একজন অভ্র এবং এককাপ অমৃত
এক
আমার মত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো পাবলিকের জন্য রাস্তার পাশের টং দোকানগুলো হচ্ছে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের মত।হাঁটতে হাঁটতে মাশরাফির মত পায়ের লিগামেন্ট ছেঁড়ার উপক্রম হল তো একটা টং-এ ঢুকে দুটাকার একটা টোস্ট আর একটা চা খেয়ে ফের হন্টন। আজকাল অবশ্য দুটাকায় টোস্ট পাওয়া যাচ্ছেনা।তিন টাকা হয়ে গেছে।দুটাকায় এক ধরনের চারকোনা নোনতা বিস্কুট পাওয়া যায় যেটার সাইজ দেখলেই অসহায় বোধ করতে হয়!
বাস যথা সম্ভব এড়িয়ে চলি বলে এই অবকাশ যাপন খরচে পুষিয়ে যায়। আমার মত মধ্যবিত্তদের সবার আগে,সবকিছুর আগে খরচের হিসাব কষে ফেলতে হয়।
এই হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমার নিয়মিত যাত্রা পথের অধিকাংশ দোকানের হাড়ির খবর আমার নখদর্পণে।কোন দোকানে চা'কে রসগোল্লার সিরাতে পরিনত করা হয়,কোন দোকানে চিনির পরিবর্তে শুধুমাত্র কনডেন্স মিল্ক দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া হয়,কোন দোকানের কাঁচা পাত্তি দিয়ে বানানো চা অমৃততুল্য, কোন দোকানের মালাই চা খেলে মনে হবে এখনই মরে যাই, ইত্যাদি সব মোটামুটি পরীক্ষার আগের রাতের পড়ার মত মুখস্ত করে ফেলেছি।
এছাড়াও দোকানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও জ্ঞান খারাপ না।যেমন এক দোকানের বিস্কুটগুলো কী এক অজ্ঞাত কারনে যেন সব সময়েই নেতিয়ে থাকে।টোস্টে কামড় দিলে মনে হয় পাউরুটি চাবাচ্ছি!
আরেক দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসতে হলে দুবার ভেবে নেয়া আবশ্যক।বেঞ্চির একটা পায়া ভাঙ্গা।তিনটা ইট দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে।যখন তখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশংকা।
তবে এই মুহুর্তে যে দোকানে ঢোকার চিন্তা ভাবনা আমি করছি সেই দোকানটা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছিনা।কারন এর আগে কখনো আসিনি এখানে।
পিজিতে যাচ্ছি।এখন কারওয়ান বাজারে।যেহেতু এটা আমার নিয়মিত রুট নয় সেহেতু এদিকের চায়ের দোকানও ভাল চিনিনা।
মোটামুটি বৃদ্ধ টাইপের এক লোক চুলার দিকে উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।যদ্দুর মনে হয় তার নজর আকাশ পানে উড়াল দেয়া সাদা ধোঁয়ার দিকে।তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে দোকান তেমন একটা চলেনা তার।দোকানের ঢং ঢাং বেশি সুবিধার না।দারিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।প্রতিটা জিনিসেরই বাহ্যিক রুপের গুরুত্ব আছে।এমন দোকানে বসে কেউ আগ্রহ নিয়ে চুক চুক করে চা খাবে এমনটা ভাবার কোনো কারন নেই।তবে সুখের কথা হল আমি চা খেতে আসিনি এখানে। একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি পিজিতে।আমার এক বন্ধুর মা খুবই অসুস্থ।গত দুদিন ধরে বন্ধুটা মা'র পাশে বসে আছে।একমুহুর্তের জন্যও নড়ার উপায় নেই।চোখের আড়াল হলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেন ওর মা।ওর বাবা থাকে বিদেশে। ভাইবোন না থাকায় ওরই দেখা শোনা করতে হচ্ছে মাকে।আমাকে বলেছে আমি যেন কয়েক ঘন্টার জন্য হাসপাতালে গিয়ে ওর মা'র পাশে বসে থাকি।ও এই ফাকে বাসায় গিয়ে গোসল টোসল করে আসবে।
আমিও "তথাস্তু"বলে বেরিয়ে পড়লাম।
উত্তরা থেকে ফার্মগেটের টিকিট কাটলাম ইচ্ছে করেই।গাড়ি ফার্মগেটে এসে জ্যামে পড়তেই আমি টুপ করে নেমে গেলাম।জ্যাম পার হয়ে আবার বাসে ওঠার ইচ্ছা।না উঠলেও অবশ্য চলে।এখান থেকে হেটে পিজিতে চলে যাওয়া আমার কাছে বাথরুমে যাবার মত!
আমি এই দোকানে এসেছি দুটো সিগারেট কিনতে।আরিফকে সিগারেটখোর না বলে সিগারেট খাদ্য বলা চলে!ও সিগারেট খায়না সিগারেট ওকে খায়।পুরোপুরি চেইনস্মোকার।এই দুদিন সিগারেট খেতে পেরেছে কিনা কে জানে।মনে হয় পারেনি।আমি চেইনস্মোকার না হয়েও বুঝতে পারছি ব্যাপার কতটা ভয়াবহ।
অমৃত নিয়ে আমার গবেষনা বলে,প্রচন্ড চাহিদা নিয়ে যে খাবারটা খাওয়া হয় সেটাই হল অমৃত।তারমানে এই মুহুর্তে আরিফের জন্য দুটো সিগারেট মানে দু টুকরো অমৃত।আমি এই দোকানে অমৃত কিনতেই এসেছি।হঠাৎ মনে পড়ল আরিফ কী সিগারেট খায় আমি জানিনা।জেনে নেয়া যায়।তবে তাতে করে আরিফ জেনে যাবে ওর জন্য সিগারেট আসছে।সারপ্রাইজটা আর দেয়া যাবেনা।একজন মানুষের আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকা চেহারা দেখার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
অন্য রাস্তা ধরতে হবে।দেখা যাক কাজ হয় কিনা। আমি কল দিলাম আরিফকে।দুবার রিং হতেই আরিফের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।'কী হল,আসবিনা?'
'আসতে ইচ্ছে করছেনা।' কথা সত্য। হাসপাতালে কেউ শখ করে রোগী দেখতে যায়না।আরিফ আর কিছু বলার আগেই আমি বললাম,'দোস্ত একটা জরুরি বিষয় জানার জন্য ফোন দিলাম।'
'কী?'বোঝাই যাচ্ছে বেশ হতাশ হয়েছে আরিফ।
'বুঝেছিস,রাস্তায় হাটছিলাম হঠাৎ করে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল।কোন সিগারেট ভাল হবে?জানিসই তো সিগারেট ফিগারেটের ব্যাপারে আমার ধারণা শূন্যের ঘরে।'
'এই তোর জরুরি বিষয়?'
'হুম,কেন তোর কাছে জরুরি মনে হচ্ছেনা?'
'না,আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হচ্ছে।'
'আমি কি ঠিক করেছি জানিস?যেহেতু তোর কথা রাখতে পারিনি তাই তোর সম্মানে আজ তোর পছন্দের সিগারেট খাওয়া হবে।এই আইডিয়াটাও কি তোর ফালতু মনে হচ্ছে?'
'আইডিয়া না আমার কাছে তোকেই ফালতু মনে হচ্ছে।যা ভাগ!'ফোন কেটে দিল আরিফ।
প্ল্যান কাজ করেনি।আচ্ছা এক কাজ করা যেতে পারে।বেনসনই নিয়ে যাই।আরিফ নিশ্চয়ই খুশি হবে।আমার তো ধারনা এখন ময়মনসিংহের "বগা বিড়ি"পেলেও আরিফ খুশিতে পিজির ছাদ থেকে লাফ মেরে বসবে।
'চাচা,দুটো বেনসন দেন তো।'
চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বেনসনের প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আমি একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম চাচার দিকে।চাচা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল দুটো সিগারেট।
প্রচুর সময় নিয়ে চাচা টাকাটা ভাঙাল।প্রত্যেকটা নোট দুবার করে গুনল,এরপর ফেরত দিল।এই বুড়োর কাছ থেকে ভুলেও কারো কোনোদিন এক টাকা বেশি পাবার সম্ভবনা নেই।না থাকাই ভাল।টাকা ভাল করে গুনে নেয়া নবীজীর সা. সুন্নত।তবে এই বুড়ো বোধহয় সুন্নত হিসেবে এতবার টাকা গোনেনা।গোনে ভয়ে।দারিদ্রতার ভয়।
আমি টাকাগুলো হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম বুড়ো কি করে যেন আমাকে দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছে।
আমি আস্তে করে টাকাগুলো পকেটে ভরে হাঁটা দিলাম জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে।
দুই
পিজির তিন নাম্বার ওয়ার্ডে আছে আরিফ আর ওর মা।খুঁজে পেতে চলে এলাম তিন নাম্বার ওয়ার্ডে।দরজা থেকেই দেখতে পাচ্ছি ওয়ার্ডের একেবারে ওই মাথায় আরিফ একটা বেডের পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি সেই চা ওয়ালা চাচার মতই উদাসী।
বেডে আরিফের মা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন।আরিফ আমাকে দেখেনি।আমি আস্তে করে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। ওর ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখতেই ফিরে তাকাল আমার দিকে।চোখের নীচে কালি ফেলে টেলে একেবারে কাহিল অবস্থা।
'তোর অবস্থা তো একেবারে কেরোসিন রে।' খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম।
প্রথম কয়েক মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আরিফ।'তুই না বললি তুই আসবিনা?'
'আসব না বলিনি,বলেছি আসতে ইচ্ছে করছেনা।'
'তুই এত অদ্ভুত কেন? 'আরিফ বোধহয় বুঝতে পারেনি এমন পরিবেশে ওর কথাটাই বরং অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম,'আমি আইডিয়া অনুযায়ী তিনটা সিগারেট কিনেছিলাম। টানতে গিয়ে দেখি অবস্থা তোর মতই কেরোসিন।তাই বাকিদুটো নিয়ে এসেছি তোর জন্য।এই নে,এখন টানতে টানতে বাড়ি যা।নাওয়া খাওয়া সেরে একটা ঘুম দে।আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি খালাম্মার পাশে।
'থাপরায়ে দাঁত ফেলে দেব।মিথ্যে বলছিস কেন,সিগারেট তুই আমার জন্যই কিনেছিস।'এটা ঠিক প্রশ্ন না,মন্তব্য।জবাব না দিলেও চলে।আরিফের চোখে এখন যে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসা ফুটে রয়েছে তার দাম কয় পৃথিবী আমি জানিনা।
বললাম,'ও ভাল কথা,খালাম্মার কী হয়েছে?'
'এত করে বলি,একটা কাজের লোক রাখো।তা না,উনি নিজেই সব করবে।বলে কিনা দুজন মানুষের জন্য কাজের লোক রেখে কী হবে?কাজ করতে করতে প্রেশার চড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে।আরো দুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।'
'এই গাধা ওকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছিস কেন?'মিহি গলায় বলে উঠলেন আরিফের মা।এতক্ষন জাগা ছিলেন না ঘুমিয়ে ছিলেন বুঝতে পারলাম না।'তোকে না কতবার বলেছি একটা বিয়ে কর।তাহলেই তো আর আমাকে এত কাজ করতে হয়না।'
'খালাম্মা,আপনি যেভাবে বলছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ওকে কয়েকটা বিয়ে করানোর চিন্তা ভাবনা আছে আপনার,আপাতত একটা করলেই চলবে।'বললাম।আরিফের মা আমাকে ভাল মতই চেনে।
'একটাই করতে চায়না,হু!' মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা।
'একটাই তো,করে ফেলবে।তা,খালাম্মা আমি আপাতত আছি আপনার পাশে,ও একটু গোসল টোসল করে আসুক বাসা থেকে।'
ভদ্রমহিলার শুকনো মুখ চোখ আরো শুকিয়ে গেল।তবে রাজি হয়ে গেলেন।
আরিফ চলে গেল। যাবার আগে সেই কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসার দৃষ্টি ওর চোখে আবার দেখতে পেলাম আমি।
তিন
সন্ধ্যা হয়েছে।একটু আগেই বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।এখন হাঁটছি।ইচ্ছে করেই বাসে উঠিনি।জরুরি কাজ আছে সেই "চা-চাচার" কাছে।"চা-চাচা"হল গিয়ে"চা ওয়ালা চাচা"র সংক্ষিপ্ত রুপ।
টাকা দশটা ফেরত দিতে হবে তাকে।ইচ্ছে করলে তখনই দিতে পারতাম কিন্তু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করেছি আমি।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে।একটা ভয় ছিল দোকানটা খোলা পাই কিনা।না,খোলা আছে।
আমি দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চা-চাচা আমার দিকে তাকাল।
'কেমন আছেন? 'ভুবন ভোলানো হাসির সাথে বললাম।বুড়ো চিনতে পেরেছে বলে মনে হলনা। 'চাচা,দুপুরে আপনার কাছ থেকে দুটো সিগারেট নিয়েছিলাম।আপনি দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছিলেন।এই যে ধরেন দশটাকা।'
চা-চাচা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন দুই মাথাওয়ালা কোনো এলিয়েন দশটাকা দিয়ে স্পেসশিপের জন্য এক লিটার জ্বালানি চেয়েছে।
'আপনে আমার ট্যাকা দেওনের জন্য এত কষ্ট কইরা ফেরত আইছেন?'
আমি বৃদ্ধের চোখে দেখতে পেলাম,বিষ্ময়,ভালবাসা,শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং আরো অনেক অনুভুতির মিলমিশ। একই সাথে। আমার উদ্দেশ্য সফল।বৃদ্ধকে তখনই টাকাটা দিয়ে দিলে নিশ্চিতভাবেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেতামনা।বৃদ্ধ খুব স্বাভাবিকভাবে টাকাটা গ্রহন করত।এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য সামান্য ছলনার আশ্রয় নেয়াতে এতটুকু অনুশোচনা আমার হলনা।
'না ঠিক ফেরত দেয়ার জন্য আসিনি,এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।'
'সেইটাই আর কয়জন করে।আইজ তুমারে আমার সাথে বইয়া এককাপ চা খাওনই লাগব।'
হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেল চা-চাচা। এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি।যেমন আফরীনদের বাড়ির গার্ড সোলেমান ভাইয়ের কথাই ধরা যাক।সবাইকে স্যার স্যার করলেও কী এক অজ্ঞাত কারণে যেন আমাকে ভাই বলে ডাকে।এই বুড়োরও দেখি একই কাহিনি।দুম করে আপনি থেকে তুমি।আমার চেহারাটাই বোধহয় গোবেচারা ধরনের।সবাই নিজের ভাই বেরাদার মনে করে।যাক,এটাও খারাপ না।আমি বসে পড়লাম চা খেতে। আজ সারাদিনে এক কাপও খাওয়া হয়নি।
চা-চাচা আমার সাথে টুক টুক করে গল্প করতে করতে চা বানাতে লাগল।উনার চা বানাতে বানাতে আমি জেনে গেলাম,উনার আমার বয়সী এক ছেলে আছে,বিয়ের কথা বার্তা চলছে তার কিন্তু টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা।ছেলে কিছুদিন হল গার্মেন্টসে পিচ্চি একটা চাকরি নিয়েছে।অভাবের সংসার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা-চাচা আমার হাতে এক চা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপে ফুরুত করে চুমুক দিল।
আমিও ফুরুত করে একটা চুমুক দিলাম।সাথে সাথে মাথাটা ভো করে উঠল।মুখটা অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে হল।এতক্ষনে বুঝলাম দোকানের করুণ অবস্থাই চা-চাচার ব্যাবসা খারাপ হবার একমাত্র কারণ না।উনি আমার হাতে যে বস্তুটা ধরিয়ে দিয়েছে সেটাকে আর যাই হোক 'চা' বলার কোনো কারনই নেই।বাচ্চাদের প্রস্রাবের সাথে এক চামচ চিনি মেশালে এরকমই স্বাদ হবার কথা!
আমি একটা হাসি কোনোমতে ম্যানেজ করে চা-চাচাকে উপহার দিলাম।খারাপ লাগছে খুব।এই বৃদ্ধ পয়সার অভাবে ছেলের বিয়ে দিতে পারছেনা।খরচ কমাতেই বোধহয় চায়ে পরিমানমত সরঞ্জামও দিতে পারেনা।
আচমকা মনে হল,উনার তো মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা,ছেলের বিয়ে হচ্ছে।টাকার অভাবে আবার ছেলের বিয়ে আটকে থাকে কিভাবে?বিশেষ করে উনাদের শ্রেনীতে তো যৌতুক নিয়ে অহরহ ছেলের বিয়ে হয়।চা-চাচার ছেলে কি প্রতিবন্ধী টতিবন্ধী নাকি?
'চাচা,আপনার ছেলে দেখতে কেমন?'
'দেখবা?'বৃদ্ধের চোখ চকচক করে উঠল।হাতড়ে হাতড়ে ক্যাশ বাক্সের ভেতর থেকে একটা ফুল সাইজ রঙিন ছবি বের করে আমার হাতে দিল।
এবার আমার অবাক হবার পালা।এই ছেলে প্রতিবন্ধী তো নয়ই বরং এক হিসেবে তাকে রাজপুত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।বেশ সুপুরুষ ছেলে।এমন ছেলের বিয়ে টাকার অভাবে আটকে রয়েছে ব্যাপারটা অষ্টমাশ্চর্যের কাছাকাছি।বললাম,'চাচা আপনার ছেলে তো মাশআল্লাহ।যৌতুক টৌতুক নিলে বিয়েটাও হত আর আপনার দোকানটাও দাঁড়িয়ে...'
আর কিছু বলতে পারলামনা।বৃদ্ধ ফুঁসে উঠল।'কী কইলা বাবা,আমি যৌতুক নিয়া ওর বিয়া দিমু?মইরা গেলেও না।দরকার হয় না খায়া থাকুম এরপরো আমি আমার পোলারে বিক্রি করতে পারুমনা।'কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার দুচোখে। আত্মসম্মান যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার গোটা অবয়ব দিয়ে।
হঠাৎ করেই আমার হাতে ধরা চায়ের স্বাদ বদলে গেল।এমন একজন পবিত্র মানুষের হাতে বানানো চা'কে অমৃত ছাড়া অন্য কিছু বলার নিয়ম নেই।
এক কাপ অমৃত!
আমার মত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো পাবলিকের জন্য রাস্তার পাশের টং দোকানগুলো হচ্ছে অবকাশ যাপন কেন্দ্রের মত।হাঁটতে হাঁটতে মাশরাফির মত পায়ের লিগামেন্ট ছেঁড়ার উপক্রম হল তো একটা টং-এ ঢুকে দুটাকার একটা টোস্ট আর একটা চা খেয়ে ফের হন্টন। আজকাল অবশ্য দুটাকায় টোস্ট পাওয়া যাচ্ছেনা।তিন টাকা হয়ে গেছে।দুটাকায় এক ধরনের চারকোনা নোনতা বিস্কুট পাওয়া যায় যেটার সাইজ দেখলেই অসহায় বোধ করতে হয়!
বাস যথা সম্ভব এড়িয়ে চলি বলে এই অবকাশ যাপন খরচে পুষিয়ে যায়। আমার মত মধ্যবিত্তদের সবার আগে,সবকিছুর আগে খরচের হিসাব কষে ফেলতে হয়।
এই হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমার নিয়মিত যাত্রা পথের অধিকাংশ দোকানের হাড়ির খবর আমার নখদর্পণে।কোন দোকানে চা'কে রসগোল্লার সিরাতে পরিনত করা হয়,কোন দোকানে চিনির পরিবর্তে শুধুমাত্র কনডেন্স মিল্ক দিয়ে কাজ চালিয়ে দেয়া হয়,কোন দোকানের কাঁচা পাত্তি দিয়ে বানানো চা অমৃততুল্য, কোন দোকানের মালাই চা খেলে মনে হবে এখনই মরে যাই, ইত্যাদি সব মোটামুটি পরীক্ষার আগের রাতের পড়ার মত মুখস্ত করে ফেলেছি।
এছাড়াও দোকানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কেও জ্ঞান খারাপ না।যেমন এক দোকানের বিস্কুটগুলো কী এক অজ্ঞাত কারনে যেন সব সময়েই নেতিয়ে থাকে।টোস্টে কামড় দিলে মনে হয় পাউরুটি চাবাচ্ছি!
আরেক দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসতে হলে দুবার ভেবে নেয়া আবশ্যক।বেঞ্চির একটা পায়া ভাঙ্গা।তিনটা ইট দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে।যখন তখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার আশংকা।
তবে এই মুহুর্তে যে দোকানে ঢোকার চিন্তা ভাবনা আমি করছি সেই দোকানটা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছিনা।কারন এর আগে কখনো আসিনি এখানে।
পিজিতে যাচ্ছি।এখন কারওয়ান বাজারে।যেহেতু এটা আমার নিয়মিত রুট নয় সেহেতু এদিকের চায়ের দোকানও ভাল চিনিনা।
মোটামুটি বৃদ্ধ টাইপের এক লোক চুলার দিকে উদাসী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।যদ্দুর মনে হয় তার নজর আকাশ পানে উড়াল দেয়া সাদা ধোঁয়ার দিকে।তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে দোকান তেমন একটা চলেনা তার।দোকানের ঢং ঢাং বেশি সুবিধার না।দারিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।প্রতিটা জিনিসেরই বাহ্যিক রুপের গুরুত্ব আছে।এমন দোকানে বসে কেউ আগ্রহ নিয়ে চুক চুক করে চা খাবে এমনটা ভাবার কোনো কারন নেই।তবে সুখের কথা হল আমি চা খেতে আসিনি এখানে। একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি পিজিতে।আমার এক বন্ধুর মা খুবই অসুস্থ।গত দুদিন ধরে বন্ধুটা মা'র পাশে বসে আছে।একমুহুর্তের জন্যও নড়ার উপায় নেই।চোখের আড়াল হলেই কান্নাকাটি শুরু করে দেন ওর মা।ওর বাবা থাকে বিদেশে। ভাইবোন না থাকায় ওরই দেখা শোনা করতে হচ্ছে মাকে।আমাকে বলেছে আমি যেন কয়েক ঘন্টার জন্য হাসপাতালে গিয়ে ওর মা'র পাশে বসে থাকি।ও এই ফাকে বাসায় গিয়ে গোসল টোসল করে আসবে।
আমিও "তথাস্তু"বলে বেরিয়ে পড়লাম।
উত্তরা থেকে ফার্মগেটের টিকিট কাটলাম ইচ্ছে করেই।গাড়ি ফার্মগেটে এসে জ্যামে পড়তেই আমি টুপ করে নেমে গেলাম।জ্যাম পার হয়ে আবার বাসে ওঠার ইচ্ছা।না উঠলেও অবশ্য চলে।এখান থেকে হেটে পিজিতে চলে যাওয়া আমার কাছে বাথরুমে যাবার মত!
আমি এই দোকানে এসেছি দুটো সিগারেট কিনতে।আরিফকে সিগারেটখোর না বলে সিগারেট খাদ্য বলা চলে!ও সিগারেট খায়না সিগারেট ওকে খায়।পুরোপুরি চেইনস্মোকার।এই দুদিন সিগারেট খেতে পেরেছে কিনা কে জানে।মনে হয় পারেনি।আমি চেইনস্মোকার না হয়েও বুঝতে পারছি ব্যাপার কতটা ভয়াবহ।
অমৃত নিয়ে আমার গবেষনা বলে,প্রচন্ড চাহিদা নিয়ে যে খাবারটা খাওয়া হয় সেটাই হল অমৃত।তারমানে এই মুহুর্তে আরিফের জন্য দুটো সিগারেট মানে দু টুকরো অমৃত।আমি এই দোকানে অমৃত কিনতেই এসেছি।হঠাৎ মনে পড়ল আরিফ কী সিগারেট খায় আমি জানিনা।জেনে নেয়া যায়।তবে তাতে করে আরিফ জেনে যাবে ওর জন্য সিগারেট আসছে।সারপ্রাইজটা আর দেয়া যাবেনা।একজন মানুষের আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকা চেহারা দেখার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই।
অন্য রাস্তা ধরতে হবে।দেখা যাক কাজ হয় কিনা। আমি কল দিলাম আরিফকে।দুবার রিং হতেই আরিফের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।'কী হল,আসবিনা?'
'আসতে ইচ্ছে করছেনা।' কথা সত্য। হাসপাতালে কেউ শখ করে রোগী দেখতে যায়না।আরিফ আর কিছু বলার আগেই আমি বললাম,'দোস্ত একটা জরুরি বিষয় জানার জন্য ফোন দিলাম।'
'কী?'বোঝাই যাচ্ছে বেশ হতাশ হয়েছে আরিফ।
'বুঝেছিস,রাস্তায় হাটছিলাম হঠাৎ করে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল।কোন সিগারেট ভাল হবে?জানিসই তো সিগারেট ফিগারেটের ব্যাপারে আমার ধারণা শূন্যের ঘরে।'
'এই তোর জরুরি বিষয়?'
'হুম,কেন তোর কাছে জরুরি মনে হচ্ছেনা?'
'না,আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হচ্ছে।'
'আমি কি ঠিক করেছি জানিস?যেহেতু তোর কথা রাখতে পারিনি তাই তোর সম্মানে আজ তোর পছন্দের সিগারেট খাওয়া হবে।এই আইডিয়াটাও কি তোর ফালতু মনে হচ্ছে?'
'আইডিয়া না আমার কাছে তোকেই ফালতু মনে হচ্ছে।যা ভাগ!'ফোন কেটে দিল আরিফ।
প্ল্যান কাজ করেনি।আচ্ছা এক কাজ করা যেতে পারে।বেনসনই নিয়ে যাই।আরিফ নিশ্চয়ই খুশি হবে।আমার তো ধারনা এখন ময়মনসিংহের "বগা বিড়ি"পেলেও আরিফ খুশিতে পিজির ছাদ থেকে লাফ মেরে বসবে।
'চাচা,দুটো বেনসন দেন তো।'
চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বেনসনের প্যাকেট খুলতে শুরু করল।
আমি একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম চাচার দিকে।চাচা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল দুটো সিগারেট।
প্রচুর সময় নিয়ে চাচা টাকাটা ভাঙাল।প্রত্যেকটা নোট দুবার করে গুনল,এরপর ফেরত দিল।এই বুড়োর কাছ থেকে ভুলেও কারো কোনোদিন এক টাকা বেশি পাবার সম্ভবনা নেই।না থাকাই ভাল।টাকা ভাল করে গুনে নেয়া নবীজীর সা. সুন্নত।তবে এই বুড়ো বোধহয় সুন্নত হিসেবে এতবার টাকা গোনেনা।গোনে ভয়ে।দারিদ্রতার ভয়।
আমি টাকাগুলো হাতে নিতেই বুঝতে পারলাম বুড়ো কি করে যেন আমাকে দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছে।
আমি আস্তে করে টাকাগুলো পকেটে ভরে হাঁটা দিলাম জনাকীর্ণ রাস্তা ধরে।
দুই
পিজির তিন নাম্বার ওয়ার্ডে আছে আরিফ আর ওর মা।খুঁজে পেতে চলে এলাম তিন নাম্বার ওয়ার্ডে।দরজা থেকেই দেখতে পাচ্ছি ওয়ার্ডের একেবারে ওই মাথায় আরিফ একটা বেডের পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে।দৃষ্টি সেই চা ওয়ালা চাচার মতই উদাসী।
বেডে আরিফের মা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন।আরিফ আমাকে দেখেনি।আমি আস্তে করে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালাম। ওর ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখতেই ফিরে তাকাল আমার দিকে।চোখের নীচে কালি ফেলে টেলে একেবারে কাহিল অবস্থা।
'তোর অবস্থা তো একেবারে কেরোসিন রে।' খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম।
প্রথম কয়েক মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল আরিফ।'তুই না বললি তুই আসবিনা?'
'আসব না বলিনি,বলেছি আসতে ইচ্ছে করছেনা।'
'তুই এত অদ্ভুত কেন? 'আরিফ বোধহয় বুঝতে পারেনি এমন পরিবেশে ওর কথাটাই বরং অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম,'আমি আইডিয়া অনুযায়ী তিনটা সিগারেট কিনেছিলাম। টানতে গিয়ে দেখি অবস্থা তোর মতই কেরোসিন।তাই বাকিদুটো নিয়ে এসেছি তোর জন্য।এই নে,এখন টানতে টানতে বাড়ি যা।নাওয়া খাওয়া সেরে একটা ঘুম দে।আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি খালাম্মার পাশে।
'থাপরায়ে দাঁত ফেলে দেব।মিথ্যে বলছিস কেন,সিগারেট তুই আমার জন্যই কিনেছিস।'এটা ঠিক প্রশ্ন না,মন্তব্য।জবাব না দিলেও চলে।আরিফের চোখে এখন যে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসা ফুটে রয়েছে তার দাম কয় পৃথিবী আমি জানিনা।
বললাম,'ও ভাল কথা,খালাম্মার কী হয়েছে?'
'এত করে বলি,একটা কাজের লোক রাখো।তা না,উনি নিজেই সব করবে।বলে কিনা দুজন মানুষের জন্য কাজের লোক রেখে কী হবে?কাজ করতে করতে প্রেশার চড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছে।আরো দুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।'
'এই গাধা ওকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছিস কেন?'মিহি গলায় বলে উঠলেন আরিফের মা।এতক্ষন জাগা ছিলেন না ঘুমিয়ে ছিলেন বুঝতে পারলাম না।'তোকে না কতবার বলেছি একটা বিয়ে কর।তাহলেই তো আর আমাকে এত কাজ করতে হয়না।'
'খালাম্মা,আপনি যেভাবে বলছেন তাতে করে মনে হচ্ছে ওকে কয়েকটা বিয়ে করানোর চিন্তা ভাবনা আছে আপনার,আপাতত একটা করলেই চলবে।'বললাম।আরিফের মা আমাকে ভাল মতই চেনে।
'একটাই করতে চায়না,হু!' মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা।
'একটাই তো,করে ফেলবে।তা,খালাম্মা আমি আপাতত আছি আপনার পাশে,ও একটু গোসল টোসল করে আসুক বাসা থেকে।'
ভদ্রমহিলার শুকনো মুখ চোখ আরো শুকিয়ে গেল।তবে রাজি হয়ে গেলেন।
আরিফ চলে গেল। যাবার আগে সেই কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালবাসার দৃষ্টি ওর চোখে আবার দেখতে পেলাম আমি।
তিন
সন্ধ্যা হয়েছে।একটু আগেই বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে।এখন হাঁটছি।ইচ্ছে করেই বাসে উঠিনি।জরুরি কাজ আছে সেই "চা-চাচার" কাছে।"চা-চাচা"হল গিয়ে"চা ওয়ালা চাচা"র সংক্ষিপ্ত রুপ।
টাকা দশটা ফেরত দিতে হবে তাকে।ইচ্ছে করলে তখনই দিতে পারতাম কিন্তু একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করেছি আমি।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কারওয়ান বাজারে।একটা ভয় ছিল দোকানটা খোলা পাই কিনা।না,খোলা আছে।
আমি দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে চা-চাচা আমার দিকে তাকাল।
'কেমন আছেন? 'ভুবন ভোলানো হাসির সাথে বললাম।বুড়ো চিনতে পেরেছে বলে মনে হলনা। 'চাচা,দুপুরে আপনার কাছ থেকে দুটো সিগারেট নিয়েছিলাম।আপনি দশটাকা বেশি দিয়ে ফেলেছিলেন।এই যে ধরেন দশটাকা।'
চা-চাচা আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন দুই মাথাওয়ালা কোনো এলিয়েন দশটাকা দিয়ে স্পেসশিপের জন্য এক লিটার জ্বালানি চেয়েছে।
'আপনে আমার ট্যাকা দেওনের জন্য এত কষ্ট কইরা ফেরত আইছেন?'
আমি বৃদ্ধের চোখে দেখতে পেলাম,বিষ্ময়,ভালবাসা,শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং আরো অনেক অনুভুতির মিলমিশ। একই সাথে। আমার উদ্দেশ্য সফল।বৃদ্ধকে তখনই টাকাটা দিয়ে দিলে নিশ্চিতভাবেই এই দৃশ্যটা দেখতে পেতামনা।বৃদ্ধ খুব স্বাভাবিকভাবে টাকাটা গ্রহন করত।এই অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য সামান্য ছলনার আশ্রয় নেয়াতে এতটুকু অনুশোচনা আমার হলনা।
'না ঠিক ফেরত দেয়ার জন্য আসিনি,এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।'
'সেইটাই আর কয়জন করে।আইজ তুমারে আমার সাথে বইয়া এককাপ চা খাওনই লাগব।'
হঠাৎ আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেল চা-চাচা। এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি।যেমন আফরীনদের বাড়ির গার্ড সোলেমান ভাইয়ের কথাই ধরা যাক।সবাইকে স্যার স্যার করলেও কী এক অজ্ঞাত কারণে যেন আমাকে ভাই বলে ডাকে।এই বুড়োরও দেখি একই কাহিনি।দুম করে আপনি থেকে তুমি।আমার চেহারাটাই বোধহয় গোবেচারা ধরনের।সবাই নিজের ভাই বেরাদার মনে করে।যাক,এটাও খারাপ না।আমি বসে পড়লাম চা খেতে। আজ সারাদিনে এক কাপও খাওয়া হয়নি।
চা-চাচা আমার সাথে টুক টুক করে গল্প করতে করতে চা বানাতে লাগল।উনার চা বানাতে বানাতে আমি জেনে গেলাম,উনার আমার বয়সী এক ছেলে আছে,বিয়ের কথা বার্তা চলছে তার কিন্তু টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা।ছেলে কিছুদিন হল গার্মেন্টসে পিচ্চি একটা চাকরি নিয়েছে।অভাবের সংসার ইত্যাদি ইত্যাদি।
চা-চাচা আমার হাতে এক চা ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাপে ফুরুত করে চুমুক দিল।
আমিও ফুরুত করে একটা চুমুক দিলাম।সাথে সাথে মাথাটা ভো করে উঠল।মুখটা অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে হল।এতক্ষনে বুঝলাম দোকানের করুণ অবস্থাই চা-চাচার ব্যাবসা খারাপ হবার একমাত্র কারণ না।উনি আমার হাতে যে বস্তুটা ধরিয়ে দিয়েছে সেটাকে আর যাই হোক 'চা' বলার কোনো কারনই নেই।বাচ্চাদের প্রস্রাবের সাথে এক চামচ চিনি মেশালে এরকমই স্বাদ হবার কথা!
আমি একটা হাসি কোনোমতে ম্যানেজ করে চা-চাচাকে উপহার দিলাম।খারাপ লাগছে খুব।এই বৃদ্ধ পয়সার অভাবে ছেলের বিয়ে দিতে পারছেনা।খরচ কমাতেই বোধহয় চায়ে পরিমানমত সরঞ্জামও দিতে পারেনা।
আচমকা মনে হল,উনার তো মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা,ছেলের বিয়ে হচ্ছে।টাকার অভাবে আবার ছেলের বিয়ে আটকে থাকে কিভাবে?বিশেষ করে উনাদের শ্রেনীতে তো যৌতুক নিয়ে অহরহ ছেলের বিয়ে হয়।চা-চাচার ছেলে কি প্রতিবন্ধী টতিবন্ধী নাকি?
'চাচা,আপনার ছেলে দেখতে কেমন?'
'দেখবা?'বৃদ্ধের চোখ চকচক করে উঠল।হাতড়ে হাতড়ে ক্যাশ বাক্সের ভেতর থেকে একটা ফুল সাইজ রঙিন ছবি বের করে আমার হাতে দিল।
এবার আমার অবাক হবার পালা।এই ছেলে প্রতিবন্ধী তো নয়ই বরং এক হিসেবে তাকে রাজপুত্র বলে চালিয়ে দেয়া যায়।বেশ সুপুরুষ ছেলে।এমন ছেলের বিয়ে টাকার অভাবে আটকে রয়েছে ব্যাপারটা অষ্টমাশ্চর্যের কাছাকাছি।বললাম,'চাচা আপনার ছেলে তো মাশআল্লাহ।যৌতুক টৌতুক নিলে বিয়েটাও হত আর আপনার দোকানটাও দাঁড়িয়ে...'
আর কিছু বলতে পারলামনা।বৃদ্ধ ফুঁসে উঠল।'কী কইলা বাবা,আমি যৌতুক নিয়া ওর বিয়া দিমু?মইরা গেলেও না।দরকার হয় না খায়া থাকুম এরপরো আমি আমার পোলারে বিক্রি করতে পারুমনা।'কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার দুচোখে। আত্মসম্মান যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে তার গোটা অবয়ব দিয়ে।
হঠাৎ করেই আমার হাতে ধরা চায়ের স্বাদ বদলে গেল।এমন একজন পবিত্র মানুষের হাতে বানানো চা'কে অমৃত ছাড়া অন্য কিছু বলার নিয়ম নেই।
এক কাপ অমৃত!
Published on October 05, 2013 01:58
No comments have been added yet.


