা হয় মৃত্য বোধহয় খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার যে কারণে আমাকে বাবার শেষ সময়ে তার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।তখন থেকেই আমার মধ্যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়।এরপর অনেক মৃত মানুষ দেখলেও কখনো চোখের সামনে কাউকে মৃত্যুবরন করতে দেখনি।আমি দেখতে চাই একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের চোখে কিসের আকুতি ফুটে থাকে।শেষ কয়টা মুহুর্ত তারা পৃথিবীটাকে কিভাবে দেখতে চায়।দেখতে চাই মৃত্যুর ভয়াবহ যন্ত্রনা নাকি বিদায়ের অবর্ণনীয় কষ্ট তাদের বেশি ব্যাথিত করে।'
আমি আচমকা ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলাম।আমার এই পেশায় আমি প্রচুর মৃত্যু দেখেছি।কখনো স্বাভাবিকভাবে, কখনো সামান্য দুঃখ নিয়ে,অবিশাস্য হলেও সত্য,কখনো হাসি মুখে।কিন্তু কখনোই মৃত্যুকে এত গভীরতা নিয়ে দেখিনি।মৃত্য আমার কাছে স্রেফ চলে যাওয়া।পাশের সিটে বসা সহযাত্রীর চলে যাবার মতই।
মৃত্যু দেখলে প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, পরে মানিয়ে নিয়েছি।আমাদের মানিয়ে নিতে হয়।কিন্তু আমি বহুবার দেখেছি কয়েকটা মিনিট বাড়তি আয়ু পাবার জন্য একজন মৃত্যুপথযাত্রী কতটা মরিয়া হয়ে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনায় একজন মানুষের গোটা দেহ কিভাবে মোচড় খায়।এখন মনে হচ্ছে সেটা চলে যাবার কষ্টেও হতে পারে।
জগলুল সাহেবের ইচ্ছেটাকেও এখন আর "উদ্ভট" মনে হচ্ছেনা।আসলেই,এ দৃশ্য বড়ই অদ্ভুত, অপার্থিব।
'তা আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? '
'কেউ পারলে আপনিই পারবেন।হাসপাতালে তো অনেক রোগী মারা যান।এমন কারো মৃত্যুর সময় আপনি কি আমাকে উপস্থিত থাকবার ব্যাবস্থা করে দিতে পারবেন? '
আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।এর মধ্যে যতই আধ্যাত্মিক ব্যাপার স্যাপার থাকুক না কেন সাদা চোখে এটা স্রেফ পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়।হুট করে এরকম একটা বিষয়ে কথা দেয়া তো সম্ভব না।একজন মানুষ কখন মারা যাবে তার কি ঠিক আছে?আর সরকারি হাসপাতালে অনিদৃষ্টকালের জন্য আন অথোরাইজড পার্সনকে অবস্থান করতে দেয়াটা খুবই জটিল ব্যাপার।তারউপর যদি কেউ জগলুল সাহেবের শখের ব্যাপারটা জেনে ফেলে তাহলে তার সাথে সাথে আমার স্থানও হবে এই হাসপাতাল থেকে সোজা পাবনায়।ডাক্তার হিসেবে নয়,রোগী হিসেবে!
তবে সরাসরি নিষেধও করতে পারছিনা।বেচারা এত ভাল খাবার খাইয়েছে!
বললাম,'দেখুন জগলুল সাহেব,এটা তো সরকারি হাসপাতাল, চাইলেই কিছু করা যায়না।তবে আমি আপনার ইচ্ছেটাকে মূল্যায়ন করছি।আপনি এক কাজ করুন,এক সপ্তাহ পর আমার সাথে যোগাযোগ করুন,আমি এর মধ্যে দেখছি কী করা যায়।'আমার ইচ্ছে এক সপ্তাহ পর এলে তাকে বুঝিয়ে বলব যে,আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছেনা।
'জী অবশ্যই।আপনি আমাকে পাগল ঠাউরে বসেননি তাতেই আমি খুশি।আমি আসব,
একসপ্তাহ পরেই আসব।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।'বলে চেয়ার ছাড়লেন তিনি।
'বাই দ্যা ওয়ে,আপনার উচিত আপনার স্ত্রীর হাত স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করে দেয়া।'
জগলুল সাহেব হেসে ফেললেন। 'সামর্থ্য থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।'
আমিও প্রতিউত্তরে পাল্টা হাসি দিলাম।
'ডাক্তার সাহেব,আমি তাহলে আসি।এক সপ্তাহ পর আসব।'জগলুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
জগলুল সাহেব এক সপ্তাহ পর আসেননি।
***
জগলুল সাহেবের সাথে আমার দেখা হল ঠিক দুবছর পর।রাতে চেম্বার থেকে হেঁটেই বাসায় ফিরি।সেদিনও ফিরছিলাম হঠাৎ রাস্তার ওপাশে স্ট্রিট লাইটের আলোয় জগলুল সাহেবকে হেঁটে যেতে দেখলাম।এ'কদিনে আরো বুড়িয়ে গেছেন তিনি।কাধদুটো ঝুলে পড়েছে।প্রথমবার চিনতে পারিনি। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফেলতে হল।চেনার সাথে সাথেই গলা চড়িয়ে ডাক দিলাম আমি,'জগলুল সাহেব!'
ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।ইতিউতি তাকিয়ে আমাকে খুঁজে পেলেন।
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।জানতে ইচ্ছে করছে কেন তিনি আর এলেন না।
রাস্তা প্রায় পার হয়ে গিয়েছি।আর কয়েক পা এগোলেই তার কাছে পৌঁছে যাব এমন সময় দেখতে পেলাম জগলুল সাহেবের চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলাম।ধাক্কাটা আমাকে ছিটকে কয়েক হাত দুরে,রাস্তায় নিয়ে ফেলল।
সাথে সাথে সমস্ত শরীর খিচুনি দিতে লাগল।অবশ হয়ে যাচ্ছে গোটা দেহ।মাথায় উষ্ণ তরলের একটা প্রসবন অনুভব করতে পারছি।আস্তে আস্তে আরো ঘোলাটে হতে থাকা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলাম জগলুল সাহেব দৌড়ে আমার দিকে আসছেন।
অবশেষে তার শখ পূরন হতে চলেছে...
Published on October 04, 2013 07:19


