আঁচল
ক্রিং করে বেল বেজে উঠতেই পড়িমড়ি করে এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে ছুটল জহির।বেল বাজলে পিয়নদের এভাবেই ছুটে যেতে হয়।
খাতা কলমে বেতন দিয়ে জহিরকে পিয়ন হিসেবে রাখা হলেও ওর কাজের গন্ডি আরো বিস্তৃত।চাকরির শুরুতে জহির ভেবে নিয়েছিল কাজটা আসলে পানির মত সোজা হবে।সারাদিন বসে বসে ঝিমানো আর এক রুমের ফাইলপত্র আরেক রুমে পৌঁছে দেয়া, মাঝে মধ্যে অফিসের বাইরে কাগজপত্র নিয়ে সামান্য দৌড়াদৌড়ি। পিয়নের কাজ তো এগুলোই নাকি? চা বানানো তো বয় বেয়ারার কাজ।তার পদ ওদের চাইতে কত উঁচুতে!
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি মোটেও সেরকম নয়।তার পদ বয় বেয়ারারও নীচে। বয় বেয়ারাদের এমডি সাহেবের বাসার বাজার করা কিংবা ছেলে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতে হয়না কিন্তু জহিরকে এগুলোও করতে হয়।
কাজে জয়েন করার পরদিন পিয়নদের জন্য বরাদ্দ লিফট সাইজের রুমে বসে ওর একমাত্র সহকর্মী মইনের সাথে আলাপ করছিল জহির।এমন সময় বেল বাজল।এমডি স্যারের রুমের বেল আলাদা,পিয়নও আলাদা।জহির হল এমডি সাহেবের,যাকে বলে "খাস পিয়ন"।বেল বাজতেই জহির যখন এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল তখন যদি সে পেছন ফিরে তাকাত তাহলে দেখতে পেত মইনের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।বলা যায়না,করুণারও হতে পারে হাসিটা।
এমডি স্যারের প্রথম ডাক,বলতে গেলে একরকম দৌড়েই স্যারের রুমের দিকে রওনা হল জহির।রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন এমডি আকবর আলী।বিরাট ধনী মানুষ।ভাল ব্যাবসায়ীক বুদ্ধি রাখেন।প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটা শূন্য যুক্ত করেছেন।তবে এর কতটুকু ব্যাবসায়ীক বুদ্ধির জোরে আর কতটুকূ কিপ্টেমির জোরে সম্ভব হয়েছে সেটা নিয়ে বাজারে জোর গুজব চালু আছে।
আকবর আলী কিপ্টের চুড়ামনি!পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের ভাষায় "হাড় কেপ্পন"ও বলা চলে।তার অফিসের যতজন লোক কাজ করে মূলত তার দিগুন লোকের প্রয়োজন।কিন্তু আকবর আলী চলেন নিজের বুদ্ধিতে।তার অফিসের প্রত্যেককে দুজনের কাজ করতে হয়।
আকবর আলীর বাড়িতেও একই ব্যাবস্থা।তার বাড়িতে গেলে প্রায়ই ড্রাইভারকে দেখা যাবে বাগানে খুড়পি নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে!
আর আকবর আলীর কাছে যারা চাকরি করে তাদের এই চাকরি চট করে ছেড়ে দেবার মত পরিস্থিতি নেই। এই অসহায় লোকগুলোকেই কিভাবে যেন বেছে বেছে চাকরি দেন আকবর আলী।হয়ত এদের চেনাটাই আকবর আলীর সবচাইতে বড় বিজনেস সিক্রেট!
এমন লোকের পিয়ন সারাদিন বসে বসে ঝিমাবে এমনটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই।
জহির আকবর আলীর সামনে দাঁড়াতেই মাথা তুললেন আকবর আলী।সে মাথায় বিশাল একটা টাক।অশ্লীল রকমের চকচকে!
'এত দেরি হয় কেন?'
লে,দেরী করলাম কখন?! মনে মনে ভাবল জহির।'স্যার আমি তো বেল বাজার সাথে সাথেই চলে এলাম। '
'বেল বাজার সাথে সাথে আসলে তো চলবেনা।সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।বেল বাজা অবস্থায়ই দৌড় দিবা,আন্ডারস্ট্যান্ড? ভাল কথা, বাজার সদাই করতে পার কেমন?'
'ভাল স্যার।'
'মাঝে মাঝে আমার বাসার বাজার করে দিতে হবে।কী পারবানা?'
'জী পারব।'মনে মনে স্যারের "খাস পিয়ন" থেকে "খাস লোক"এ পরিণত হবার আনন্দে জহির তখন বিভোর।স্যারের "খাস লোক" হওয়া মানেই প্রমোশন,বোনাস!
জহির স্যারের "খাস লোক" হয়েছে ঠিকই তবে জহিরের অবস্থা এখন ছেড়ে দে আকবর কেঁদে বাঁচি!
তবে ছেড়ে দেবারও কোনো উপায় নেই।ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা ছাড়লে গুষ্টিশুদ্ধ বটতলায় এসে দাঁড়াতে হবে।অবশ্য গুষ্টি বলতে আছেই বা কে?যে আছে তাকে বললেই গাট্টি বোচকা নিয়ে গাছতলায় চলে আসবে।ওর বউ,আসমা।কী সুন্দর নাম! বউটাও কত লক্ষী!জহির তো মাঝে মধ্যে লক্ষ্মী বলেও ডাকে।এই লক্ষী!
বউয়ের কথা মনে পড়তেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায় জহিরের।তবে আকবর আলীর রুমের সামনে চলে আসাতে মধুর ভাবনায় জোর করে ছেদ টানে।সেদিন আকবর আলী বলার পর থেকে এখন বেল বাজার সাথে সাথেই দৌড় দেয় সে।
রুমে ঢুকতেই যথারীতি আকবর আলীর অশ্লীল রকমের চকচকে টাকটার দিকে চোখ চলে যায় জহিরের।লোকটা বোধহয় টাকে নিয়মিত তেল দেয়।নইলে এত চকচকে থাকে কী করে?জহির অনেক দিন ধরে একটা ইচ্ছে গোপনে লালন করে আসছে।
দেখা গেল কোনো একভাবে জহির প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। অনেক ক্ষমতা তার।হোমরা চোমরারা তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।একদিন আকবর আলীও একটা কাজ নিয়ে তার কাছে এল।জহির ঠিক করে রেখেছে, তখন সে আকবর আলীকে বলবে,'আচ্ছা আকবর সাহেব,আপনি কি টাকে তেল দেন?নিয়মিত?একটু কাছে আসেন তো চেক করি!
'কী হল ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?'
জহিরের চটকা ভাঙ্গে আকবর আলীর গলায়।চমকে ওঠার সাথে সাথে কিঞ্চিত ভয়ও পেল জহির।ও যে এতক্ষন আকবর আলীর টাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা কী আকবর আলী ধরতে পেরেছে?মনে হয়না।
'শোনো,একটু কাজ করতে হবে।"
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।'জী স্যার।'
একটা প্যাকেট বের করলেন আকবর আলী।'শোনো এখানে একটা শাড়ি আছে।তোমাদের ম্যাডামের জন্য কিনেছিলাম।কাল ভুলে বাসায় নেয়া হয় নাই।তোমাদের ম্যাডাম আজ বিকালে আবার একটা পার্টিতে যাবে।তুমি শাড়িটা আমার বাসায় দিয়ে আসো।'
এবার হাপ ছাড়ল জহির।এটাও গোপনে।তাও ভাল বাজার করতে দেয়নি।আকবর আলীর বাজার করতে যাওয়া মানেই একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং যন্ত্রনাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়া।পুরো বাজার খুঁজে সবচাইতে ভাল জিনিস সবচাইতে কম দামে আনতে হবে.আকবর আলীর জন্য!প্রতিবারই বাজারের টাকা থেকে অতি কষ্টে নিজের রিকশা ভাড়াটা বাঁচাতে সক্ষম হয় জহির।
এমনিতে আকবর আলীর বাজার করার দায়িত্ব বাসার কাজের লোকের।কিন্তু আকবর আলী হিসেব করে দেখেছে জহিরকে দিয়ে বাজার করালে লাভ অনেকগুলো।খুব ভাল কেনাকাটা করতে পারে সে।এজন্য প্রায় দিনই বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটতে হয় জহিরকে।
আকবর আলী শাড়ির প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল জহিরের দিকে।জহির ওটা নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রাইজ ট্যাগের দিকে চোখ পড়তেই অবিশ্বাসে কপাল কুঁচকে গেল জহিরের।শাড়িটার দাম পাঁচ হাজার টাকা!
না,দামটা আশ্চর্যের বিষয় না বিষয় হল এই শাড়ি আকবর আলী কী করে কেনে?
হঠাৎ জহিরের মনে পড়ল কাল একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক এমডি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল।হাতে বড়সড় একটা ব্যাগও ছিল।নিশ্চয়ই সেই লোকই শাড়িটা গিফট করেছে।অথচ ছোটলোকটা বলছে শাড়ি নাকি সেই কিনেছে।তোর বাপ জীবনে এতটাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছে রে!এরপর একটা কুতসিৎ গালি দিল জহির আকবর আলীর উদ্দেশ্যে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় প্যাকেটের এককোনা সামান্য উঁচু করল জহির।শাড়িটা দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।সত্যি বলতে জীবনে এর পাঁচভাগের এক ভাগ দামের শাড়িও ধরে দেখেনি জহির।
প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল চমৎকার আকাশি রঙের শাড়িটা।শুধু চমৎকার বলা এর যথার্থতা প্রকাশের জন্য অপ্রতুল।
হালকা আকাশি জমিনে বেশ ভারী কাজ করা হয়েছে। তবে সবচাইতে সুন্দর এর আঁচলটা।দেখলেই আকাশের কথা মনে পড়ে যায়!
জহির জানেনা এটা কী শাড়ি।জানার ইচ্ছেও নেই।এমন শাড়ি জীবনে কখনো কেনার প্রয়োজন পড়বেনা তার।তবে এটা ঠিক এই শাড়ির কারিগরের কল্পনায় কখনই আকবর আলীর ধুমসো বউ ছিলনা।ছিল আসমার মত মায়াবী সৌন্দর্যের কোনো লাজুক রমনী যে কিনা আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।একটু পর পরই আয়নায় দেখছে নিজেকে।আয়নার ছায়ায় পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে আঁড় চোখে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।এবার গোপনে নয়,একেবারে ভেতর থেকে।
পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি তো দুরের কথা,আসমার সাথে ওর দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে ওকে দুটো মাত্র শাড়ি দিতে পেরেছে জহির।সবচাইতে দামীটা বোধহয় সাড়ে ছয়শ টাকা দিয়ে কিনেছিল।
গত ঈদে তো সেটাও দিতে পারেনি।কিভাবে দেবে,ওর গোটা সংসারে অভাব প্রতিনিয়ত মুখ ব্যাদান করে থাকে।
আসমা অবশ্য কখনই কিছু চায়না জহিরের কাছে।এজন্যই তো বাঁচোয়া।
আজ ঘন ঘন আসমার কথা মনে হওয়াতে জহির ঠিক করল বাসা হয়ে এরপর আকবর আলীর বাড়িতে যাবে।সেই কখন থেকে ওর লক্ষীটাকে দেখেনা!
যেহেতু ম্যাডাম বিকেলে পার্টিতে যাবে সেহেতু একটু দেরী করলে কিছু হবেনা।আজ আকবর আলীর একটা জরুরী মিটিং আছে এক জায়গায়।সুতরাং সেদিক থেকেও ভয় নেই।অতএব নিশ্চিন্তে বাড়ির দিকে রওনা হল জহির।
আকবর আলীর মত ধনীরা যদি জানতে পারে জহির তার কবুতরের খোপের মত দেখতে বস্তুটাকে "বাসা " বলে তাহলে নিজেদের "বাসা" নিয়ে যথেষ্টই অপমানিতবোধ করত তারা।
দুহাজার টাকা দিয়ে টিনশেড এই খুপড়িটা ভাড়া নিয়েছে জহির।রুম একটাই।কেউ বেড়াতে টেড়াতে এলে আসমাকে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতে হয়।তবে এটাই জহিরের রাজ্য।এ রাজ্যে সে রাজা,আসমা রানী।চলেই তো যাচ্ছে বেশ।
দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে আওয়াজ এল,'কে'?
জহির সাড়া দিতেই দরজা খুলে দিল আসমা।রান্না করছিল বোধহয়, গরমে নাকের আগায় শিশিরের মত ঘাম জমেছে।শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে রাখায়।মুরব্বী মুরব্বী একটা ভাব চলে এসেছে মেয়েটার মধ্যে।
'আজ এই সময়? 'বোঝাই যায় অবাক হয়েছে আসমা।
'হুম।'ছোট্ট করে জবাব দিল জহির।
' কী হল এমন করে কী দেখতাছ?'জহিরকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন আসমার।
'আমার লক্ষীটাকে। '
'উঁউউহ,ঢং!'
জহির হেসে ফেলল,একটু পর আসমাও।
এই বাচ্চা বাচ্চা চেহারার শ্যামলা মেয়েটাকে জহির কী পরিমান ভালবাসে সেটা কেউ জানেনা।উহু,জানে একজন।আসমা জানে।
আসমার শখ বলতে একটাই,চোখে কাজল দেয়া।হরিনীর মত মায়াবী চোখদুটোয় যখন কাজলের ছোঁয়া লাগে তখন তাতে এক সমুদ্র ভালবাসা দেখতে পায় জহিরও।
'তুমি কি আজকে আমার সাথে খাবা?'কথাটা বলেই বড় বড় চোখে জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে আসমা।
"আমার সাথে খাবা" কথাটা শুনেই জহিরের বুকের ভেতর কেমন টনটন করে ওঠে।প্রতিদিন দুপুরে আসমাকে একা একা খেতে হয়।আকবর আলীর নিয়ম হল সবাইকে দুপুরের খাবার অফিসেই নিয়ে আসতে হবে।
প্রায়দিনই রাতে খোঁজ নিয়ে জহির জানতে পারে দুপুরে আসমা কিছু খায়নি।কারন জিজ্ঞেস করলে মাথা নীচু করে থাকে মেয়েটা।জবাব দেয়না। জহির বুঝতে পারে একা একা খেতে আসমার একটুও ভাল লাগেনা।
'হুম,'মাথা ঝাকাল জহির।
'সত্যি!'চাঁদের মত উজ্জল মুখটা পরক্ষনেই অমাবস্যার আঁধার ঢেকে নিল।'তেমন কিছু তো রান্না হয় নাই।শুধু বেগুন ভাজি।'
'আর কী লাগে পাগলী?! '
'আচ্ছা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো,আমি একটা ডিম ভাজি এই ফাঁকে।'
'একটা কেন,দুইটাই ভাজো।আজ আরাম করে খাই দুজন।'
'একটাই ডিম আছে।'মুখ কালো করে জবাব দিল আসমা।'
'আচ্ছা তুমি একটা ভাজতে থাক,আমি আরেকটা কিনে নিয়ে আসি।'
জহির প্যাকেটটা রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।যখন ফিরে এল তখন ওর জন্য বড় সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
হাতে একটা ডিম নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল আসমা শাড়িটা শালের মত করে গায়ে জড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।জহিরকে উপস্থিতি লক্ষ্য করে লজ্জা পেল মেয়েটা।'কত দিয়ে কিনছো?'
জহির বুঝতে পারল আসমা প্রাইজ ট্যাগটা দেখেনি।দেখলে ওটা ছোঁয়ারও সাহস পেতনা।সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরে জহিরের সারা শরীর অবশ হয়ে এল।আসমা ভেবেছে শাড়িটা জহির ওর জন্যই কিনেছে।মেয়েটা বুঝতেও পারেনি শাড়িটা এত দামি। বোঝার কথাও না অবশ্য।জহিরের মত আসমাও কখনো এত দামি শাড়ি দেখেনি।
'এইতো।' আর কিছু বলার মত খুঁজে পায়না জহির।
'খুব সুন্দর।'
জহির নিশ্চুপ।
আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আসমা।অপুর্ব লাগছে ওকে আকাশি রঙের শাড়িটাতে।যেন এক খন্ড আকাশ গায়ে জড়িয়ে আছে কোনো পরী।কালো চুলগুলো মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আঁচলে।
জহিরের ইচ্ছে হল এই আকাশে ভেসে বেড়াতে,মেঘে মুখ লুকোতে,আঁচলে আশ্রয় নিতে।একখন্ড আকাশ,একরাশ মেঘ,একটুকরো আঁচল।এই আকাশ,এই মেঘ,এই আঁচল শুধুই ওর,ওদের।
জহির খুব দ্রুত দুটো সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথমেই ওকে প্যাকেটটা থেকে গোপনে প্রাইজ ট্যাগটা সরিয়ে ফেলতে হবে।আসমাকে কোনোমতেই শাড়ির দাম জানতে দেয়া যাবেনা।
দ্বিতীয় কাজটা কিভাবে করবে,জহির জানেনা।শুধু এতটুকু জানে ওকে করতে হবে,করতেই হবে।একখন্ড আকাশ, একরাশ মেঘ আর একটুকরো আঁচলের জন্য...
উপসংহার
তিনদিন পর জহির যখন দেহে মারাত্মক এক ছুরিকাঘাত নিয়ে অফিসে হাজির হল তখন সবাই জানতে পারল তিনদিন আগে ভয়াবহ এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল সে। আরেকটু হলেই মারা যেতে পারত।
পুনশ্চঃ ভালবাসা এখন বন্দি ফেসবুক আর স্টুডেন্টদের সীমিত গন্ডিবদ্ধ জগতে।সে জগতের বাইরে,দরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যেও যে ভালবাসার আধার থাকতে পারে সে খবর কি আমরা রাখি?
উৎসর্গঃ
বেশ কিছুদিন আগে একটা কারণে লেখালেখি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় মাসখানেক একটা অক্ষরও লিখিনি।সে সময়ে একজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত বলেছে,আপনার লিখতে হবে,আপনাকে ফিরে আসতে হবে।
আমি লিখেছি,ফিরে এসেছি।
এই ফিরে আসার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য সেই মানুষটার আজ জন্মদিন। আমার পক্ষ থেকে এই গল্পটা তাকে উপহার।
শুভ জন্মদিন ইব্রাহিম বিন আজিজ।
খাতা কলমে বেতন দিয়ে জহিরকে পিয়ন হিসেবে রাখা হলেও ওর কাজের গন্ডি আরো বিস্তৃত।চাকরির শুরুতে জহির ভেবে নিয়েছিল কাজটা আসলে পানির মত সোজা হবে।সারাদিন বসে বসে ঝিমানো আর এক রুমের ফাইলপত্র আরেক রুমে পৌঁছে দেয়া, মাঝে মধ্যে অফিসের বাইরে কাগজপত্র নিয়ে সামান্য দৌড়াদৌড়ি। পিয়নের কাজ তো এগুলোই নাকি? চা বানানো তো বয় বেয়ারার কাজ।তার পদ ওদের চাইতে কত উঁচুতে!
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল পরিস্থিতি মোটেও সেরকম নয়।তার পদ বয় বেয়ারারও নীচে। বয় বেয়ারাদের এমডি সাহেবের বাসার বাজার করা কিংবা ছেলে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতে হয়না কিন্তু জহিরকে এগুলোও করতে হয়।
কাজে জয়েন করার পরদিন পিয়নদের জন্য বরাদ্দ লিফট সাইজের রুমে বসে ওর একমাত্র সহকর্মী মইনের সাথে আলাপ করছিল জহির।এমন সময় বেল বাজল।এমডি স্যারের রুমের বেল আলাদা,পিয়নও আলাদা।জহির হল এমডি সাহেবের,যাকে বলে "খাস পিয়ন"।বেল বাজতেই জহির যখন এমডি স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল তখন যদি সে পেছন ফিরে তাকাত তাহলে দেখতে পেত মইনের মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠেছে।বলা যায়না,করুণারও হতে পারে হাসিটা।
এমডি স্যারের প্রথম ডাক,বলতে গেলে একরকম দৌড়েই স্যারের রুমের দিকে রওনা হল জহির।রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে আছেন এমডি আকবর আলী।বিরাট ধনী মানুষ।ভাল ব্যাবসায়ীক বুদ্ধি রাখেন।প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকটা শূন্য যুক্ত করেছেন।তবে এর কতটুকু ব্যাবসায়ীক বুদ্ধির জোরে আর কতটুকূ কিপ্টেমির জোরে সম্ভব হয়েছে সেটা নিয়ে বাজারে জোর গুজব চালু আছে।
আকবর আলী কিপ্টের চুড়ামনি!পশ্চিম বঙ্গের লেখকদের ভাষায় "হাড় কেপ্পন"ও বলা চলে।তার অফিসের যতজন লোক কাজ করে মূলত তার দিগুন লোকের প্রয়োজন।কিন্তু আকবর আলী চলেন নিজের বুদ্ধিতে।তার অফিসের প্রত্যেককে দুজনের কাজ করতে হয়।
আকবর আলীর বাড়িতেও একই ব্যাবস্থা।তার বাড়িতে গেলে প্রায়ই ড্রাইভারকে দেখা যাবে বাগানে খুড়পি নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে!
আর আকবর আলীর কাছে যারা চাকরি করে তাদের এই চাকরি চট করে ছেড়ে দেবার মত পরিস্থিতি নেই। এই অসহায় লোকগুলোকেই কিভাবে যেন বেছে বেছে চাকরি দেন আকবর আলী।হয়ত এদের চেনাটাই আকবর আলীর সবচাইতে বড় বিজনেস সিক্রেট!
এমন লোকের পিয়ন সারাদিন বসে বসে ঝিমাবে এমনটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই।
জহির আকবর আলীর সামনে দাঁড়াতেই মাথা তুললেন আকবর আলী।সে মাথায় বিশাল একটা টাক।অশ্লীল রকমের চকচকে!
'এত দেরি হয় কেন?'
লে,দেরী করলাম কখন?! মনে মনে ভাবল জহির।'স্যার আমি তো বেল বাজার সাথে সাথেই চলে এলাম। '
'বেল বাজার সাথে সাথে আসলে তো চলবেনা।সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।বেল বাজা অবস্থায়ই দৌড় দিবা,আন্ডারস্ট্যান্ড? ভাল কথা, বাজার সদাই করতে পার কেমন?'
'ভাল স্যার।'
'মাঝে মাঝে আমার বাসার বাজার করে দিতে হবে।কী পারবানা?'
'জী পারব।'মনে মনে স্যারের "খাস পিয়ন" থেকে "খাস লোক"এ পরিণত হবার আনন্দে জহির তখন বিভোর।স্যারের "খাস লোক" হওয়া মানেই প্রমোশন,বোনাস!
জহির স্যারের "খাস লোক" হয়েছে ঠিকই তবে জহিরের অবস্থা এখন ছেড়ে দে আকবর কেঁদে বাঁচি!
তবে ছেড়ে দেবারও কোনো উপায় নেই।ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরিটা ছাড়লে গুষ্টিশুদ্ধ বটতলায় এসে দাঁড়াতে হবে।অবশ্য গুষ্টি বলতে আছেই বা কে?যে আছে তাকে বললেই গাট্টি বোচকা নিয়ে গাছতলায় চলে আসবে।ওর বউ,আসমা।কী সুন্দর নাম! বউটাও কত লক্ষী!জহির তো মাঝে মধ্যে লক্ষ্মী বলেও ডাকে।এই লক্ষী!
বউয়ের কথা মনে পড়তেই মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায় জহিরের।তবে আকবর আলীর রুমের সামনে চলে আসাতে মধুর ভাবনায় জোর করে ছেদ টানে।সেদিন আকবর আলী বলার পর থেকে এখন বেল বাজার সাথে সাথেই দৌড় দেয় সে।
রুমে ঢুকতেই যথারীতি আকবর আলীর অশ্লীল রকমের চকচকে টাকটার দিকে চোখ চলে যায় জহিরের।লোকটা বোধহয় টাকে নিয়মিত তেল দেয়।নইলে এত চকচকে থাকে কী করে?জহির অনেক দিন ধরে একটা ইচ্ছে গোপনে লালন করে আসছে।
দেখা গেল কোনো একভাবে জহির প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। অনেক ক্ষমতা তার।হোমরা চোমরারা তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।একদিন আকবর আলীও একটা কাজ নিয়ে তার কাছে এল।জহির ঠিক করে রেখেছে, তখন সে আকবর আলীকে বলবে,'আচ্ছা আকবর সাহেব,আপনি কি টাকে তেল দেন?নিয়মিত?একটু কাছে আসেন তো চেক করি!
'কী হল ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?'
জহিরের চটকা ভাঙ্গে আকবর আলীর গলায়।চমকে ওঠার সাথে সাথে কিঞ্চিত ভয়ও পেল জহির।ও যে এতক্ষন আকবর আলীর টাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা কী আকবর আলী ধরতে পেরেছে?মনে হয়না।
'শোনো,একটু কাজ করতে হবে।"
গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।'জী স্যার।'
একটা প্যাকেট বের করলেন আকবর আলী।'শোনো এখানে একটা শাড়ি আছে।তোমাদের ম্যাডামের জন্য কিনেছিলাম।কাল ভুলে বাসায় নেয়া হয় নাই।তোমাদের ম্যাডাম আজ বিকালে আবার একটা পার্টিতে যাবে।তুমি শাড়িটা আমার বাসায় দিয়ে আসো।'
এবার হাপ ছাড়ল জহির।এটাও গোপনে।তাও ভাল বাজার করতে দেয়নি।আকবর আলীর বাজার করতে যাওয়া মানেই একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং যন্ত্রনাদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়া।পুরো বাজার খুঁজে সবচাইতে ভাল জিনিস সবচাইতে কম দামে আনতে হবে.আকবর আলীর জন্য!প্রতিবারই বাজারের টাকা থেকে অতি কষ্টে নিজের রিকশা ভাড়াটা বাঁচাতে সক্ষম হয় জহির।
এমনিতে আকবর আলীর বাজার করার দায়িত্ব বাসার কাজের লোকের।কিন্তু আকবর আলী হিসেব করে দেখেছে জহিরকে দিয়ে বাজার করালে লাভ অনেকগুলো।খুব ভাল কেনাকাটা করতে পারে সে।এজন্য প্রায় দিনই বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটতে হয় জহিরকে।
আকবর আলী শাড়ির প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল জহিরের দিকে।জহির ওটা নিয়ে বেরিয়ে এল।
প্রাইজ ট্যাগের দিকে চোখ পড়তেই অবিশ্বাসে কপাল কুঁচকে গেল জহিরের।শাড়িটার দাম পাঁচ হাজার টাকা!
না,দামটা আশ্চর্যের বিষয় না বিষয় হল এই শাড়ি আকবর আলী কী করে কেনে?
হঠাৎ জহিরের মনে পড়ল কাল একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক এমডি স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল।হাতে বড়সড় একটা ব্যাগও ছিল।নিশ্চয়ই সেই লোকই শাড়িটা গিফট করেছে।অথচ ছোটলোকটা বলছে শাড়ি নাকি সেই কিনেছে।তোর বাপ জীবনে এতটাকা দিয়ে শাড়ি কিনেছে রে!এরপর একটা কুতসিৎ গালি দিল জহির আকবর আলীর উদ্দেশ্যে।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় প্যাকেটের এককোনা সামান্য উঁচু করল জহির।শাড়িটা দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।সত্যি বলতে জীবনে এর পাঁচভাগের এক ভাগ দামের শাড়িও ধরে দেখেনি জহির।
প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল চমৎকার আকাশি রঙের শাড়িটা।শুধু চমৎকার বলা এর যথার্থতা প্রকাশের জন্য অপ্রতুল।
হালকা আকাশি জমিনে বেশ ভারী কাজ করা হয়েছে। তবে সবচাইতে সুন্দর এর আঁচলটা।দেখলেই আকাশের কথা মনে পড়ে যায়!
জহির জানেনা এটা কী শাড়ি।জানার ইচ্ছেও নেই।এমন শাড়ি জীবনে কখনো কেনার প্রয়োজন পড়বেনা তার।তবে এটা ঠিক এই শাড়ির কারিগরের কল্পনায় কখনই আকবর আলীর ধুমসো বউ ছিলনা।ছিল আসমার মত মায়াবী সৌন্দর্যের কোনো লাজুক রমনী যে কিনা আঁচল উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।একটু পর পরই আয়নায় দেখছে নিজেকে।আয়নার ছায়ায় পেছনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে আঁড় চোখে।
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জহির।এবার গোপনে নয়,একেবারে ভেতর থেকে।
পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি তো দুরের কথা,আসমার সাথে ওর দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে ওকে দুটো মাত্র শাড়ি দিতে পেরেছে জহির।সবচাইতে দামীটা বোধহয় সাড়ে ছয়শ টাকা দিয়ে কিনেছিল।
গত ঈদে তো সেটাও দিতে পারেনি।কিভাবে দেবে,ওর গোটা সংসারে অভাব প্রতিনিয়ত মুখ ব্যাদান করে থাকে।
আসমা অবশ্য কখনই কিছু চায়না জহিরের কাছে।এজন্যই তো বাঁচোয়া।
আজ ঘন ঘন আসমার কথা মনে হওয়াতে জহির ঠিক করল বাসা হয়ে এরপর আকবর আলীর বাড়িতে যাবে।সেই কখন থেকে ওর লক্ষীটাকে দেখেনা!
যেহেতু ম্যাডাম বিকেলে পার্টিতে যাবে সেহেতু একটু দেরী করলে কিছু হবেনা।আজ আকবর আলীর একটা জরুরী মিটিং আছে এক জায়গায়।সুতরাং সেদিক থেকেও ভয় নেই।অতএব নিশ্চিন্তে বাড়ির দিকে রওনা হল জহির।
আকবর আলীর মত ধনীরা যদি জানতে পারে জহির তার কবুতরের খোপের মত দেখতে বস্তুটাকে "বাসা " বলে তাহলে নিজেদের "বাসা" নিয়ে যথেষ্টই অপমানিতবোধ করত তারা।
দুহাজার টাকা দিয়ে টিনশেড এই খুপড়িটা ভাড়া নিয়েছে জহির।রুম একটাই।কেউ বেড়াতে টেড়াতে এলে আসমাকে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতে হয়।তবে এটাই জহিরের রাজ্য।এ রাজ্যে সে রাজা,আসমা রানী।চলেই তো যাচ্ছে বেশ।
দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে আওয়াজ এল,'কে'?
জহির সাড়া দিতেই দরজা খুলে দিল আসমা।রান্না করছিল বোধহয়, গরমে নাকের আগায় শিশিরের মত ঘাম জমেছে।শাড়ির আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে রাখায়।মুরব্বী মুরব্বী একটা ভাব চলে এসেছে মেয়েটার মধ্যে।
'আজ এই সময়? 'বোঝাই যায় অবাক হয়েছে আসমা।
'হুম।'ছোট্ট করে জবাব দিল জহির।
' কী হল এমন করে কী দেখতাছ?'জহিরকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন আসমার।
'আমার লক্ষীটাকে। '
'উঁউউহ,ঢং!'
জহির হেসে ফেলল,একটু পর আসমাও।
এই বাচ্চা বাচ্চা চেহারার শ্যামলা মেয়েটাকে জহির কী পরিমান ভালবাসে সেটা কেউ জানেনা।উহু,জানে একজন।আসমা জানে।
আসমার শখ বলতে একটাই,চোখে কাজল দেয়া।হরিনীর মত মায়াবী চোখদুটোয় যখন কাজলের ছোঁয়া লাগে তখন তাতে এক সমুদ্র ভালবাসা দেখতে পায় জহিরও।
'তুমি কি আজকে আমার সাথে খাবা?'কথাটা বলেই বড় বড় চোখে জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে আসমা।
"আমার সাথে খাবা" কথাটা শুনেই জহিরের বুকের ভেতর কেমন টনটন করে ওঠে।প্রতিদিন দুপুরে আসমাকে একা একা খেতে হয়।আকবর আলীর নিয়ম হল সবাইকে দুপুরের খাবার অফিসেই নিয়ে আসতে হবে।
প্রায়দিনই রাতে খোঁজ নিয়ে জহির জানতে পারে দুপুরে আসমা কিছু খায়নি।কারন জিজ্ঞেস করলে মাথা নীচু করে থাকে মেয়েটা।জবাব দেয়না। জহির বুঝতে পারে একা একা খেতে আসমার একটুও ভাল লাগেনা।
'হুম,'মাথা ঝাকাল জহির।
'সত্যি!'চাঁদের মত উজ্জল মুখটা পরক্ষনেই অমাবস্যার আঁধার ঢেকে নিল।'তেমন কিছু তো রান্না হয় নাই।শুধু বেগুন ভাজি।'
'আর কী লাগে পাগলী?! '
'আচ্ছা তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো,আমি একটা ডিম ভাজি এই ফাঁকে।'
'একটা কেন,দুইটাই ভাজো।আজ আরাম করে খাই দুজন।'
'একটাই ডিম আছে।'মুখ কালো করে জবাব দিল আসমা।'
'আচ্ছা তুমি একটা ভাজতে থাক,আমি আরেকটা কিনে নিয়ে আসি।'
জহির প্যাকেটটা রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।যখন ফিরে এল তখন ওর জন্য বড় সড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
হাতে একটা ডিম নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল আসমা শাড়িটা শালের মত করে গায়ে জড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।জহিরকে উপস্থিতি লক্ষ্য করে লজ্জা পেল মেয়েটা।'কত দিয়ে কিনছো?'
জহির বুঝতে পারল আসমা প্রাইজ ট্যাগটা দেখেনি।দেখলে ওটা ছোঁয়ারও সাহস পেতনা।সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরে জহিরের সারা শরীর অবশ হয়ে এল।আসমা ভেবেছে শাড়িটা জহির ওর জন্যই কিনেছে।মেয়েটা বুঝতেও পারেনি শাড়িটা এত দামি। বোঝার কথাও না অবশ্য।জহিরের মত আসমাও কখনো এত দামি শাড়ি দেখেনি।
'এইতো।' আর কিছু বলার মত খুঁজে পায়না জহির।
'খুব সুন্দর।'
জহির নিশ্চুপ।
আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আসমা।অপুর্ব লাগছে ওকে আকাশি রঙের শাড়িটাতে।যেন এক খন্ড আকাশ গায়ে জড়িয়ে আছে কোনো পরী।কালো চুলগুলো মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আঁচলে।
জহিরের ইচ্ছে হল এই আকাশে ভেসে বেড়াতে,মেঘে মুখ লুকোতে,আঁচলে আশ্রয় নিতে।একখন্ড আকাশ,একরাশ মেঘ,একটুকরো আঁচল।এই আকাশ,এই মেঘ,এই আঁচল শুধুই ওর,ওদের।
জহির খুব দ্রুত দুটো সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথমেই ওকে প্যাকেটটা থেকে গোপনে প্রাইজ ট্যাগটা সরিয়ে ফেলতে হবে।আসমাকে কোনোমতেই শাড়ির দাম জানতে দেয়া যাবেনা।
দ্বিতীয় কাজটা কিভাবে করবে,জহির জানেনা।শুধু এতটুকু জানে ওকে করতে হবে,করতেই হবে।একখন্ড আকাশ, একরাশ মেঘ আর একটুকরো আঁচলের জন্য...
উপসংহার
তিনদিন পর জহির যখন দেহে মারাত্মক এক ছুরিকাঘাত নিয়ে অফিসে হাজির হল তখন সবাই জানতে পারল তিনদিন আগে ভয়াবহ এক ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছিল সে। আরেকটু হলেই মারা যেতে পারত।
পুনশ্চঃ ভালবাসা এখন বন্দি ফেসবুক আর স্টুডেন্টদের সীমিত গন্ডিবদ্ধ জগতে।সে জগতের বাইরে,দরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যেও যে ভালবাসার আধার থাকতে পারে সে খবর কি আমরা রাখি?
উৎসর্গঃ
বেশ কিছুদিন আগে একটা কারণে লেখালেখি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় মাসখানেক একটা অক্ষরও লিখিনি।সে সময়ে একজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত বলেছে,আপনার লিখতে হবে,আপনাকে ফিরে আসতে হবে।
আমি লিখেছি,ফিরে এসেছি।
এই ফিরে আসার পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য সেই মানুষটার আজ জন্মদিন। আমার পক্ষ থেকে এই গল্পটা তাকে উপহার।
শুভ জন্মদিন ইব্রাহিম বিন আজিজ।
Published on October 12, 2013 05:10
No comments have been added yet.


