জগলুল সাহেবের শখ

চেম্বারের বাইরে রোগীদের বিশাল সিরিয়াল,তাদের অসংখ্য অভিযোগ,আর সামনে বসে থাকা বিরক্তিকর চরিত্র,মেজাজ খিচড়ে দেবার জন্য আর কী লাগে?

সরকারি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান আমি।প্রতিদিন আউটডোরে রোগী দেখতে হয়।রুমের বাইরে বিশাল এক লাইন নিয়ে দিন শুরু করি দিন শেষে সে লাইনের দৈর্ঘ আরো বড় হয়।

এটাই হল মফস্বল শহর।অধিকাংশ মানুষেরই কাজ কর্ম নেই।হাসপাতালে,আমার ধারনা,হাওয়া খেতে আসে এরা।সরকারি হাসপাতাল,টিকিট মাত্র দশটাকা।বেশিরভাগ অষুধ তো ফ্রি-ই।সস্তা পেয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে-সকালে উঠে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে তো একটু হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি!

অনেকদিন সাদা এপ্রোন পড়া মেয়ে ডাক্তার দেখিনা,হাসপাতালে ঢু মেরে আসা যাক! টিকিট মাত্র দশ টাকা।

ইদানিং অবশ্য আমি নতুন একটা ট্রিক্স আবিষ্কার করেছি।যেগুলোকে দেখে ত্যাদোর কিসিমের পাবলিক মনে হয় ওদের এমন ওষুধ লিখে দেই যেটা হাসপাতালের ফার্মেসীতে নেই।বেশ কাজ হচ্ছে এতে।একবার যাকে এই “ওষুধ” দেয়া হয় কারণ ছাড়া দ্বিতীয়বার আর হাসপাতালে আসার সম্ভবনা নেই তার।

তবে সামনে বসা এই লোকটাকে কী করে ঘাড় থেকে নামানো যায় বুঝতে পারছিনা।টিকিটে নাম লেখা আছে জগলুল হোসেন,বয়স ৪২।টিকিটে রোগের বিবরন লেখা থাকে।সেখানে দেখতে পাচ্ছি এই লোক মাথাব্যাথার সমস্যা নিয়ে এসেছে।

লোকটা ঢোকার পর আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দেরি না করে বললাম,’মাথাব্যাথাটা ঠিক কী ধরনের আপনার?’

টিকিটে লেখা দেখার পরও "আপনার কী সমস্যা" বলা আমার স্বভাবে নেই।

আমার প্রশ্নটা শুনে জগলুল হোসেন কিছুক্ষন আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন।যেন বুঝতে পারছেননা তাকে কোন মাথাব্যাথার কথা বলা হচ্ছে।এবং আমাকে চুড়ান্ত অবাক করে দিয়ে সে সত্যি সত্যিই বলে বসলেন‘কিসের মাথা ব্যাথা?’

আমার রেগে যাওয়া উচিৎ।বদরাগী বলে আমার একটা কুখ্যাতি পরিচিত মহলে আছে।অন্তত খ্যাতিটা ধরে রাখবার জন্য হলেও আমার রেগে যাওয়া উচিত।কিন্তু আমি এই লোকটার উপর রাগলাম না,কিংবা বলা ভাল,রাগতে পারলাম না।লোকটার চেহারায় একটা মায়া আছে।মায়া সাধারণত থাকে তরুনী এবং শিশুদের চেহারায়।কিছু কিছু বৃদ্ধও আছে দেখলেই মায়া লাগে।কিন্তু জগলুল হোসেনকে কোনো শ্রেনীতেই ফেলা যাচ্ছেনা।তারপরও এর চেহারায় এমন একটা কিছু আছে যার কারনে এর উপর রাগও করা যাচ্ছেনা।আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,'এখানে দেখতে পাচ্ছি আপনি মাথা বাথ্যার সমস্যা নিয়ে এখানে এসেছেন।তা সমস্যাটা কী ধরনের জানতে পারি?'

জগলুল সাহেব কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন,'ও আচ্ছা।একটু পরে বলি?'

'কী পরে বলবেন?'মেজাজটা আবার খিচড়ে যেতে চাইছে।

'আমার সমস্যার কথা।আমি এখানে অপেক্ষা করছি।আপনি একটু ফ্রি হলেই আমরা কথা বলব।'

আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম।যেন আমি না,এই জগলুল হোসেনই আসলে ডাক্তার।মানসিক ডাক্তার।আর আমি হলাম পুরোপুরি নেংটা পাগল।তবে এবারও মাথা ঠান্ডা করে বললাম,‘এখন বললে কী সমস্যা?’

'জী আছে একটু সমস্যা।'

এবার আমার সন্দেহ হতে লাগল।ব্যাটা যৌন রোগের চিকিৎসার জন্য আসেনি তো?যৌন রোগীরা ডাক্তারের কাছে রোগের কথা বলতে শরম পায়।যতই ভাবলাম ধারনাটা পোক্ত হল।নিশ্চয়ই কাউন্টারের ছাগলটা গুলিয়ে ফেলেছে।“চর্ম এবং যৌন” রোগের রোগীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।ছাগলটা এমন কাজ আগেও করেছে।না,এবার একটা ব্যবস্থা নিতে হবে।

আসল ব্যাপারটা ধরতে পারার সাথে সাথেই বিরক্তিভাবটা চলে গেল।আমি হাসি হাসি মুখে বললাম,‘আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি।আপনি এক কাজ করুন।এখান থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে সোজা গেলেই ২৫৪ নাম্বার রুম দেখতে পাবেন।ওটাই “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের রুম।’

জগলুল সাহেবের মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে গেল।‘চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের কাছে কেন যাব?আপনি ডাক্তার আনোয়ার না?’

হঠাৎ করে লজ্জা পেয়ে গেলাম।এই লোক তো মনে হচ্ছে আমার কাছেই এসেছে।নাম ধাম জেনে ভূল লোকের কাছে আসার কোনো কারন নেই।পন্ডিতি করে “চর্ম এবং যৌন” বিশেষজ্ঞের ঠিকানা দেবার কী দরকার ছিল?ছিহঃকী লজ্জা!

আমতা আমতা করে বললাম,‘ইয়ে মানে...আপনি সমস্যা বলতে ইতস্তত করছিলেন তো তাই...’

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন।‘বুঝতে পেরেছি।আপনি রোগী দেখুন।বেলা একটার সময় তো আপনার ডিউটি শেষ তাইনা?তখন বলব আমার সমস্যার কথা।’

মাথায় ঢুকছে না কিছু।এই লোক বলে কী?আমি রোগী দেখব আর এ গ্যাট হয়ে চেম্বারে বসে থাকবে?সাফ নিষেধ করে দেব ভাবছি এমন সময় দেখলাম কম্পাউন্ডারের অসহায় মুখ দরজার ফাঁকে।রোগীরা বোধহয় গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছে।আমি কিছু না বলে হাক ছাড়লাম,'নেক্সট!'



'ডাক্তার সাহেব,আজকের পেপারটা দেখা যাবে?'

আধঘন্টা পার হয়ে গেছে অদ্ভুত মানুষটা রুমে ঢোকার পর থেকে।তবে সুখের কথা হল লোকটা বিরক্ত করছেনা।চুপচাপ রুমের এক কোনায় বসে আছে।এখন বারোটা বাজে,একটার সময় আউটডোর বন্ধ হয়ে যাবে। একজন রোগীকে বিদায় করে পরের জনকে পাঠাতে বলব এমন সময় কথাটা বলে উঠলেন জগলুল সাহেব।

'কী বললেন?'

'বললাম,আজকের পত্রিকাটা দেখা যাবে?'

আমি টেবিলের উপর থেকে পত্রিকা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।জগলুল সাহেব চুপচাপ পেপার পড়তে লাগলেন।

একটু পর আবার বললেন,'ডাক্তার সাহেব,একগ্লাস পানি খাওয়াতে পারবেন?'

আমার ক্ষীন সন্দেহ হল,লোকটা বোধহয় আমাকে ইচ্ছে করেই জ্বালাচ্ছে।কেন জ্বালাবে?মোটিভ কী?

আমি নিজেই উঠে ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি এনে দিলাম তাকে।কেন দিলাম?মোটিভ কী?

একটার সময় আজানের আওয়াজ শুনে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম।যাক,আর লোকটার বেগার খাটতে হবেনা!আমি তার দিকে ফিরে বললাম,'তো জগলুল সাহেব,এবার বলুন আপনার সমস্যা।'

'আপনি মানুষটা অনেক ভাল।'

'এটাই কী আপনার সমস্যা?'

জগলুল সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন।জিভে কামড় দিয়ে বললেন,'না না, তা হবে কেন?আমি এটা বোঝাতে চাইনি।আচ্ছা,ডাক্তার সাহেব আপনি দুপুরে কোথায় খাবার খান?'

'বাসায়।ওখান থেকে আবার আমার প্রাইভেট চেম্বারে যেতে হবে।' ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম,তার সাথে বসে খোশগল্প করার মত সময় আমার নাই।ইঙ্গিতটা ধরতে পারলে হয়!

'আজ কি আমার সাথে খাবেন? '

'আপনার সাথে খাব মানে?কোথায়?'

'জী এখানে।আমি খাবার সাথে করে নিয়ে এসেছি।খেতে খেতে আরাম করে গল্প করা যাবে।'

আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম জগলুল সাহেবের হাতে একটা ব্যাগ আছে।তবে তিনি যে সাথে খাবার দাবার নিয়ে ঘুরে বেড়ান সেটা কে জানত?'আপনি কি প্রায়ই খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসেন "গল্প" করতে?'

'না,এই প্রথম এলাম।আপনি হাত ধুয়ে আসুন।প্লেট আমার সাথেই আছে।'

লোকটার মতিগতি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। তবে এটাও ঠিক,তার কথাগুলো শোনার খুব কৌতুহল হচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে এটাচ বাথরুমে ঢুকলাম ফ্রেশ হতে।মিনিট পাঁচেক পর বের হয়ে দেখি জগলুল সাহেব বেসিন থেকে ধোয়ার কাজ টাজ সেরে প্লেট নিয়ে বসে আছেন।আমাকে দেখেই লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন,'আয়োজন সামান্যই।আমার ওয়াইফ রেঁধেছে।ওর রান্নার হাত মাশআল্লাহ খারাপ না।'

আয়োজন "সামান্য " বলা হলেও দেখে মনে হচ্ছে "অসামান্য"।বিশাল টিফিন ক্যারিয়ারের চার বাটি ভর্তি খাবার।নীচের বাটিতে ঠেসে ভাত দেয়া হয়েছে।উপরেরটাতে করলা আর আলুর মিক্স ভাজি,পটল ভাজি আর বেগুন ভাজি।নেক্সটে আছে ভর্তা। আলু, বেগুন আর কালো জিরার ভর্তা। সবার উপরেরটাতে রয়েছে গরু ভূনা। হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল হাজার বছর ধরে আমি ক্ষুধার্ত!

কথা ছিল খেতে খেতে কথা হবে। কিন্তু আমি খাওয়াতে এতই ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম জগলুল সাহেব বোধহয় লজ্জা পেয়েই পুরোটা সময় নীরব থেকে এটা ওটা বাড়িয়ে দিতে লাগলেন আমার দিকে। বুকে হাত রেখে বলতে পারব,এমন চমৎকার রান্না কখনোই খাইনি।

খেয়ে দেয়ে মুখে লেগে থাকা তৃপ্তি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিলাম।একটা পান খেতে পারলে ষোলকলা পূর্ন হত।কম্পাউন্ডারকে বিদায় করে দিয়েছি বলে ষোলকলা পূর্ন করা গেলনা।

জগলুল সাহেব গোছগাছ করছেন।তার হাতের কাজ শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলাম,'সবই তো হল,এবার বলুন কেন এসেছেন?'

'বলছি।আমি এত ভনিতা করলাম কেন জানেন?আসলে কথাটা কিভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই সময় বের করার জন্যই এত কান্ড।'

'সমস্যা নেই,বলে ফেলুন।'

'ডাক্তার সাহেব আমার একটা শখ আছে।শখ না বলে ইচ্ছাও বলতে পারেন।'

এতক্ষনে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হল আমার কাছে।অনেকের থাকে এমন শখ।যেমন,কারো শখ থাকে মানুষের একসেট কংকালের,কারো বা আবার অপুর্ন ভ্রুনের।কেমিক্যাল ভর্তি কাঁচের জারে মানুষের অপুর্ন ভ্রুন সংরক্ষন করে রেখে দেয়। কী বিচ্ছিরি!

লোকটার কথা না শুনে খাবারগুলো খাওয়াই উচিত হয়নি।এখন কিভাবে মুখের উপর বলব যে এসব আমার দ্বারা হবে টবেনা?তবুও আমি জিজ্ঞেস করলাম,'কী শখ?'

এরপর জগলুল সাহেব যা বললেন তাতে করে আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম।বলে কী এই লোকটা!' কী বললেন,আপনি চোখের সামনে মানুষের মৃত্যু দেখতে চান?'

'জী।'নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন জগলুল সাহেব।

'আপনি কী জানেন,আপনি একটা অদ্ভুত কথা বলছেন?'

'জানি।'

'তা আপনার এমন শখের কারনটা কী?'

'ডাক্তার সাহেব,ছোটবেলায়ই আমার বাবা মারা যান।আমার তখন ছয় সাত বছর হবে।এপেন্ডিসাইটিসে মারা যান তিনি। অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি আর বাঁচবেন না।এ কারণেই আমাকে তার মৃত্যুশয্যার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।যখন যাবার অনুমতি দেয়া হয় তখন তিনি শেষ যাত্রায় রওনা দিয়ে দিয়েছেন।

ব্যাপারটা আমার উপর খুব প্রভাব ফেলে।আমার ধারনা হয় মৃত্য বোধহয় খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার যে কারণে আমাকে বাবার শেষ সময়ে তার কাছে যেতে দেয়া হয়নি।তখন থেকেই আমার মধ্যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়।এরপর অনেক মৃত মানুষ দেখলেও কখনো চোখের সামনে কাউকে মৃত্যুবরন করতে দেখনি।আমি দেখতে চাই একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের চোখে কিসের আকুতি ফুটে থাকে।শেষ কয়টা মুহুর্ত তারা পৃথিবীটাকে কিভাবে দেখতে চায়।দেখতে চাই মৃত্যুর ভয়াবহ যন্ত্রনা নাকি বিদায়ের অবর্ণনীয় কষ্ট তাদের বেশি ব্যাথিত করে।'

আমি আচমকা ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলাম।আমার এই পেশায় আমি প্রচুর মৃত্যু দেখেছি।কখনো স্বাভাবিকভাবে, কখনো সামান্য দুঃখ নিয়ে,অবিশাস্য হলেও সত্য,কখনো হাসি মুখে।কিন্তু কখনোই মৃত্যুকে এত গভীরতা নিয়ে দেখিনি।মৃত্য আমার কাছে স্রেফ চলে যাওয়া।পাশের সিটে বসা সহযাত্রীর চলে যাবার মতই।

মৃত্যু দেখলে প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, পরে মানিয়ে নিয়েছি।আমাদের মানিয়ে নিতে হয়।কিন্তু আমি বহুবার দেখেছি কয়েকটা মিনিট বাড়তি আয়ু পাবার জন্য একজন মৃত্যুপথযাত্রী কতটা মরিয়া হয়ে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনায় একজন মানুষের গোটা দেহ কিভাবে মোচড় খায়।এখন মনে হচ্ছে সেটা চলে যাবার কষ্টেও হতে পারে।

জগলুল সাহেবের ইচ্ছেটাকেও এখন আর "উদ্ভট" মনে হচ্ছেনা।আসলেই,এ দৃশ্য বড়ই অদ্ভুত, অপার্থিব।

'তা আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? '

'কেউ পারলে আপনিই পারবেন।হাসপাতালে তো অনেক রোগী মারা যান।এমন কারো মৃত্যুর সময় আপনি কি আমাকে উপস্থিত থাকবার ব্যাবস্থা করে দিতে পারবেন? '

আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।এর মধ্যে যতই আধ্যাত্মিক ব্যাপার স্যাপার থাকুক না কেন সাদা চোখে এটা স্রেফ পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়।হুট করে এরকম একটা বিষয়ে কথা দেয়া তো সম্ভব না।একজন মানুষ কখন মারা যাবে তার কি ঠিক আছে?আর সরকারি হাসপাতালে অনিদৃষ্টকালের জন্য আন অথোরাইজড পার্সনকে অবস্থান করতে দেয়াটা খুবই জটিল ব্যাপার।তারউপর যদি কেউ জগলুল সাহেবের শখের ব্যাপারটা জেনে ফেলে তাহলে তার সাথে সাথে আমার স্থানও হবে এই হাসপাতাল থেকে সোজা পাবনায়।ডাক্তার হিসেবে নয়,রোগী হিসেবে!

তবে সরাসরি নিষেধও করতে পারছিনা।বেচারা এত ভাল খাবার খাইয়েছে!

বললাম,'দেখুন জগলুল সাহেব,এটা তো সরকারি হাসপাতাল, চাইলেই কিছু করা যায়না।তবে আমি আপনার ইচ্ছেটাকে মূল্যায়ন করছি।আপনি এক কাজ করুন,এক সপ্তাহ পর আমার সাথে যোগাযোগ করুন,আমি এর মধ্যে দেখছি কী করা যায়।'আমার ইচ্ছে এক সপ্তাহ পর এলে তাকে বুঝিয়ে বলব যে,আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছেনা।

'জী অবশ্যই।আপনি আমাকে পাগল ঠাউরে বসেননি তাতেই আমি খুশি।আমি আসব,

একসপ্তাহ পরেই আসব।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।'বলে চেয়ার ছাড়লেন তিনি।

'বাই দ্যা ওয়ে,আপনার উচিত আপনার স্ত্রীর হাত স্বর্ণ দিয়ে বাধাই করে দেয়া।'

জগলুল সাহেব হেসে ফেললেন। 'সামর্থ্য থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।'

আমিও প্রতিউত্তরে পাল্টা হাসি দিলাম।

'ডাক্তার সাহেব,আমি তাহলে আসি।এক সপ্তাহ পর আসব।'জগলুল সাহেব বেরিয়ে গেলেন।

জগলুল সাহেব এক সপ্তাহ পর আসেননি।

***

জগলুল সাহেবের সাথে আমার দেখা হল ঠিক দুবছর পর।রাতে চেম্বার থেকে হেঁটেই বাসায় ফিরি।সেদিনও ফিরছিলাম হঠাৎ রাস্তার ওপাশে স্ট্রিট লাইটের আলোয় জগলুল সাহেবকে হেঁটে যেতে দেখলাম।এ'কদিনে আরো বুড়িয়ে গেছেন তিনি।কাধদুটো ঝুলে পড়েছে।প্রথমবার চিনতে পারিনি। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফেলতে হল।চেনার সাথে সাথেই গলা চড়িয়ে ডাক দিলাম আমি,'জগলুল সাহেব!'

ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।ইতিউতি তাকিয়ে আমাকে খুঁজে পেলেন।

আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম।জানতে ইচ্ছে করছে কেন তিনি আর এলেন না।

রাস্তা প্রায় পার হয়ে গিয়েছি।আর কয়েক পা এগোলেই তার কাছে পৌঁছে যাব এমন সময় দেখতে পেলাম জগলুল সাহেবের চোখজোড়া বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে।

আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচন্ড এক ধাক্কা খেলাম।ধাক্কাটা আমাকে ছিটকে কয়েক হাত দুরে,রাস্তায় নিয়ে ফেলল।

সাথে সাথে সমস্ত শরীর খিচুনি দিতে লাগল।অবশ হয়ে যাচ্ছে গোটা দেহ।মাথায় উষ্ণ তরলের একটা প্রসবন অনুভব করতে পারছি।আস্তে আস্তে আরো ঘোলাটে হতে থাকা দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলাম জগলুল সাহেব দৌড়ে আমার দিকে আসছেন।

অবশেষে তার শখ পূরন হতে চলেছে...
 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on October 04, 2013 07:19
No comments have been added yet.