নিঃশব্দ ঘাতক

পুলিশের গাড়িতে চেপে বিশিষ্ট হার্ট স্পেশালিস্ট ড. রকিব আহমেদের বাসায় উপস্থিত হল শখের গোয়েন্দা তারেক ফয়সাল।সঙ্গে আছে ওর বন্ধু গুলশান থানার এস আই মাহফুজ।

হাতে কাজ না থাকলে প্রায়ই থানায় এসে মাহফুজের সাথে বিভিন্ন কেস নিয়ে আলোচনা করে তারেক।থানাটা ওর বাসার কাছেই কিনা।থানার ওসি সাহেবও তারেককে অনেক স্নেহ করেন।বেশ কিছু কেসে পুলিশকে সাহায্য করেছে তারেক।

আজ সকালে জগিং সেরে আর বাসায় যায়নি তারেক।থানায় বসে কিছুদিন আগে সলভ করা একটা কেস নিয়ে মাহফুজের সাথে আলোচনা করছিল।এমন সময় ফোনটা এল।

ওপাশ থেকে একটা নারীকন্ঠ জানাল,তার স্বামী ড.রকিব গতরাতে খুন হয়েছেন।

মাহফুজ ফোনে তাকে বলল,‘ঠিকআছে,আমরা আসছি।কোনো কিছুতে যেন হাত দেয়া না হয়।

‘কী যাবি?ফোন রেখে তারেককে বলে মাহফুজ।

হাতে তেমন কোনো কাজ নেই।নাস্তাও থানাতেই আনিয়ে খেয়ে নিয়েছে,সুতরাং আপত্তি করার কোনো কারণ দেখতে পেলনা তারেক।এমনিতেই ওর কাছে সব কেস আসে বাসী হয়ে যাবার পর।অপরাধ ঘটার সাথে সাথেই অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ।সময়ের সাথে সাথে সেটা কঠিন হয়ে আসে।বলল,‘চল,দেখি তোর খুনীকে ধরা যায় কিনা।

রকিব সাহেবের আলিশান বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তারেক অস্ফুটে বলল,‘বাঙ্গালীদের হার্ট যে কতটা দুর্বল সে্টা রকিব সাহেবের বাড়িটা দেখেই বোঝা যায়!’

দুজন কনস্টেবল আর ডিবির একজন ফরেনসিক এক্সপার্টকে সাথে নিয়ে এসেছে মাহফুজ।লাশের প্রাথমিক পরীক্ষা করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা সম্ভব।

পাঁচজনের দলটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।

ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখা গেল যুবক বয়সী একজন বসে আছে।পরিচয় হতে জানা গেল লোকটার নাম মামুন।রকিব সাহেবের কম্পাউন্ডার।এ বাড়িতেই থাকেন।অনেকটা রকিব সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারীও বলা যায় তাকে।

‘আমাদের ফোন করেছিলেন যিনি,অর্থাৎ রকিব সাহেবের স্ত্রী,তিনি কোথায়?’মাহফুজ প্রশ্ন করল মামুনকে।

‘উনি ভেতরের রুমে আছেন।দাড়ান আমি ডেকে নিয়ে আসছি,’বলে ভেতরে চলে গেল মামুন।

বাড়িটা দোতলা।ডুপ্লেক্স।ভেতর দিয়েই দোতলায় ওঠার ব্যাবস্থা আছে।তারেক ভালমত চারদিকে নজর বুলাতে লাগল।

একটু পরই মিসেস রকিবকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল মামুন।

রকিব সাহেবের স্ত্রী শক্ত ধাতের মহিলা।শোকের ছাপ তেমন একটা পড়েনি তার চেহারায়।তিনি রুমে ঢুকতেই মাহফুজ বলল,‘আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

পুলিশের কাজে বাগড়া দেয়া তারেকের স্বভাব নয়,কিন্তু এই মুহুর্তে মাহফুজের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,‘আগে লাশটা দেখে আসা উচিত,তাহলে বোঝা যাবে কী প্রশ্ন করতে হবে আমাদের।এখন শুধু জিজ্ঞেস কর,মৃতদেহটা তিনি কখন দেখতে পেয়েছেন,’

মাহফুজ মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল তারেকের কথায়।ওর উপর আস্থা আছে মাহফুজের।জিজ্ঞেস করল,‘আচ্ছা,ম্যাডাম,আপনি কখন জানতে পারেন আপনার স্বামী মারা গেছেন?’

‘এইতো ঘন্টা খানেক আগে।’

তারেক মনে মনে হিসেব কষে ফেলল।এখন বাজে সকাল আটটা।তারমানে তিনি সকাল সাতটার দিকে লাশটা পেয়েছেন।এবং ফোন করেছেন সাড়ে সাতটারও পরে।ওদের এখানে আস্তে বিশ মিনিটের বেশি লাগেনি।

তারেক প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিল,তার আগেই মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘লাশ দেখার পর আমাদের জানাতে এত দেরী হল যে?’

‘সেটাই কী স্বাভাবিক নয়,অফিসার?বাড়ির কর্তা মারা গেলে সবাই তো একটু দিশেহারা বোধ করবেই,তাইনা?’জবাবটা দিল মামুন।

মাহফুজ তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,’প্রশ্নটা আপনাকে করা হয়নি।’

‘সরি।’

‘আচ্ছা,আমরা আগে লাশটা দেখে আসি এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করার আছে।’

মামুনই পথ দেখিয়ে ওদের উপরতলায় নিয়ে এল।বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দলটা।একজন কন্সটেবলকে নীচে রেখে আসা হয়েছে।

বিছানায় রকিব আহমেদের লাশ পড়ে আছে।বয়স চল্লিশের মত হবে।একটা সাদা রং-এর নাইট ড্রেস পরনে।বুকের কাছটা রক্তে লাল হয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে,গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাকে।চেহারায় যন্ত্রনার একটা ছাপ পরিষ্কার।মৃত্যুর যন্ত্রনা।

মৃত্যু সব সময়ই কষ্ট দেয় তারেককে।লাশের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলনা ও।দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে পুরো ঘরটা দেখায় মনোযোগ দিল।

বেশ বড় আকারের ঘর।দামী আসবাবে সজ্জিত।এমনিতে উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই অবশ্য।

থাটের মাথার কাছে ছোট্ট একটা ওষুধের বোতল।বোতলটা দিয়ে ভাঁজ করা একটা কাগজ চাপা দেয়া।কাগজটা পড়ে দেখল তারেক।বোতলটাও উল্টে পাল্টে দেখল। এরপর মেঝেতে বিছানো কার্পেট আর দরজার নবটা ভাল মত দেখল।

এদিকে মাহফুজ ফরেনসিক এক্সপার্টকে লাশের পরীক্ষা করার কাজে লাগিয়ে দিয়ে কনস্টেবলকে নিয়ে রুমটা তল্লাশি করছে।

রুমের একমাত্র জানালাটার সামনে দাড়িয়ে মাহফুজ প্রশ্ন করল,‘আচ্ছা তারেক,এমন কী হতে পারেনা,পাশের বিল্ডিং থেকে কেউ স্নাইপার দিয়ে গুলি করেছে ড.রকিবকে?’

তারেক মুচকি হেসে বলল,‘ইদানীং হলিউডের মুভি দেখিস বোধহয় খুব বেশি।ডাক্তার রকিব এমন কোনো মানুষ না যে তাকে স্নাইপার দিয়ে মারতে হবে।তাছাড়া দেখছিস না রুমে এসি চলছে।তারমানে এই জানালাটা রাতে বন্ধ থাকে।গুলি বাইরে থেকে এলে জানালার কাঁচ এখন অক্ষত থাকত না। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে।হয়ত রুমের ভেতর থেকে নয়ত ওই ব্যালকনি থেকে।’ এরপর বিরতি দিয়ে বলল,’এখানে আর দেখার মত তেমন কিছুই নেই।’

মাহফুজও সায় জানিয়ে বলল,‘হ্যাঁ,জাফর সাহেব লাশটা পরীক্ষা করুক আমরা বরং নীচে যাই।’

ফরেনসিক এক্সপার্ট জাফর সাহেবকে উপরে রেখে নীচে চলে এল সবাই।তারেক আর মাহফুজ একটা রুমে

বসল।বাড়ির কাজের লোকজনসহ বাকী সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়েছে। এক এক করে ডেকে নিয়ে প্রশ্ন করা হবে।এখন ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. জাফরের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা।তার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানার পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে।বাড়ির লোকদের কনস্টেবল দুজন পাহারা দিচ্ছে।

একটু পরই রুমে ঢুকলেন ড. জাফর।বললেন,‘ভিকটিম রাত তিনটার দিকে মারা গেছেন।গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে।সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন ভিকটিম।পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ অর্থাৎ খুব কাছ থেকে গুলিটা করা হয়েছে।সম্ভবত একেবারে বুকের সাথে ঠেকিয়ে।কারণ ক্ষতের আশেপাশে গান পাউডার পাওয়া গেছে।.৪৫ ক্যালিবারের বুলেট বলেই আমার বিশ্বাস।পোস্টমর্টেম করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’

‘হুমম,তারমানে তোর কথাই ঠিক। গুলি কাছ থেকে চালানো হয়েছে। আচ্ছা এখন তাহলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যাক।’

প্রথমেই মিসেস রকিবকে ডাকা হল।ভদ্রমহিলা সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন।

‘ম্যাডাম,আপনার নামটা?’

‘আসমা আহমেদ।’

‘ওকে। আপনার হাজবেন্ডকে রাত তিনটার দিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।আপনি কী রাতে কিছু টের পেয়েছিলেন?’

‘না তো। ’

‘আপনার পাশে আপনার স্বামীকে গুলী করে হত্যা করা হল,আর আপন কিছুই টের পেলেননা?’

‘খুনী সম্ভবত সাইলেন্সার ব্যাবহার করেছে।সেক্ষেত্রে তো আমার টের পাবার কথা না।’

‘রকিব সাহেবের কোনো আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন?’

‘সেটা সম্ভব নয়।তখন বললাম না,গুলিটা একেবারে হৃৎপিন্ড ভেদ করে গেছে। দুসেকেন্ডের মধ্যেই মারা গেছেন ভদ্রলোক।কোনো ধরনের আর্তনাদ করার সুযোগই পাননি।’ জবাবটা দিলেন ড. জাফর।

‘ও আচ্ছা, তা কে আপনার স্বামীকে হত্যা করতে পারে বলে মনে হয় আপনার?আইমিন,কোনও শত্রু?’

‘তেমন কাউকে তো মনে পড়ে না,তবে…’

‘তবে কী?’

‘না মানে,আমার হাজবেন্ডের একটা লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল।পিস্তলটা মামুনকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন উনি,পিস্তলটা নাকি হারিয়ে ফেলেছে মামুন।ওটা দিয়ে তো বাড়ির যে কেউ খুন করতে পারে।’

‘পিস্তলটা কত ক্যালিবারের বলতে পারবেন?’

‘না।’

‘লাইসেন্সের কাগজপত্র নিশ্চয়ই আছে।ওগুলো দিয়ে মামুন সাহেবকে পাঠিয়ে দেবেন।আপাতত আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন নেই।প্রয়োজন হলে ডাকা হবে।’

মিসেস রকিব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।একটু পরই মামুন ঢুকল রুমে।হাতে পিস্তলের কাগজপত্র।

‘দেখি,’বলে হাত বাড়িয়ে দিল মাহফুজ।কাগজটা দেখে মাথা দুলিয়ে বলল,‘হুমম,পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ ক্যালিবার।’এরপর মামুনের দিকে তাকিয়ে বলল,‘গতকাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘এ বাড়িতেই থাকি আমি।নীচতলায় আমার রুমে ছিলাম। ’

‘রাতে কিছু শুনতে পাননি?’

‘না,ম্যাডামই শুনতে পাননি,আমি কিভাবে পাব?’

‘রকিব সাহেব নাকি তার পিস্তলটা আপনাকে পরিষ্কার করতে দিয়েছিলেন শুনলাম?’

কথা না বলে মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল মামুন।

‘পিস্তলটা এখন কোথায়?’

‘আমার রুমে।’

‘কী!আপনার রুমে?’মাহফুজসহ রুমের সবাই অবাক হয়েছে।‘কিন্তু একটু আগে মিসেস রকিব বলে গেলেন পিস্তলটা নাকি আপনি হারিয়ে ফেলেছেন?’

‘হ্যাঁ,প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমার রুম থেকে পিস্তলটা গায়েব হয়ে যায়।কাল হঠাৎ দেখি আমার জানালার নীচে বাগানে পড়ে আছে পিস্তলটা।সম্ভবত পিস্তলটা পরিষ্কার করে রোদে শুকাতে দিয়েছিলাম তখনই পড়ে যায়।আমারও মনে ছিলনা। যখন পিস্তলটা হারিয়েছিল,তখন রুমের সব জায়গায় খুঁজলেও ওখানে খোঁজা হয়নি।কাল স্যার একটা কাজে বাগানে পাঠিয়েছিলেন,তখনই পিস্তলটা দেখতে পাই।’

‘কিন্তু মিসেস রকিব তো আমাদের বললেন না যে,আপনি পিস্তলটা পেয়েছেন?’

‘তিনি জানেননা।আমি যখন স্যারকে জানাই,তখন ম্যাডাম বাসায় ছিলেননা।ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন।তবে পরে রকিব সাহেব বলে থাকতে পারেন,কিন্তু এখন আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে তিনি আসলেই জানেননা।’

‘পিস্তলটা একটু নিয়ে আসুন তো। ’

মামুন উঠে চলে গেল।একটু পরই একটা বক্সে করে পিস্তলটা নিয়ে ফিরল।

মাহফুজ পিস্তলটা নিয়ে ড.জাফরের হাতে তুলে দিলেন।ড.জাফর পিস্তলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।ব্যারেলটা নাকের কাছে ধরে বললেন,গত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পিস্তলটা থেকে গুলি চালানো হয়েছে।ব্যারেলে গান পাউডারের দাগ দেখা যাচ্ছে।বারুদের হালকা গন্ধও আছে।আমার ধারণা এটাই মার্ডার ওয়েপন।’

‘হুমম,তা মিষ্টার মামুন,আপনাকে পিস্তল পরিষ্কার করতে দেয়ার কী কারণ?অভিজ্ঞতা আছে নাকি আগের?’

কেমন ইতস্তত করতে লাগল মামুন। এতগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নীচু করে ফেলল।বলল,‘আমি একজন শুটার চ্যাম্পিয়ান। ’

‘আচ্ছা!’এমনভাবে কথাটা বলল মাহফুজ যেন কেসটা এইমাত্র সলভ করে ফেলেছে ও।‘আচ্ছা,আপনি যান।আমাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই আপাতত। ’

মামুন বেরিয়ে যেতেই মাহফুজ বলে উঠল,‘দোস্ত তোর সাথে থাকতে থাকতে আমারও মাথা খুলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কেসটা সলভ করতে পারব ভাবিনি।’

‘তাইনাকি?কি রকম?’মুচকি হেসে প্রশ্ন করল তারেক।

‘খুনটা বাড়ির লোকই করেছে,মানে এই মামুন ব্যাটাই খুনটা করেছে।লোকটা এমনিতেই শুটার চ্যাম্পিয়ান। তার পক্ষে গুলি চালানো খুব সহজ। নিশ্চই রকিব সাহেবের বেডরুমের মাস্টার কী-ও যোগার করেছিল। রাতে চাবি দিয়ে দরজা খুলে রকিব সাহেবকে হত্যা করে সে। সাইলেন্সার লাগানো থাকায় তার স্ত্রী টের পাননি,’ব্যাখ্যা দিল মাহফুজ।

‘কিন্তু বন্ধু তোমার ব্যাখ্যায় একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।সেক্ষেত্রে লোকটা মার্ডার ওয়েপন আমাদের হাতে তুলে দিল কেন?’

‘সহজ,যাতে আমরা তার পিস্তল হারানো এবং ফিরে পাবার গল্পটা বিশ্বাস করি।’

‘উল্টোটাই কিন্তু ঘটেছে।তুই তাকে অবিশ্বাস করছিস।সে যদি বলত পিস্তলটা এখনও নিখোঁজ,তাহলে সেটাই তার জন্য বেশি উপকারি ও বিশ্বাস্য হত।কারণ তার পিস্তল পাবার সাক্ষী এমন একজন যে আর এখন সাক্ষ্য দেবার অবস্থায় নেই,রকিব সাহেব।

তাছাড়া তোর কথা যদি মেনেও নেই,খুন মামুন করেছে,তাহলে পিস্তলটা এতক্ষণে পরিষ্কার করে ফেলত সে। খুন হবার পর থেকে লাশ আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত প্রায় চার ঘন্টা সময় পেয়েছে মামুন।সেক্ষেত্রে আমরা জানতেও পারতামনা এই পিস্তলটা দিয়ে গত চব্বিশ ঘন্টায় গুলি চালানো হয়েছে। ’

‘তাইতো,’মাহফুজকে চিন্তিত দেখালো। ‘তাহলে?’

‘তোর একটা কথা কিন্তু আংশিক ঠিক।রকিব সাহেবকে তার বাড়ির লোকই খুন করেছে।আমি এর সঙ্গে আরেকটু যোগ করতে চাই,শুধু তার বাড়ির লোকই নয়,বরং তার ঘরের লোক।’

‘মানে তার স্ত্রী?!’ বিস্ময় প্রকাশ পেল মাহফুজের গলায়। ড.জাফরও বেশ অবাক হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ,একটি সুনিপুন প্ল্যান করেছিলেন তিনি।এবং এই প্ল্যানের অংশ হিসেবেই সপ্তাহ খানেক আগে পিস্তলটা মামুনের রুম থেকে চুরি করেন।এরপর গতকাল মামুনের জানালার নীচে বাগানের মধ্যে ফেলে রাখেন পিস্তলটা,যাতে করে মামুন সেটা খুঁজে পায়।’

‘কিন্তু তারেক,মামুন কিন্তু পিস্তলটা কাকতালীয়ভাবে খুঁজে পায়।রকিব সাহেব যদি তাকে না পাঠাতেন…’

‘উঁহু কাকতালীয় নয়,’ মাহফুজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল তারেক। ‘আমি নিশ্চিত,মিসেস রকিবই কাজের ছুতোয় স্বামীকে দিয়ে বলিয়ে মামুনকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন। এবং ওই সময়টাতে ইচ্ছে করেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন যাতে করে সবাই ভাবে তিনি পিস্তল পাবার ঘটনা জানেন না।আর এই না জানার ভাণ করে পিস্তল হারাবার গল্প আমাদেরকে বলে দিয়ে সব সন্দেহ মামুনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। বেচারা শুটার চ্যাম্পিয়ান হওয়াতে সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে।’

‘কিন্তু পিস্তলটা তো গতরাতে মামুনের কাছে ছিল,তাহলে সেটা দিয়ে মিসেস রকিব কিভাবে খুন করবে রকিব সাহেবকে?’

‘পিস্তল কি পৃথিবীতে একটাই?পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের মত কমন একটা পিস্তল যোগার করা মিসেস রকিবের মত ধনী মানুষদের পক্ষে কঠিন কিছুনা। আর রকিব সাহেবের পিস্তলটা বাগানে ফেলে রাখবার আগে তিনি সেটা দিয়ে একবার ফাঁকা গুলী করেছিলেন যার ফলে আমাদের ধারণা হয়েছে ওটাই আসলে মার্ডার ওয়েপন। কিন্তু আসল মার্ডার ওয়েপন হল একই ক্যালিবারের আরেকটি পিস্তল। খুবই চতুর মহিলা।’

‘হুমম,সেটা তো দেখাই যাচ্ছে।কিন্তু এতক্ষণ যা বললি তা প্রমাণ করতে পারবি?’

‘হ্যাঁ পারব। মিসেস রকিব তখন বলেছিলেন আততায়ী সাইলেন্সার ব্যাবহার করায় তিনি কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু সাইলেন্সার লাগালে যে একেবারেই শব্দ হয়না তা তো না।হালকা একটা শব্দ হয়ই যেটা,দশ বারো ফুট দুর থেকে অনায়াসেই শোনা যায়।’

‘সেটা ঠিক আছে,কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন একজন মানুষের পক্ষে সেটা না শোনাই স্বাভাবিক।’

‘কিন্তু মানুষটার যদি অনিদ্রা রোগ থাকে?’

‘অনিদ্রা রোগ?’

‘হ্যাঁ।মিসেস রকিবের ইনসমনিয়া আছে।গতকাল ডাক্তারের কাছেও তিনি এজন্যই গিয়েছিলেন। তাকে একটা ঘুমের অষুধ পেসক্রাইব করা হয়।কিন্তু রাতে জেগে থাকবার জন্য অষুধটা তিনি গতরাতে খাননি।বোতলের সিলটা এখনো অক্ষত আছে।এটা একটা ভাল প্রমাণ হতে পারে কোর্টে। এছাড়া সত্যিকারের মার্ডার ওয়েপনটা আমার ধারণা,খুঁজলে এবাড়িতেই পাওয়া যাবে।কারণ খুন করার পর থেকে মিসেস রকিব বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ পাননি।তাহলে বাড়ির কাজের লোকজন তাকেই সন্দেহ করে বসত।’

‘কিন্তু মোটিভ?কী উদ্দেশ্যে খুনটা করলেন তিনি?সম্পত্তির লোভ?’

‘সেটা বের করার দায়িত্ব তোদের।আমি আমার কাজ করেছি।খুনীকে ধরিয়ে দিয়েছি।আমি আসলে দোতলায় থাকতে ওষুধের বোতলটা দেখেই বুঝে ফেলি আসলে কে খুনী। কিন্তু পুলিশের কাজে বাধা দিতে চাইনি বলেই এতক্ষন কিছু বলিনি।

ওই অষুধের বোতলটাই মিসেস রকিবের সুনিপুন প্ল্যানের একমাত্র ভুল।অবশ্য তাকেও দোষ দেয়া যায়না। প্রফেশনাল ক্রিমিনালরাই এরচাইতে বড় ভুল করে বসে।

আসলে প্রত্যেক অপরাধীর মন ছোট হয় তো যার ফলে প্রত্যেকেই ভুল করে থাকে। সেই ভুলটা খুঁজে বের করতে পারলেই অপরাধী ধরা পড়তে বাধ্য।’
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 05, 2013 21:47
No comments have been added yet.