সর্পরহস্য

এক



মোটাসোটা মানুষ সাজেদা বেগম।অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। একটু পর পরই পানি খাওয়া তার অভ্যেস।রান্না করার সময়ও বড়সড় একটা পানির বোতল পাশে নিয়ে রাখেন।আজ গরমটা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি।বিরাট আকারের বোতলের পানিও তলানিতে এসে ঠেকেছে।কাজের ছেলে টিটু দোকানে গেছে।ওকে দিয়ে পানি আনার কোন উপায় আপাতত না থাকায় সাজেদা বেগম নিজেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ফিল্টারের সামনে দাড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢাললেন।গ্লাস থেকে পানিটা যখন গলায় ঢালতে যাবেন তখনই তার চোখের কোনে একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। অর্ধেক খাওয়া গ্লাসটা নামিয়ে সেদিকে তাকালেন। ওদিকটাতে শুধু একটা টেবিল রাখা।যতদুর মনে হয় টেবিলটার আশেপাশেই নড়াচড়াটা দেখেছিলেন তিনি।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পরও কোন ধরনের বৈসাদূশ্য তার চোখে ধরা পড়লনা। গ্লাসটা আবার তুললেন মুখের কাছে, ঠিক তখনই টেবিলের নিচে ফের নড়াচড়া।তাকালেন তিনি, এবং ভয়ঙ্কর জিনিসটা এবার স্পষ্টই দেখতে পেলেন। মিশমিশে কালো রংএর একটা সাপ! লম্বায় চার ফুট তো হবেই।কুন্ডলী পাকাচ্ছে। এই বাড়িতে সাপ কোত্থেকে আসবে সে ভাবনা চিন্তা করার আগেই চিল চিৎকার ছাড়লেন সাজেদা বেগম,'বাচাও!সাআআআপ!'প্রলম্বিত আত্মচিৎকার। 'কি হইছে আম্মা? 'হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল তের বছর বয়সী টিটু। দোকানে গিয়েছিল লবন কিনতে। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই শুনতে পায় তার আম্মা চিৎকার করছে। টিটু এতিম মানুষ।ছোটবেলা থেকেই আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম দম্পতির কাছে মানুষ।তাদের দুই ছেলেই দেশের বাইরে থাকায় টিটুর প্রতি তাদের মমতা একটু অন্যরকম।টিটুও এই মধ্যবয়সী দম্পতিকে নিজের বাবা মায়ের মতই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।তাই সাজেদা বেগমের চিৎকার শুনেই ছুটে এল। 'সাপ,সাপ! 'শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। টিটু হাতের লবনের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে একদৌড়ে স্টোররুমে চলে গেল।খুঁজে পেতে একটা শক্তপোক্ত লাঠি মুঠোয় করে ফিরে এল ডাইনিং রুমে। 'সাপ কোন জায়গায় আম্মা? ' সাজেদা বেগম হাত ইশারায় শুধু.টেবিলটাই দেখাতে পারলেন টিটুকে।বাক এখনও রুদ্ধ। সাপটা ইতোমধ্যে সাজেদা বেগমের চিৎকারে জায়গা বদল করেছে ফেলেছে।টেবিলের নিচটা এখন শুন্য। টিটু হাতের লাঠিটা বাড়িয়ে ধরে সামনে এগোতে লাগল। 'সাবধানে যাস বাবা,' এতক্ষণে কথা বলতে পারলেন সাজেদা বেগম। 'চিন্তা কইরেন না আম্মা। ছোডকালে কত সাপ ধইরা ধইরা গিট্টু দিয়া ছাইড়া দিছি। ' 'এটা কিন্তু বিষাক্ত হবার সম্ভবনা আছে। ' সাজেদা বেগমের এ কথাটার জবাব দিলনা টিটু।টেবিলের সামনে এসে হামা দিয়ে নিচটা দেখল।না, সাপটা ওখানে নেই। উঠে দাড়িয়ে সতর্ক চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। ঘরের একমাত্র জানালাটা অনেক বড়।জানালার চাইতে পর্দাটা আরো বড়।একেবারে মেঝে পর্যন্ত ঝুল। পর্দাটা আচমকা নড়ে উঠতেই টিটু পর্দার দিকে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে গেল।ঝটকা দিয়ে পর্দাটা সরাতেই কুন্ডলী পাকানো সাপটা দেখা গেল। গায়ের রং কুচকুচে কালো।কেমন একটা হিমশীতল ভাব।গা শিউরে ওঠে দেখলে। টিটুকে দেখে সাপটা ফনা তোলার উপক্রম করল।টিটু অবশ্য সে সুযোগ সাপটাকে দিলনা।লাঠিটা দিয়ে কষে একটা বাড়ি বসাল সাপটার পিঠে।জায়গামতো পড়েছে বাড়িটা।ফোঁসফোঁস করে উঠল সাপটা।গোটা দেহ মোচড় খেতে লাগল। টিটু বাড়ি দিয়ে লাঠিটা ওঠায়নি।মেঝের সাথে চেপে ধরে আছে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখার পর কেমন নেতিয়ে গেল সাপটা।তবে মরেনি যে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে নড়তে থাকা লেজটা দেখে। টিটু লাঠিটা ওঠাল।উঠিয়ে আরেকটা যুৎসই বাড়ি দেবার ইচ্ছা।লাঠিটা ওঠাতেই নেতিয়ে পড়া সাপটা স্বরুপে ফিরে গেল।বিদ্যুৎবেগে ছোবল বসাল টিটুর পা লক্ষ্য করে। সতর্ক থাকায় অল্পের জন্য বেঁচে গেল টিটু।সাপের মাথাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।টিটুর পায়ে গা শিউরানো একটা স্পর্শ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টিটুর দ্বিতীয় বাড়ি আছড়ে পড়ল আগের জায়গায়। এবার আগের চাইতেও বেশি জোরে। এবার আর ভান নয়, সত্যি সত্যিই পটল তুলল সাপটা।শিড়দাড়া গুড়িয়ে গেছে। টিটু লাঠির আগাটা দিয়ে মাথায় আঘাত করে সাপটার মৃত্যু নিশ্চিত করল। 'আম্মা চান্দু শ্যাষ! ' লাঠির আগায় সাপটা তোলার কসরত করতে করতে বলল টিটু।মুখে একগাল হাসি, যেন বিশ্ব জয় করে এইমাত্র ঘোড়া থেকে নামল আলেকজান্ডার। 'বাসার পেছনে পুঁতে দিয়ে আয়। ভালমত গর্ত করিস, নয়ত আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে।' 'জে আম্মা। 'সাপটাকে দোলাতে দোলাতে বাইরে নিয়ে গেল টিটু। এতক্ষণে হাপ ছাড়লেন সাজেদা বেগম। উত্তেজনার প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যেতেই তিনি অনুভব করলেন, তার প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে।অর্ধেক ভরা গ্লাসটা মুখে তোলার আগেই নাকে পোড়া গন্ধ পেলেন। সর্বনাশ! চুলার তরকারি পুড়ে খাক হচ্ছে!



দুই

গেট দিয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় আফজাল সাহেব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় আবিষ্কার করলেন বাড়ির চারপাশটা বেশ জঙ্গল হয়ে আছে।পরিষ্কার করাতে হবে লোক এনে। তিনি তার ডাক্তারি পেশা নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় সাংসারিক ব্যাপারে তেমন মনোযোগ দিতে পারেননা।তার প্রবাসী দুই ছেলে প্রতিমাসে যথেষ্ঠ পরিমাণে টাকা পাঠালেও তিনি তার পেশাটাকে ছাড়তে পারেননি।পৃথিবীতে কাজের মানুষের খুব অভাব।আফজাল সাহেব একজন সত্যিকারের কাজের মানুষ।আজকাল দরিদ্র রোগীদের ফ্রীতেই দেখেন তিনি। দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল চাপ দিলেন তিনি।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল টিটু।বোধহয় তৈরী হয়েই ছিল। 'খালু জানেন আইজ কি হইছিল?' দরজা খুলেই প্রশ্ন করল টিটু। উত্তেজনায় চোখ চকচক করছে। টিটুর উত্তেজনা অবশ্য আফজাল সাহেবকে ছুঁতে পারলনা।বাচ্চারা তো কত কিছুতেই উত্তেজিত হয়।নিরাসক্ত গলায় বললেন, 'কিভাবে জানব? তোরা তো কেউ বলিসনি।' 'আর বলোনা, আজ সন্ধ্যায় বিশাল এক সাপ ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে।ভাগ্যিস সময়মত টিটু মারতে পেরেছিল।'আফজাল সাহেবের গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন সাজেদা বেগম।তরকারি পুড়ে যাওয়ায় এখনো রান্নাঘরের পাট চুকাতে পারেননি।আবার রাধতে হচ্ছে। 'তাইনাকি! ' ভ্রু কুঁচকে বললেন আফজাল সাহেব। 'তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো, খেতে খেতে শুনবে। ' আফজাল সাহেব কথা না বাড়িয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন। আজ গরমটা পড়েছে মারাত্মক। গোসল করলে ভাল হতো। 'টিটু, আমার লুঙ্গি আর গামছাটা দিয়ে যা তো বাবা, 'হাক ছাড়লেন আফজাল সাহেব। বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপটা পুরো ছেড়ে দিলেন।বালতিতে গোসল করে অভ্যেস আফজাল সাহেবের। ঝর্ণা দিয়ে গোসল করে ঠিক তৃপ্তি পাননা তিনি। পানি পড়ে তো পড়েনা। বালতিটা ভরা হতেই একমগ পানি গায়ে ঢাললেন।পানির ধারাটা সারাদিনের ক্লান্ত দেহে শীতল একটা পরশ দিয়ে গেল। আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললেন আফজাল সাহেব।চোখ বন্ধ করেই আরেক মগ পানির জন্য বালতিতে মগ ডুবাতেই কিসের যেন স্পর্শ পেলেন হাতে।ঝট করে চোখ খুলে দেখেন বড়সড় লাল বালতিটাতে একটা বিরাটাকারের সাপ কিলবিল করছে। লম্বায় চারহাতের মত হবে। চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চোখ থেকে পানির কনাগুলো মুছে ঝাপসা দৃষ্টি স্বচ্ছ করে নিয়ে আবার তাকালেন।এবারের চমকটা আগের চাইতেও তীব্র। বালতি পুরো খালি! তাহলে একটু আগে কি ভুল দেখলেন? ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন? তাহলে হাতের স্পর্শটা? বালতির পুরো পানি ফেলে দিয়ে নতুন করে ভরে নিলেন।এই পানি আর ব্যবহার করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলেন খাবার দেয়া হয়েছে।তিনি মেঝেতে বসে পড়লেন। আফজাল সাহেবের বাসায় দামী একটা ডাইনিং টেবিল থাকলেও সেটা শোভাবর্ধন ছাড়া আর কোনো কাজে আসেনা।আফজাল সাহেব মাটিতে বসে খান।নবীজীর সা.সুন্নত।তাছাড়া আফজাল সাহেব লক্ষ করে দেখেছেন মাটিতে ছড়িয়ে বসে খাওয়ার আনন্দের ধারে কাছেও ডাইনিং টেবিলের স্থান নেই। মাটিতে বসে খাবার নিয়মে সবচাইতে বেশি খুশি টিটু।খাওয়ার সময় ওর বসা দেখলে মনে হতে পারে খাওয়ার চাইতে বসায় বেশি আনন্দ পাচ্ছে ছেলেটা। 'কি হয়েছিল বলতো। 'প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে জানতে চাইলেন আফজাল সাহেব। সাজেদা বেগম যখন বিতং বর্ননা শেষে সাপটার বর্ননায় এলেন তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, 'সাপটা কেমন? চারহাত লম্বা, কালো রংয়ের? ' 'হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে? 'বিস্ময়ের সাথে বললেন সাজেদা বেগম। আফজাল সাহেব তার কথার জবাব দিলেননা।কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেননা তিনি। যদি ধরেও নেয়া যায় যে, বাথরুমে তার ভ্রম হয়েছিল,তাহলে একটু আগের মৃত সাপটার সাথে তার "ভ্রম "মিলে গেল কিভাবে? এত কাকতালীয় ঘটনা কী পৃথিবীতে ঘটে? অর্ধেক খেয়েই উঠে পড়লেন আফজাল সাহেব।সাপটা দেখার পর থেকেই তার গা ঘিনঘিন করছে।



তিন

সিলিংএর ফ্যানটা সর্বশক্তি নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।এরপরও যে ঘরের গুমোট গরমটা দুর করতে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারছে সেটা বলা যাবেনা। আফজাল সাহেবের কোল্ড অ্যালার্জি থাকায় এসি লাগাননি ঘরে। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল সাজেদা বেগমের।কয়েকমূহুর্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারলেননা তিনি। ঘুম ভাঙ্গার কারণটাও পরিষ্কার না। হঠাৎ করে মাথার কাছে হিসহিস আওয়াজ হতেই ফিরে তাকিয়ে দেখেন হাতচারেক লম্বা একটা কালো সাপ ফনা তুলে আছে! সাজেদা বেগম ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই সাপটা হিলহিল করে খাট থেকে মেঝেতে নেমে গেল। সাজেদা বেগম সাপটার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য মেঝেতে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঝকঝকে সাদা টাইলসের মেঝে সম্পুর্ন খালি। সাপটা উধাও! সাজেদা বেগম স্বামীকে ডাক দিতে যাবেন এমন সময় টিটুর ভয়ার্ত আত্মচিৎকার শোনা গেল পাশের রুম থেকে।সে চিৎকার আফজাল সাহেবের ঘুমটাও ভাঙ্গিয়ে দিল। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পাশের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলেন তিনি, পেছন পেছন সাজেদা বেগম। টিটুর রুমে এসে লাইট জ্বালাতেই ওকে বিছানায় বসে থাকতে দেখা গেল। দুচোখে নগ্ন আতংক।'খালু আমারে বাচান। ' আফজাল সাহেবদের দেখে বলে উঠল টিটু। 'কি হয়েছে? ' 'খালু তহন যে সাপটারে মারছি সেইটার বউ "পুরতিশুধ "নিতে আইছে! ' টিটুর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলার যথেষ্ঠ কারণ থাকা সত্বেও হাসতে পারলেন না আফজাল সাহেব। 'কোথায় সাপটা? ' 'খাটের নিচে হান্দাইছে। ' আফজাল সাহেব উবু হয়ে খাটের নিচে তাকালেন।যা ভেবেছিলেন,সেটাই।খাটের নিচটা পুরো ফাঁকা।ভিন্ন পরিস্থিতিতে হয়ত খুঁজে দেখতেন আশপাশটা। কিন্তু তিনি জানেন সাপটাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। টিটুকে মশা না থাকা সত্বেও মশারি টানাবার পরামর্শ দিয়ে নিজেদের রুমে চলে এলেন আফজাল সাহেব আর সাজেদা বেগম। রুমে এসে সাজেদা বেগমকে ড্রয়ার থেকে মশারি বের করতে দেখে আফজাল সাহেব বললেন, 'তুমিও একটু আগে দেখেছ সাপটাকে, তাইনা? ' জবাবে কথা না বলে সম্মতিসূচক মাথা ঝাকালেন সাজেদা বেগম। পরেরদিন সামনে একজন রোগী নিয়ে চেম্বারে বসে আছেন আফজাল সাহেব।সামনে যে রোগীটা বসে আছে সে যেকোনো মূহুর্তে প্রপাত ধরনীতল হতে পারে।হলে কি করা উচিৎ সেটা নিয়ে তিনি খানিক চিন্তিত। লোকটা তার চেম্বারে একাই এসেছে টলতে টলতে।সাপের ফনার মত শরীরটা দুলছে তার। হঠাৎ করেই বিরক্তবোধ করলেন আফজাল সাহেব।তিনি এসব কি ভাবছেন।সাপের ফনার মত দুলতে যাবে কেন একজন মানুষ। গতকালের ব্যাপারটা বেশ প্রভাব ফেলেছে তার মনে। খারাপ প্রভাব। মোবাইলটা বেজে উঠতে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল আফজাল সাহেবের। ডিসপ্লেতে রমজান আলির নাম ভেসে আছে।তিনি চেম্বারে আসার আগে তিনজন লোক ঠিক করে দিয়ে এসেছেন বাড়ির চারপাশটা সাফাই করার জন্য।রমজান হল তাদের লিডার।আফজাল সাহেবের পূর্ব পরিচিত। 'বলো, রমজান, 'ফোন রিসিভ করে বললেন আফজাল সাহেব। এরপর হড়বড় করে রমজান আলি যা বলল তার সারমর্ম হল, সে এবং তার লোকরা জঙ্গল সাফ করতে গিয়ে বারবার সাপ দেখে ভিড়মি খাচ্ছে।সাপগুলোও ভারী বদ।এই আছে, এই নেই! আফজাল সাহেব বাড়তি টাকা দেবার আশ্বাস দিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করলেন। ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।অন্য সময় হলে ভাবতেন অদৃশ্য সাপের আজগুবি গল্গ ফেঁদে বাড়তি টাকা নেয়ার ফন্দি করছে রমজান আলি।এখন সেটা ভাবছেননা। তিনি জানেন কোথাও কোনো গড়বড় হয়ে গেছে।রহস্যময় কিছু একটা ঘটছে বাড়িটাতে।দ্রুত কিছু একটা করা উচিৎ,কোনো অঘটন ঘটবার আগেই।



চার

মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।কিছু কিছু মানুষ থাকেনই এমন।সৌম্য দর্শন চেহারা।ধবধবে সাদা চাপদাড়ি তার মধ্যে এনে দিয়েছে একধরনের গাম্ভীর্য।ষাটোর্দ্ধ এই বৃদ্ধ হলেন আফজাল সাহেবদের মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম।খুবই কামেল লোক।প্রতিদিন বহু মানুষ নানান ধরনের সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসেন।রহস্যময় সব সমস্যা। আফজাল সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়লেও ইমাম সাহেবের সাথে তার বিশেষ পরিচয় নেই। দেখা হলে "কেমন আছেন, ভাল আছি " পর্যন্তই তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ,অন্তত এতদিন ছিল।এইমূহুর্তে তিনি ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। সকালের দিকে রমজান আলির কথা শোনার পর আজ আগেভাগেই চেম্বার ছেড়েছেন তিনি।এখন মাগরিবের নামাজ শেষ করে ইমাম সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছেন। মসজিদে আপাতত তিনি আর ইমাম সাহেব ছাড়া কেউ নেই।নামাজ শেষে সবাই চলে গেছে।ইমাম সাহেব দীর্ঘক্ষণ ধরে নফল নামাজ পড়েন।আফজাল সাহেব গিয়ে দেখা করলে হয়ত তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন, কিন্তু আফজাল সাহেব সেটা করলেন না।তার হাতে সময় আছে।তিনি আপাতত তার চলমান সমস্যাটা নিয়ে ভাবছেন। আফজাল সাহেব নিজে পেশায় একজন ডাক্তার হওয়ায় সারাজীবন সমস্ত ঘটনার পেছনে কার্যকারণ খুঁজে এসেছেন। পৃথিবীতে রহস্যময় ঘটনা ঘটে, তিনি সেটা স্বীকারও করেন।সব ঘটনার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারেনা।তবে রহস্যময় ঘটনা ঘটার পেছনেও তো একটা কার্যকারণ থাকতে বাধ্য।কিন্তু তাদের সাথে ঘটা রহস্যময় ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?একটা মৃত সাপ কেন বারবার ফিরে আসবে? পৃথিবীতে,বিশেষ করে বাংলাদেশে এই কিলবিলে প্রাণীটাকে নিয়ে যত ধরনের রহস্যময় ঘটনা প্রচলিত আছে আর কোনো প্রাণী সম্পর্কে এতটা নেই।এদেশে সাপ যতটা না একটা সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী তারচাইতে বেশি একটা রহস্যময় প্রাণী। বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা এই প্রাণীটাকে নিজেদের স্বার্থে একটি অতিলৌকিক রুপ দান করেছে।যেমন,কালনাগিনী সাপের মানুষের রুপ ধারণ করা, শনি আর মঙ্গলবারে ঢোড়া সাপের বিষ আসা, জোড়া সাপের একটাকে মারলে অপরটা বাড়ি চিনে হত্যাকারীকে উপর প্রতিশোধ নেয়া, বিণ বাজালে সাপ এসে ধরা দেয়া কিংবা বাজনার তালে তালে নাচা, ,ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য গুজব। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে আফজাল সাহেব জানেন এগুলোর প্রায় সবই মিথ্যের জালে আবৃত। কালনাগিনীকে খুবই বিষাক্ত এবং অলৌকিক একটা প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।অবশ্য সুন্দরবন এলাকায় কালনাগিনী নামে এক প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়াও যায়। মজার ব্যাপারটা হল এই কালনাগিনী খুবই নিরীহ এবং নির্বিষ একটা সাপ।নিরীহ এই সাপের মানুষের রুপ ধারন করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। এরপর ধরা যাক জোড়া সাপের কথা।এটাও একটা গুজব।সাপের দৃষ্টিশক্তি খুবই কম,প্রায় না থাকার মতোই।সুতরাং সঙ্গীর হত্যাকারীকে ভালমত দেখাই সাপের পক্ষে সম্ভব না, বাড়ি চিনে প্রতিশোধ নেয়া তো হাস্যকর। দৃষ্টিশক্তির মত সাপের শ্রবনশক্তিও খুবই দুর্বল। জিহ্বাটাই হল তার শ্রবণযন্ত্র। যেটা একটু পর পর মুখ থেকে বের করে সে শোনার কাজ চালায়। এত দুর্বল শ্রবনযন্ত্র দিয়ে মাইলকে মাইল দুরের বিণের আওয়াজ শোনার কোন যৌক্তিক কারণ নেই সাপের।বিণের তালে তালে নাচ দেখিয়ে বেদেরা যে টাকা পয়সা নেয় এর পেছনেও রয়েছে সুক্ষ কারসাজি।বেদেরা যখন বিণ বাজায় তখন সাপ সেটা শুনতে পায়না, বরং আগে থেকে ট্রেনিং দেয়ার ফলে বেদের হাতের নড়াচড়া দেখে সাপও নিজের ফণা তোলা দেহ নাচায়। দেখলে মনে হয় বুঝি বিণের মায়াবী সুরেই. . .! মানুষ সবচাইতে বেশি যে ব্যাপারটাতে বিভ্রান্ত হয় সেটা হল, অলৌকিক গাছ! বেদেরা দাবি করে এসব গাছের যেকোনো অংশ সাথে থাকলে তাকে আর সাপ ছোবল দিতে পারবেনা।প্রমাণ হিসেবে তারা দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে ডেকে হাতে একটা গাছের ছোট্ট টুকরো ধরিয়ে দিয়ে সাপের কাছে নিতে বলে হাতটাকে।এরপর দেখা যায় সাপটা তার হাত দেখে ভয়ে মাথা সরিয়ে নিচ্ছে। এটাও বেদেদের আরেকটা ধোকাবাজি।তারা প্রথমে সাপ ধরে ধরে লোহার শিক দিয়ে ছ্যাঁকা দেয় সাপের গায়ে। পরবর্তীতে সাপটা এমনই ভীতু হয়ে পড়ে, তখন কেউ তার দিকে হাত বাড়ালেই সে ছ্যাঁকা খাবার ভয়ে মাথা সরিয়ে নেয়।আর বেদেরা এই সুযোগে সাধারণ মানুষের কাছে গাছের আজেবাজে ছাল বিক্রি করে। সাপ সম্পর্কে যতগুলো গুজব প্রচলিত আছে তার সবগুলোর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাই আফজাল সাহেব জানেন।কিন্তু তার সাথে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে নেই।দেখা যাক ইমাম সাহেবের কাছে আছে কিনা। ইমাম সাহেবের নামাজ শেষ। তিনি জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাড়াতে আফজাল সাহেবও উঠে দাড়ালেন। 'কেমন আছেন আফজাল সাহেব? ' আফজাল সাহেবকে দেখে ভরাট গলায় বলে উঠলেন ইমাম সাহেব। 'জী ভাল, আপনি? ' 'আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন ? ' 'জী ' 'তো সেটা আগে বলবেন তো। আমি নামাজ সংক্ষিপ্ত করতাম ' 'না, কোনো অসুবিধা নেই, আমার হাতে সময় আছে। ' 'তা কি সমস্যা আপনার? ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন। তিনি তো বলেননি তার কোনো সমস্যা আছে। ইমাম সাহেব যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই বললেন,'ভাবছেন, আমি কিভাবে জানলাম? না না, কোনো জ্বীন টীন এসে বলে যায়নি আমাকে।আসলে সমস্যা ছাড়া কেউ তেমন একটা আসেনা আমার কাছে,'বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন ইমাম সাহেব। এবার আফজাল সাহেব যথেষ্ঠ লজ্জিত হলেন। সত্যিই তো, মানুষটার সাথে এতদিন হল পরিচয়, কখোনো তো তেমনভাবে কথাও বলেননি।আজ যেই সমস্যা দেখা দিয়েছে,অমনি এসে হাজির। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেননা তিনি, এমনসময় ইমাম সাহেব তাকে উদ্ধার করলেন, 'চলুন, আমার রুমে গিয়ে কথা বলি। ' তারা দুজনে মসজিদ সংলগ্ন ইমাম সাহেবের কামরায় এলেন। রুমটাতে ইমাম সাহেব নামাজের আগে পরে বিশ্রাম নেন।ঘর ভর্তি দেশী বিদেশী বই, বেশিরভাগই আরবী। খানিক বাদেই আফজাল সাহেবের আপত্তি সত্বেও মসজিদের খাদেম চা নাস্তা দিয়ে গেল। 'অসুবিধা না থাকলে আপনার সমস্যাটা এবার বলতে পারেন, 'চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব শুরু করলেন। কিছুই বাদ দিলেন না।সাপটাকে মারার পর থেকে কিভাবে মৃত সাপটাকে বারবার দেখা যেতে লাগল সেটাও বিস্তারিত বলে গেলেন। শুনে ইমাম সাহেব কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন, 'হুমম্ সমস্যাটা বোধহয় আমি বুঝতে পারছি। ' 'কী সেটা? ' 'বলব, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।আজ তো রাত হয়ে গেছে, আজ আর হবেনা। আপনি কাল সাপটা যেখানে পোঁতা হয়েছিল সে জায়গাটা খুড়ে দেখবেন মৃত সাপটা এখনো সেখানে আছে কিনা। ' আফজাল সাহেব একটু অবাক হলেন।এটা কি বলছেন ইমাম সাহেব? 'হুজুর, আপনি কি ভাবছেন সাপটা ভূত হয়ে. . .' 'আমি কিছুই ভাবছিনা, এটা শুধুমাত্র আমার কৌতুহল বলতে পারেন।আপনি কাল ব্যাপারটা দেখে আসুন, আমি ইনশাআল্লাহ সমাধান দেবার চেষ্টা করব। ' আফজাল সাহেব আর তেমন কথা বাড়ালেননা। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন। মনটা কেমন খুতখুত করছে। ইমাম সাহেবও তাহলে ভূতে বিশ্বাস করেন! বাসায় এসে তিনি আর আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারলেননা।টিটুকে একটা শাবল নিয়ে বাইরে আসতে বললেন।টিটু শাবল আনতে তিনি বললেন, 'সাপটাকে কোথায় পুঁতেছিলি দেখা তো একটু। ' 'কেন খালু? ' 'আছে, দরকার আছে। তুই দেখিয়ে দে।' টিটু বাড়ির পেছনে এসে একটা জায়গা দেখাল,'উই যে। ' জায়গাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকাল খোঁড়া হয়েছিল।এরপরও নিশ্চিত হবার জন্য বললেন, 'শিওর তুই? ' 'এক্কেরে শিউর। "হানডেডে হানডেড! " আফজাল সাহেব মাটি খুঁড়তে শুরু করলেন।সেটা দেখে টিটু বলে উঠল, 'খালু এইডা কি করেন? ' 'দেখতে থাক, 'মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই জবাব দিলেন আফজাল সাহেব। প্রায় দেড় হাতের মত খোঁড়ার পরও সাপ তো দুরের কথা, একটা কেঁচোও দেখা গেলনা।এতক্ষণে টিটুও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। বলল, 'খালু, মাটি তো এতো খুড়ছিলাম না। আধা হাত খুইড়াই হান্দাইয়া থুইছিলাম।চান্দু গেলো কুনহানে? আমার মনে কয় চান্দু মরে নাই।কব্বর থিকা বাইর হইয়া আইছে। "পুরতিশুধ" নিবো,গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে লাগল টিটু। আফজাল সাহেব টিটুর কথার জবাব দিলেন না।তিনি খুব বেশি অবাক হননি।যেন জানতেন এটাই ঘটবে। তবে রহস্যটা তাতে এতটুকুও পরিষ্কার হয়নি, আরো ঘোলাটে হয়েছে।



পাঁচ

চারদিকটা এখনো আঁধারে ঢাকা।দিগন্তের কাছে একটা শুভ্র রেখা জানান দিচ্ছে আঁধারের আয়ু কমে আসছে। আফজাল সাহেব মসজিদের দিকে চলছেন।তার ইচ্ছে করছে একছুটে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে বলেন। গতকাল রাতে ঘুমানোর আগে বেশ ভালমত মশারী টানানো হয়েছিল। আফজাল সাহেব চেম্বার থেকে ফেরার পথে এক বোতল কার্বলিক এসিড নিয়ে এসেছিলেন। সেটারও সদ্ব্যবহার করা হয়। যদিও আফজাল সাহেব নিশ্চিত ছিলেননা একটা ভূতুড়ে সাপের বিরুদ্ধে এগুলো কতটা কাজে আসবে কিংবা আদৌ আসবে কিনা। একটা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই বিছানায় যান তিনি।এর আগের রাতেও তেমন ভাল ঘুম হয়নি। গতকাল তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যান আফজাল সাহেব।ঘুম ভাঙ্গে বুকের উপর একটা চাপ অনুভূত হওয়ায়। চোখ খুলে একমূহুর্ত আবছা আঁধারে কিছুই ঠাহর করতে পারেননা আফজাল সাহেব।একটু পরই অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখতে পান মৃত সাপটা তার বুকের উপর বসে আছে! আফজাল সাহেবকে চোখ মেলতে দেখেই কিনা, সাপটা ফণা তুলল। এক্ষুনি ছোবল দেবে! আফজাল সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন আতঙ্কে। এক এক করে দশটা সেকেন্ড পার হয়ে গেল।প্রতিটা সেকেন্ড যেন এক একটা ঘন্টা।দেহের কোথায় কোন তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করতে না পেরে চোখ মেললেন তিনি।সাপটা অদৃশ্য হয়েছে। বাকি রাতটা আর ঘুম আসেনি তার।আজ ফজরের আজান দিতে না দিতেই মসজিদের পথ ধরেছেন তিনি। ফজরের নামাজ শেষ। ইমাম সাহেব সম্ভবত কোনো দোয়া পড়ছেন। মুসল্লীরা একে একে উঠে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। ইশারায় তার পিছু পিছু যেতে বললেন আফজাল সাহেবকে। ইমাম সাহেবের রুমে মুখোমুখি বসলেন দুজন। 'তারপর বলুন,কি অবস্থা আপনার? 'বললেন ইমাম সাহেব। আফজাল সাহেব সব খুলে বললেন।গতরাতের ঘটনাটাও। 'বুঝতে পেরেছি, 'মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ইমাম সাহেব। কিছু বললেন না আফজাল সাহেব। একটা ব্যাখ্যার আশায় আছেন। 'আপনাকে একটা হাদীস শোনাই, তাহলেই আশা করি রহস্যটা পরিষ্কার হবে আপনার কাছে। ' তার এই অদ্ভুত সমস্যার সাথে হাদীসের কি সম্পর্ক সেটা বুঝতে ব্যর্থ হলেন আফজাল সাহেব। 'হাদীসের সবচাইতে প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ "মুসলিম শরীফের "একটা হাদীস এটা। পুরো ঘটনাটা বেশ বড়, আমি সংক্ষেপে মূল ঘটনাটা বলছি।ঘটনাটা খন্দকের যুদ্ধের সময়।ওই সময় এক সদ্য বিবাহিত যুবকও যুদ্ধে অংশ নেয়।সে প্রতিদিন দুপুর বেলা রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে বলে নিজের বাড়িতে আসতো।একদিন দুপুরবেলা বাড়ি এসে দেখে তার সদ্য পরীনিতা স্ত্রী বাড়ির বাইরে দাড়িয়ে আছে।যুবক খানিকটা রেগে যায় এতে।বকাঝকা শুরু করে স্ত্রীকে।তখন তার স্ত্রী কী ঘটেছে সেটা ভেতরে গিয়ে তাকে দেখে আসতে বলে। যুবক তখন ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে বিরাট এক সাপ বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। সে তখন হাতের বর্শাটা দিয়ে আঘাত করে সাপটাকে।সাপটাও এই আঘাতে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।যুবক ধরে নেয় সাপটা মারা গেছে।সে সাপটাকে বর্শায় গেঁথে বাইরে নিয়ে আসে, ঠিক তখনই আহত সাপ তাকে ছোবল দেয়।এরপর হাদীসের ভাষায় এভাবে লেখা আছে, 'এরপর তাদের মধ্যে কে আগে মারা গেল, সাপ নাকি যুবক, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ' 'কী ভয়ঙ্কর! 'শিউরে উঠলেন আফজাল সাহেব। 'হুমম্ ভয়ঙ্কর।তারপর যুবকের পরিবার পরিজন রাসূলুল্লাহ সা.এর কাছে এসে তাঁকে অনুরোধ করে তিনি যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করে যুবককে বাঁচিয়ে তোলেন।তাদের ধারণা ছিল সাপে কাটা ব্যাক্তিকে বোধহয় বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব।মজার ব্যাপার কি জানেন আফজাল সাহেব? এই সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগের ভুল ধারণা কিন্তু এখনো আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আছে। মানুষ ভাবে সাপে কাটা মানুষকে বোধহয় ওঝারা বাঁচিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা.সেদিন বলেছিলেন, 'তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা কর।' অর্থাৎ ইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুবকটি মারা গেছে। এরপর তিনি যা বললেন সেটাই হল আমাদের আলোচ্য বিষয়। 'এপর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন ইমাম সাহেব। মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ সব শুনছিলেন আফজাল সাহেব। 'এরপর রাসূল সা.যা বললেন তার মর্মার্থ হল,'কিছু কিছু বাড়িতে সাপের রুপ ধারণ করে জ্বীনেরা বসবাস করে।আরবীতে এদের "আওয়ামের "বলা হয়।এদের দেখামাত্র তিনবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিতে হবে।যদি চলে যায় তাহলে ভাল।বুঝতে হবে এটা ভাল জ্বীন।আর যদি না যায় তখন ধরে নিতে হবে এটা সত্যিকারের সাপ অথবা দুষ্ট জ্বীন।সেক্ষেত্রে অতিদ্রুত সাপটাকে মেরে ফেলতে হবে। এই নিয়মের কারণ হল, যদি ভুলে একটা ভাল জ্বীনকে কোনো ধরনের সতর্ক করা ছাড়াই মেরে ফেলা হয় তাহলে তার স্বজনরা হত্যাকারীর নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে।এবার নিশ্চয়ই সব বুঝতে পেরেছেন? ' মাথা ঝাঁকালেন আফজাল সাহেব, বুঝতে পেরেছেন তিনি সবই। 'তারমানে সেদিন যে সাপটা মারা হয়েছিল সেটা সাপ ছিলনা, সাপরুপী একটা জ্বীন ছিল?আর এখন যে সাপটা আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি সেটা আসলে মৃত জ্বীনের কোনো স্বজন?সতর্ক না করেই তাদের বন্ধুকে মেরে ফেলায় আমাদের ভয় দেখিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে? ' 'সম্ভবত, কারণ জ্বীনেরা সবচাইতে বেশি কালো সাপের আকার ধারণ করতে পছন্দ করে।আর মৃত সাপটা ছিল কালো। 'সাপটা কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করছেনা, বারবার শুধু দেখা দিয়েই অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ' 'যদ্দুর মনে হচ্ছে এটা কোনো ভাল জ্বীনই হবে, তাই শুধু ভয় দেখাচ্ছে। খারাপ জ্বীন হলে কি ঘটত বলা যাচ্ছেনা। ' 'এখন তাহলে কি করতে পারি আমরা? ' 'দাড়ান, আপনাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, 'বলে একটা ড্রয়ার খুলে ইমাম সাহেব চারটা পেড়েক আফজাল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিলেন।' বাড়িতে গিয়েই এই চারটা পেড়েক বাড়ির চারকোনায় পুঁতে দেবেন। আর রাতে শোবার সময় আয়াতুল কুরসী পড়ে শোবেন, ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা হবেনা।' আফজাল সাহেব আরো দু একটা কথা বলে বিদায় নিলেন। দরজার কাছে গিয়ে একটা কথা মনে হতে ফিরে তাকিয়ে বললেন, 'আচ্ছা হুজুর, সাপটাকে যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সে জায়গাটা খালি কেন? কোথায় গেল সাপটা? ' 'ধারণা করছি তার স্বজনরা নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও সম্মানের সাথে দাফন করেছে তাকে। ' আফজাল সাহেব ফিরে আসতে লাগলেন। মনটা হঠাৎ করেই খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে তার।



উপসংহার

টানা দু রাত প্রায় নির্ঘুম কাটাবার পর আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আফজাল সাহেবের ছোট্ট পরিবার। তবে যদি এই মূহুর্তে কেউ জেগে থাকত তাহলে দেখতে পেত. . .
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 05, 2013 02:06
No comments have been added yet.