রঙিন ছায়া
এক
রাতুলের মন এত ভাল শেষ কবে ছিল মনে করতে পারছেনা ও।ওর জীবনে বড় আনন্দের প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। ছোট ছোট আনন্দ নিয়েই ওর বসবাস।এরপরও এই ক্ষুদে আনন্দগুলো যে অহরহ ওর জীবনে আসে তাও না। এজন্যই শেষ আনন্দের মুহুর্তটা মনে করতে গিয়ে মোটামুটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ওকে।
যতদুর মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে যেদিন ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠল সেদিনও এরকমই আনন্দ হয়েছিল ওর। অনেক বড় বড় মনে হয়েছিল নিজেকে। তবে এটাই একমাত্র কারন ছিল না।
রাতুল ধরেই নিয়েছিল, ফাইভ পাশ করার পর ওকেও ওর বেশিরভাগ বন্ধুর মত হোটেলের বয় কিংবা টেম্পুর হেলপার হতে হবে।
হোটেলের ওয়েটার বা, লোকাল বাসের হেলপার হতে হলে আগে এসব করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, রাতুল জানে। ওর বন্ধুরা ওকে বলে। ও আরো জানে ড্রাইভার
কিংবা ওয়েটারদের "ওস্তাদ "বলে ডাকতে হয়।
হামিদ অবশ্য কিভাবে কিভাবে যেন প্রথমবারেই একটা লোকাল বাসের হেলপার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ওর অন্যরকম একটা দাম আছে। ইনকামটাও ওর একটু বেশি। মাঝে মধ্যেই স্টার সিগারেট খাওয়ায় ওদের। রাতুল অবশ্য সিগারেট খায়না। ওর বন্ধুদের খেতে দেখে একদিন একটা টান দিয়েছিল।টান দেয়ার পরবর্তী কয়েকমিনিট ওর মাথা ঝিম ধরে থাকায় আর কখনো ও
জিনিসে হাত দেয়নি। তবে হামিদ, শরীফ, বিকাশ, মোমেন ওরা দিব্যি টেনে যায়। সিগারেট খেলে নাকি ক্লান্তি দুর হয়,টেনশন থাকেনা, আরো কী কী সব হাবিজাবি বলে ওরা।
রাতুলের এসব বিশ্বাস হয়না। এই অভ্যেস আসলে বাইরে কাজ করতে গিয়ে হয়েছে ওদের। রাতুল যদি ওদের মত কাজ করত তাহলে হয়ত ওরও এমনটাই মনে হত।
"ওস্তাদের "দেখা দেখি ও-ও সিগারেট টেনে যেত দ্বিদ্ধাহীন।কিন্তু এমনটা হয়নি।
ওদের স্কুলে যেদিন ভর্তি শুরু হয় ও সেদিন ইচ্ছে করেই যায়নি ভর্তি হতে।
রাতেরবেলা ওর বাবা রিকশা চালিয়ে এসে বলে, 'কিরে, ইস্কুলে ভর্তি হইতে গেলি না কেন? '
রাতুল কথা না বলে মাথা নীচু করে রাখে।
'পড়াশোনা না কইরা লায়েক হবি? এই সব টাল্টি বাল্টি চলবনা।কাইল সকালেই ইস্কুলে যাবি। 'এরপর ওর মা'র দিকে তাকিয়ে বলে, 'সালেহা, ও জানি কাইল ইস্কুলে ভর্তি হয়, এইটা দেখার দায়িত্ব তুমার। আমরা গাধা হইছি দেইখা পোলাডাও গাধা হইব,এইটা তো কুনো কথা না...ওই হাসোছ কেন তুই?'
'হাসি না তো আব্বা! 'বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলে রাতুল।
সেদিন যেমন আনন্দ হয়েছিল আজকের আনন্দটাও ওই রকমই।একটু বেশিই বরং।
কাল ঈদ।ওর বন্ধুরা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ঈদের। এক ধরনের সিগারেট নাকি আছে, যেটাতে দুর্গন্ধ নেই।টানলে কেমন যেন এলাচির সুবাস পাওয়া যায়। এক এক শলা পনেরো টাকা করে। ওর বন্ধুরা ঈদ উপলক্ষে ওরই এক প্যাকেট নিজেরা নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে কিনেছে। ঈদের দিন রাতে খাওয়া হবে। এছাড়াও দিনের বেলা সবাই একসাথে পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরতে বের হবে।পরিকল্পনা হয়েছে,সবার পাঞ্জাবী একই রকম হবে।
সবার পাঞ্জাবী জোগাড় হয়ে গেছে, রাতুলেরটা ছাড়া। পাঞ্জাবীটা খুব বেশি দামি তা না।মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু এই সামান্য টাকা রাতুলের রিকশাচালক বাবার জন্য অনেক বেশি কিছু।
দিব,দিচ্ছি করে করে পুরোটা রমজান চলে গেছে।পাঞ্জাবীটা আর পাওয়া হয়নি রাতুলের। তবে ওর বাবা কথা দিয়েছে ওর জন্য আজ পাঞ্জাবী অবশ্যই কেনা হবে।বাবা আজ রিকশা নিয়ে বেরই হয়েছে রাতুলের পাঞ্জাবীর টাকা জোগার করতে।ওর কাছে কিছু টাকা আছে,সেটা দিয়ে কাল হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারবে,এখন শুধু পাঞ্জাবীর অপেক্ষা।
রাতুল অনেক খুশি।
দুই
'খচ্চরের গুষ্টি কুনহানকার! 'বলে একদলা থুথু সামনে দিয়ে পাই পাই করে ছুটে যাওয়া একটা অটো রিকশার গায়ে লাগাতে গিয়েও ব্যার্থ হল ফারুক মিয়া। বিড়বিড় করে চাইনিজদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল সে।
এই "খচ্চর" জাতি এক ধরনের ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা আবিস্কার করল, সেটা এ দেশে আমদানি হল আর রিকশাওয়ালাদের পেটে লাথি পড়ল।
একটা অটো রিকশাতে গাদাগাদি করে মোটামুটি একটা মাইক্রোর চাইতে বেশি মানুষ নেয়া হয়!
ভাড়া রিকশার চাইতে তিনগুন কম। গতিও বেশি।ক'জনের অমন তালুকদারি আছে অটো রিকশা রেখে তার রিকশাতে উঠবে?
এবার রোজা ত্রিশটা হচ্ছে। কাল নিশ্চিত ঈদ। অথচ এখনো অনেক অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে ফারুক মিয়াকে।
সারাটা রোজার মাস ধরে এই দিনটার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে ফারুক। সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকা হয়।ঈদের একটা দিন তো ভাল মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে হয়ই। এজন্য টাকা জমিয়েছে ফারুক। পোলাও, মুরগি আর সেমাই কেনা হবে এটাকা দিয়ে। একেবারে হিসেব করা টাকা। এখান থেকে ছেলেটাকে চারশ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনে দিলে কালকের দিনটাও প্রতিদিনের মত কাটবে তাদের।
আজ অনেক সকালে বের হয়েছে ফারুক। ভেবেছিল সারাদিন রিকশা চালালে রাতুলের পাঞ্জাবী কেনার টাকাটা জোগার হয়ে যাবে। ছেলেটা কখনো কিছু চায়না, এবার ঈদে একটা পাঞ্জাবীই শুধু চেয়েছে।কিন্তু মনে হচ্ছেনা সেটা দিতে পারবে ফারুক। মাত্র শ দেড়েক টাকা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোগার করতে পেরেছে। ঈদের আগে কেউ টাকা ধার দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখতে পাচ্ছেনা।
ফারুক এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিল বাজারের টাকা দিয়েই রাতুলের পাঞ্জাবী কিনে দেবে সে। ৩৬৪ দিন আধ পেটা খেয়ে থাকতে পারলে আর একটা দিনও পারবে। রাতুল যে পাঞ্জাবী চেয়েছে সেটাই কিনে দেবে সে। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নয়।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগে। একটা মসজিদ থেকে ইফতারি করে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সে একটু আগেই।
এতক্ষন উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশা চালিয়ে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফারুক।পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনও বলা যাবেনা।ঈদের আগের দিন এসব এলাকায় ভাড়া পাওয়ার সম্ভবনা আছে।
হঠাত ফারুক খেয়াল করে দেখল সে একটা নির্জন রাস্তায় এসে পড়েছে। যতদুর দেখতে পাচ্ছে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই।
যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফারুক রিকশা ঘুরিয়ে নিতেই সাথে সাথে বুকটা ছ্যাত করে উঠল তার।
রাস্তার পাশের অন্ধকার কোণ থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয়বারের মত রিকশা ঘুরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ছায়ামুর্তি দুটো ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
বুক পকেটে রাখা টাকাগুলোর দিকে একবার তাকাল ফারুক মিয়া। রিকশার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরল।
তিন
রাতুলের মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছেনা। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে ও।চাইলেই কি কাঁদা যায়?
তবে কতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারবে ও জানেনা। মা 'ও বেশ কিছুক্ষন ধরেই ছটফট করছে। রাত প্রায় বারটা বাজে।বাবা কখনোই এত রাত করেনা। আজ তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা।
ওদের বস্তিতে ঈদ শুরু হয়ে গেছে। কেউই বোধহয় ঘরে নেই।সবাই বাইরে এসে দল বেধে গল্প করছে। ছোটরা হইচই করছে।একটু পর পরই বেসুরো গলায় "রমজানের ওই রোজার শেষে" গান গেয়ে উঠছে। অবশ্য কারো কাছেই এই মুহুর্তে গানটাকে "বেসুরো" মনে হচ্ছেনা। ব্যাতিক্রম শুধু সালেহা আর রাতুল।
রাতুলের বন্ধুরা কয়েকবার করে ডেকে গেছে ওকে, ও যায়নি।
ও মনে প্রাণে চাইছে মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখতে। নিজের মনেঈ আউড়ে যাচ্ছে"আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক চলে আসবে।"
এরপরও যখনই বাইরে থেকে হইচই-এর আওয়াজ বেড়ে যায় সাথে সাথে রাতুলের বুকটাও চিলিক দিয়ে ওঠে অজানা শংকায়।
"মা, আব্বা কখন আসবো?"
"আমি কী জানি। "অকারণেই ঝাঁজিয়ে ওঠে সালেহা।
রাতুল চুপ মেরে যায়। এখন আর রাতুলের পাঞ্জাবীর একটুও দরকার নেই, ওর শুধু। বাবাকে খুব প্রয়োজন।
বাবা এলে ও মা'কে বলবে ওর পুরনো পাঞ্জাবীটা ভাল করে ধুয়ে দিতে। রাতের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। কাল সকালে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনলে কেউ বুঝতেই পারবেনা পাঞ্জাবীটা পুরনো। হাতার কাছে একটু ছেঁড়া আছে অবশ্য।হাতাটা গুটিয়ে নিলেই হবে।
এক রকম পাঞ্জাবী না হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে ঘুরতে না নিলেও সমস্যা নেই। ও বাসায় বসে থাকবে সারাদিন।এরপরও বাবাকে ভীষন প্রয়োজন রাতুলের। ভী-ষ-ন।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে,আরো গভীর...
উপসংহার
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতুল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাবার মুখটাকে চোখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। বাবাই ঘুম ভাঙিয়েছে ওর।
রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। 'কী হইছিল আব্বা তোমার? ' ইশ এত ভাল লাগছে রাতুলের!
'আরে আর কইস না রে ব্যাটা। দুইটা পোলা ঈদের পরেরদিন কী অনুষ্ঠানের লিগা বন্ধু বান্ধবরে দাওয়াত দিব তাই আমারে ভাড়া করল। সেই সন্ধ্যা থিকা রাইত একটা পর্যন্ত দুনিয়া ঘুইরা বেড়াইলাম। ম্যালা ট্যাকা ভাড়া দিছে। বখশিশও পাইছি।এরপর বাজার সদাই কইরা আইতে আইতেই দেরী হইয়া গেল।এই যে তোর পাঞ্জাবী। ' বলতে বলতে একটা প্যাকেট রাতুলের হাতে ধরিয়ে দেয় ফারুক।
রাতুল কোনো কথা বলতে পারলনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
এক ধরনের ছায়া পড়েছে রাতুলের দু চোখে।রঙিন ছায়া।
রাতুলের মন এত ভাল শেষ কবে ছিল মনে করতে পারছেনা ও।ওর জীবনে বড় আনন্দের প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। ছোট ছোট আনন্দ নিয়েই ওর বসবাস।এরপরও এই ক্ষুদে আনন্দগুলো যে অহরহ ওর জীবনে আসে তাও না। এজন্যই শেষ আনন্দের মুহুর্তটা মনে করতে গিয়ে মোটামুটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ওকে।
যতদুর মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে যেদিন ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠল সেদিনও এরকমই আনন্দ হয়েছিল ওর। অনেক বড় বড় মনে হয়েছিল নিজেকে। তবে এটাই একমাত্র কারন ছিল না।
রাতুল ধরেই নিয়েছিল, ফাইভ পাশ করার পর ওকেও ওর বেশিরভাগ বন্ধুর মত হোটেলের বয় কিংবা টেম্পুর হেলপার হতে হবে।
হোটেলের ওয়েটার বা, লোকাল বাসের হেলপার হতে হলে আগে এসব করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, রাতুল জানে। ওর বন্ধুরা ওকে বলে। ও আরো জানে ড্রাইভার
কিংবা ওয়েটারদের "ওস্তাদ "বলে ডাকতে হয়।
হামিদ অবশ্য কিভাবে কিভাবে যেন প্রথমবারেই একটা লোকাল বাসের হেলপার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ওর অন্যরকম একটা দাম আছে। ইনকামটাও ওর একটু বেশি। মাঝে মধ্যেই স্টার সিগারেট খাওয়ায় ওদের। রাতুল অবশ্য সিগারেট খায়না। ওর বন্ধুদের খেতে দেখে একদিন একটা টান দিয়েছিল।টান দেয়ার পরবর্তী কয়েকমিনিট ওর মাথা ঝিম ধরে থাকায় আর কখনো ও
জিনিসে হাত দেয়নি। তবে হামিদ, শরীফ, বিকাশ, মোমেন ওরা দিব্যি টেনে যায়। সিগারেট খেলে নাকি ক্লান্তি দুর হয়,টেনশন থাকেনা, আরো কী কী সব হাবিজাবি বলে ওরা।
রাতুলের এসব বিশ্বাস হয়না। এই অভ্যেস আসলে বাইরে কাজ করতে গিয়ে হয়েছে ওদের। রাতুল যদি ওদের মত কাজ করত তাহলে হয়ত ওরও এমনটাই মনে হত।
"ওস্তাদের "দেখা দেখি ও-ও সিগারেট টেনে যেত দ্বিদ্ধাহীন।কিন্তু এমনটা হয়নি।
ওদের স্কুলে যেদিন ভর্তি শুরু হয় ও সেদিন ইচ্ছে করেই যায়নি ভর্তি হতে।
রাতেরবেলা ওর বাবা রিকশা চালিয়ে এসে বলে, 'কিরে, ইস্কুলে ভর্তি হইতে গেলি না কেন? '
রাতুল কথা না বলে মাথা নীচু করে রাখে।
'পড়াশোনা না কইরা লায়েক হবি? এই সব টাল্টি বাল্টি চলবনা।কাইল সকালেই ইস্কুলে যাবি। 'এরপর ওর মা'র দিকে তাকিয়ে বলে, 'সালেহা, ও জানি কাইল ইস্কুলে ভর্তি হয়, এইটা দেখার দায়িত্ব তুমার। আমরা গাধা হইছি দেইখা পোলাডাও গাধা হইব,এইটা তো কুনো কথা না...ওই হাসোছ কেন তুই?'
'হাসি না তো আব্বা! 'বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলে রাতুল।
সেদিন যেমন আনন্দ হয়েছিল আজকের আনন্দটাও ওই রকমই।একটু বেশিই বরং।
কাল ঈদ।ওর বন্ধুরা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ঈদের। এক ধরনের সিগারেট নাকি আছে, যেটাতে দুর্গন্ধ নেই।টানলে কেমন যেন এলাচির সুবাস পাওয়া যায়। এক এক শলা পনেরো টাকা করে। ওর বন্ধুরা ঈদ উপলক্ষে ওরই এক প্যাকেট নিজেরা নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে কিনেছে। ঈদের দিন রাতে খাওয়া হবে। এছাড়াও দিনের বেলা সবাই একসাথে পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরতে বের হবে।পরিকল্পনা হয়েছে,সবার পাঞ্জাবী একই রকম হবে।
সবার পাঞ্জাবী জোগাড় হয়ে গেছে, রাতুলেরটা ছাড়া। পাঞ্জাবীটা খুব বেশি দামি তা না।মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু এই সামান্য টাকা রাতুলের রিকশাচালক বাবার জন্য অনেক বেশি কিছু।
দিব,দিচ্ছি করে করে পুরোটা রমজান চলে গেছে।পাঞ্জাবীটা আর পাওয়া হয়নি রাতুলের। তবে ওর বাবা কথা দিয়েছে ওর জন্য আজ পাঞ্জাবী অবশ্যই কেনা হবে।বাবা আজ রিকশা নিয়ে বেরই হয়েছে রাতুলের পাঞ্জাবীর টাকা জোগার করতে।ওর কাছে কিছু টাকা আছে,সেটা দিয়ে কাল হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারবে,এখন শুধু পাঞ্জাবীর অপেক্ষা।
রাতুল অনেক খুশি।
দুই
'খচ্চরের গুষ্টি কুনহানকার! 'বলে একদলা থুথু সামনে দিয়ে পাই পাই করে ছুটে যাওয়া একটা অটো রিকশার গায়ে লাগাতে গিয়েও ব্যার্থ হল ফারুক মিয়া। বিড়বিড় করে চাইনিজদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল সে।
এই "খচ্চর" জাতি এক ধরনের ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা আবিস্কার করল, সেটা এ দেশে আমদানি হল আর রিকশাওয়ালাদের পেটে লাথি পড়ল।
একটা অটো রিকশাতে গাদাগাদি করে মোটামুটি একটা মাইক্রোর চাইতে বেশি মানুষ নেয়া হয়!
ভাড়া রিকশার চাইতে তিনগুন কম। গতিও বেশি।ক'জনের অমন তালুকদারি আছে অটো রিকশা রেখে তার রিকশাতে উঠবে?
এবার রোজা ত্রিশটা হচ্ছে। কাল নিশ্চিত ঈদ। অথচ এখনো অনেক অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে ফারুক মিয়াকে।
সারাটা রোজার মাস ধরে এই দিনটার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে ফারুক। সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকা হয়।ঈদের একটা দিন তো ভাল মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে হয়ই। এজন্য টাকা জমিয়েছে ফারুক। পোলাও, মুরগি আর সেমাই কেনা হবে এটাকা দিয়ে। একেবারে হিসেব করা টাকা। এখান থেকে ছেলেটাকে চারশ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনে দিলে কালকের দিনটাও প্রতিদিনের মত কাটবে তাদের।
আজ অনেক সকালে বের হয়েছে ফারুক। ভেবেছিল সারাদিন রিকশা চালালে রাতুলের পাঞ্জাবী কেনার টাকাটা জোগার হয়ে যাবে। ছেলেটা কখনো কিছু চায়না, এবার ঈদে একটা পাঞ্জাবীই শুধু চেয়েছে।কিন্তু মনে হচ্ছেনা সেটা দিতে পারবে ফারুক। মাত্র শ দেড়েক টাকা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোগার করতে পেরেছে। ঈদের আগে কেউ টাকা ধার দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখতে পাচ্ছেনা।
ফারুক এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিল বাজারের টাকা দিয়েই রাতুলের পাঞ্জাবী কিনে দেবে সে। ৩৬৪ দিন আধ পেটা খেয়ে থাকতে পারলে আর একটা দিনও পারবে। রাতুল যে পাঞ্জাবী চেয়েছে সেটাই কিনে দেবে সে। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোনও কৃপনতা নয়।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষন আগে। একটা মসজিদ থেকে ইফতারি করে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সে একটু আগেই।
এতক্ষন উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশা চালিয়ে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফারুক।পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনও বলা যাবেনা।ঈদের আগের দিন এসব এলাকায় ভাড়া পাওয়ার সম্ভবনা আছে।
হঠাত ফারুক খেয়াল করে দেখল সে একটা নির্জন রাস্তায় এসে পড়েছে। যতদুর দেখতে পাচ্ছে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই।
যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফারুক রিকশা ঘুরিয়ে নিতেই সাথে সাথে বুকটা ছ্যাত করে উঠল তার।
রাস্তার পাশের অন্ধকার কোণ থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয়বারের মত রিকশা ঘুরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ছায়ামুর্তি দুটো ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
বুক পকেটে রাখা টাকাগুলোর দিকে একবার তাকাল ফারুক মিয়া। রিকশার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরল।
তিন
রাতুলের মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছেনা। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে ও।চাইলেই কি কাঁদা যায়?
তবে কতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারবে ও জানেনা। মা 'ও বেশ কিছুক্ষন ধরেই ছটফট করছে। রাত প্রায় বারটা বাজে।বাবা কখনোই এত রাত করেনা। আজ তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা।
ওদের বস্তিতে ঈদ শুরু হয়ে গেছে। কেউই বোধহয় ঘরে নেই।সবাই বাইরে এসে দল বেধে গল্প করছে। ছোটরা হইচই করছে।একটু পর পরই বেসুরো গলায় "রমজানের ওই রোজার শেষে" গান গেয়ে উঠছে। অবশ্য কারো কাছেই এই মুহুর্তে গানটাকে "বেসুরো" মনে হচ্ছেনা। ব্যাতিক্রম শুধু সালেহা আর রাতুল।
রাতুলের বন্ধুরা কয়েকবার করে ডেকে গেছে ওকে, ও যায়নি।
ও মনে প্রাণে চাইছে মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখতে। নিজের মনেঈ আউড়ে যাচ্ছে"আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক চলে আসবে।"
এরপরও যখনই বাইরে থেকে হইচই-এর আওয়াজ বেড়ে যায় সাথে সাথে রাতুলের বুকটাও চিলিক দিয়ে ওঠে অজানা শংকায়।
"মা, আব্বা কখন আসবো?"
"আমি কী জানি। "অকারণেই ঝাঁজিয়ে ওঠে সালেহা।
রাতুল চুপ মেরে যায়। এখন আর রাতুলের পাঞ্জাবীর একটুও দরকার নেই, ওর শুধু। বাবাকে খুব প্রয়োজন।
বাবা এলে ও মা'কে বলবে ওর পুরনো পাঞ্জাবীটা ভাল করে ধুয়ে দিতে। রাতের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। কাল সকালে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনলে কেউ বুঝতেই পারবেনা পাঞ্জাবীটা পুরনো। হাতার কাছে একটু ছেঁড়া আছে অবশ্য।হাতাটা গুটিয়ে নিলেই হবে।
এক রকম পাঞ্জাবী না হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে ঘুরতে না নিলেও সমস্যা নেই। ও বাসায় বসে থাকবে সারাদিন।এরপরও বাবাকে ভীষন প্রয়োজন রাতুলের। ভী-ষ-ন।
সময় বয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে,আরো গভীর...
উপসংহার
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতুল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাবার মুখটাকে চোখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। বাবাই ঘুম ভাঙিয়েছে ওর।
রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। 'কী হইছিল আব্বা তোমার? ' ইশ এত ভাল লাগছে রাতুলের!
'আরে আর কইস না রে ব্যাটা। দুইটা পোলা ঈদের পরেরদিন কী অনুষ্ঠানের লিগা বন্ধু বান্ধবরে দাওয়াত দিব তাই আমারে ভাড়া করল। সেই সন্ধ্যা থিকা রাইত একটা পর্যন্ত দুনিয়া ঘুইরা বেড়াইলাম। ম্যালা ট্যাকা ভাড়া দিছে। বখশিশও পাইছি।এরপর বাজার সদাই কইরা আইতে আইতেই দেরী হইয়া গেল।এই যে তোর পাঞ্জাবী। ' বলতে বলতে একটা প্যাকেট রাতুলের হাতে ধরিয়ে দেয় ফারুক।
রাতুল কোনো কথা বলতে পারলনা। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
এক ধরনের ছায়া পড়েছে রাতুলের দু চোখে।রঙিন ছায়া।
Published on October 05, 2013 02:00
No comments have been added yet.


